নিমাই পাত্র হেরে গেল

নিমাই পাত্র হেরে গেল | কুশান গুপ্ত

কুশান গুপ্ত  

 

–ও কাত্তিকা উঠ না, মোরে নিমেই যে হাইরেয়্যাল, চেঁচিয়ে ওঠে চারুবালা।

চারুবালা এই নিয়ে বারচারেক হাঁক পাড়ল।

কার্তিক সরেন, নিমাই পাত্রের বৈঠকঘরে আপাতত একটি তক্তপোশে ঘুমে উপুড়। রঙিন লুঙ্গি হাঁটুর কাছাকাছি উঠে এসেছে, খালি তার কালো গা, খোলা স্যান্ডো গেঞ্জিটি সামনের চালের বস্তায় আলগোছে রাখা। গত রাত সে কার্যত জাগরণে কাটিয়েছে। পৌরনির্বাচন হয়ে গেছে, যদিও এই কর্মযজ্ঞে তার ভূমিকা নামমাত্র। চারুবালার ডাকাডাকিতেও তার ঘুমন্ত শরীরে এই মরা বিকেলে হেলদোল নেই।

এবারে চারুবালাকে খানিক, কষ্টকর, ঝুঁকতে হয়। সে কার্তিকের কালো পিঠে হাত দিয়ে ঠেলতে সচেষ্ট। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কেননা কার্তিকের শরীর সামান্য নড়ে মাত্র। কার্তিকের ঘুমন্ত মুখকে তার শয়নভঙ্গি ও হাতের অবস্থান লুকিয়েছে।

এখন সত্তরোর্ধ চারুকে আরও ন্যুব্জ হতে হয়, মুখটি কার্তিকের ডানকানের নিকটে যেতে সচেষ্ট, আপ্রাণ উদ্দিষ্ট কানের কাছে ঝুঁকে, সজোরে, রাগত চারু একটি উপায়হীন কু দেয়।

কার্তিককে ঘুমের থেকে বাধ্যত ফিরে আসতে হয়। ধড়মড় করে ওঠে তার বাহান্ন বৎসরের শরীর। হাতে ভর রেখে ভোঁ লাগা কাতর কানটি কচলাতে কচলাতে মুখের কাছে কমরেড নিমাই পাত্রের মা চারুর ব্যাকুল মুখ দেখতে পায় কার্তিক।

তক্তপোশে পা ঝুলিয়ে চোখ কচলায় তন্দ্রাচ্ছন্ন কার্তিক। ফ্যালফ্যাল করে চারুর দিকে তাকায়। চারু লক্ষ করে কার্তিকের অলস আড়মোড়া ভাঙা ও দুইচোখ, চোখদুটি জবারং ধারণ করেছে।

বিরক্ত চারু বলে ওঠে, কদবানু ডাকিঠি! উঠে মরুনি ক্যানে! ই যে কুম্ভকন্ন ঘুম!

কার্তিক কিছু বলতে উদ্যত হয়, কিন্তু চারু তাকে থামায়, ওরে কাত্তিকা, মোরে নিমেই যে হাইরেয়্যাল রে! এটুকু আর্ত উচ্চারণ করে চারুর কন্ঠ। সাদা থানের আঁচলটুকু নিয়ে তার ডান হাত অশ্রু সংবরণের পরিচিত মুদ্রা রচনা করতে উদ্যত।

—নিমাই? হাইরেয়্যাল! কার্তিকের ওষ্ঠদ্বয় একবার স্বগতোক্তি করে মাত্র।

সম্যক পরিস্থিতি অনুধাবন করতে কিছু সময় নেয় সর্বাঙ্গে ঘুমমাখা কার্তিক। তার ঠোঁট দুটি নিজ মুদ্রাদোষে অসহায় বিড়বিড় করতে থাকে, অস্ফুট। তাহলে মাওয়া চকমরামপুরের অবিসংবাদী কৃষক নেতা বামফ্রন্ট সমর্থিত সিপিআই প্রার্থী নিমাই পাত্র আজ উনিশশো একাশির মেদিনীপুর পৌরনির্বাচনে উনিশ নম্বর ওয়ার্ডে পরাজিত! কী করে সম্ভব! তার ঘুমের অন্তরালে কখন এসব ঘটে গেল?

নিমাইয়ের একান্ত অনুগামী, পাথরঘাটা বস্তির বছর পঁচিশের শেখ রহমত সামান্য কিছু আগে ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল নিয়ে দাওয়ায় দাড়িয়ে সংক্ষেপে দুঃসংবাদ দিয়ে গেছে এই নৈর্ব্যক্তিক বাক্যে: বৌদি, আমরা হেরে গেছি। নিমাইপত্নী বিএ বাংলা অনার্স গ্র্যাজুয়েট, বছর পঁয়ত্রিশের মানসী তখন উঠোনের সামনে আলগোছে গুলঞ্চফুল নিরীক্ষণরত। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই বার্তাবাহক রহমত সাইকেল নিয়ে ঝোড়ো কাকের মতো কোথাও দ্রুত পালায়। সম্ভবত মানসীর সামনে রহমতের কাঁদতে লজ্জা করছিল, এমনই ধারণা হয় মানসীর।

যে মুহূর্তে রহমতের ঝটিকা আগমন ও দ্রুত প্রস্থান, সেই সময়ে দাওয়ার অনতিদূরে উবু হয়ে বসে নিজস্ব তুলসিগাছের নীচের আগাছা একমনে সাফ করছে চারুবালা। ভেতরের ঘরে পাঠ সঙ্কলন থেকে বাপ্পাদিত্যর ‘ঝুলত ঝুলনে শ্যামর চন্দ’ অংশটি নিবিষ্টে পাঠমগ্ন নিমাইয়ের আসছে-বছর-মাধ্যমিক-দেবে মেয়ে রানি। নিমাইপুত্র বছর দশেকের নবা পাশের মাঠে পিটটু খেলছে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে। তাদের কোলাহল থেকে থেকে ভেসে আসছিল। রহমত যে এল, গেল, মানসীর ধারণা, সে ছাড়া সেভাবে আর কেউ বোধহয় টের পায়নি। কিন্তু, চারুবালা লক্ষ করেছিল, তার মন অকস্মাৎ কু গেয়ে ওঠায়, সে, হাতের খুরপি ফেলে ধীরে ধীরে মানসীর দিকে এগিয়ে আসে।

—সে… কী কয়ে গেল, বৌমা?
—হেরে গেছে।
—কে হারল?
—ও।

ও, এই স্বরধ্বনি— মানসীর, স্বামীসম্বোধন। নতমুখ চারু কথা থামিয়ে ধীরে ধীরে দাওয়ায় ঢোকে। দাওয়া থেকে ছোট বৈঠকঘরে ঢুকে কার্তিককে ঘুমন্ত দেখে অবশ্যকর্তব্য স্থির করে। আসলে চারু শোকসংবাদ ভাগ করার উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজছিল। চারুবালা ও কার্তিক একই গ্রামের বাসিন্দা। ইদানিং চারু বছরের অধিকাংশ সময় তার ছেলের এই শহরের বাড়িতে থাকে। মাঝেমধ্যে দেশের বাড়ি যায়।

আলো আরেকটু মরে এসেছে, কার্তিক উঠে বসে গেঞ্জি গায়ে দেয়, চারু বৈঠক পেরিয়ে ভেতরের ঘরে অস্থির পায়চারিরত। মানসী রান্নাঘরের দিকে ফিরে গেছে, রাতের রান্নার বিষয়ে ঈষৎ ভাবনা সহ। নিমাইয়ের এই পরাজয় রাজনীতিবিমুখ মানসীকে ততটা বিচলিত করতে পারেনি। বস্তুত নিমাইয়ের বা তার পার্টির জয় ও পরাজয় কিছুতেই মানসীর দিনরাতের এতটুকু বদল ঘটাবে না, বিগত পনেরো বছর এক ছাতের তলায় থেকে মানসী বুঝে গেছে।

এখন সকলের অগোচরে নিমাইয়ের বাড়ি সংলগ্ন মাঠ ও বাড়ির মধ্যবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থিত বাবলাগাছের একটি নিচু ডালে তৎপরতায় গাছবোম বাঁধতে সক্রিয় উনিশ নম্বর ওয়ার্ডের বিজয়ী ক্যান্ডিডেট কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী মহিম মাইতির খাস লোক বছর পঁচিশের হাবু, তার সঙ্গে সমবয়স্ক আরও দুজন। হাবু কিলোমিটার দুয়েক দূরে নতুনবাজারে থাকে। তার দুই স্যাঙাতের একটি বস্তায় কয়েকটি তাজা গাছবোম, অপর বস্তায় সবুজ আবির।

হাবু জয়সূচক উদ্বোধনী বোমাটি স্থানীয় এই গাছটিতে বাঁধা সমীচীন মনে করেছে, সে সযত্নে ঝুলন্ত বোমায় নির্ভুল অগ্নিসংযোগ করে ও দূরে সদলবলে দ্রুত সরে যায়। তুমুল শব্দে সহসা পাড়া কেঁপে ওঠে। কাছের একটা চরতে থাকা মুরগি ভয়ার্ত ডেকে এলোমেলো ছুটতে থাকে পাশের নালার গা বরাবর, বাবলার ডাল থেকে কয়েকটা চড়ুই পাখা ঝাপটে উড়ে যায়, কলতলার দুটো কুকুর অস্থির হয়ে ওঠে। পাশের মাঠে ছেলেপুলের খেলা থেমে গেছে। তারা ধোঁয়া উড়তে দেখে ও বারুদের গন্ধ পেয়ে এদিকে এগিয়ে আসে।

এতক্ষণ বাপ্পাদিত্য পড়তে পড়তে ঘোরে নিজেকে শোলাঙ্কির রাজকুমারী ভাবছিল রানি, হঠাৎ এমন ব্যাঘাতে চমকে ওঠে, পড়া থামিয়ে মানসীকে জিজ্ঞেস করে: কে বোম ফাটাল মা?

—কী জানি?

বোমের শব্দ হওয়ার পরে হাবুরা হৈ হৈ করে সিটি দেয়, বস্তার আবির বেরুয়, তারা সোৎসাহে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাখে। আগ্রহী ছেলের দল সামনে।

—আয়, তোদের মাখিয়ে দিই, হাবুর সহৃদয় আহ্বানে কয়েকটি বালক এগিয়ে আসে।

আলগোছে তাদের সবুজ আবির মাখিয়ে হাবুর দল এগিয়ে যায় রাস্তা ধরে।

কার্তিক দাওয়া থেকে বেরিয়ে রাস্তার কলতলায়। তার মুখে আপাতত একটি জ্বলন্ত বিড়ি। বোম ফাটার শব্দে সে একবার বাবলাগাছটির দিকে ফিরে নিরৎসুক তাকিয়েছিল, তবে এই ভিনদেশে এদের কার্তিক চেনে না। ওরাও চেনে না কার্তিককে। শুধু বোমার শব্দ ও সবুজ আবির তাকে অবহিত করে, এরা শত্রুপক্ষ। নিমাই কখন ফিরবে কে জানে। নির্বাচন মানে শুধু শুরু নয়, শেষ হওয়ার পরে হাজার ঝুটঝামেলা, কার্তিক কমবেশি জানে। বিগত কুড়ি বছর ধরে সে চকমরামপুর গ্রামাঞ্চলে পার্টি করছে, বস্তুত সে নিমাইয়ের কিছু আগে ধীরেন দাসের সংস্পর্শে পার্টি, ভাগ হওয়ার আগে আগে, জয়েন করেছিল, বেশ কিছু নির্বাচনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে এখন সে এবিষয়ক পোড়খাওয়া। রাস্তা ধরে সদরঘাট রোডের দিকে এগিয়ে যায় সে। বিগত দিন সাতেক ধরে ঘুরে ঘুরে কার্তিক আশেপাশের এলাকা ও গোটাকয় গলি মোটামুটি চিনে গেছে।

কাঁসাইয়ের মাটির বাঁধের ওপর দরমা ও খড়ছাওয়া চালার পার্টি অফিসের কাছে এসে দাঁড়ায় কার্তিক। কেউ নেই পার্টি অফিসে। ধ্যাবড়া অক্ষরে লেখা আছে— নির্বাচনী কার্যালয়। চালার একদিকে বাঁধা একটা লাল পতাকা মৃদু উড়ছে। নদীর দিক থেকে হালকা হাওয়া আসছে। রাতে নিমাইয়ের টালির বাড়ির খোলা মাটির ছাদে দড়ির খাট পেতে শোয় কার্তিক। ঝিরঝির, একটানা হাওয়া আসে। শরীর জুড়িয়ে যায়। হঠাৎ তার ঈষৎ আত্মধিক্কার আসে, সে মনে করতে পারে না, কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল?

নিমাই যে হেরে যাবে, কার্তিক বুঝতে পারেনি। অবশ্য সাতাত্তরেও কি আদৌ বুঝতে পেরেছিল, তারা হারবে? আশি সালে অবশ্য লোকসভায় তাদের কেন্দ্র পাঁশকুড়ায় জিতেছে বামফ্রন্ট-ঐক্য। বাহাত্তরের ভুল পার্টি শুধরাচ্ছে এখন, মূল্য দিতে হয়েছে তার জন্য। সাতাত্তরে বিধানসভায় সিপিআই প্রায় শূন্য। এত বছর শহরে থেকেও গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু পার্টি আগলাচ্ছে তাদের নেতা নিমাই, তবুও এই প্রথম সে এ-শহরে ভোটে দাড়াল। পার্টির নির্দেশ। সাতদিন আগে এসেছিল কার্তিক, সঙ্গে খাঁদা মুর্মু ও জনা বাগদি। জনার নির্দিষ্ট উপদেশে চালের বস্তা মুখ বেঁধে এনেছিল কার্তিক, যদিও চারুবালা সে-বস্তা খুলতে দেয়নি। বলেছিল, দেশের লোক তরা, ঘরের দু মুঠা ভাত মুড়ি খাবি, তার তরে কি চাউল বাইন্ধে আনে কেউ? খাঁদা, জনা চলে গেছে দিন তিনেক আগে, সেও যেতে পারত, গেলে কিছু মনে করত না নিমাই, কার্তিক জানে, তবুও যেতে পারেনি সে।

এখানে বিশেষ কী আর করবে সে এই ভিনদেশে, পোস্টার সাঁটানো দড়ি বাঁধায় একটু সহায়তা, আর মাঝেমধ্যে নিমাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া। নিমাই তাকে একটু অস্বস্তিসহ এড়িয়ে যাচ্ছিল, বিশেষত দোরে দোরে প্রচারের সময়, লক্ষ করেছে কার্তিক। নিমাই যা বুঝেছিল, কার্তিক বুঝেছে নিজেও, এখানে কে চেনে তাকে, সে বা কাকে চেনে? কোনখান থেকে সে শুরু করবে রাজনৈতিক আলাপ? নিমাই বুঝেছিল সব, চলে যেতে বলেছিল তাই, কিন্তু কার্তিকের মন বলল, থাকা দরকার, অন্তত রেজাল্ট আসার দিন অবধি। কাল রাতে সে স্থানীয় অচেনা কমরেডদের সঙ্গে পাড়া পাহারা দিচ্ছিল। কখন কী হয়, ভোটের আগের রাত তো জাগতেই হয়!

রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ঝুপড়ির থেকে রহমতের মা বছর পঞ্চান্নর হামিদা এসে পৌঁছে গেছে নিমাইয়ের দাওয়ায়, দরজার কাছে এসে হাক পাড়ে: বৌমা!

ডাকের উদ্দেশ্য ছিল মানসী, কিন্তু বেরোয় চারু। সামান্য নীরবতা সজাগ রাখে হামিদা। পরে নিচু গলায় কথা শুরু করে: মাস্টারভাই ঘরকে এসছে?

–না। কেদবা আসবে কী জানি!
–রাইমতও আসেনি।
–সে তো এসছিল একবার।
–কাল্লু মিঞা বলতে ছিল, তোদের মাস্টার যে মহিম মাইতির কাছে হেরে গেল! আমি বললম, জিতেছে জুতা খেয়েছে, হেরেছে হার পরেছে।

শেষ বাক্যটি বলার সময় হামিদার দুই হাত ওপরে উত্তোলিত হয়, শরীর দুলতে থাকে। চারুকে নিরুত্তর দেখে হামিদা পুনরায় মুখ খোলে:

–আমিও ছোড়নেবালা নেই। বললাম, কী বে মহিম মাইতির চামচা, হারামের পয়সায় তোর তিনতলা ঘর, ময়দাভানা কল, গটা মহল্লা জানে, তুই চ্যাটাজ্জির গুয়ের টিন আগে মাথায় লিয়ে যেতিস।

গল্পটা হামিদার কাছ থেকে চারু বহুবার শুনেছে। মানসীও জানে এই গল্প, এমনকি রানিও জানে। এপাড়ার অধুনা ধনী কাল্লু মিঞার একদা নাকি হতশ্রী অবস্থা ছিল, পরে একটি সাবান কারখানার ম্যানেজার হয়, সেখান থেকেই তার যত উন্নতি।

হামিদা লক্ষ করে চারুর মুখে ভাবান্তর নেই। হামিদা আবার সোচ্চার হয়:

–আমি বলি কী দিদি, জিতলেও ঘরের ভাত, হারলেও সেই ঘরের ভাত।

এই সান্ত্বনাবাক্যেও চারুবালার মুখে ভাবান্তর হয় না। হামিদা এবার, যাই, রাইমত যে কুথায় গেল!– বলে চলে যায়।

সন্ধে নামছে। রানি এসে দাওয়া পেরিয়ে মাঠের দিকে মুখ করে ভাইকে গলা উচু করে ডাকে, নবা, বাড়ি আয়!

ছেলেদের দল খেলা থামিয়ে মাঠের ধারে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। নবা এগিয়ে আসে, রানি তার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে: গালে আবির মেখেছিস কেন?

হাবুদা মাখিয়ে দিল।

অসভ্য, বেহায়া, এই বলে ঠাস করে একটি সটান থাপ্পড় নবার গালে কষায় রানি, তাকে ভেঙ্গায়: হাবুদা মাখিয়ে দিল!

নবা পাড়ার কলতলার দিকে ত্রস্ত পায়ে পালিয়ে যায়, গালের আবির তুলতে হবে। তার নিজেরও আবির মাখার সময় কাজটা অনুচিত মনে হচ্ছিল, কিন্তু ছেলের দঙ্গলে না করতে পারেনি। তার ভয় হয়, দিদি যদি বাবাকে বলে দেয়!

বাঁধের ওপর থেকে কার্তিক দেখতে পায়, নিমাই হেঁটে ফিরছে সদর রাস্তার উত্তর দিক থেকে। জনা দশ-বারো লোক সঙ্গে। দুয়েকজন সাইকেল হাঁটিয়ে ফিরছে। কার্তিক নেমে যোগ দেয়। আগে আগে জোরে জোরে হাঁটে নিমাই। মোড়ের মুখে দুতিনজন এসে যোগ দেয়। গলিতে ঢোকে নিমাই ও তার দল। নিমাইয়ের গলা শোনা যায়, পাথরঘাটা আমাদের লিড দিয়েছে, মণ্ডলমহল্লা আর শিয়ালডাঙায় আমরা জিতেছি।

–নতুনবাজার, বিদ্যাসাগর পল্লী আর পাহাড়িপুরে এই রেজাল্ট! একজন পেছন থেকে বলে।
–হ্যাঁ, নতুনবাজার এতটা খারাপ হবে, বুঝতে পারিনি। হাল ছাড়লে চলবে কী করে কমরেড? আমরা হার থেকে শিখব। কাল থেকেই আমাদের আবার কাজ শুরু করতে হবে।

কার্তিক লক্ষ করে, বিমর্ষ ও পরাজিত একটি বাহিনিকে কীভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে দৃশ্যত অবিচল নিমাই। এমন দৃশ্য কার্তিক আগেও দেখেছে। সাতাত্তরে তারা হেরে গেল, আটাত্তর পঞ্চায়েতে তবুও গ্রামপঞ্চায়েত ধরে রেখেছিল দাঁতে দাঁত চেপে কার্তিক, লখু, জনারা। নিমাই ছুটে ছুটে গেছে প্রতিবার সব কাজ ফেলে। আজ নিমাইয়ের জন্য তাকেও তো থাকতেই হত।

নিমাইয়ের সঙ্গে তার কিছু কথা আছে, বিশেষত কার্তিক তার গ্রাম নিয়ে কোনও কথাই বলতে পারেনি। এই বিগত কয়েকদিন এখানকার ভোট নিয়ে এত ব্যস্ততা ছিল। এতক্ষণ সে হাঁফিয়ে উঠছিল একা, বিশেষত নিমাই হেরে গেল, আর সে ঘুমিয়ে পড়েছিল?

সন্ধে নামে। নিমাই তার দলবল নিয়ে মাঠে বসে। কার্তিক নিমাইয়ের কোণাকুণি নিকটবর্তী অবস্থানে, বিড়ি ধরায়। নির্বাচন-ফলাফল নিয়ে আলোচনা চলছে। চারু রান্নাঘরের কাছে গিয়ে বলে, বৌমা, সন্ধ্যাটা দিয়ে দাও। দাওয়ায় এসে দাঁড়ায় চারু। ভেতর থেকে তিনবার প্রলম্বিত শাঁখের শব্দ ভেসে আসে ও থেমে যায়। চারু টের পায়, অন্ধকারে জটলা, মাঠ থেকে নিমাইয়ের গলা ভেসে আসছে। ভেতরের ঘরে খাটে বসা রানির কাছে যায় চারু, বলে, তোর বাপ মাঠে বসে, তাকে একবার ডাক না!

–আমি যেতে পারব না এখন। অনেক লোক।
–এ বাপপা, সে ঘর আসবে কখন? সারাদিনে খাইছে সে? মুড়ি যে বাড়ব, কার তরে? কার্তিকাটা কুথায় গেল? গজগজ করে পায়চারি করে বিরক্ত চারু।

নিমাই মাঠে বক্তৃতা দিচ্ছে: শুধু এই ওয়ার্ডের ব্যাপার নয়। আমরা লড়াই করেছিলাম। কিন্তু, এই পৌরনির্বাচনে বামফ্রন্ট ও বামপন্থী প্রার্থীরা হেরে গেছে। উনিশটি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র পাঁচটা জিতেছি আমরা। চারটিতে সিপিআইএম, একটিতে সিপিআই। ফলে, কংগ্রেস বোর্ড গঠন করবে। কিন্তু খেটেখাওয়া মানুষের জন্য আমাদের লড়াই জারি থাকবে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। এরপরে গলা উচু করে স্লোগান দেয়, বামপন্থী ফ্রন্ট ঐক্য জিন্দাবাদ।

কোরাস ওঠে, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।

কিন্তু এই স্লোগানকে ছাপিয়ে অন্য স্লোগান নিজেকে শোনাতে চায়। গলির উল্টোদিকের রাস্তা ধরে বন্দেমাতরম আওয়াজ দিতে দিতে ঢোকে লম্বা বিজয়মিছিল। একটি হ্যাজাক সামনে ধরা, ধুতিপাঞ্জাবি পরা বিজয়ী মহিম মাইতিকে দেখা যায়।

নিমাইয়ের বাড়ির সামনে মিছিলের গতি শ্লথ থেকে শ্লথতর হয়, উল্লাসে শ্লোগান ওঠে: হায় হায় এ কী হল?

–সর্বদলের চামচা পার্টি সিপিআই হেরে গেল। কোরাস জবাব দেয়।

এই একটি স্লোগানই বারবার উচ্চারিত হতে থাকে। রাস্তার দুধারে এসে দাঁড়ায় পাড়ার কৌতূহলী লোকজন। ভিড়ে হামিদাকেও দেখা যায়। মালাসুসজ্জিত কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল মহিম মাইতি দুদিকে মুখ ফিরিয়ে নমস্কার করতে করতে ধীর হাঁটে।

নবা দাওয়ার কাছে। পাশে দাঁড়ানো পাড়ার সমবয়সী ইরশাদ তার কানের কাছে বলে: তোর বাবাকে চামচা বলল। রানি দ্রুত বেরিয়ে নবাকে হিড়হিড় করে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়, চেঁচায়, দ্যাখো মা, লোকগুলো কী অসভ্যের মতো চেঁচাচ্ছে!

মানসী উত্তর দেয় না।

মিছিল মাঠের পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার সময় মাঠ থেকে কেউ একটা চিৎকার করে, মহিমের বাপের বিয়ে হচ্ছে নাকি?

নিমাই তাকে ধমকে থামায়। সবাইকে শান্ত থাকতে বলে।

মিছিল চলে যায়। হঠাৎ একটা রিকশা এসে থামে মাঠের কাছে। রক্তাক্ত রহমতকে নামাচ্ছে আরেকজন। মাঠের ভিড় সেদিকে এগোয়। রহমতের ঘাড় এলিয়ে আছে, জানা যায়, প্রথমে বচসা শুরু হয়েছিল, পড়ে হাতাহাতি, তার মাথা একটু আগে ফাটিয়ে দিয়েছে হাবু ও তার দলবল। নিমাই শান্ত করে সবাইকে। একবার কার্তিককে ডেকে বলে, ঘরে যা। রাতে এসে কথা বলব তোর সঙ্গে। মনে হয় স্টিচ দিতে হবে। হাসপাতাল যাই। একবার জেলা পার্টি অফিসও যেতে হবে।

রহমতকে হাসপাতাল নিয়ে যায় নিমাই। মাঠের ভিড় হালকা হয়ে যায়।

রাত হয়। নির্বাচন-উত্তর পাথরঘাটা শান্ত। চারু ঘুমিয়ে পড়েছে বৈঠকের ঘরে। রানি ও নবাও। মানসী আধো তন্দ্রায়, নিমাই এলে দরজা খুলবে। নিমাই ফিরলে তবে কার্তিক খাবে, জানিয়েছে।

এখন কার্তিক সরেন নিমাই পাত্রের খোলা ছাদে দড়ির খাটে বসে বিড়ি টানতে টানতে টের পায় কাঁসাইয়ের দিক থেকে ঝিরঝির হাওয়া; সে দ্যাখে, বাবলাগাছের আবডালে চাঁদ। দ্যাখে ভিনদেশের জনমানবহীন ফাঁকা মাঠ ও রাস্তা। তার নিমাইকে বলার আছে দরকারি কিছু কথা, নিমাইও তো কিছু কথা বলবে। কিন্তু, কখন ফিরবে নিমাই?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...