রাজদ্রোহ আইন: অনিশ্চিত বর্তমান, অনিবার্য ভবিষ্যৎ

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য 

 



প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

সুকুমার রায়ের ‘ঝালাপালা’ নাটকের এক স্বঘোষিত গায়ক-চরিত্র কেবলচাঁদ প্রায় জোর করেই উপস্থিত শ্রোতাদেরকে একটি গান শোনায়, এক জমিদার-বাড়ির আড্ডায়। দেশাত্মবোধক গান। শ্রোতাদের কেউ কেউ তাতে করুণরসে আর্দ্র হয়ে উঠলেও, তাদেরই মধ্যে একজন অকস্মাৎ অভিযোগ করে বসে, গানটি রাজদ্রোহসূচক। তারপর যা ঘটল, নাটকটির নিজস্ব বয়ানে, তা এইরকম:

দুলিরাম। এই! সিডিশাস!
পণ্ডিত। অ্যাঁ, কী বললে? রাজদ্রোহসূচক? অ্যাঁ?
খেঁটুরাম। তবে রে! সিডিশাস গান কচ্ছিস কেন রে?
দুলিরাম। জানিস, আমার মামাতো ভাই গবর্মেন্টের চাকরি করে।
খেঁটুরাম। হ্যাঁরে, ওর মামাতো ভাইয়ের চাকরি ঘোচাবি কেন রে?
কেবল। আমি তো জানতুমনে— আমি জানতুমনে—
পণ্ডিত। জানতিনে কিরে? কেন জানতিনে?

[পণ্ডিতের কেবলচাঁদকে প্রহার]

সুকুমারীয় প্রতিভা রাজদ্রোহ-আইনের আতঙ্ককে শিশুপাঠ্য কৌতুকের লেন্সের মধ্যে দিয়ে পাঠিয়ে তার এমনই এক কার্টুন-প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করেছিল, যাকে নাছোড় বিরক্তিকর গায়কের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু, রাজদ্রোহ-আইনের কবলে পড়লে শুধু যে মামাতো ভাইয়ের গবর্মেন্টের চাকরি ঘুচত তা নয়, প্রায়শই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ড মাথায় নিয়ে আন্দামানের সঙ্কীর্ণ কুঠুরিতে পচতেও হত। সেটা যখন আমরা ভাল করে ভেবে দেখি, তখন বুঝতে পারি— প্রকৃত শিল্পীর কাজটা তো আসলে ঠিক তাইই— ক্ষমতার দম্ভকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। আজ যখন দেশে রাজদ্রোহ-আইনে মামলা, গ্রেপ্তারি ও সুদীর্ঘ পুলিশি হেফাজতের ঘটনা অবিশ্বাস্য হারে বাড়ছে, এবং দেশের শীর্ষ আদালত স্বয়ং এ বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে তার পুনর্বিবেচনা ও সাময়িক মুলতুবির নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন সরকারি দমন-পীড়ন ও হিংস্রতার সুকুমারীয় কার্টুন-কে স্মরণ করা প্রায় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।

 

চোর চাই, হোক না সে যে কোনও লোক

খবরে প্রকাশ, এবং বস্তুত বহু-প্রচারিত যে, বিগত প্রায় সব সরকারই রাজদ্রোহ আইনের প্রয়োগে কমবেশি উৎসাহী হলেও, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় আসার পরবর্তী কয়েক বছরে এ প্রবণতা বেড়েছে ভয়ঙ্করভাবে— বছর-পিছু আঠাশ শতাংশ। ভয় পাওয়ানো আরও যে সব পরিসংখ্যান রঙিন সারণি ও তালিকা হয়ে সংবাদ-মাধ্যমে ভাসছে, সেগুলো কিছু কিছু এখানে দিচ্ছি। সবাই জানেন, তবুও। ২০১০ সাল থেকে ৮১৬-টি মামলায় অভিযুক্ত প্রায় এগারো হাজার (এবং তার ৬৫ শতাংশই মোদিজির আমলে)। শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন ৪০৫ জন নাগরিক (যার ৯৫ শতাংশই বর্তমান আমলে, বলা বাহুল্য)— যার মধ্যে ১৪৪ জন নাকি ‘মোদি বিদ্বেষী’, এবং ১৪৯ জন ‘যোগী বিদ্বেষী’। এইসব ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে সেই সব রাজ্যেই, যেগুলোতে ক্ষমতায় আছে বিজেপি। এবং, প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই এ ধরনের মামলা-গ্রেপ্তারি-হয়রানির পেছনে উপযুক্ত আইন বা তথ্য-প্রমাণের সমর্থন নেই। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এ ধরনের ৩২৬-টি মামলায় চার্জশিট হয়েছে মাত্র ১৪১-টি, আর বিচারে শেষপর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হয়েছে নগণ্য ৬ জন! ভয় পাওয়ার এখানে শেষ নয়, শুরু, যদিও। এমনকি বিজেপি সরকারের আমলটুকুর সময়সীমার মধ্যেও এ প্রবণতা বেড়েই চলেছে লাগামহীন ও আতঙ্কজনকভাবে। যেমন, ২০১৬ সালের তুলনায় রাজদ্রোহ-আইনের মামলা ২০১৯-এ বেড়েছে ১৬৫ শতাংশ, আর সে আইনেরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী ‘ইউএপিএ’ আইনের মামলা বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। আর মামলা, গ্রেপ্তারি ও চূড়ান্ত হয়রানির পরে শেষতক অপরাধের প্রমাণ? হ্যাঁ, আছে বইকি। ২০১৯-এ সমগ্র বিচারপর্ব সমাপ্তির পর রাজদ্রোহ-আইনে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে সাজা হয়েছে ৩.৩ শতাংশ ক্ষেত্রে, আর ‘ইউএপিএ’-র ক্ষেত্রে ২৯.২ শতাংশ ক্ষেত্রে! এ সব আইনে গ্রেপ্তারির শিকার কারা? সাংবাদিক, বিরোধী রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, মানবাধিকার-কর্মী, লেখক, ছাত্র, এমন কি পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী। এমনও ক্ষেত্র আছে, যেখানে একটি স্কুলে বাচ্চাদের নাটকে মোদির সমালোচনা ছিল বলে রাজদ্রোহ-আইনে মামলা করা হয়েছে। এই তো সেদিন, গত বছরেই, অতিশয় প্রতিষ্ঠিত ও প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ দুয়াকে দেওয়া হল রাজদ্রোহের মামলা, যেহেতু তিনি বলেছিলেন যে, কোভিড অতিমারির মোকাবিলায় মোদির ভূমিকা সঠিক নয়। একই আইনের শিকার হয়েছেন দিল্লির পরিবেশকর্মী দিশা রবি, যিনি সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে পুস্তিকা প্রচার করেছিলেন। পরিষ্কার বোঝা যায়, দেশ বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা সম্মানরক্ষা নয়, এইসব মামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে অসন্তোষী কণ্ঠকে রোধ করা, সমালোচনাকে দমন করা, আইন-আদালত-কারাগারের ভয় দেখিয়ে বিরোধিতার টুঁটি টিপে ধরা। এবং, হয়তোবা শুধু এটুকুও নয়। হয়তোবা বাস্তবটি এর চেয়েও ভয়ঙ্কর, এর চাইতেও নৃশংস। বহু ক্ষেত্রেই এইসব প্রশাসনিক দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন দরিদ্র নিম্নবর্গীয় গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। হিন্দুত্বকে দেশপ্রেমের সমার্থক করে তোলার মাধ্যমে ভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাস-অবস্থানই হয়ে উঠছে দেশদ্রোহের তুল্য, ফলে রাজদ্রোহ-আইন হয়ে উঠছে ধর্মীয় ঘৃণা ও হিংস্রতার রাষ্ট্রনৈতিক ভিত্তি ও প্রশাসনিক হাতিয়ার। এই প্রক্রিয়ায়, শত বিকলাঙ্গতা সত্ত্বেও, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার যা কিছু উপাদান আমাদের সংবিধান ও রাষ্ট্রদেহের মধ্যে বেঁচে ছিল, তা খুন হয়ে যাচ্ছে সাড়ম্বরেই।

তাই আজ একবার ফিরে দেখা দরকার, কোথা থেকে কীভাবে এল এই আইন, আর কোন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আজকের পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াল। সেটা এখুনিই দেখব, অতি সংক্ষেপে যদিও। তবে তারও আগে একবার একটু দেখে নেব, ঠিক কী আছে এই আইনে।

 

কী আছে রাজদ্রোহ আইনে?

আইনটি আসলে আমাদের ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ (সংক্ষেপে ‘আইপিসি’) বা ‘ভারতীয় দণ্ডবিধি’ আইনের ‘১২৪এ’ (124A) ধারা। সেখানে যা আছে, তার মুল ইংরেজি বয়ানটি এইরকম।

Whoever, by words, either spoken or written, or by signs, or by visible representation, or otherwise, brings or attempts to bring into hatred or contempt, or excites or attempts to excite disaffection towards, the Government established by law in India, shall be punished with imprisonment for life, to which fine may be added, or with imprisonment which may extend to three years, to which fine may be added, or with fine.

  • Explanation 1.—The expression “disaffection” includes disloyalty and all feelings of enmity.

  • Explanation 2.—Comments expressing disapprobation of the measures of the Government with a view to obtain their alteration by lawful means, without exciting or attempting to excite hatred, contempt or disaffection, do not constitute an offence under this section.

  • Explanation 3.—Comments expressing disapprobation of the administrative or other action of the Government without exciting or attempting to excite hatred, contempt or disaffection, do not constitute an offence under this section.

এর বাংলা তর্জমা হয়তোবা এইরকম হতে পারে–

কোনও ব্যক্তি যদি, লিখিত বা মৌখিক বাক্যের মাধ্যমে, অথবা ইঙ্গিতে, অথবা কোনও দৃশ্যায়িত উপস্থাপনার মাধ্যমে, বা অন্য যে কোনওভাবে, এ দেশের আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে দোষারোপ ও ঘৃণা-সঞ্চার করে বা করার চেষ্টা করে, বা সে সরকারের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তোলে বা তোলার চেষ্টা করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে যার সঙ্গে জরিমানা যুক্ত হতে পারে, বা সে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড পেতে পারে যার সঙ্গে জরিমানা যুক্ত হতে পারে, অথবা শুধু জরিমানাই হতে পারে।

  • ব্যাখ্যা ১— ‘বিতৃষ্ণা’ অর্থে অনানুগত্য এবং যে কোনও ধরনের শত্রুতার অনুভূতিকেও ধরতে হবে।
  • ব্যাখ্যা ২— সরকারি কোনও পদক্ষেপের অসমর্থন যদি এইভাবে হয় যেখানে আইনি পথেই তার পরিবর্তন চাওয়া হচ্ছে, ঘৃণা উদ্রেক বা তার প্রয়াস ছাড়াই, সেখানে এই ধারা ভঙ্গ হবে না।
  • ব্যাখ্যা ৩— সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক মন্তব্য যদি এমনভাবে হয় যে তার মধ্যে ঘৃণা বা দোষারোপ বা বিতৃষ্ণা ছড়ানো হচ্ছে না বা তেমন চেষ্টাও করা হচ্ছে না, সেখানে এই ধারা ভঙ্গ হবে না।

 

রাজদ্রোহ আইনের সৃষ্টি স্থিতি বিলয়

‘ভারতীয় দণ্ডবিধি’-র খসড়া প্রথম লেখেন যে ইংরেজ ভদ্রলোক, সেই সুদূর ১৮৩৭ সালে— তাঁর নাম টমাস ব্যারিংটন মেকলে— তিনি কে তা আর ব্যাখ্যা করতে হবে না নিশ্চয়ই। বহুদিন পর ১৮৬০ সালে যখন সে খসড়া সত্যি সত্যি আইন হিসেবে কার্যকর হয়, তখন কিন্তু ওই ধারাটি বাদ যায়। কেন যে বাদ গেল, সে নিয়ে নানা অনুমান হতে পারে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ইংরেজ আধিকারিকদের ভুল বা গাফিলতির কথাই প্রথমে মনে আসে, তবে সে প্রায় অসম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কঠোরতার প্রশ্নে তাঁরা ঢিলে দিতে পারেন, তেমন সুনাম তাঁদের সম্পর্কে কেউ কখনও করেনি। তার চেয়ে আরেকটু সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বরং এই হতে পারে যে, খোদ বিলেতেই ওই সময়ে ওই আইনটি গুরুত্ব হারিয়েছিল। বস্তুত, আইনটি মধ্যযুগীয়, এবং সেখানে আইনটিকে মান্ধাতার আমলের ব্যাপার বলেই মনে করা হত। আইনটির শিকড় আছে ১২৭৫ সালের ব্রিটিশ আইন ‘স্ট্যাটিউট অফ ওয়েস্টমিন্সটার’-এর মধ্যে। সেই সময়ে রাজাগজাদের দুর্নাম করাটাকে মহাপাপ বলে মনে করা হত, এবং মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার ধারণার জন্মই হয়নি তখনও। আইনটি তখনও বেঁচে ছিল ঠিকই, কিন্তু ১৮৩২ সালের পর থেকে তার আর তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগই হয়নি। ফলত, এটা হতেই পারে যে, ব্রিটিশ আইনের ধাঁচে ভারতীয় আইন বানাতে চাওয়া ইংরেজ আমলার কাছে ওটি মোটেই তেমন প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। ধারাটি আরও দশ বছর পরে ১৮৭০ সালে দণ্ডবিধিতে ঢোকে আরেক ব্রিটিশ আমলা জেমস স্টিফেন-এর সুপারিশে। প্রথমদিকে ওয়াহাবি আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে এ আইনের ব্যাপক ও সফল প্রয়োগ হয়েছিল। যে আইন তাদের নিজেদের দেশেই প্রান্তিক হয়ে গিয়েছে, উপনিবেশে সে আইনের সোৎসাহ ও তৎপর প্রয়োগে ইংরেজরা মোটেই পিছপা হয়নি। কিন্তু, এহেন একটি আইন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে স্বাধীনতার পর থেকেই। বারবারই আপত্তি উঠেছে, এ আইন বাকস্বাধীনতার বিপক্ষে, সমালোচনার অধিকারের বিপক্ষে, এবং সেইহেতু গণতন্ত্র ও মানবাধিকারেরও বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখা এক আদ্যন্ত দমনমূলক ও সংবিধান-বিরোধী আইন।

১৯৫০ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, সরকারের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করলেই তাকে রাজদ্রোহ বলা যায় না, যদি না তাতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা থাকে। বিচারক মনে করিয়ে দেন, ‘সেডিশন’ শব্দটি কিন্তু আমাদের সংবিধানে নেই, এবং, ‘কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’ ইচ্ছাকৃতভাবেই তা বর্জন করেছিল। ১৯৫১ সালে ভারতীয় সংবিধানের প্রথম সংশোধন যখন হয়, তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেহরু-ই আইনটিকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেন, এবং তারপর থেকে এর বিরুদ্ধে একের পর এক আপত্তি উঠতে থাকে— বিচারব্যবস্থার ভেতর থেকেই। ওই সালেই পাঞ্জাব হাইকোর্ট, এবং ১৯৫৯ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট একে সংবিধান-বিরোধী বলে খারিজ করে দেয়, যেহেতু তা সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় প্রদত্ত বাকস্বাধীনতার অধিকারের বিরোধী। ১৯৬২ সালে এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, রাজদ্রোহ আইনের প্রয়োগ হতে পারে, কিন্তু নিছক সরকারের সমালোচনা থাকলে তা যথেষ্ট হবে না, সেক্ষেত্রে সত্যিকারের গণবিশৃঙ্খলা বা হিংসা-মূলক কাজকর্মের প্ররোচনা থাকতে হবে। তারই দশক খানেক বাদে ইমার্জেন্সি জারির প্রাক্কালে এ আইন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছে। তিনি ১৯৭৩ সালে রাজদ্রোহের অপরাধকে ‘কগনিজেব্‌ল্‌’ বলে ঘোষণা করেন, যস্যার্থ, এ আইনে অভিযুক্ত হলে কাউকে আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যেতে পারবে। মোদিজির আমলে এ আইনের প্রয়োগ আতঙ্কজনকভাবে বৃদ্ধি পেলেও, পূর্ববর্তী সরকারেরা কিন্তু এর প্রয়োগে মোটেই খুব বেশি আপত্তি করেনি। ২০১৩ সাল নাগাদ তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলাম-এ পরমাণু চুল্লি বসানোর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন শুরু হলে ২৩০০০ জন নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়, যার মধ্যে ৯০০০ জনের বিরুদ্ধে ছিল রাজদ্রোহের অভিযোগ।

মোদি সরকারের সাম্প্রতিক কাজকর্মের প্রেক্ষিতে এ আইন সম্পর্কে দীর্ঘকালীন আপত্তিগুলো এক আলাদা মাত্রা অর্জন করেছে। ছাত্র, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রাক্তন আধিকারিক, আইনি বিশেষজ্ঞ ও বিচারক, মানবাধিকার-কর্মী, গবেষক, সাংবাদিক— সকলেই আজ এ আইন বর্জন করার পক্ষে সওয়াল করছেন— যা শেষপর্যন্ত পরিণতি পেল গত ১১ মে ২০২২ তারিখে, সুপ্রিম কোর্টের একটি যুগান্তকারী রায়ের মধ্য দিয়ে। এই বিচারটি হয়েছে তিন বিচারকের এক বেঞ্চে, যার নেতৃত্বে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণ। এ রায়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হয়েছে আইনটিকে পুনর্বিবেচনা করতে, এবং কেন্দ্রীয় ও সমস্ত রাজ্য সরকারকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হচ্ছে ততক্ষণ এ আইনে আর কোনও মামলা বা গ্রেপ্তার না করতে। ইতিমধ্যে যে সমস্ত মামলা চলছে সেগুলোতে অভিযুক্তদেরকে জামিন দিয়ে দিতে হবে, যদি অন্য কোনও আইন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, পুনর্বিবেচনার নাম করে যাতে এ আইনকে আরও বেশ কিছুকাল চালু রাখা যায়, কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত তাতে সায় না দিয়ে আইনটিকে স্থগিত করে দেয়।

ক্ষমতাসীন মোদি সরকার যে আইন সংশোধনের নামে কিছু চালাকি ও বাগাড়ম্বর করে এ আইনের গণতন্ত্র-বিরোধী মোদ্দা সারসত্তাটিকে সংরক্ষণ করতে চাইবে, তাতে বোধহয় কারও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু, দেশব্যাপী আপত্তির মুখে, এবং ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের মনোভাবটি দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায়, সেটা হয়তো আর তত সহজ হবে না। তা আরও কঠিন হয়ে উঠবে এই প্রেক্ষিতে যে, স্বয়ং ব্রিটেন ২০০৯ সালে, এবং অস্ট্রেলিয়া ২০১০ সালে, তাদের নিজেদের দেশে এ আইনকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছে।

শেষের কথা

পরাক্রমী শাসকের সব নখদাঁতই শেষপর্যন্ত ক্ষয়ে যায় মহাকালের অমোঘ ঘষাঘষিতে। সব রক্তচক্ষুই শেষপর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি’। যা কিছু অসত্য অমানবিক অযৌক্তিক, তা ইতিহাসের অমোঘ ঢাল বেয়ে ক্রমেই গড়াতে থাকে আঁস্তাকুড়ের দিকে। আর যেখানে সে ঢালটি শুরু হচ্ছে, তার সন্ধিক্ষণ-বিন্দুতে একযোগে দাঁড়িয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ ও সুকুমার।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...