হিমাংশু কুমার বিষয়ক দু-একটি কথা যা আমি জানি

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

এবার কার পালা!

দেশজুড়ে অধিকার-কর্মীদের প্রতি দিল্লির সরকারের নিরন্তর আক্রমণের পরবর্তী শিকার কে? প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেছে। এবারের লক্ষ্য ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলার সুপরিচিত গান্ধিবাদী মানবাধিকার কর্মী হিমাংশু কুমার। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী হিমাংশু কুমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত তাই শুধু আর্থিক জরিমানা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনে সিবিআই বা ছত্তিশগড় সরকার তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে যথাযোগ্য শাস্তি দিতে পারে। অর্থাৎ হিমাংশু কুমারের জেলযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য বিচারবিভাগ যা যা করার তা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে। কী কারণে হিমাংশু কুমার আজ শাস্তির মুখোমুখি তা ইতিমধ্যেই বহু আলোচিত, তবু এই নিবন্ধের আলোচনার সুবিধার্থে বিষয়টা সংক্ষেপে আরেকবার উল্লেখ করা প্রয়োজন। ২০০৯ সালে দান্তেওয়াড়া জেলায় মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যখন ছত্তিশগড় পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনি অভিযান চালাচ্ছিল (১৭ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর) তখন ১৭ জন আদিবাসী মানুষ মারা যান। প্রথম ঘটনাটি গাচানপল্লী এবং দ্বিতীয়টি গোমপাড গ্রামে ঘটে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে হিমাংশু কুমার ও সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলির ১২ জন বাসিন্দা অভিযোগ করেন এই মানুষদের সশস্ত্র বাহিনি ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে এবং তারা পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আবেদন করেন। সুপ্রিম কোর্ট দু পক্ষের শুনানির পর তদন্তের দাবি নাকচ করে। কিন্তু বিষয়টা নাকচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিচারপতি এ এম খানউইলকর ও জে বি পারদিওয়ালার বেঞ্চ হিমাংশু কুমারের প্রতি ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ঘোষণা করে। বেঞ্চের মতে ঐ হত্যাকাণ্ড আদতে মাওবাদীরাই ঘটিয়েছে এবং এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে হিমাংশু কুমার ও তার সঙ্গীরা পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনিকে কলঙ্কিত করতে পিটিশন করেছে। হিমাংশু কুমার রায় শোনার পর তাঁর প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন তিনি এই জরিমানা দেবেন না, প্রয়োজনে জেলে যাবেন। তিনি আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতায় তিনি কখনও মিথ্যা অভিযোগ মেনে নেবেন না।

 

চেনা ছক, চেনা ফন্দি

সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় কয়েকদিন আগের আরেকটি রায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বা আরও সহজ করে বললে রায় দুটোর মধ্যে একটা চেনা ছক লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা সংক্রান্ত একটা মামলায় সর্বোচ্চ আদালত স্পেশাল ইনভেসটিগেশন টিম (সিট)-এর তদন্ত রিপোর্টকে তুলে ধরে মামলাকারীদের (তিস্তা শীতলওয়াড় ও অন্যান্য) বৃহত্তর চক্রান্তের স্বরূপ উন্মোচনের দাবিকে শুধু নাকচই করেনি বরং মামলাকারীদের ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করে। এই পর্যবেক্ষণের পরের দিন সমাজকর্মী তিস্তা ও গুজরাটের প্রাক্তন পুলিশ মহানির্দেশক আর বি শ্রীকুমারকে গ্রেফতার করা হয়। এই দুটো রায়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হল সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে দেশের নাগরিকদের প্রতি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। এই বার্তা বলতে চায় যদি কোনও নাগরিক রাষ্ট্রের কোনও এজেন্সির আচরণ বা কাজকে অন্যায় মনে করে তার প্রতিবিধান পাওয়ার আশায় আইনের দ্বারস্থ হয় তবে তার জন্য এক ভয়ঙ্কর পরিণাম অপেক্ষা করছে। গণতন্ত্রে এই রায় শুধু অন্যায্যই নয়, তা রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক এবং আইনের প্রাথমিক ধারণার বিরোধী। পাটনা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন, আগে মানুষ অভিযোগ যত ছোটই হোক না কেন, নিশ্চিন্তে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারত, তারা ভাবত না অভিযোগ করার কারণে তাদেরই বিপদে পড়তে হতে পারে। আদালতও কখনও এমন আচরণ করত না। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। প্রবীণ আইনজীবি চান্দের উদয় সিং এই রায়কে ব্যাখ্যা করে বলেছেন এর ফলে অভিযুক্তদের আদালতে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। পর্যবেক্ষণ লেখার জন্য যেভাবে শব্দ চয়ন করা হয়েছে তা গণতন্ত্রের জন্য শুধু বিপজ্জনকই নয়, তা আইনবিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। প্রবীণ আইনজীবীর এই রায় কেন যথার্থ তা রায়ের কিয়দংশ পাঠ করলেই বোঝা যায়—

“(b) pass an order directing CBI/NIA or any other central investigating agency… as this Hon’ble court deems fit and proper to register an FIR and conduct an in-depth investigation to identify the individuals/organisations who have been conspiring, abetting and facilitating filing of petitions premised on false and fabricated evidence before this Hon’ble court… with a motive to either deter the security agencies to act against the left wing (naxals) militia by imputing false charges on them or to screen of the left wing (naxals) militia from being brought to justice by creating a false narrative of victimization before the Hon’ble court…”

 

বিচারব্যবস্থা ও এক মায়াবী বিভ্রম

হিমাংশু কুমারকে জরিমানা করার পর তিস্তা শীতলওয়াড় ও হিমাংশু কুমারের রায়ের মধ্যে পরিস্ফুট চেনা ছক নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বর্তমান নিবন্ধকারের মতে এই চেনা ছকের থেকে অনেক বেশি চিন্তার হল ২০১৪ পরবর্তী সময় থেকে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন যা নাগরিকদের চেতনায় এক মায়াবী বিভ্রম তৈরি করছে। একদিকে উলঙ্গ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি ও রাষ্ট্রশক্তির আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে হতাশ জনগনের সামনে আদালতকে একমাত্র ‘মসিহা’ হিসাবে নির্মাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অন্যদিকে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ মডেলে এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গঠনের পথ সহায়ক করতে আদালতের রায় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করছে। দানবীয়, চূড়ান্তভাবে অগণতান্ত্রিক সিডিশন আইনের প্রয়োগ সাময়িকভাবে স্থগিত করে আদালত নিজেকে এই বিপন্ন সময়ে সাংবিধানিক মূল্যবোধের রক্ষাকর্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চাইছে। জামিন আইন সহজ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ, কোনওভাবেই দেশকে পুলিশ রাষ্ট্র করা যাবে না— এইসব বক্তব্য রেখে আদালতের প্রগতিশীল ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এক আলোচনাচক্রে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি বলেছেন— “আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় গোটা পদ্ধতিটাই একটা শাস্তি। তাড়াহুড়ো করে নির্বিচারে গ্রেফতারি থেকে শুরু করে জামিন পেতে সমস্যা— যেভাবে বিচারাধীন বন্দিদের দীর্ঘ দিন ধরে বন্দি থাকতে হয় সেই পুরো প্রক্রিয়াটিতেই জরুরি ভিত্তিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন— সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে আগে যথেষ্ট পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধীদের সেই পরিসরটি কমে আসছে।” এই সমস্ত সুবচনী মুদ্রার একটা পিঠ মাত্র।

মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে একের পর এক রায় যা আদতে দিল্লির মসনদে আসীন শাসকদের অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক আচরণকে মান্যতা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলা। পরিকল্পিতভাবে একটি সুপ্রাচীন মসজিদকে যারা গোটা পৃথিবীর চোখের সামনে ভেঙে গুড়িয়ে দিল তাদের সবাইকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করল সর্বোচ্চ আদালত। শুধু তাই নয়, দুষ্কৃতকারীদের দাবি মেনে নিয়ে ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ স্লোগানের বাস্তবায়ন ঘটল খোদ আদালতের নজরদারিতে। দিল্লি দাঙ্গা বা বহু আলোচিত ভীমা-কোঁরেগাও মামলা, আইনের সাধারণ পাঠগুলিকে অগ্রাহ্য করেছে আইনব্যবস্থা। হজরত মহম্মদ সম্পর্কে বিজেপি মুখপাত্র নুপুর শর্মার মন্তব্যের পর দেশজুড়ে হাঙ্গামার পর তীব্র ভাষায় তাকে অভিযুক্ত করল আদালত, কিন্তু দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তার বিরুদ্ধে একাধিক এফআইআর থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতারিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। তালিকা দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই, আপাতত আমরা হিমাংশু কুমারের মামলা প্রসঙ্গে আদালতের অবস্থান পরিবর্তনটাকে লক্ষ করতে পারি। পূর্ব-উল্লেখিত মামলায় ২০১০ সালে ছত্তিশগড় সরকার সর্বোচ্চ আদালতের কাছে এক হলফনামা পেশ করে বলে সমস্ত আবেদনকারীরা আসলে ‘নকশাল সিমপ্যাথাইজার’। আদালত এই হলফনামা নাকচ করে জানিয়ে দেয়, এই বক্তব্য যেন আর না তোলা হয়। ২০১৭ সালে ছত্তিশগড় সরকার আবার একটা হলফনামা দিয়ে জানায় সমাজকর্মী সোনি সোরি ও হিমাংশু কুমার নকশালঘনিষ্ঠ, আদালত আবার তা নাকচ করে। কিন্তু ২০২২ সালে ছবিটা পাল্টে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার এক হলফনামা দিয়ে জানায় যারাই এনকাউন্টার কিলিং নিয়ে মামলা করছে, মাওবাদী দমন অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সরব হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে এনআইএ এবং সিবিআই দিয়ে তদন্ত করা হোক কারণ এই সমস্ত সমাজকর্মী দীর্ঘদিন ধরে ছত্তিশগড়ে আছেন, তাই তাঁরা সবাই নকশালঘনিষ্ঠ। হিমাংশু কুমারের মামলায় আদালতের রায় সরকারের সেই দাবিরই সিলমোহর।

 

কেন হিমাংশু কুমার দীর্ঘ সময় ধরে আক্রমণের লক্ষ্য

প্রথমে তথ্যের খাতিরে একটা কথা বলা প্রয়োজন। হিমাংশু কুমার দীর্ঘ সময় ধরে ছত্তিশগড়ের উপর্যুপরি সরকারের (কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপি) দমনপীড়নের শিকার। আর তার কারণটা অস্পষ্ট নয়। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে ‘গ্রামেই প্রকৃত ভারত বাস করে’— গান্ধিজির এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছত্তিশগড়ে দান্তেওয়াড়ায় হিমাংশু কুমার তার আশ্রম স্থাপন করেন।

হিমাংশু কুমারকে জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০০৯ সালের ১৮ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সেই বহু আলোচিত বক্তব্যে যেখানে তিনি বলেছিলেন— “যদি বামপন্থী উগ্রবাদ আমাদের বিপুল খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকাতে এভাবে বাড়তে থাকে তবে অবশ্যই বিনিয়োগের পরিমণ্ডল নষ্ট হবে… আমরা তা হতে দিতে পারি না।” অর্থাৎ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নয়, এমনকি মাওবাদীদের হাত থেকে এলাকাগুলিকে মুক্ত করে উন্নয়নের স্রোত বইয়ে দেওয়াও নয়, সরকারের লক্ষ্য এই সমস্ত অঞ্চলে বিনিয়োগের পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখা অর্থাৎ দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থকে সুনিশ্চিত করা।

এই স্বার্থ সুনিশ্চিত করা অর্থাৎ পূর্ব ও মধ্য ভারতের অপার খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের পথ প্রশস্ত করতে ছত্তিশগড়ে আদিবাসী জনগণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লাগানোর লক্ষ্যে আদিবাসীদের একটা অংশকে সশস্ত্র করা হয়, যার আনুষ্ঠানিক নাম সালওয়া জুড়ুম। কিন্তু আদালতে এই পরিকল্পনা অসাংবিধানিক বলে ঘোষিত হলে কেন্দ্র সরকার নিজেই রাজ্য সরকারগুলির সহায়তায় তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের অভিভাবকত্বে সেই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। তারপর থেকে বহু সময় কেটে গেছে, অপারেশন গ্রিন হান্টের নতুন নামকরণ হয়েছে ‘অপারেশন সমাধান’। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে মাওবাদী প্রতিস্পর্ধা দমন করতে সরকার হেলিকপ্টার ও ছোট বিমান পর্যন্ত ব্যবহার করছে। প্রকৃত অর্থে বস্তার, দান্তেওয়াড়া, অবুঝমাড় আজ এক প্রসারিত যুদ্ধক্ষেত্রের নাম যেখানে প্রতি মুহূর্তে আদিবাসী মানুষ মারা যাচ্ছেন। আর এই পরিস্থিতিতে হিমাংশু কুমার, বেলা ভাটিয়া, নন্দিনী সুন্দর বা সুধা ভরদ্বাজের মত সমাজকর্মীরা হয়ে উঠেছেন জনগণের মুখপাত্র যারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে শাসক শিবিরকে বারংবার অস্বস্তির মুখে ফেলছেন। তাই এই সমাজকর্মীরা আজ আক্রমণের শিকার।

 

বস্তারের বাস্তবতা হিমাংশু কুমারের বয়ানে

হিমাংশু কুমার ছত্তিশগড়ে কর্পোরেট লুণ্ঠন ও আদিবাসী মানুষকে ছিন্নমূল করার ইতিহাস বহু দিন ধরে আমাদের কাছে বলার চেষ্টা করে আসছেন। ২০০৯ সালের ৩১ অক্টোবর মুম্বাই প্রেস ক্লাবে তিনি এক দীর্ঘ বক্তব্য উপস্থিত করেন যা ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই নিবন্ধের কিয়দংশ আরেকবার দেখে নেওয়া যেতে পারে—

আজ লক্ষ লক্ষ নাগরিক কেন বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছে? আমাদের মত মধ্যবিত্ত লোকদের কাছে ব্যাপারটা ব্যাখ্যাতীত। আমরা শহরে বাস করি, পুলিশ সরকার সবই আমাদের জন্য। আমরা একটা পক্ষে। অন্য পক্ষে যারা রয়েছে তাদের জন্য পুলিশও নেই, সরকারও নেই, তাদের খাবারও কিছু নেই। তারাই আজ অস্ত্র তুলে নিয়েছে। এরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত। একটা কাঠামো আছে। যারা এই কাঠামোর বাইরে চলে গেছে এটা তাদের লড়াই….

অসাম্য এই ব্যবস্থার অনিবার্য উপকরণ। আমাদের মূল্যবোধ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটা মন্ত্রেই চালিত— কে বেশি সম্পদের উপর দখলদারি চালাতে পারবে। এটাই এই সমাজের চালিকাশক্তি। এই কাঠামো গরিবকে আরও গরিব ও ধনীকে আরও ধনী করে। আমরা এই কাঠামোয় পরিতৃপ্ত। কিন্তু যারা এই কাঠামোর কারণে বঞ্চিত তাদের কী হবে? তারা এটা ভাঙতে চাইবে। এই লড়াই কাঠামোগত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এই কাঠামো বদল করে পূর্ণ সাম্য না আসা পর্যন্ত এই লড়াই থামবে না। এটা গরিব মানুষের লড়াই। নকশালরা জড়িয়ে গেছে মাত্র। যদি কোনও মার্কস বা গান্ধি না থাকত তবে কি গরিবরা লড়ত না? তাদের কোনও নকশাল বা গান্ধিবাদীর দরকার নেই। কিন্তু কখনও কখনও কোনও বিনোবা বা গান্ধি বা মাওবাদী এই লড়াইতে যুক্ত হয়ে যায়।

 

হিমাংশু কুমার ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সঙ্কট

একথা অস্বীকার করার কিছু নেই যে হিমাংশু কুমার নিজে সেই তৃপ্ত কাঠামোর মানুষ। কিন্তু হিমাংশু কুমার ও তাঁর মত বহু বিবেকবান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ সমস্ত বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কর্পোরেট কামানের শিকার মানুষদের পক্ষ নিয়েছেন। তাঁরা সেই বার্তাবাহক যারা বলছেন অসাম্য, অত্যাচার ও লুণ্ঠনের কথা যা প্রজাতন্ত্রের ধারণাকে এক বিপজ্জনক খাদের সামনে এনে ফেলেছে। এই বার্তাবাহকদের ধ্বংস করে সরকার আজ সত্যের মুখ বন্ধ করতে চাইছে। তাই হিমাংশু কুমার গান্ধিবাদী-মাওবাদী না কি মাওবাদী-গান্ধিবাদী এই আলোচনা নিরর্থক, গণতান্ত্রিক ভারতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাঁদের উপস্থিতি নিশ্চিত করাটাই আজ নাগরিকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...