ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো— একটি সহজপাঠ [১১]

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: চিন্তার শারীরতত্ত্ব

শারীরতত্ত্ব থেকে মনস্তত্ত্ব

আগের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের চিন্তা করার শারীরতাত্ত্বিক বিষয়টি বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে পাভলভ এবং তাঁর ছাত্রদের উচ্চতর স্নায়বিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত গবেষণা অনেকখানি সাহায্য করেছে। শর্তাধীন পরাবর্ত থেকে সঙ্কেতের ধারণা গ্রহণ এবং তার আরও সম্প্রসারণের ভিত্তিতে মানুষের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সঙ্কেতের ধারণা কথা বা ভাষার শারীরতাত্ত্বিক অবকাঠামো বুঝতে প্রভূত সাহায্য করেছে। চিন্তা করার কাজটা যে মানুষের কোনও রহস্যময় অতীন্দ্রিয় বা ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা নয়, এটা যে বিবর্তনের ধারাপথে বিকশিত মানবমস্তিষ্কেরই স্নায়ুশারীরতাত্ত্বিক বিশেষ ধরনের ক্রিয়াকলাপের ফল, যার একটা সামগ্রিক বিজ্ঞানসম্মত বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব— তা এই গবেষণার মাধ্যমে প্রথম মানবজাতির কাছে সংশয়াতীত রূপে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

পাভলভের এক ছাত্র কনস্তান্তিন ইভানোভিচ প্লাতোনভ (১৮৭৭-১৯৬৯)-এর মতে,

উচ্চতর স্নায়বিক কার্যাবলির নিয়ম আবিষ্কার করতে গিয়ে পাভলভ প্রমাণ করেছিলেন যে মানুষের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু মানুষের বেলায় সামাজিকভাবে শর্তাধীন একটা বিশেষ সংযোজন ঘটে যার কিছু গুণগত নতুনত্ব দেখা যায়। এই সংযোজন শ্রম ও সামাজিক কাজের সঙ্গে বিজড়িত, এতে ভাষার ক্ষমতার প্রশ্ন যুক্ত হয়েছে, এবং তার ফলে দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্রের আকারে গুরুমস্তিষ্কের কাজকর্মে একটা নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে, যা শুধু মানুষেরই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রতিদিন পরিবেশের সঙ্গে যোগসাজসে প্রথম সঙ্কেত তন্ত্রের বিভিন্ন উদ্দীপকের সঙ্গে একটা করে শব্দকে যুক্ত করার ফলে সেই সব শব্দও বাস্তব তাৎপর্যপূর্ণ উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করে এবং মানুষে মানুষে সঙ্কেত বিনিময় বা বাক্‌সঙ্কেতগুচ্ছের এক জটিল প্রক্রিয়া গড়ে তোলে। উপরন্তু সেই সব বাক্‌-উদ্দীপক বাস্তব থেকে বিমূর্তায়নের কাজ করে, সাধারণীকরণের দরজা খুলে দেয়, যার ভিত্তিতেই ঘটে বিশেষ করে মানুষের, উচ্চতর, চিন্তন ক্রিয়া। বস্তু ও ঘটনার প্রতিচ্ছবিগুলি কথন ও ধারণা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার ফলে জীবের উপর প্রত্যক্ষ ক্রিয়ার বদলে দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্রের বিমূর্ত ক্রিয়া করা সম্ভব হয়।…

বাক্‌শক্তির উদ্ভব ও বিকাশ সমাজের অস্তিত্বের অন্যতম শর্ত ভাষার গড়ে ওঠার পথ সুগম করেছে। চিন্তা করার মতো মস্তিষ্কের একটি জটিল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে শব্দ ও বাক্যের সমাহারে ভাষা চিন্তার ফসলকে একভাবে নথিভুক্ত ও সংহত করে, যার মধ্যে রক্ষিত হয় মানুষ জ্ঞান-প্রক্রিয়ার অর্জন, আর এর দ্বারাই মানবসমাজে চিন্তার আদানপ্রদানকে সম্ভব করে তোলে।…

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, মানুষের উচ্চতর স্নায়বিক ক্রিয়াগুলি সামাজিকভাবে নির্ধারিত। সেইজন্য প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্রের সম্মিলিত কাজের মধ্যে সামাজিক পরিবেশের প্রতিফলন ঘটে।[1]

কিন্তু চিন্তনক্রিয়া বোঝার জন্য এই সব তথ্যই কি যথেষ্ট?

পাভলভ এবং তাঁর ছাত্ররা মনে করতেন, হ্যাঁ, শারীরতাত্ত্বিক বিশ্লেষণই যথেষ্ট। কেননা, চিন্তা করার ভিত্তি হল প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্র এবং সেই দুটোই শর্তাধীন পরাবর্ত সংক্রান্ত শারীরতাত্ত্বিক একই নিয়মসমূহের অধীন।[2] পাভলভ প্রথম সঙ্কেত তন্ত্রকে “মূর্ত চিন্তন” (concrete thinking) এবং দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্রকে “বিমূর্ত চিন্তন” (abstract thinking) হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।[3] আর শব্দকে তিনি চিহ্নিত করেছেন “শর্তাধীন উদ্দীপক” হিসাবে— যদিও প্রাণীজগতের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য যে কোনও শর্তাধীন উদ্দীপক থেকে এর গুণগতভাবে পৃথক এবং ব্যাপকতম তাৎপর্য আছে বলে দেখিয়েছেন।[4] পাভলভের একদল ছাত্র খুব জোর দিয়ে দাবি করেছেন: “পাভলভীয় শারীরতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে মনের ভিত্তি বা মানসিক প্রক্রিয়ার সমস্ত রূপ বৈচিত্র্য আবির্ভাবের মূল প্রক্রিয়া হল শর্তাধীন পরাবর্ত। পাভলভ খোলাখুলিই বলেছেন, শর্তাধীন পরাবর্ত একই সঙ্গে একটি শারীরবৃত্তীয় এবং মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা।” তাঁদের আরও বক্তব্য হল, “সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মতো চিন্তনও মস্তিষ্কের পরাবর্ত ক্রিয়া রূপেই ঘটে থাকে।… সংবেদন থেকে প্রত্যক্ষণের শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি যতটা জানা গেছে চিন্তন প্রক্রিয়ার স্নায়ুতান্ত্রিক ভিত্তি ততটা স্পষ্ট করে এখনও জানা যায়নি। তথাপি এটুকু জানা গেছে যে চিন্তার ক্রিয়া সংঘটনের পেছনে রয়েছে মস্তিষ্কের পরাবর্ত ক্রিয়ার ভূমিকা।”[5] অর্থাৎ, চিন্তার প্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে তাঁরা পাভলভীয় শারীরতাত্ত্বিক তত্ত্বকে শুধু আবশ্যক নয়, যথেষ্ট বলেও মনে করেছেন।

কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের একদল মনোবিজ্ঞানী শারীরতত্ত্ব দিয়ে মনস্তত্ত্বের যাবতীয় সমস্যা ব্যাখ্যা করার বা দুটোকে একাকার করে দেখার এই প্রবণতাকে সমালোচনা করেন। এই ক্ষেত্রে প্রথম এগিয়ে আসেন লেভ সেমিওনোভিচ ভাইগতস্কি (১৮৯৬-১৯৩৪)। তাঁর মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায় প্রবেশ পেশাগত স্বাভাবিক রাস্তায় ঘটেনি। অত্যন্ত প্রতিভাবান এই মানুষটি প্রথাগত শিক্ষার ভিত্তিতে ডিগ্রি নিয়েছিলেন আইনশাস্ত্রে। তারপর শুরু করেছিলেন নবগঠিত সোভিয়েত রাজত্বে শিক্ষকতা এবং স্কুল সংগঠন। সেখান থেকে হাত দিয়েছিলেন সাহিত্য বিচারে এবং শিল্পের মনস্তত্ত্ব সন্ধানে। অবশেষে তিনি শুরু করেন মনোবিজ্ঞান বিষয়ক সমীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, অধ্যয়ন এবং গবেষণা। নবীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মূক-বধির ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষাদান সংগঠিত করতে গিয়ে তিনি শিশু ও কিশোরদের মানসিক বিকাশের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যে জ্ঞানলাভ করেন তা শিক্ষাবিষয়ক মনোবিজ্ঞানেও এক নতুন ধারা প্রবর্তন করে। জার্মানির উইলিয়াম স্টার্ন (১৮৭১-১৯৩৮) এবং ফ্রান্সের জ্যাঁ পিয়াজে (১৮৯৬-১৯৮০) প্রমুখ থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান তিনি গ্রহণ করেছেন, আবার অনেক প্রশ্নে তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত হয়ে নিজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ফলে তাঁর কাজ খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি ঠিকই। তথাপি স্বল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি যেটুকু কাজ করে যেতে পেরেছিলেন, তাতে মার্কসীয় বীক্ষার আলোকে মনস্তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত এক পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষামূলক বিদ্যাচর্চায় উন্নীত হয়।[6] পরবর্তীকালে সের্গেই লিওনিদভিচ রুবিনস্তাইন (১৮৮৯-১৯৬০), পিওতর কুঝমিচ আনোখিন, আলেক্সান্দার রোমানোভিচ লুরিয়া (১৯০২-৭৭), আলেক্সেই নিকোলায়েভিচ লিওনতিয়েভ (১৯০৩-৭৯), প্রমুখ অনেকেই এই ধারায় বিস্তৃততর গবেষণা করেছেন। বর্তমানে যাঁরাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মন ও চিন্তার সমস্যা, শিশুমনের বিকাশ এবং শিক্ষা প্রদানে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বিচার করে থাকেন তাঁরা বিভিন্ন মাত্রায় ভাইগতস্কির চিন্তাধারার দ্বারা পরিচালিত হন। লুরিয়া নাকি একবার বলছিলেন, “All that is good in Russian psychology today comes from Vygotsky.”[7]

ভাইগতস্কি দেখিয়েছেন, মানবমন বিচারের ক্ষেত্রে আমরা তিনটি পদক্ষেপে অগ্রসর হতে পারি। প্রথম ধাপে বিবর্তনবাদী প্রেক্ষাপটে মননক্রিয়ার শারীরিক ভিত্তি কীভাবে বিকশিত হয়েছে দেখতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই জৈব শারীরিক কাঠামোটি এবং এর ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু তারপরেও একটা ধাপ আছে। সেটা হল, মানুষের চিন্তার বিকাশের পেছনে সমাজ ও ইতিহাসের ভূমিকা বিচার। প্রথম দুটি ধাপ পাভলভীয় শারীরতাত্ত্বিক উপস্থাপনার মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন হয় মহামতি কার্ল মার্কসের একটি অসাধারণ পর্যবেক্ষণকে অনুধাবন এবং তাঁরই অভিন্ন হৃদয় সুহৃদ ফ্রেডারিক এঙ্গেল্‌সের একটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান।

আমরাও এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই এগোব। প্রথম দুটো পদক্ষেপ আমরা ইতিমধ্যেই নিয়ে ফেলেছি। প্রাসঙ্গিক আলোচনা কমবেশি সেরে ফেলেছি। এবার তৃতীয় ধাপ।

মার্কস বলেছিলেন, বহির্বাস্তবের সঙ্গে ক্রিয়া করতে করতেই মানুষের যাবতীয় মননশীলতা (গান শুনবার কান, শিল্প বুঝবার চোখ, ইত্যাদি) তৈরি হয়। এই মানসিক কাঠামো শুধু ব্যক্তিবিশেষের সমসাময়িক পরিবেশ থেকে গড়ে ওঠে না, মানুষ যুগে যুগে যা কিছু সৃষ্টি করে তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায় উত্তরাধিকার হিসাবে। তাই ব্যক্তির মনন গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে “আজ পর্যন্ত বিশ্ব-মানবজাতির ইতিহাস।”[8]

আর এঙ্গেল্‌সের প্রশ্ন ছিল,

একদিন আমরা নিশ্চয়ই চিন্তনক্রিয়াকে পরীক্ষামূলকভাবে মস্তিষ্কের অণুগুলির রাসায়নিক খেলা হিসাবে দেখাতে পারব। কিন্তু তাতেই কি চিন্তার সমস্ত দিক বোঝা সম্ভব হবে?[9]

এই সমস্ত বিষয় পর্যালোচনা করেই রুবিনস্টাইন দেখিয়েছিলেন, মনন ও চিন্তন যেহেতু মস্তিষ্কেরই এক বিশেষ ধরনের ক্রিয়া, তাই মস্তিষ্কের স্নায়ুশারীরতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলির নিয়মকানুন বাদ দিয়ে তা বোঝা সম্ভব নয়। আবার একথাও সত্য যে শারীরতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে কোনও একরৈখিক পরিমেল (one-to-one correspondence) নেই। একটি মননক্রিয়ার সঙ্গে একাধিক শারীরতাত্ত্বিক ক্রিয়া যুক্ত থাকে। আবার একই শারীরতাত্ত্বিক ক্রিয়াসমষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন মননক্রিয়া নিষ্পন্ন হতে পারে। যেমন, একটা আনন্দের কবিতা আর একটা দুঃখের কবিতা রচনার সময় লিখনক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত শারীরতাত্ত্বিক ক্রিয়াগুলি একই, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক রূপটি আলাদা আলাদা। তাই, রুবিনস্তাইনের মতে, শারীরতাত্ত্বিক সংজ্ঞা বা নিয়মকানুন দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাবলির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব নয়।[10]

ভাইগতস্কি এবং লিওনতিয়েভের মতে, শর্তাধীন পরাবর্ত গঠন অন্যান্য প্রাণী তো বটেই, এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও বাইরের পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের ক্রিয়ারই অঙ্গ— যেটা প্রজাতিক বিকাশ (phylogenetic development) নয়, ব্যক্তিক বিকাশ (ontogenetic development)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু মানুষের মননক্রিয়ার চরিত্র ঠিক অভিযোজনমূলক নয়। এর চরিত্র হল প্রকৃতির উপর স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করতে গিয়ে সামাজিক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করার প্রচেষ্টা মূলক। অভিযোজন থেকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য তাঁরা এর নাম দিয়েছেন স্বাঙ্গীকরণ (appropriation) বা স্বান্তর্ভুক্তি (internalization)।

দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী?

প্রথমত অভিযোজন হল পরিবেশের পরিবর্তনসাপেক্ষে প্রাণীর দেহগত বৈশিষ্ট্যের কম বেশি পরিবর্তন। কিন্তু স্বাঙ্গীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজের চাইতে পরিবেশের উপরই বেশি পরিবর্তন ঘটায়। দ্বিতীয়ত, অভিযোজন একটা মন্থর প্রক্রিয়া। একই প্রজাতির বিভিন্ন প্রজন্মের সদস্যদের একই অভিযোজনমূলক আচরণ আলাদা-আলাদাভাবে আয়ত্ত করতে হয়। প্রজাতিগতভাবে নির্বাচনী সুবিধা লাভের উপযোগী কোনও বংশানুক্রমিক অভিযোজন ঘটতে অনেক সময় হাজার বা লক্ষ লক্ষ প্রজন্মও লেগে যেতে পারে। কিন্তু ভাষা ও চিন্তার সাহায্যে মানুষের যে স্বাঙ্গীকরণ তা এক প্রজন্ম থেকেই অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয় এবং প্রতিটি প্রজন্ম তা লাভ করে সুদূর অতীতকাল থেকে সমকাল পর্যন্ত সঞ্চিত একটি ক্রমপুঞ্জিত উত্তরাধিকার হিসাবে।[11]

সাধারণ মানুষ তত্ত্বগতভাবে এটা বুঝুন বা না বুঝুন, বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এই ঘটনাটা একভাবে অনুভব করেন। অনেক সময় তাঁরা বলেন, “আমাদের ছোটবেলার তুলনায় এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি চালাকচতুর এবং তারা অনেক বেশি খবরটবর রাখে।” কম্পিউটার মোবাইল ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি আসার পর তা ব্যবহার করতে গিয়ে বয়স্করা নবীন প্রজন্মের কাছে নিয়মিত শিক্ষার্থী হতে বাধ্য হচ্ছে। আর ঠিক এই কারণে মানবশিশু অন্যান্য পশুপাখির শাবকদের তুলনায় কম সামর্থ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও চিন্তাগত ক্ষমতার ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আসে। এই সম্ভাবনার বাস্তবায়নকে কোনও মতেই শর্তাধীন পরাবর্ত গঠনের প্রকৌশল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা বোঝাতে গিয়েই পাভলভের একজন বিশিষ্ট ছাত্র ইউরি পেত্রভিচ ফ্রলভ (১৮৯২-১৯৬৭) মন্তব্য করেছিলেন:

মানুষ কখনওই তার আচরণের জৈব ভিত্তির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয় না, যথা— শর্তহীন পরাবর্ত, প্রবৃত্তি, ইত্যাদি যা কিছু বিভিন্ন ক্রিয়ার জৈবিক আধার। তথাপি মানুষের আচরণ প্রধানত তার সামাজিক চেতনা, সামাজিক রীতিনীতি এমনকি শ্রেণিসংগ্রামের চাহিদার দ্বারা নির্ধারিত হয়।… মস্তিষ্কের দ্বিতীয় সঙ্কেত তন্ত্র অবশ্যই চেতনা, সচেতন ও ঐচ্ছিক ক্রিয়া, অর্থাৎ, মানুষের সামগ্রিক আচরণের শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি। কিন্তু চেতনার শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি আর চেতনা নিজে আলাদা বিষয়। এই দুটো এক জিনিস নয়, চেতনা অত্যন্ত সুগঠিত বস্তুরই ফসল, তাই বলে সে নিজেই বস্তু নয়।[12]

সুতরাং যে চিন্তাশক্তির সাহায্যেই মানুষ প্রকৃতি এবং সমাজ পরিবেশ থেকে স্বাঙ্গীকরণ প্রক্রিয়া চালায়, সেই ক্ষমতাটিকেও সে কীভাবে সামাজিক আবহ থেকে আত্মীকৃত করে, মনস্তত্ত্বের সেটাই হচ্ছে গোড়ার কথা। এই গোড়ায় পৌঁছতে পারলে আমরা দেখব, মানুষ কী চিন্তা করে এবং কীভাবে চিন্তা করে— এই দুটো প্রশ্ন পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়, একই সূত্রে গ্রথিত। ভাইগতস্কি সেই দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দেখিয়েছেন, মানুষের সামাজিক সত্তা তাকে কীভাবে আচরণগত ক্ষেত্রে পশুর অবস্থা থেকে, অর্থাৎ, পরাবর্ত ক্রিয়ার আচরণগত পর্যায় থেকে মানব পর্যায়ে, অর্থাৎ, সচেতন ও সৃজনশীল আচরণ করার স্তরে উন্নীত করে। পরবর্তী গবেষণায় তাঁর সেই সিদ্ধান্তগুলি আরও দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়েছে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]


[1] Platonov 1959, 15-16; italics in the original.
[2] Pavlov n. d.a, 262.
[3] Pavlov n. d.a, 285.
[4] Cited, Chauchard 1964, 72.
[5] Shorokova 1966, 202 & 213.
[6] Graham 1987, 168-76. ভাইগতস্কির মৌলিক কাজের সংক্ষিপ্ত অথচ সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায় এখানে।
[7] Graham 1987, 168. সূত্র সহ উদ্ধৃত।
[8] Marx 1967, 101.
[9] Engels 1974, 248.
[10] Rubinstein 1966, 53-54.
[11] Vygotsky 1978; Leontyev 1981.
[12] Frolov 1962, 132.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...