গরমিল

গরমিল | সোহম দাস

সোহম দাস

 

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। শীত-শীত ভাবটা রয়ে গিয়েছে এখনও। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকে। বয়স্কদের জন্য এ হাওয়াটা ভাল নয়। বছর পঞ্চান্নর ইসমাইল উদ্দিন তার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চাদরটা তাই ভাল করে মাথায় জড়িয়ে নেয়। চারিদিক থমথমে হয়ে রয়েছে। মাঝেমাঝে এদিক-ওদিক থেকে গাড়ির শব্দ আসছে। দু-একটা প্যাট্রল ভ্যানও চলে যাচ্ছে, শব্দ করে। থেকে থেকে সজাগ হয়ে উঠছে প্রৌঢ় মানুষটি। ওই শব্দটাকে ভীষণ ঘেন্না করতে ইচ্ছে করে তার।

তিনদিন কেটে গেল, তবু কিছু সুরাহা হল না। রাইসুলনগর এখন দিন গুনছে কেবল।

এলাকায় ঢোকার ঠিক মুখের বড় গলিটার একদম প্রথম দোকানটা দীনদয়ালের চায়ের দোকান। বহু পুরনো। তার বাবা খুলেছিল একসময়। এখন তার ছেলেও দোকানে আসে নিয়মিত। সকাল-সন্ধে ভাল বিক্রি। চায়ের দোকানের রোজগার থেকেই নিজের বাড়ি করেছে দীনদয়াল। চা ছাড়াও ফ্রেঞ্চটোস্ট, স্যান্ডউইচ, ছোলে-কুলচার জন্য তার দোকানের বেশ নাম। সন্ধে হলে তিলধারণের জায়গা থাকে না। তারা স্বামী-স্ত্রী-ছেলে তিনজনে মিলে প্রায় হিমসিম খেয়ে যায়। কিন্তু গত কয়েকদিনের চিত্র একেবারে আলাদা। দোকানে কেউ বসছে না। না দীনদয়াল, না তার বউ-ছেলে, না কোনও খদ্দের।

চায়ের দোকানটা ফেলে এগিয়ে গেলে একখানা চারমাথার মোড়। সেখানে একটা ফলের রসের দোকান। দোকানের মালিক একজন বিহারি। রামগোপাল তিওয়ারি। আম-লেবু-আনারস এবং অন্যান্য যত রকমের ফল আছে, সবকিছু নিংড়ে রস বের করা হয় মেশিনে। মে-জুন মাসে যখন হলকা ছোটে আশেপাশের পরিবেশে, তখন বিক্রি হয় প্রচুর। শীতের দিনে দুপুরেও ভাল বিক্রি হয়। কিছুদূরে একটা স্কুল, ছুটি হয় বিকাল তিনটেয়। ছুটির পরে সে স্কুলের সদ্যযুবা ছেলেমেয়ের দল কিংবা বাবা-মার হাত ধরা হাফপ্যান্ট-স্কার্টের কিশোর-কিশোরী, প্রত্যেকের অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য এই দোকানটা। সেও বন্ধ। রামগোপাল তিওয়ারি শোনা যাচ্ছে পাড়া ছেড়ে ভেগেছে।

পাড়ার ভেতরকার বিভিন্ন জায়গার অবস্থা আরও ভয়াবহ।

রাইসুলনগরের সবচেয়ে বড় ব্যাবসাটি হল ইসমাইল উদ্দিনের। অনেকখানি জায়গা নিয়ে তার গাড়ি সারাইয়ের গ্যারেজ। ইসমাইল এতদিন প্রায় একাই ব্যবসা দেখাশোনা করত, দুবছর হল তার আঠাশ বছরের জোয়ান ছেলে তাজুও ব্যাবসায় যোগ দিয়েছে। ছজন মেকানিক কাজ করে গ্যারেজে। সে গ্যারেজ এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ। টায়ার পোড়ার কটু গন্ধ সেখানের বাতাসে, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে গাড়ির পার্টস। সেদিনকার ঘটনা ঘটার সময়ে ইসমাইল গ্যারেজে ছিল না, শরীরটা খারাপ থাকায় কদিন ধরেই সে অনুপস্থিত। ছিল তাজু, এবং জনা চারেক মেকানিক। তারা প্রত্যেকেই যে পৈতৃক প্রাণটি হাতে করে সেদিন পালাতে পেরেছিল, এ তাদের পরম ভাগ্য।

গ্যারেজের পাশে সারি সারি দোকান। বেশিরভাগেরই বয়স দশ বছরের বেশি। যেমন, মুস্তাফিজুরের মোবাইল ফোন মেরামতির দোকানটি। আকারে খুব বড় নয়, কিন্তু মুস্তাফিজুরের এতেই বেশ চলে যায়। দোকানঘরের উপরেই থাকে বাড়ির মালিক জিতেন্দ্র নারায়ণ। দুজন আক্রমণকারী এসে মুস্তাফিজুরকে হিড়হিড় করে দোকান থেকে টেনে বার করে আনে। তারপর তার দোকানের জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুস্তাফিজুর প্রাণপণ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন তাকে চুলের মুঠি ধরে বেধড়ক মারধোর করা হয়। যেন বহুদিনের পুরনো আক্রোশ মিটিয়ে নিচ্ছিল ওরা। মারের চোটে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দোকানঘর অবশ্য অক্ষতই আছে।

দোকানপাট সেভাবে আর খুলছে না। যাদের একেবারে না খুললে নয়, তারা সকালের দিকে খুলছে, তাতে কিছুমিছু বিক্রিবাটা হয়। মুদি বা মণিহারি দোকানের মালিকরা বাড়ি-বাড়ি জিনিসপত্র দিয়ে আসছে। টাকা নিচ্ছে অনলাইনে। সবার মনেই নির্ভেজাল উৎকণ্ঠা।

চা বানানোর পাত্রটার মধ্যে চামচ নাড়তে নাড়তে দীনদয়াল এদিক-ওদিক তাকায়। অবস্থা এমন হয়েছে, খানিক জোরালো আওয়াজ শুনলেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠছে। দীনদয়াল ভাবে, এই তো কদিন আগেও সব ঠিকঠাক ছিল। বিকেলের পর থেকে খদ্দের গমগম করছে, সে, তার বউ, জোয়ান ছেলে তিনজনে মিলে খদ্দের সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। তার মধ্যেই চলছে টিকা-টিপ্পনি, অভিযোগ, খিস্তিখেউড়। এই তো যেদিন এতকিছু কাণ্ড ঘটে গেল, সেদিন সকালেও তো কত লোক এসে জলখাবার খেয়ে গেল। তার বউ লছমি নতুন একখানা ম্যাগির রেসিপি বানিয়েছিল ওদিন, খদ্দেররা কত তারিফ করল।

বাড়ির সামনে একটুখানি জায়গা পেতে সে চা, অমলেট আর পোচ বিক্রির ব্যবস্থা করে ফেলেছে। বিকেলের পরে বসে। যে কয়েকজন টহলদার বাহিনির ছেলে রাস্তায় থাকে, তারা এসে চা-অমলেট খেয়ে যায়, খবরাখবর দিয়ে যায়।

একটু আগে যেমন ইউসুফ এল। দীনদয়াল তাকে প্রশ্ন করে— আজকে কী খবর?

ইউসুফ সতর্ক স্বরে বলে— খবর ভাল নয়। ডেঞ্জারাস-ডেঞ্জারাস ঘটনা ঘটছে, হেবি বাওয়াল চলছে সব জায়গায়। ভয় লাগছে চাচা।

দীনদয়াল একপ্রকার সায় দেয় তার কথায়। বলে— হ্যাঁ রে, আমারও বুকটা ঢিপ-ঢিপ করছে, এই বুঝি আবার কিছু হল। নে, তোর চা-টা ধর।

মাটির খুরিতে চা নিয়ে ইউসুফ বলল— চাচা, পুলিশ ইসমাইল চাচার এফআইআর নেয়নি, শুনেছ?

দীনদয়াল শোনেনি খবরটা। বলল— না তো। সে কী, এফআইআর নিল না কেন?

ইউসুফ বলল— এইরকমই হারামিপনা শুরু করেছে। চাচাকে অনেকক্ষণ থানায় বসিয়ে রেখেছে। তারপর বলেছে, যথেষ্ট এভিডেন্স নেই, তাই এফআইআর হবে না। এদিকে শালারা আজহার আর সুধীরকে দুদিন ধরে নিয়ে গিয়ে ছাড়ছে না। বলেছিল, জাস্ট কিছু পুছতাছের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আজহারের ভাই আর সুধীরের মা রোজ থানায় গিয়ে পড়ে থাকছে। এর বেলা এভিডেন্স লাগে না! আরও দেখো, যে শুয়োরের বাচ্চারা একদম খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হুমকিটা দিল, সবার ফোনে সেসব ভিডিও আছে, সেই মালগুলো এখনও কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছক কষছে। পুলিশ শালা সার্কাস দেখছে। জানোয়ার!

উত্তেজিত হয়ে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি কথা বলে সে থামে।

দীনদয়াল স্বগতোক্তি করে— এখনও ছাড়েনি ওদের? কী দিনকাল এল রে ভাই! তারপর ইউসুফের উদ্দেশে এমনিই প্রশ্ন ছোঁড়ে— এসব কবে ঠিক হবে বল তো?

ইউসুফ অসহায়ের মতো উত্তর হাতড়ায়। বলে— জানি না, চাচা। আব্বার মুখে পুরনো কথা শুনেছি অনেক। কিন্তু এসব আমাদেরকেও দেখতে হবে ভাবিনি।

ইউসুফ ছেলেটি চাকরিবাকরি কিছু করে না। টিউশনি করে খরচ চালায়। এই কয়েকদিনে সেসবের পাট নেই। চা-টা শেষ করে খুরিটা বেঞ্চের নিচে রাখা ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে বলল— স্টুডেন্টগুলোর কী হবে কে জানে! সামনে পরীক্ষা সব, আমি তো যেতেই পারছি না। ওদের ওদিকেই যে কী অবস্থা কে জানে।

দীনদয়াল বলল— তোরা ফোনে কীসব করে খবর পাস যে, সেসব পাচ্ছিস না।

ইউসুফ বলে— ধুর, নেট তো বন্ধ করে দিয়েছে।

দীনদয়াল এই ব্যাপারটা একেবারেই বোঝে না, তাই খবরটা কখনও শুনে থাকলেও তেমন গা করেনি। তবে ইউসুফের কথায় এখন বুঝল ব্যাপারটার গুরুত্ব। কী আজব দুনিয়া মাইরি, যত খারাপ হয় সব খেটে-খাওয়া মানুষের। খারাপের কথা মনে হতেই তার মুস্তাফিজুরের কথা মনে হল। রোগা ছেলেটাকে কী মারটাই না মারল ওই শয়তানগুলো। ভাবলেই কান্না এসে যাচ্ছে। সে ইউসুফকে জিজ্ঞাসা করে— মুস্তাফিজুরের হালত কেমন?

ইউসুফ বলে— ওই ওদিকের একটা ক্লিনিকে ট্রিটমেন্ট হচ্ছে। মাথায় ভাল চোট আছে। খুলিতে ফ্র্যাকচার হয়েছে মনে হয়। এখন সেরে ওঠা বহুত কিসসা।

–কোন ক্লিনিক?
–ওই সেই একজন ডাক্তার আছে না, সেবার পেপারে নাম বেরিয়েছিল, তার ক্লিনিকে। আরে ওকে ভর্তি করাতে গিয়েও এক বাওয়াল!

দীনদয়াল কৌতূহলী হয়। প্রশ্ন করে— এখানেও বাওয়াল? কী হয়েছে?

–আমাদের বড় হাসপাতালে প্রথমে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে বলেছে ভর্তি নেব, তারপরে আর নেয়নি। সঠিক কারণ বলেনি, বলেছে একজন খুব ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট হঠাৎ এসে পড়ায় স্লট আর নেই। কিন্তু আমাকে ওই ব্রিজেশ বলল, ওসব একদম ফালতু কথা। ওর নাম শুনেই ভর্তি নেয়নি। ওরা তারপর একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে ওই ক্লিনিকটাতে নিয়ে গেছে।

–ওরা মানে?
–ওই ওর দোকানের আশেপাশের লোকজন। ব্রিজেশ, নাগিন্দর, নিশান্ত, এরা। নিশান্তই শুনলাম অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছে। ওর এক ভাইয়ের সঙ্গে এনজিও-ফেনজিও-র জানাশোনা আছে।

সন্ধেটা নেমে গেছে। রাস্তায় লোকজন বলতে শুধু পাহারা-বাহিনির ছেলেরা। দীনদয়াল হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। কীসের একটা শব্দ আসছে না? ঘড়-ঘড়-ঘড়। সে ইউসুফকে বলে— ইউসুফ, শোন একবার। কেউ কি দোকানের শাটার তুলছে?

ইউসুফ কিছুক্ষণ শোনবার চেষ্টা করে বলল— না না। সেরকম কোনও আওয়াজ নয়। এখন এই অন্ধকারে কে আবার দোকান খুলবে। ও তোমার শোনার ভুল, চাচা।

শোনার ভুল? তাই হবে হয়তো। এই নিয়ে তিনবার হল। গত কয়েকদিন এই একটা আওয়াজ যেন হঠাৎই বিলুপ্ত হয়ে গেছে পাড়াটা থেকে। দীনদয়ালের অভিজ্ঞ কানজোড়া অধীর হয়ে থাকে এই একটা শব্দের জন্য।

ইউসুফ প্রায় কুড়ি মিনিট বসে আছে তার কাছে। পাহারা দেওয়ার মাঝে এতক্ষণ কোথাও বসে থাকা কাম্য নয়। একটি ছেলে প্রায় শশব্যস্ত হয়ে ঢুকে পড়ে। এ ছেলেটিকেও দীনদয়াল চেনে, নাম রাজিবুল হুসেন। পেশায় জিমট্রেনার। পেশিবহুল গড়ন আর লম্বা চেহারায় বেশ চট করে চোখে পড়ে। পাহারাদার হওয়ার জন্য আদর্শ একদম। এসেই সে ইউসুফকে বলল— আরে ভাইয়া, তুমি এখানে বসে আছ? আমরা ওদিকে তোমাকে গরুখোঁজা খুঁজে চলেছি।

ইউসুফ বলে— কেন রে? কী হয়েছে?

রাজিবুল বলে— কিছু হয়নি। কিন্তু হতে কতক্ষণ! তুমি ভাইটাল মেম্বার আমাদের। এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকলে আমরা কমজোর হয়ে যাব যে। চলো, চলো। ওদিকে হনুমান মন্দিরের দিকটায়, মানে শাহপুরের সঙ্গে যে রাস্তাটা কানেক্টেড, ওদিকটায় রাকেশ একা হয়ে যাচ্ছে, তুমি একবার ওদিকে যাও।

ইউসুফ সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে যায়। দীনদয়াল বলে— তোরা কজন আছিস?

রাজিবুল বলে— খুব বেশি নয়, চাচা। পনেরো-ষোলোজন।

দীনদয়াল জিজ্ঞাসা করে— এত কম লোক নিয়ে পারবি ওদের সঙ্গে?

রাজিবুল বেশ খানিকটা আত্মশ্লাঘার সঙ্গেই বলে— এই দিয়েই পারতে হবে। শালারা আমাদের পাড়ায় ঢুকে দোকান জ্বালিয়ে দিয়ে, লোককে কেলিয়ে অজ্ঞান করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যাবে, ইয়ার্কি হচ্ছে? আসুক ঢ্যামনার বাচ্চাগুলো আরেকবার, অ্যায়সা দাওয়াই লাগাব না।

দীনদয়াল শিহরিত হয় তার হাঁটুর বয়সি ছেলেটার কথা শুনে। কী দুর্জয় সাহস, বাপরে! তার ছেলে সতীশও এ দলে আছে অবশ্য। এ সাধারণ পেটোয়া গুণ্ডা-বদমাশ নয় যে শুধু মারামারি করে আটকানো যাবে। সেই কারণেই ভয় এবং উদ্বেগ দুটোই বেশি।

রাজিবুলও বেরিয়ে পড়ছিল, দীনদয়াল হঠাৎ বলল— এককাপ চা খেয়ে যা না। সারাদিন খাটা-খাটনি যাচ্ছে, খাওয়াদাওয়া তো ভোগে।

রাজিবুল কী ভেবে বসে পড়ল। আইডিয়া মন্দ নয়। চট করে এককাপ চা খেয়ে নিলে বেশ কিছুক্ষণ আর খিদে পাবে না। তার উপর দীনদয়ালচাচার চা।

দীনদয়াল নতুন করে চা ফোটাতে লাগল। এক মিনিটও কাটেনি, হঠাৎ রাজিবুলের ফোন বেজে ওঠে। ফোনপরিষেবা যে বন্ধ করে দেয়নি, এই ভাগ্যি। কলকর্তার নাম দেখেই অবশ্য ভ্রূ-টা কুঁচকে গেল তার। ফোনটা তাড়াতাড়ি ধরে বলল— হাঁ জি, বোলিয়ে।

তারপরেই কেয়াহ? বলে বেঞ্চ থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল। দীনদয়াল ওভেনের গ্যাসটা অফ করে দিল। রাজিবুল উত্তেজনা নিয়ে হাঁ-হাঁ-হাঁ, একদম-একদম, ঠিক-হ্যায়-জি এসব বলে যাচ্ছে। ব্যাপার যে গুরুতর, তা বুঝতে অসুবিধা হল না। কথা শেষ করে ফোনটা রেখেই সে দীনদয়ালকে বলল— চাচা, চা রেখে দাও তুমি। হেবি বাওয়াল ওদিকে।

দীনদয়াল শিউরে ওঠে। আবার কী হল নতুন করে? উত্তরটা রাজিবুলই দেয়— বাদশাবাগে মসজিদে হাঙ্গামা হয়ে গেছে। লোকজন মাঘরিবের নমাজ পড়ছিল, তখন হামলা হয়েছে। আমার আর দাঁড়ানোর সময় নেই চাচা। এখানেও বাওয়াল লাগতে পারে। তুমিও এসব গুটিয়ে ঘরে যাও।

এই বলে দীনদয়ালকে আর বলার অবকাশ না দিয়েই সে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়।

দীনদয়ালের পা-হাত কাঁপতে থাকে থরথর করে। আর কত?

বাইরে কিছু দৌড়োদৌড়ির আওয়াজ শুনতে পায় সে। ও-ই বুঝি আবার এল! এখুনি আবার ভাঙচুর করবে চারিদিক। লোকের মাথা ফাটাবে। জঘন্যভাবে স্লোগান দেবে।

দীনদয়ালের ভয় করতে শুরু করল। হাতঘড়িতে সময় দেখল, সাতটা পঁচিশ প্রায়। অনেক হয়েছে বিক্রিবাটা। এখন এসব বন্ধ করে উপরে চলে যাওয়াই ভাল। রাজিবুল ঠিকই বলেছে। সে তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে।

***

 

রাত নটা নাগাদ হঠাৎ পুলিশ ভ্যানের তীব্র আওয়াজে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে যায়। দীনদয়াল তড়িঘড়ি ছুটে যায় বারান্দায়। তাহলে কি সত্যি সত্যি বাওয়াল লেগেই গেল? বুক কাঁপতে থাকে তার। ইউসুফ, রাজিবুল, ইয়াসিন, এই ছেলেগুলোর কিছু হবে না তো? ওরাই যে পাড়াটাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও বুকের সাহস নিয়ে দিন-রাত্রি পাহারা দিয়ে চলেছে।

দীনদয়াল বারান্দায় ঘনঘন পায়চারি করতে শুরু করল। যেন খাঁচায় পোরা বাঘ।

সাড়ে নটা বাজতে যায়। এই সময়ে তারা খাওয়াদাওয়া করে। কারণ, অনেক ভোরে উঠে দোকানের জন্য জোগাড়যন্ত্র করতে হয়। এখন যদিও দোকান বন্ধ, তাও সে নিয়মের নড়চড় নেই। কিন্তু দীনদয়ালের আজকে খিদে পাচ্ছে না। সেই যে ভ্যানটা গেল, তারপর থেকে এদিকে আর কোনও শব্দ বা চলাফেরা নেই। অসহ্য নিস্তব্ধতা যেন আরও বেশি করে ভয়ের বিষ ছড়িয়ে দেয় সারা মনে। সে ভয় সবকিছুকে ভুলিয়ে দেয়।

এমন সময়ে লছমি এসে ডাকল তাকে— আরে, খেতে এসো। এতবার ধরে ডাকছি।

ছেলেগুলোর চিন্তায় দীনদয়ালের মন ওদিকেই পড়ে আছে। লছমি যে এতবার ডেকেছে, সেটা সে তাই শুনতেই পায়নি। বউকে সে উত্তর দিল— খিদে নেই।

লছমি অবাক হয়। জিজ্ঞাসা করে— কেন? তবিয়ত ঠিক আছে তো?

দীনদয়াল উত্তর দিতে গিয়েও থমকে যায়। তবিয়ত তার ঠিক নেই, অবশ্যই নেই, কিন্তু সেকথা লছমিকে বলা মানে সে এবার টেনশন করতে শুরু করবে। তাই সে মিথ্যে কথাই বলল— তবিয়ত ঠিক আছে। এমনিই খিদে নেই।

লছমি বুঝল, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু সেটা যে কী, তা বোঝা তার আয়ত্তের বাইরে। সে তাই জিজ্ঞাসা করল— আবার কিছু হয়েছে নাকি?

দীনদয়াল অস্বস্তি বোধ করে। লছমি কিছু টের পাচ্ছে নিশ্চয়। বলবে তাকে? শেষমেশ বলেই ফেলল— আবার পুলিশের গাড়ি দেখলাম। ভয় লাগছে লছমি, হেবি ভয় লাগছে। ইউসুফ, ইয়াসিন, ওদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। পুলিশ তো বেছে বেছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

লছমি বুঝল ব্যাপারটা। ব্যাপারটা ভয়ের ঠিকই। তাদেরই ছেলের বন্ধুবান্ধব সব। তাদের ছেলেও আছে এই দলে। না থেকে উপায় ছিল না। ভয় ব্যাপারটা সংক্রামক ঠিকই, তবু মায়ের মন সর্বদাই ছেলের ভাল চিন্তা করতে অভ্যস্ত। স্বামীকে আশ্বস্ত করার জন্য লছমি বলে— চিন্তা কোরো না। কিছু হবে না ওদের। তুমি খেয়ে নাও।

দীনদয়াল আর কথা বাড়াল না। এতক্ষণ যখন আর কোনও আওয়াজ আসেনি, নিশ্চয় খারাপ কিছু হবে না। সে খেতে গেল।

***

 

ভোর পাঁচটা। তখনও চারিদিকে অন্ধকার-অন্ধকার। কলিং বেলটা বাজছিল অবিরাম।

দীনদয়াল ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিল সে। ছেলে কাল খেতে আসেনি। দুবার ফোন করলেও ফোন ধরেনি। অবশ্য দ্বিতীয়বারে মেসেজ পাঠিয়েছে— ব্যস্ত আছি। পরে বলব সব। ফোন কোরো না।

তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তার নিজের মনে নেই।

জাগতেই কাল রাতের সমস্ত চিন্তা এক ঝটকায় এসে হাজির হয় মাথায়। এত ভোরে কে এল আবার? পুলিশ নয় তো? তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে নাকি?

আজহার আর সুধীরের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়তেই কেমন কুঁকড়ে গেল সে। বিছানা থেকে নেমে দরজা অবধি যেতে গিয়ে দেখে, পা আর সরছে না। আবার কলিং বেল বাজল। সঙ্গে চিৎকার— আরে, দরজা খোলো না। হেবি জোর পেচ্ছাপ পেয়েছে।

সতীশেরই গলা। সঙ্গে আরও লোক আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছিল দীনদয়াল। পারল না। বুকে সাহস সঞ্চয় করে কোনওরকমে গিয়ে দরজা খুলল সে।

সতীশ একাই দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা লাঠি। আর কেউ নেই আশেপাশে। হাতের লাঠিটা দরজায় রেখেই সে প্রায় একলাফে ঘরে ঢুকল। তারপর যেন প্রায় উড়ে গেল বাথরুমের দিকে। দীনদয়াল আশপাশটা আরও একবার ভাল করে দেখে, লাঠিটা হাতে নিয়ে দরজা বন্ধ করল। এখনও দিনের আলো ফোটেনি ভাল করে। কিছুটা নিশ্চিন্তি। কিন্তু কালকের ঘটনা জানার জন্য সে উদগ্রীব। সতীশ বলেছিল, ব্যস্ত আছি। কী হচ্ছিল তখন?

সময় যেন কাটতে চাইছে না। পেচ্ছাপ করতে এতক্ষণ লাগে? ছেলের উপর রাগ হতে শুরু করে। সে আবারও কাল রাতের মতো পায়চারি করা শুরু করল।

প্রায় মিনিট দশেক পর বাথরুম থেকে বেরোল সতীশ। মুখে, ঘাড়ে জল। বেরোতেই দীনদয়াল বলে ওঠে— এতক্ষণ ধরে কী করছিলি?

সতীশ অবাক হয়। বলে— আরে, কাল বিকেল থেকে তো বাইরে। সারারাত ঘুমোইনি। চোখে-মুখে জল না দিলে চলে!

দীনদয়াল বুঝতে পারে, ভয়ে-উদ্বেগে বাস্তববুদ্ধি কাজ করছে না তার। কিন্তু মন বাগে আসছেই বা কোথায়? সে তাই প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে বলে— কাল কী হয়েছিল বেটা? রাতে খেতে এলি না, মেসেজ করলি, ব্যস্ত আছি। তোর মা খুব টেনশন করছিল।

ঘরের মাঝখানে রাখা চেয়ারটা নিয়ে সতীশ বসে পড়ে। তারপর বলে— আরে, সে পুরো কমেডি সার্কাস। মালগুলোর কাল হেবি বেইজ্জত হয়েছে। উফ! এই বলে সে হাসতে থাকে।

দীনদয়াল মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না। বলে— আরে, কী হয়েছে বলবি তো।

সতীশ বলে— কাল ওই বাদশাবাগে মসজিদ আর কবরখানায় হামলা হয়েছিল, শুনেছিলে তো? রাজিবুল তো তখন তোমার এখানেই ছিল। ও এখান থেকে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নির্দেশ দিল, যে কটা মন্দির এই এলাকায় আছে, সবকটায় যেন আমাদের ছেলেরা চলে যায়। বড়ে মসজিদের দিকেও কয়েকজনকে আমরা পাঠিয়ে দিলাম। তারপরে কী করেছে জানো? শুয়োরের বাচ্চাগুলো বড়ে মসজিদের দিকে হামলা করেনি, শাহপুরের দিকে যে পুরনো মন্দিরটা আছে, মহাদেবের, ওটাকে ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কী রেটের মাদারচোদ, ভাবতে পারছ? মন্দিরটা ভাঙলে ওটাকে শালা ইস্যু করে আরও কটা ঘর জ্বালাবে। কিন্তু আমাদের ছেলেগুলোর জন্যে সেসব কিছু করতে পারেনি। আমাদের নসিব ভাল যে ওখানে রাজিবুল-ইয়াসিন ওরা ছিল। লাঠিসোটা নিয়ে এসেছিল, সব কটা ভেগেছে।

যত শুনছে, ততই শিউরে উঠছে দীনদয়াল। কোনওরকমে জিজ্ঞাসা করল— পুলিশ এসেছিল কেন তাহলে?

রাগে সতীশের গলা চড়ে যাচ্ছে। সে বলল— ওদেরই মধ্যে কেউ পুলিশকে ফোন করে ঘাপলা দিয়েছে, আমাদের এদিকে নাকি দুটো মন্দিরকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা পুরো বাদশাবাগের ঘটনাটা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার ফন্দি। পুলিশেরও হারামিপনাটা দেখো, আমরা সেদিন অতবার ফোন করেছি, শালারা আসেনি। এদিকে কাল একদম বাবুদের বলার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন।

তারপর কিছু থেমে যোগ করে— একেবারে নাচতে নাচতে চলে এসেছে। সঙ্গে ওয়ারেন্ট-ফোয়ারেন্ট কিচ্ছু নেই কিন্তু। ওদের কাছে মোবাইলে ভিডিও আছে, সেটাই প্রমাণ। কিন্তু এদিকে তো কিছুই হয়নি। আমাদের জিজ্ঞাসা করেছে, তখন আমরা পরিষ্কার বলেছি, হামলা করতে ওরাই এসেছিল, আমাদের ছেলেদের জন্যে কিছু করতে পারেনি। ওদেরই কেউ ফোন করে ব্লাফ দিয়েছে। এমন কুত্তার বাচ্চা, তখন আমাদের উপর তম্বি শুরু করেছে। আমরাই নাকি ফোন করে ওদের উল্লু বানিয়েছি। খেলাটা বুঝতে পারছ, পুরো ওদের হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

দীনদয়াল শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছে। সে অকুস্থলে ছিল না, সতীশ ছিল, সেজন্যেই যেন আরও বেশি অজানা আতঙ্ক তাকে চেপে ধরেছে।

সতীশ বলছিল— কোনও একটা বাহানায় আমাদের কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়ার তালে ছিল। ওই আজহার আর সুধীরের মতো। কিন্তু কাল আমরা ঠিক করেই রেখেছিলাম, বাধা দেবই। ওয়ারেন্ট-ফোয়ারেন্ট নেই, এদিকে অ্যারেস্ট করবে, শালা নৌটঙ্কি হচ্ছে নাকি! জোর ক্যাচাল শুরু হল। আমাদের সঙ্গে ওই সিসিএইচ কমিটিও কাজ করছে শুনে অবশেষে নরম হল। ওদেরও তো ভয় আছে, অনেকেই আঙুল তুলেছে এখন। হম্বিতম্বিতে কাজ হল না দেখে বড় যে ইনস্পেক্টর এসেছিল, সে জিজ্ঞাসা করছে, হামলার সময়ে মন্দিরে কেউ ছিল না? যদি থাকে, তাকে আনা হোক। সে যা বলবে, তার উপরে বেস করে পরের অ্যাকশন।

কথা বলতে বলতে সতীশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ভেতর থেকে লছমির চুড়ির শব্দ এল, ছেলের গলার স্বরে বোধহয় ঘুম ভেঙে গেছে তার। দীনদয়াল যেন খানিক সাহস ফিরে পাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল— তারপর?

সতীশ বলল— ওই যে উপাধ্যায় আছে না, মন্দিরে পুজো দেয় রোজ, ও নাকি হামলার সময়ে মন্দিরেই ছিল। রাজিবুল তার কথা বলল। আমরা ভাবলাম, পুলিশ বুঝি বিশ্বাস করবে না। কিন্তু দেখলাম, করে গেল। এখন বুঝতে পারছি, পুলিশ ভেবেছিল, এই একটা হেবি চাল হতে পারে। উপাধ্যায় কি আর ইউসুফ, ইয়াসিনদের পক্ষে কথা বলবে? যাইহোক, আমাদের নিয়ে পুলিশ গেল ওর ঘরে। সে বুড়ো প্রথমে দরজাই খোলেনি। তারপর পুলিশের হাঁকডাকে খুলল, ভয়ে হেগেই ফেলে। পুলিশ ওই রাজিবুল-ইয়াসিনদের দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, দেখে বলো, বিকেলে মন্দিরে যারা হামলা করতে এসেছিল, তাদের মধ্যে এরা ছিল? উপাধ্যায় কথা বলবে কি, ভয়েই তো অস্থির, ওর অবস্থা দেখে আমাদেরও টেনশন হয়ে যাচ্ছে। ঝুট না বলে দেয়। যাইহোক, অনেক কষ্টেই বলল, না স্যার, এরাই তো ওই যারা হামলা করতে এসেছিল, তাদের ভাগিয়েছে। এরা নিজেরা কেন হামলা করতে যাবে! পুলিশ দুবার ক্রস করল। কিন্তু উপাধ্যায় ওই একই কথা বলে গেল। উফ, ওই সময়ে থোবড়াগুলো যদি একবার দেখতে গো! পুরো মনে হচ্ছিল, শাদির সময়ে ওদের আওরতকে নিয়ে কেউ ভেগেছে। শাসিয়ে গেছে আমাদের, কিছু বেগড়বাঁই দেখলেই অ্যারেস্ট করবে। ইয়াসিন তো পুরো বোমা হয়ে ছিল, পারলে কেলিয়েই দেয়। সবাই মিলে কাল সামলেছি। আমাদের দিক থেকে একটু বেচাল হলে সব বানচাল। যাইহোক, কাল হেবি বেইজ্জত হয়েছে শালারা!

কথা শেষ করতে করতে সতীশ হাসতে শুরু করল। সারারাত জেগে থাকার ক্লান্তিকে যেন হেসেই ভুলিয়ে দেবে ছেলেটা। সকালটার মতোই উজ্জ্বল লাগছে ওকে। হাসি থামলে সে বলল— আমি ঘরে যাই। গা-হাত ম্যাজম্যাজ করছে, খানিক শুয়ে নিই।

লছমি উঠে পড়েছে ততক্ষণে। বাথরুমে ঢুকেছে। দীনদয়ালের মনে পড়ল, অনেকক্ষণ ধরে সে-ও নিজের পেচ্ছাপ চেপে রয়েছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...