সাহনি

রাজা সিংহ

 

এক

উনুনের পাশে উবু হয়ে বসে সাহনির রান্না করা দেখে রুকু। রসুন আর শুকনো লঙ্কা ভাজতে ভাজতে প্রায় পুড়িয়ে ফেলে সাহনি। তেলচিটে ছোট একশো গ্রামের শিশিতে তেল প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। সেটাই উবুর করে ধরে থাকে ভুষো-কালো লোহার কড়াইটার ওপর যতক্ষণ না সেই তেলচিটে গা বেয়ে তেলের শেষ ফোঁটাটুকু নিঃশেষ হয় কড়াইয়ে। হাঁটুর ওপর থুতনি গুঁজে দেখে রুকু, প্রথমে রসুনগুলো থেঁতো করে নেয় লাইন পার থেকে তুলে আনা তেকোণা পাথরের টুকরো দিয়ে। তারপর ঝপাস করে কড়াইয়ে ঢেলে দেয় এক গামলা ট্যালটেলে সেদ্ধ ডাল। বার কয়েক বুড়বুড়ি কেটে ডাল ফুটতে শুরু করে টগবগ টগবগ। ভাজা রসুন আর শুকনো লঙ্কার ফোড়নে জিভে জল আনা গন্ধ ওঠে বাতাসে। তারপর রুকু আর বাবার জন্য কাঁসার ঝকঝকে থালায় ভাত আর বড় বাটিতে ডাল, আলুসেদ্ধ তুলে রেখে খেতে বসে সাহনি। রুকু ওর খাওয়ার ধরণটা খেয়াল করে রোজ। অ্যালম্যুনিয়ামের কানা উঁচু একটা থালায় প্রথমে ভাত নেয়, থালার তিন-চতুর্থাংশ জায়গা জুড়ে উঁচু পাহাড় হয়ে থাকে ভাত। বাকি অংশটুকুতে ঢেলে দেয় গরম মুশুর ডাল যতক্ষণ না কানা ছাপিয়ে ওঠে, যতক্ষণ না ভাতের পাহাড়ে এসে ধাক্কা খায় ডালের সমুদ্র। এক কোণায় থাকে পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা দিয়ে মাখা এক মুঠো আলুসেদ্ধ কিংবা এক হাতা ভিণ্ডি ভাজা আর একটা গোটা কাঁচা পেঁয়াজ। সাহনি ভাত ভেঙে ডালের সমুদ্রে ফেলে, তারপর সেই ডাল ভাতের মিশ্রণ সপাসপ শব্দে চালান করে মুখের ভেতর, জিভ বেরিয়ে আসে, কনুই বেয়ে গড়িয়ে নামে ডাল। আঙুলের ডগায় একচুটকি আলুসেদ্ধ মুখের ভেতর পাচার করে জিভ দিয়ে কনুইয়ের ডাল চেটে নিয়ে আবার ভাতে মনোযোগ দেয় সাহনি। খাওয়ার সময় কথা বলে না ও। তবে মাঝে মাঝে থামে আর ঠোটঁটা ছুঁচলো করে দু-তিনবার বাতাস টেনে নেয় ভেতরে। খেতে খেতে হাঁপিয়ে গিয়ে যেন দম নেয় একটু। এইভাবে একথালা ভাতের অবশিষ্ট দানাটিও শেষ করে রুকুর দিকে চেয়ে চোখেমুখে হাসে সাহনি। যেন এইমাত্র একটা মজার গল্প বলা শেষ করেছে।

দুই

সবচেয়ে কাছের বড় শহর ঝাঁঝরপুর। কখনও যায়নি সাহনি। যাওয়ার কথা ভাবেওনি কখনও। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এখানেই বেড়ে ওঠা। এই মধুবনি জেলার গণ্ডগ্রাম পরসা বাসুয়ারিতে। রেলস্টেশান ছিল না আগে। বছর কয়েক আগে আসে। পাশের সাতটা গ্রামের লোকের দাবিদাওয়া মেনে হল্ট স্টেশনের মাহাত্ম্য পেয়েছে বাসুয়ারি গ্রাম। তা গাঁয়ের লোক তাতেই খুশি। খুশি সাহনিও। রেলস্টেশনের দৌলতে কয়েকটা রেল কোয়ার্টার, সেগুলিই গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়ি। লম্বা টানা একটা প্ল্যাটফর্ম, তাতেই খুপড়ি স্টেশনঘর। স্টেশনঘর ঘেঁষে জবা আর অতসি গাছের জঙ্গল। সকাল আর সন্ধ্যায় দুটি মাত্র প্যাসেঞ্জার ট্রেন থামে এখানে। বাকি সব দূরপাল্লার ট্রেন। নাক উঁচিয়ে লম্বা ক্যুউউউউউ বাজিয়ে দমদম ঝমঝম দেমাক দেখিয়ে স্টেশনঘরে ধুলোর ঘূর্ণি তুলে বেরিয়ে যায়।

রুকুর বয়স বারো পেরোল এবার। গরমের ছুটিতে বাবা নিয়ে এসেছে তার সদ্য বদলি হয়ে আসা কাজের জায়গায়। বাবা স্টেশনমাস্টার। সবাই বলে বড়বাবু। রুকুর এমন মাঝেমাঝেই হয়, প্রতি গরমের ছুটিতে কয়েকদিনের জায়গাবদল। পরসা বাসুয়ারি পুরোপুরি গণ্ডগ্রাম। সর্বসাকুল্যে খান বিশেক ঘর। সব চাষি, তারা অড়হর বোনে, খেসারি ফলায়। দো-ফসলি জমিতে যে ধান হয় তাতে তাদের সারা বছর চলে যায় মোটামুটি। যা বাঁচে তা বিক্কিরি করে তারা কেনে নুন আর তেল। শাকসবজি, কলাটা-মুলোটা ফলে বাড়ির সামনের ক্ষেতিতে। লাউ, তোরাই, শশা, উচ্ছে ধরে থাকে কুটিয়ার আনাচেকানাচে, কাঁচা বেড়ায়, ঘরের চালে। মাছ-টাছ বিশেষ খায় না এরা। কখনও সখনও হাঁসের ডিম আর সুযোগ পেলে বনমুরগি বা কবুতর, তাও ছেলেছোকড়ারা খায়, বছরে-দুবছরে একবার। গ্রামের একমাত্র টিমটিমে দোকানে যৎসামান্য অতি প্রয়োজন ছাড়া আর কিছুই মেলে না। রুকুর অসুবিধা হত প্রথম প্রথম। শহরের অভ্যস্ত প্রয়োজনের কোন জিনিসই প্রায় মেলে না। ব্রাশ করা ছেড়ে বাবুলের পাতলা ডাল দিয়ে দাঁতন করা শিখেছে রুকু। রাতে বিজলিহীন গরমে নিচু ছাদওয়ালা কোয়ার্টারে ঘুমনো যায় না। তাই আর্মি ডিসপোজাল থেকে কেনা সাদা ফিতের ক্যাম্পখাট বিছিয়ে স্টেশনের ছাউনির নিচে বাবার গায় সেঁটে শোয় রুকু। রাত বাড়ে আর তার সাথে বাড়ে রাতের শব্দ। জ্বলজ্বলে অজস্র তারার নিচে, ঝুপসি ঘন বাঁশবাগান থেকে ভেসে আসে একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দ, কিরকিট… কিরকিট… কিরকিট। ডানা ঝাপ্টে উড়ে যায় হুতোম প্যাঁচা। জোর করে দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে রুকু। চার দেওয়ালের বাইরে ঘুম আসে না সহজে। রাতচরা পাখির ডাকে উঠে বসে রুকু। পাশে বাবা ঘুমিয়ে কাদা, দূরে ভূতের চোখের মতো দপদপ করছে ডিসট্যান্ট সিগন্যাল। ভয় লাগে রুকুর। ফিসফিসিয়ে ডেকে ওঠে… সাহনি… সাহনি। নিচে কাগজ পেতে সাহনি অঘোরে ঘুমোয়। কখনও রুকুর ঠেলায় উঠে বসে চোখ রগড়ায় ‘ক্যা পিসাব লাগল বা ক্যা?’ শহুরে অভ্যাস থেকে বহুদূরের এই গণ্ডগ্রামে রুকু একদিনও কাটাতে পারত না যদি না সাহনি থাকত। বাবা সারাদিন ব্যস্ত থাকে স্টেশনের কাজে। কখনও যেতে হয় সদরে। সকালের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে গিয়ে আবার সেই প্যাসেঞ্জার ট্রেনেই ফিরে আসা সাঁঝবেলায়।

সাহনি গবগবিয়ে হাসে। সরল সোজাসাপটা মুখে হালকা গোঁফের উপস্থিতি দেখে মনে হয় সাহনির বয়স ষোল কি সতেরো। সঠিক বলে দেওয়ার জন্য সাহনির তিনকূলে কেউ নেই। আর কী ভাবে যে সে পরসা বাসুয়ারি গ্রামে এসে ঠেকেছে তার সুলুকও দিতে পারে না কেউ। আড়ম্বরহীন জলা-জঙ্গলের আগাছার মতোই বেড়ে উঠেছে সাহনি। বলরাম যাদবের বাড়িতে যখন মোষ চরানো শুরু করে সাহনি তখন তার বয়স ছয় কি সাত। রেললাইন পেরিয়ে, আল ঢিবি পেরিয়ে, অড়হরের ক্ষেত পার করে মোষগুলো ঝিল পারের বড় ঘাস জমিতে ছড়িয়ে পড়ত। আর সাহনি সেই ঝিলের জলে ঝাঁপিয়ে তুলে আনত পদ্মটাটি। তারপর সূয্যি যখন দূরের বিএসএফ ক্যাম্প পেরিয়ে বড় গাবগাছের মাথা ছুঁই ছুঁই, তখন সে তার লাঠি বাগিয়ে মোষগুলোকে ইকঠঠা করত তারপর সবচেয়ে বড় জানোয়ারটার পিঠে উবুড় হয়ে শুয়ে মুখ দিয়ে আওয়াজ তুলত হুরররররটটটট।

বোশেখ-জষ্টি মাসের গরমে বেশির ভাগটাই কাটত জলে। যত্ন-আত্তি ছাড়াই ফনফন বেড়ে ওঠা জংলী আকন্দ গাছের মত শরীর সাহনির। পরনে শুধুমাত্র একটা ঘুনসি। শুধু ছট পরবের পর যখন ভুতের চোখের মতো ডিসট্যান্ট সিগন্যালটা আর দেখা যেত না ভোরের দিকে, সেই সময় ঠাণ্ডায় গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত ওর। সেই দু-তিনমাস যাবত সে চলে যেত দু-গ্রাম পেরিয়ে কাঠকলে। সেখানে বড় বড় লাকড়ি ফেড়ে দু-ফাঁক করত সারাদিন। সবাই পৌষ শীতে ঠকঠকিয়ে পুঁটলিপানা হয়ে যেত আর সাহনি শীত ভাগাতে কুড়ুল চালাত দমাস দমাস আর ঘামত গলগল করে। কাঠগোলার ইজারাদার লছমন পাঁড়ে পার্সেলের বস্তা কেটে একটা লম্বা আলখাল্লা বানিয়ে দিয়েছিল তাকে। সে শীতে সাহনির ফূর্তি দেখে কে। সেই পুরো শীত একদিনের জন্যেও ও গা থেকে নামায়নি সেই আলখাল্লা। তবে চৈতসংক্রান্তির চূড়া দহি খাবার পরপরই আবার ফিরে গেছে আবার সেই পুরনো ঘুনসিতে। কোথায় যে গেল তার আলখাল্লা, পরের শীতে যে আবার সেটার দরকার হবে, সে সব চিন্তা বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না ওকে। নিজস্ব বলতে একটা সুতোও নেই। তবু সে হতদরিদ্দির নয়। মানুষ সঞ্চয় করে। সাহনি করে না। নিয়ম করে সকাল সাঁঝে খিদে পায় না তার। তেমন অভ্যেস গড়ে ওঠেনি। জঙ্গলের পশুর মতোই তার চলনচালন। তাই যখন তার খিদে পায়, তখন হপাহপ সপাসপ খায় সাহনি। খাওয়া শেষ করে আবার হাসে। এত রাশি রাশি অনুভূতির মধ্যে সে শুধু হাসতেই শিখেছে। অন্যগুলো কোনওটাই জানেনি কোনদিন। ভয় ডর শেখায়নি কেউ। মানুষ কাকে ভয় পায়? তার চেয়ে শক্তিমানকে। তা সে অর্থেই হোক বা পেশিতে বা পদমর্যাদায়। সাহনির কোনও মনিব নেই। সে নিজের ইচ্ছেতেই থাকে অথবা নিজের ইচ্ছেতেই চলে যায়। দিনে একবার খাবার ঠিক জুটেই যায় তার। কেউ কোনওদিন তাকে মারেনি। চেঁচিয়ে ধমক দেয়নি। তাই সাহনি ভয় পেতেও শেখেনি। জামাকাপড়, টাকাপয়সা ইত্যাদিতেও কোনও প্রয়োজন জন্মায়নি তার। চল্‌ বললে তখুনি গা হাত পা ঝেড়ে সঙ্গে চলতে পারে সাহনি। একটা পুঁটুলিও সঙ্গে নিতে হবে না তার।

অবাক হয় রুকু। তার চেয়ে মাত্র বছর কয়েকের বড় এই ছেলেটির ঔদাসীন্য রুকুর মতো সদ্য কিশোরকেও অবাক করে। রুকুর বাবার রন্ধনজ্ঞান বড়ই সীমিত, তবুও তাই শিখিয়ে দিয়েছেন সাহনিকে। ফলে অন্ততঃ তাদের আর অনাহারে থাকতে হয় না। সারাদিন টই টই করে ঘোরে সাহানি আর রুকু। পুরনো ঝিলের কাছে বিশাল তেঁতুল-বট আর তার গায়ে অজস্র কোটরে রাজ্যের পাখি, কাঠবেড়ালি, সাপ, বিছের বাসা। সাহনির সেটা বড় প্রিয় জায়গা। মাঝে মাঝে তড়তড়িয়ে উঠে হারিয়ে যায় ঘন পাতার ফাঁকে। কিছুক্ষণ পর নেমে আসে এক থেলো পাকা তেঁতুল নিয়ে। এমন মিঠে তেঁতুল রুকু কখনও খায়নি আগে। সে থেলো নিয়ে এসেই সাহনি খাওয়া শুরু করে। একবারও রুকুর দিকে এগিয়ে দেয় না। ইচ্ছেমতো সেখান থেকে তেঁতুল ছিঁড়ে খায় রুকু। সাহনি আবার হাসে গবগবিয়ে। কিছু বলে না। জঙ্গলের প্রাণীদের মতোই সে বন্ধনহীন। অনুভূতিগুলো যেন তার অন্য তারে বাঁধা। সে খবর সামাজিক মানুষের জানার কথা নয়। বোঝার কথা নয়।

তিন

রোজ সকালে আর বিকেলে ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে দাঁড়ায় সাহনি। পয়েন্টসম্যান এতোয়ারির হাতে স্টেশনের বড়বাবু চামড়ার রিঙে মোড়া গোলা দিয়ে দ্যান। তার মানে পরের স্টেশন অবধি ‘লাইন কিলিয়ার’। এতোয়ারি ডিসট্যান্ট সিগন্যালের মাথায় সেই চামড়ার রিং ঝুলিয়ে দেয়। চলতি গাড়ির ফায়ারম্যান কিংবা অ্যাসিস্ট্যান্ট হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয় সেই ‘লাইন কিলিয়ার গোলা’। এই সময়টুকু অদ্ভুত উত্তেজনা হয় সাহনির। রোজ সে এতোয়ারির হাত থেকে রিং নিয়ে ডিসট্যান্ট সিগন্যালের উপর টাঙ্গিয়ে দেয়।

সেদিন দিনের ট্রেনে রুকুর বাবার সদরে যাওয়ার কথা সকালের ট্রেনেই। এতোয়ারি আর সাহনি ডিসট্যান্ট সিগন্যালে পৌঁছে গেছে। টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে গোলা। ঠিক তখনি এতোয়ারির পেটটা মোচড় মেরে উঠল। এতোয়ারি একছুটে লাইন পেরিয়ে একটু নিচু জমিতে মিলিয়ে গেল। ট্রেন এগিয়ে এল, বাড়ানো হাত টেনে নিল গোলা সমেত চামড়ার রিং। আর তখনি সাহনি দেখল ট্রেনের ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ল একটা বস্তার মতো কিছু। এক লাফে সে ছুটে গেল বস্তাটার দিকে আর কাছে গিয়ে একদম থমকে গেল। ততক্ষণে এসে গেছে এতোয়ারি। দুজন মিলে উলটে দিয়েই থমকে গেল ওরা, বছর কুড়ি একুশের একটা মেয়ে। বোধহয় কামিন খাটতে যাচ্ছিল পাশের স্টেশনে। অনেকেই মাটি কাটার কাজে যায় আশেপাশের গ্রাম থেকে।

পড়ল কি করে?

কেউ কি ঠেলে ফেলল তবে? না হাত পিছলে গেল?

নিজের মনেই একরাশ প্রশ্ন করে নাকের পাশে হাত রাখে এতোয়ারি।

শ্বাস চলছে এখনও। এতোয়ারির কথায় সাহনি আঁজলা ভরে জল এনে মুখে ছেটায়। ঠোঁটের ওপর ফেলে ফোঁটাফোঁটা। দু-কষ বেয়ে গড়িয়ে যায় জল। এতোয়ারি পোড়খাওয়া মানুষ। অ্যাক্সিডেন্টের কেস, থানা পুলিশ হবে। হাত ঝেড়ে ফেলতে চায় ও–

‘চল্‌ রে সাহনি, কনটরল ফোনুআ সে পুলিস কে বতাওয়ে কে পড়ি।’

সাহনি নড়ে না। কুকুরের মতো পাক খেতে থাকে শরীরটার চারপাশে। হাত রাখে নাকের নিচে। এতোয়ারি তাড়া লাগায়, এগিয়ে পড়ে। নড়ে না সাহনি। অসহায় চেয়ে থাকে ট্রেন রাস্তার দিকে। রোগ, শোক, জরা এর আগে সরাসরি দেখেনি সে। আঘাত লাগলে, ঘাস থেঁতো করে লাগাতে শিখেছে। এক ছুটে এক মুঠো ঘাস নিয়ে এল সাহনি। মাথার পেছন দিকে তাজা রক্ত জমাট বেঁধেছে ততক্ষণে। সাহনি ঘাস থেঁতো করে লাগিয়ে দেয়। নিথর শরীরে কোনও হেলদোল হয় না। রোদ বাড়ে। শরীর আগলে বসে থাকে সাহনি, ঝাঁকানি দেয়, আঙুল রাখে নাকের পাশে বারবার। প্রাণহীনতার প্রথম খবর আনে একঝাঁক নীল ডুমো মাছি। উড়ে এসে বসে মুখে গায়ে, গড়িয়ে যাওয়া রক্তে। তবু বোঝে না সাহনি। বসে থাকে মেয়েটার কৃশ মুখের দিকে চেয়ে।

অত সহজে পুলিশ আসে না গ্রামে। তাই গ্রামের লোক জড়ো করে ফিরে আসে এতোয়ারি ঘণ্টাদুয়েক পর। আশেপাশে গুটি গুটি কিছু শকুন এসে জুটেছে ততক্ষণে। সাহনি রেললাইনের পাথর ছোঁড়ে একটা দুটো। এতোয়ারি এসে হাত লাগায়। গ্রামের লোক জনাদশেক, গ্রামের মাথাও। মৃত্যুতে অনভ্যস্ত নয় এরা, অপ্রস্তুতও নয়। চাঁদা করে উঠে গেল কুড়ি টাকা খানেক। তখনি এল আসল সমস্যা। মড়া ছোঁবে কে? কোন জাতের মড়া তার তো ঠিক নেই কোনও। বেজাতের মড়া ছুঁলে না জানি কী বিপদ আসে গেরস্থের। তার ওপর জেনানার মড়া। যদি বেশ্যা হয়? বেশ্যার মড়া ছুঁয়ে শেষে জাত খোয়াতে হবে যে। গ্রামে জানাজানি হলে একঘরে করবে সব। রোদ বাড়ে, ভাবতে বসে সবাই। শেষ অবধি সমাধান করে দিল এতোয়ারি।

এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি সাহনি। বসে বসে একমনে মাছি তাড়িয়েছে সমানে। মাঝে মাঝে সকলের চোখ এড়িয়ে হাত রেখেছে নাকের কাছে। এতোয়ারির কথা মনে ধরল সকলের। গাঁয়ের মাথাদের বিধান মেনে, নতুন মার্কিন কাপড়ে মুড়ে পাঁজা কোলা করে এগিয়ে চলল, সাহনি একাই। মেঠো পথ ধরে সবার আগে আগে এগিয়ে চলল সে। পেছন পেছন ধুপকাঠি আর লোবানের আগুন নিয়ে গুটিকয় লোক, গলায় মৃদু ধ্বনি তুলে, ‘রাম নাম সত্য হ্যায়, রাম নাম সত্য হ্যায়।’

এই প্রথম পরিপূর্ণ এক নারী শরীরের সংস্পর্শে এল সাহনি। তার বুকের কাছে ধরা নিবিড় বাহুবন্ধনে এক নারী শরীর। পূর্ণযৌবনা শরীরের স্পর্শ গায়ে বুকে মেখে নিতে কেমন যেন শিরশিরিয়ে উঠল সে।

চার

সেদিন রুকুকে অবাক করে প্ল্যাটফর্মের চাপাকলে স্নান করল সাহনি। খুব করে গায়ে মাখল একচিলতে লাইফবয় সাবান।

তারপর ফিরে এসে দু-ফোঁটা তেলে রসুন আর শুকনো লঙ্কা ভেজে বানাল এক কড়াই ডাল। ভাত, পেঁয়াজ দিয়ে ভিণ্ডি ভাজা। রুকু দু-হাঁটুর ফাঁকে থুতনি গুঁজে দেখল একমনে। সপাসপ শব্দে ডালে ভাতে থালার শেষ দানাটুকু নিঃশেষ করে যেন একটু দম নিল সাহনি। তারপর ঢক ঢক করে জল খেল ঘটি থেকে। মুখ উপচে ঘটির জল নামল বুক ভাসিয়ে। এতক্ষণ পর যেন শান্তি পেল সাহনি। রুকুর দিকে তাকিয়ে বসেই রইল সে। রোজকার মতো মজার গল্প শেষ করা হাসি হাসল না গবগবিয়ে।

–কী রে, কী হল? রুকু সাহনির দিকে তাকাল শান্তভাবে।

কিচ্ছু বলল না সাহনি। উঠে গিয়ে ঘটির জলে হাত ধুল, কুলকুচি করল শব্দ করে।

তারপর রুকুর মুখোমুখি এসে বসল আবার।

–কী রে, হল কী তোর? ভাসাভাসা কানে এসেছে রুকুর, তবু সাহনির কাছ থেকে শুনতে চাইছিল রুকু। দিগন্ত পেরিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল সাহনি। পৌষ শীতে টাঙানো মাটির হাঁড়িতে বুঁদ বুঁদ জমা হওয়া রসের মতো যন্ত্রণা চুঁইয়ে পড়ছে, জমছে তার বুকের ভেতর। এমন তো হয়নি কখনও আগে। গলার কাছটা একটা গোল্লা আটকে এল ওর। তারপর এক ঠেলায় কেমন চোখের কোল উপচে এল জল। এসব কী? কী এসব? জানে না সাহনি। এর আগে বোঝেনি কোনওদিন।

বিড় বিড় করে রুকুর দিকে চেয়ে বলল, ‘একবার খালি চোখ খুলেছিল জানিস, মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘হমকা বঁচাই লো ববুয়া, হমকা বঁচাই লো।’

 

(ছবি-অন্তরা সেনগুপ্ত)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4645 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...