কত্থক আকর

 

গৌতম উপাধ্যায়




লেখক নৃত্যশিল্পী। 'সৃজক' নৃত্যগোষ্ঠীর কর্ণধার।

 

 

সালটা মনে নেই, ১৯৯১ বা ৯২ হবে, আমি দিল্লিতে। দিল্লির শ্রী আনন্দশঙ্কর শ্রীমতী তনুশ্রীশঙ্কর নৃত্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে জংপুরা জি ১০ এক্সটেনশন-এ আছি। একদিন বাজারের রাস্তায় সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোককে দেখলাম। মনে হল খুব চেনা, দূরত্বের জন্য ঠিক চিনতে পারলাম না। তখন আমি আর আমার সহকর্মী ডিপিএস আর কে পুরম স্কুলে নাচ শেখাতে যাচ্ছি রোজ। একদিন আমাদের মহড়ার জায়গায় রামায়ণের মহড়া চলছে। অগত্যা আমরা অন্যত্র মহড়া নিয়ে চলে গেলাম। বেশ কষ্ট হল আর বিরক্ত লাগল। পরদিন আবার মহড়া। ছাত্রদের নিয়ে একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম করাব, বিষয়— ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি’। স্কুলে গিয়ে দেখি, আবার সেই রামায়ণেরই মহড়া চলছে। একজন আমাদের অপেক্ষা করতে দেখে বললেন, “আরও মিনিট কুড়ি লাগবে। আমরা (শাশ্বতী সেন ও অন্যেরা) কত্থকে রামায়ণ করাচ্ছি।” আবার অন্য জায়গায় চলে গেলাম, অবশ্যই ক্ষুণ্ণ মনে। পরদিন আবার মহড়ার জন্য গেছি, মিউজিক রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, হঠাৎ সাদা পাজমা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক পেছন থেকে এসে বললেন— থোড়া সাইড দিজিয়ে, মুঝে অন্দর যানা হ্যায়। পিছন ফিরতেই যাকে দেখলাম, তাঁকে দেখেই আমি আনন্দে বিস্ময়ে প্রথমে হাতজোড় করে, পরে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করলাম। একটা স্নেহের পরশ পেলাম আমার মাথায়। পরদিন সকালেও মহারাজজিকে আবার দেখলাম জংপুরায়। হেসে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। একই পাড়ায় আমরা থাকি, অথচ আলাপ করার সময় পেলাম না।

ওঁর নাচ দেখেছি বার পাঁচেক মহাজাতি সদনে, রবীন্দ্র সদনে ও অন্যান্য জায়গায়। মহারাজজির নাচ ভালো লাগার কারণ ওঁর নিখুঁত পদচালনা। গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছিল যখন মহারাজজির ঘুঙুরের আওয়াজে রেলযাত্রা, পাখির ওড়ার আওয়াজ বা বাতাসের শব্দ মঞ্চে ঝড় তুলেছিল।

আমার প্রথম নাচ শেখা— কত্থক। মাত্র এক মাস। ভালো লাগেনি, ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরে খুব ইচ্ছে হয়েছিল মহারাজজির কাছে কত্থক শিখব। সম্ভব হয়নি, কত্থকের প্রতি ভালোবাসা জন্মালেও শেষ পর্যন্ত শেখা হয়ে ওঠেনি। ওঁর সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন শুধু শেখো আর শেখো। উনি নিজে ভালো গান গাইতে পারতেন। মিউজিক সম্বন্ধে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তবে দূর থেকে দেখে মনে হয়েছে উনি মানুষ হিসেবে একেবারে শিশু, ভালোবাসতে পারতেন সমস্ত শিল্পকেই।

ওঁর নাচে আমি মোহিত হয়ে যেতাম, যখন মহারাজজির পরিচালনায় ‘দেবদাস’ ছবিতে মাধুরী দীক্ষিতের নাচ দেখি। ৭/৮ বার দেখেছি শুধু সেই নাচের মাধুর্য দেখতেই। এক-একটা সামান্য ভঙ্গি কেমন মূর্ত মূর্তিতে পরিণত হত, যা একমাত্র ওঁর পক্ষেই সম্ভব। কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতের কত্থক শিল্পী হিসাবে একচ্ছত্র রাজা হয়ে রাজত্ব করেছেন বিরজু মহারাজ। শিল্পের কারিগর হিসাবে বলতে পারি ভারতের অনেক কত্থকশিল্পী ওঁর ছত্রচ্ছায়ায় প্রথমে শিক্ষার্থী হয়েছেন, শিক্ষক হয়েছেন, সর্বোপরি শিল্পী হয়েছেন। সর্বোপরি, সারা বিশ্বে কত্থক শিল্পের প্রচারে ও প্রসারে বিরজু মহারাজের অবদান অতুলনীয়। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান, আমার মনে হয় এই যে তিনি এই ধ্রুপদী শিল্পকলাকে খুব সহজে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, সহজ সরল ভঙ্গিতে কিন্তু আমজনতার উপযোগী করে কত্থকের গভীরতাকে তিনি ব্যক্ত করেছেন। প্রতিটি শিল্পীকে তার যথাযোগ্য সম্মান করতেন তিনি। লখনৌ ঘরানার এই মহীরুহ, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ কালের নিয়মে বিলীন হলেও তিনি ভারতের শিল্পী আকর হয়ে রয়ে যাবেন আমাদের শিল্পীমণ্ডলে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...