আর্থিক নীতি ও লিঙ্গবৈষম্য: কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ থেকে আমাদের প্রত্যাশা

প্রতিভা কুণ্ডু

 



লেখক নয়াদিল্লির সেন্টার ফর বাজেট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স অ্যাকাউন্টেবিলিটি সংস্থায় গবেষক হিসেবে কর্মরত 

 

 

 

লিঙ্গের নিরিখে সমানাধিকার দেশের আর্থ-সামাজিক বিকাশের অন্যতম সূচক হলেও, বেশিরভাগ সময়েই এই প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক নীতির বদলে সামাজিক নীতি পরিবর্তনকেই হাতিয়ার করা হয়, এবং বাজেটকে মনে করা হয় লিঙ্গ-নিরপেক্ষ (gender-neutral)। এই অনুমানের ফলে আমরা শুরুতেই এই সত্যকে উপেক্ষা করি যে, বাজেটের প্রভাব পুরুষ এবং মহিলাদের ওপর শুধুমাত্র আলাদাই নয়, অসমও বটে।

তাই সমাজের লিঙ্গবৈষম্য কম করতে বাজেট প্রক্রিয়ার প্রতিটা ধাপ অর্থাৎ পরিকল্পনা, খসড়া, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়ন— মহিলাদের দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করতে হবে এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। আর এই প্রক্রিয়াটিই হল Gender Responsive Budgeting (GRB)।

এবার ভারতবর্ষে মহিলাদের কিছু উন্নয়নমূলক সূচকের দিকে তাকানো যাক। প্রথমেই আসি লিঙ্গবৈষম্য সূচক (Gender Inequality Index)-এ। ২০২২ সালের Global Gender Gap রিপোর্ট অনুযায়ী এই সূচকে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩৫-এ। বিশ্বব্যাঙ্কের ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী নারী-ক্ষমতায়ন সূচকের বিশ্ব-তালিকায় ১৯০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১৭-তে। এই পরিসংখ্যানগুলিই বলে দেয়, ভারতে লিঙ্গবৈষম্যের শিকড় কতটা গভীরে প্রোথিত। নিঃসন্দেহে এই বৈষম্যের মূলে রয়েছে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র এবং সামাজিক রীতিনীতি (social norms)। সমাজের এই চরিত্রগত অবস্থান পরিবর্তনে সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ভারতবর্ষে সরকারের এই সদিচ্ছার প্রকাশ আমরা প্রথমবার দেখি ২০০৬ সালের বাজেটে মহিলাদের জন্য সরকারি বরাদ্দের বিশ্লেষণে, যা Gender Budget Statement (GBS) নামে একটা আলাদা বিবৃতি হিসেবে কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গে পেশ করা হয়। দুঃখের বিষয় হল, যে প্রক্রিয়া প্রায় ১৬ বছর আগে শুরু হয়েছিল, আজও তার খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। Gender Budgeting-এর অনুশীলন সীমিত রয়েছে GBS-এর প্রকাশনা আর কিছু মন্ত্রকে Gender Budget Cell প্রতিষ্ঠায়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় আংশিকভাবে সক্রিয় না হলে নিষ্ক্রিয়।

একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে GRB-র কৌশল হিসেবে প্রতি বছর আমাদের সামনে যে GBS পেশ করা হয়, তা মহিলাদের পেছনে সরকারের আর্থিক ব্যয়ের খতিয়ান দেখালেও তাতে বহু ফাঁক আছে। তাই লিঙ্গবৈষম্য রুখতে সরকারের বাজেট নীতির সঠিক চিত্র আমাদের কাছে পৌঁছয় না।

আরও বিশদে এই ফাঁকগুলি নিয়ে আলোচনা করার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন, GBS আসলে কী।

 

GBS হল কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের মহিলাদের উন্নয়নের পেছনে বরাদ্দ এবং খরচের বিবৃতি। মেয়েদের উন্নতির জন্য বিভিন্ন মন্ত্রক নানাবিধ প্রকল্প রূপায়ণ করে। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প বা যোজনা, যেগুলো শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য পরিকল্পিত অর্থাৎ যোজনার ১০০ শতাংশ যদি মহিলাদের জন্য হয়, তখন সেটা GBS-এ Part A-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর একটা উদাহরণ হল, মেয়েদের জন্য হস্টেল।

অন্যদিকে কিছু যোজনা আছে, যার আংশিক বাজেট (ন্যূনতম ৩০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৯৯ শতাংশ) মহিলাদের উন্নয়নের স্বার্থে বরাদ্দ করা হয়। এই সমস্ত খরচ GBS-এর Part B-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কিন্তু এ তো গেল GBS-এর নির্দেশিকার কথা, বাস্তবে Part A এবং Part B-র রিপোর্টিং-এ প্রচুর খামতি নজরে আসে। অনেক সময়েই এমন কিছু যোজনা Part A-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা কোনওভাবেই পুরোপুরি মহিলাদের জন্য পরিকল্পিত নয়। আবার Part B-র কিছু যোজনাতে সঠিকের চেয়ে কম বা বেশি বরাদ্দ রিপোর্ট করা হয়। কিছু কিছু যোজনার Part B-তে অন্তর্ভুক্তির কোনও যুক্তিই খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার কখনও কোনও প্রকল্প হয়তো GBS-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত, অথচ তার কোনও রিপোর্টিং হয় না।

বহু বছর ধরে GBS-এ এরকম বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্টিং আমরা দেখতে পাই— গত বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রকাশিত GBS-এও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবুও এই স্টেটমেন্ট-এর গুরুত্ব অপরিসীম কারণ এটাই একমাত্র রাজস্বঘটিত নথি যা থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন মন্ত্রকের মহিলাদের জন্য বরাদ্দ এবং খরচের পরিমাণ এক জায়গায় পাওয়া যায়। তা ছাড়া কোনও মন্ত্রক লিঙ্গবৈষম্য কম করতে বা মেয়েদের উন্নয়নের বিষয়টিকে কতটা প্রাধান্য দিচ্ছে, তাদের বাজেট-নীতিতে তার একটা আভাস পাওয়া যায়।

২০২২-২৩-এ কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রকাশিত GBS অনুসারে মহিলাদের জন্য বরাদ্দ বাজেট ছিল প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২১-২২-এ বাজেট প্রস্তাবনার চেয়ে প্রায় ১৮,০০০ কোটি টাকা (১১.৫ শতাংশ) বেশি। কিন্তু ভারত সরকারের সম্পূর্ণ বাজেটের নিরিখে এই পরিমাণ মাত্র ৪.৩ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ০.১ শতাংশ পয়েন্ট কমে গেছে।

অতিমারি এবং তার সঙ্গে অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব মহিলাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে— যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা, গার্হস্থ্য হিংসা— বিশেষভাবে পড়েছে এবং অতিমারির মাত্রা দুই বছরে কম হলেও মহিলাদের জীবনে এর প্রভাব এখনও ভীষণভাবে বর্তমান। আশা করা গিয়েছিল গত বছরের বাজেটে কিছু আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ থাকবে। কিন্তু বাজেট গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে মহিলাদের সমস্যা মোকাবিলায় কার্যত অসফল।

২০২৩-২৪ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট দোরগোড়ায়। ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই আমরা নতুন বাজেট পেতে চলেছি যা আগামী এক বছরের আর্থিক রূপরেখা হবে। আশা থাকবে একটা Gender Responsive Budget-এর, কিন্তু বাজেটে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া একান্ত আবশ্যক।

 

মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি

ভারতবর্ষে মহিলাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি খুবই ছোট এবং অতিমারির পরে তা আরও সঙ্কুচিত হয়েছে। Periodic Labour Force Survey, 2020-21 অনুযায়ী মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার মাত্র ২৫.১ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নিতান্তই কম।

২০২২-২৩-এর বাজেটে আশা করা হয়েছিল যে মেয়েদের কর্মসংস্থান খাতে বাজেট-বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের যে কটি কর্মসংস্থান সংক্রান্ত যোজনা আছে, তাতে বাজেট-বরাদ্দ সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরে।

মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি যোজনা (MGNREGS) একটি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ যোজনা হলেও গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়নে এর ভূমিকা অপরিসীম। ২০২২-২৩ সালে MGNREGS-এর আওতায় কাজ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই মহিলা। অথচ গত বছরে MGNREGS-এ বরাদ্দ ২০২১-২২-এর পরিবর্তিত ব্যয় (revised estimate)-এর থেকেও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিন্তু গত দুবছরে MGNREGS-এ কাজের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে এবং প্রায় ৮.২ কোটি মানুষ কাজের জন্য আবেদন করা সত্ত্বেও কাজ পাননি।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান যোজনা হল জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন (National Rural Livelihood Mission)। এই যোজনায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে (Self-help Group) সাহায্যের মাধ্যমে গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া হয়। এটা যোজনাতেও বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় কমে গেছে। MGNREGS-এর মত শহরভিত্তিক কর্মসংস্থান যোজনার দাবি সোচ্চার হলেও কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ সেই আশাপূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন ঋণসংক্রান্ত প্রকল্প (Credit Guarantee Schemes)— যেমন প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা যা আংশিকভাবে হলেও মহিলা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদের হারে ঋণ নিতে সাহায্য করে— সেইসব প্রকল্পতেও গত বছরের বাজেটের তুলনায় এ-বছর বাজেট হ্রাস পেয়েছে। এমনিতেই প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুবিধা মহিলাদের ক্ষেত্রে অনেক কম এবং সেজন্য মহিলা ব্যবসায়ীরা অনেকটাই নিজেদের মূলধনের (Self-financing) ওপর নির্ভর করেন। কাজেই মহিলাদের আর্থিক ক্ষমতায়নে এই যোজনা/প্রকল্পগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।

মহিলাদের সত্যিকারের ক্ষমতায়নের জন্য অনেক বেশি মহিলাকে বিভিন্ন কর্মসংস্থান যোজনার আওতায় আনতে হবে, মহিলাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির (fiscal inclusion) প্রয়াস বাড়াতে হবে এবং সেইজন্য এই বাজেটে খুব সক্রিয়ভাবে কর্মসংস্থান খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

 

মহিলাদের প্রতি অপরাধ এবং হিংসা রোধ

National Crime Record Bureau-র সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ সালে মহিলাদের প্রতি অপরাধের হার তার আগের বছরের তুলনায় ১৫.৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা, পঞ্চম (National Family Health Survey, 5)-এর পরিসংখ্যান বলে ভারতবর্ষে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। কিন্তু মাত্র ১৪ শতাংশ মহিলাই বিষয়টিকে প্রকাশ্যে আনার মত সাহস দেখান। গত পাঁচ বছরে সার্বিকভাবে গার্হস্থ্য হিংসার হার সামান্য কম হলেও কিছু রাজ্যে, যেমন অসম, দিল্লি এবং পশ্চিমবঙ্গে ১৮-২৯ বছর বয়সি মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের হার গত পাঁচ বছরে ঊর্ধ্বগামী। জাতীয় মহিলা কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী অতিমারির সময়ে মহিলাদের প্রতি অপরাধ এবং গার্হস্থ্য হিংসা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ নিশ্চিতরূপে এই পরিসংখ্যানের প্রভাব গত বছরের বাজেটে কোনওভাবেই দেখা যায়নি। ২০২১-২২ সালে ‘নির্ভয়া ফান্ডে’ মোট ৬২১৩ কোটি টাকার করপাস ছিল। অথচ আজ পর্যন্ত নির্ভয়া ফান্ড থেকে মাত্র ২৯২২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কম খরচের পাশাপাশি এই ফান্ডের ব্যবহার নিয়েও কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে। যেমন, নির্ভয়া ফান্ডের একটা অংশ বিভিন্ন সাধারণ সেবা (General Services) যেমন, আপৎকালীন সহায়তা (Emergency Response Support System)-র জন্য খরচ করা হয়েছে। অন্যদিকে মহিলাদের সুরক্ষা সংক্রান্ত পরিষেবা যেমন, মহিলা সহায়তা কেন্দ্র (Women Help Desk), মানবপাচার রোধী ইউনিট (Anti Human Trafficking Unit)-এর জন্য বাজেটে ঘাটতি রয়েছে।

মহিলাদের প্রতি অপরাধ রোধে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য যোজনা যেমন, One Stop Centre, Women Helpline, Swadhar Greh, Ujjwala, কর্মজীবী মহিলাদের জন্য হোস্টেল-কে গত বছর একসঙ্গে এনে দুটি মিশন ‘সামর্থ্য’ এবং ‘সম্বল’ নামকরণ করা হয়েছিল। সম্বল মূলত মহিলাদের সুরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যোজনার একত্রীকরণ এবং সামর্থ্য হল মহিলাদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত যোজনার একত্রীকরণ। গত বছর সামর্থ্য-র জন্য বাজেট সামান্য বৃদ্ধি পেলেও সম্বল-এর বাজেটের ওপর কোপ পড়েছে।

কাজেই শুধুমাত্র গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধক আইন-ই যথেষ্ট নয়, তাকে বাস্তবায়িত করতে সরকারকে আরও অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে আর তার একটি অন্যতম উদ্যোগ বাজেট নীতিতে এই খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

 

মহিলাকর্মীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা

ভারতবর্ষে ৯০ শতাংশের ওপরে মহিলা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। যার ফলে তাঁরা অধিকাংশ সময়েই কোনওরকম সামাজিক সুরক্ষা জাল (social security net)-এর সুবিধা পান না। অতিমারির সময়ে এই সামাজিক সুরক্ষার যে কী অপরিসীম গুরুত্ব তা অনুভব করা গেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই নানাবিধ স্বাস্থ্যবিমা, সুরক্ষা বিমার আওতায় মূলত প্রথম সারির কর্মী (Frontline Workers) যেমন, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মীদের নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেই সহায়তা ছিল সাময়িক। কেন্দ্র সরকারের ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’র বাজেট প্রায় চারগুণ কমে গেছে ২০২১-২২-এর পরিবর্তিত ব্যয় থেকে ২০২২-২৩-এর আনুমানিক ব্যয়ের মধ্যে।

গত কেন্দ্রীয় বাজেটে ‘জাতীয় সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি’ (National Social Assistance Programmes)-র বাজেট ২০২১-২২-এর থেকে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল, যা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। তবে এই কর্মসূচির অন্তর্গত উল্লেখযোগ্য যোজনা যেমন, ‘ইন্দিরা গান্ধি জাতীয় বিধবা ভাতা যোজনা’ এবং ‘ইন্দিরা গান্ধি জাতীয় প্রতিবন্ধী যোজনা’র জন্য মাসিক ভাতার অঙ্ক হল মাত্র ৩০০ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু পেনশনের হার শুধুমাত্র কমই নয়, বর্ধিত দ্রব্যমূল্যের কথা মাথায় রাখলে দৈনন্দিন সাধারণ জীবনযাপনের জন্য অকিঞ্চিৎকর।

কাজেই শুধুমাত্র পেনশন অঙ্কের বৃদ্ধি নয়, তাকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সূচকের (inflation-indexed) সঙ্গে সংযুক্তিকরণ আবশ্যক।

 

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উন্নয়ন

GRB এখনও ‘পুরুষ এবং মহিলা’ এই দুই লিঙ্গের কাঠামোতেই মূলত সীমাবদ্ধ। তৃতীয় লিঙ্গের পরিসর এখনও সমানভাবে উন্মুক্ত নয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকারি প্রকল্পের সংখ্যাও সীমিত। এমনকি GRB-র অন্যতম কৌশল— লিঙ্গভিত্তিক বাজেট বিবৃতি (GBS)-তে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের উন্নতির জন্য ব্যয়িত সমস্ত খরচের বিবরণ পাওয়া যায় না। যেমন, ভারত সরকার প্রকল্পিত যোজনা ‘প্রান্তিক ব্যক্তির জন্য জীবিকা ও উদ্যোগে সহায়তা’ (Support for Marginalised Individuals for Livelihood and Enterprise, SMILE) মূলত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উন্নয়নে রূপায়িত। কিন্তু GBS-এ আমরা শুধুমাত্র এর একটি উপ-যোজনা (sub-scheme) ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত ব্যক্তির পুনর্বাসন’ (Comprehensive Rehabilitation of Persons Engaged in Begging)-এর উল্লেখ পাই।

আশা করা যেতে পারে যে সরকার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উন্নয়নের প্রতি আরও সচেষ্ট হবে এবং বাজেট নীতিতে তার প্রতিফলন ঘটবে। এই ক্ষেত্রে GBS-এর মধ্যে একটা পৃথক অনুচ্ছেদে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উন্নয়নের জন্য সমস্ত বরাদ্দ এবং খরচকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এক জায়গায় রিপোর্ট করলে তা হবে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

 

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি

এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী ও পুরুষ সম্পর্কে কিছু প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা রয়েছে— যা প্রশ্রয় পায়, লালিত হয়, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই লিঙ্গ-পক্ষপাত দূর করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, আর লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি রূপায়ণের জন্য সরকারি আধিকারিক এবং নীতি-প্রণেতাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ। মহিলা এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি পরিকল্পনা, তার রূপায়ণ এবং বাজেট বরাদ্দ না হলে লিঙ্গবিশেষ সমানাধিকার, মহিলাদের ক্ষমতায়ন তত্ত্ব হয়েই রয়ে যাবে, অভীষ্ট অংশগ্রহণকারীরা (beneficiaries) এর সুফল থেকে বঞ্চিত হবে।

 

আমরা Sustainable Development Goal (SDG)-এর পঞ্চম লক্ষ্য— লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত ১০ বছরে সেই লক্ষ্যে কিছুটা এগোলেও অতিমারি এই লিঙ্গ-ব্যবধান ঘোচাবার সময়কে আরও দীর্ঘায়িত করেছে। তাই কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪-এর থেকে আশা অনেক। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা বাজেট কতটা সেই আশাকে বাস্তবায়িত করল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...