ভগবানের ভবিষ্যৎ

ভগবানের ভবিষ্যৎ | সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়

সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে জোশিমঠ— খবরটা যখন জানতে পারলাম, একটুও অবাক হইনি। একবারের জন্যও প্রশ্ন জাগেনি এরকম কী করে হয়। বরং মনে হচ্ছিল এটা হতে এত দেরি হল কেন? মাউন্ট এভারেস্টের মাথা থেকে বিস্তৃত পাদদেশ পর্যন্ত হিমালয় পর্বতমালাকে যেভাবে উন্নয়নের পরীক্ষাগার বানিয়ে তোলা হয়েছে তাতে অনেক আগেই এ ঘটনা ঘটার কথা ছিল।

আমার প্রতি কিঞ্চিৎ সদয় হওয়ায় হিমালয়ের একটু-আধটু পাদস্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এখন সেভাবে যেতে না পারলেও কোথাও একটা টান অনুভব করি। বিস্তর প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে দুর্গম পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বেঁচে থাকা নির্বিরোধী মানুষগুলোর কষ্টের কথা জানলে বুকটা চিনচিন করে ওঠে। পাহাড়ের রুক্ষ পাথর ফাটিয়ে তার থেকে রস নিংড়ে শস্যবীজের মুখে ঢালে এই মানুষগুলো। দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষগুলোর একচিলতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তাও ভাগ করে নিতে হয় গবাদি পশুর সঙ্গে। শরীরের রক্ত জমিয়ে পাথর করে দেওয়া ঠান্ডা হাওয়া থেকে বাঁচতে কতগুলো কাঠের পাটাতন পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে কোনওরকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে পাহাড়ের মানুষ। তাদের কোনও অনুযোগ নেই। প্রকৃতিকে বিপন্ন করে, নদীর মুখ রুখে দিয়ে উন্নয়ন দাবি করেছে পাহাড়ের মানুষ— এমন প্রমাণ খুব একটা মেলে না। নিস্তব্ধ, ধ্যানমগ্ন, সবুজ বনানীঘেরা পাহাড়ের বুকে ভারি ভারি যন্ত্রের বেমানান শব্দে শান্তি বিঘ্নিত হয় পাহাড়ের বাসিন্দাদের। ক্ষোভে ফেটে পড়ার মতো বারুদও তাদের বুকে নেই। এতটাই শান্তিপ্রিয়, কষ্টসহিষ্ণু এই সহজ সরল পাহাড়ি মানুষগুলো।

কিছুদিন আগে খবর পাওয়া গিয়েছিল ধৌলিগঙ্গার হড়পা বানে খড়কুটোর মতো তলিয়ে গিয়েছে নদীর উপর তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। সব হারিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন রেনি গ্রামের গাড়োয়ালি মানুষের দল। রেনি সেই গ্রাম, যে গ্রামের মানুষ গাছ কেটে প্রকৃতি নষ্ট করার বিরোধিতা করেছিল। গাছকে সন্তানের মতো জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ আন্দোলন চালিয়েছিল। প্রকৃতি বাঁচানোর এই আন্দোলন ‘চিপকো আন্দোলন’ নামে স্থান পায় ইতিহাসের পাতায়।

জোশিমঠের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা পড়তে পড়তে জনপদটির ভবিষ্যতের কিছু ছবি চোখে ভেসে উঠল। সেবার যাচ্ছিলাম আদি কৈলাস। দিনছয়েকের হাঁটা পথ। পথে দেখা হয়েছিল একটি জনশূন্য গ্রামের সঙ্গে। এখনও তাকে গ্রাম বলা চলে কারণ বেশ কয়েকটি বাড়ি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অসাধারণ সেসব বাড়ির নির্মাণ। খুব উঁচুমানের কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়িগুলোর পরতে পরতে রয়েছে নিখুঁত কারুকাজ। আধখোলা দরজা, আধখানা ভেঙে যাওয়া জানলার কোটরে লুকিয়ে আছে কোনও এক সময়ের সমৃদ্ধির ইতিহাস। কিন্তু আজ সেখানে কোনও মানুষ বাস করে না। গ্রামটির নাম গার্বেয়াং। পথচলতি কিছু যাত্রীর বিশ্রামের ব্যবস্থা আর চা-জলখাবার বিক্রির জন্য কয়েকটি পরিবার অস্থায়ীভাবে থাকে মাসখানেক, তাও একরাশ অনিশ্চয়তা সঙ্গে নিয়ে। ভূবিজ্ঞানীদের নিদান অনুযায়ী এটি একটি সিঙ্কিং ভিলেজ বা ডুবন্ত গ্রাম। এ গ্রামের সমস্ত মানুষ তাদের বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে থেকে উৎখাত হয়েছেন সরকারি নির্দেশে। বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে ভূগর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম গার্বেয়াং। ভূবিজ্ঞানীরা বলেন হিমালয় প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত ও পরিণত হচ্ছে। প্রকৃতির পরিবর্তমান সন্তান এই হিমালয়। ভূপ্রকৃতির পরিবর্তনের জেরে, একটি অঞ্চল নিশ্চিহ্ন হয়ে নতুন আকার ও রূপ ধারণ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা সুপ্রাচীন জনপদের হঠাৎই হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার ঘর-বসতি, মন্দির, পুরনা রাস্তায় ফাটল ধরে যাওয়া শুধু উদ্বেগের নয় বড় কষ্টের। কিন্তু কেন হল এত বড় বিপর্যয়? খুঁজতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক শতাব্দী।

অদ্বৈত বেদান্তের পথ ধরে জগৎগুরু শঙ্করাচার্য সনাতন হিন্দু ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে লাগেন। ভারতভূমির চার প্রান্তে নির্মাণ করেন “চতুর্মঠ” (চারটি মঠ)। যার মধ্যে উত্তরের মঠটি প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমান উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার জোশিমঠে। সময়কাল ৮ম শতাব্দী। এ মঠের নাম হয় জ্যোতির্মঠ। অন্য একটি মত অনুযায়ী জ্যোতির্মঠের প্রতিষ্ঠার পর ওই জনপদের নাম হয় জোশিমঠ। ক্রমশ ধর্মগুরু ও তীর্থযাত্রীদের সূত্র ধরে দুর্গম পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট এই পবিত্র জনপদের সন্ধান পৌঁছে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে। হিমালয়কে জানতে, ভারতীয় দর্শনকে বুঝতে গোটা পৃথিবীর মানুষ এসেছে ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে। তাদের মনে ছিল অদম্য কৌতূহল। সংযমী সুঠাম শরীরে ছিল মাইলের পর মাইল পাহাড়ি পথ হেঁটে চলার অসীম ক্ষমতা। জ্যোতির্মঠ গড়ে ওঠার পর থেকে হিমালয়ের এই অংশে যাতায়াত করতে শুরু করেন উৎসুক সন্ধানী মানুষ। জোশিমঠের অনতিদূরে বিষ্ণুপ্রয়াগে ধৌলিগঙ্গা আর অলকানন্দা দুই নদীর সঙ্গম। এটি হিমালয়ের বিখ্যাত পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম। প্রয়াগ শব্দের অর্থই নদীর মিলনক্ষেত্র। কথিত আছে এই বিষ্ণুপ্রয়াগেই নারদ মুনিকে দর্শন দিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু। দুই নদীর মিলনের এই মনোরম ক্ষেত্র এখন হিমালয়ে বেড়াতে আসা মানুষের অন্যতম দ্রষ্টব্য। আর বিষ্ণুভক্ত তীর্থযাত্রীদের পুণ্যক্ষেত্র। স্থানীয় ইতিহাস বলে বিষ্ণুপ্রয়াগের কাছাকাছি দুর্বার গতিতে ছুটে চলা অলকানন্দার হিমশীতল স্রোতের মধ্যে আদিগুরু শঙ্করাচার্য খুঁজে পেয়েছিলেন এক বিষ্ণুমূর্তি।

আদি শঙ্করাচার্য যখন জ্যোতির্মঠ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন হিমালয়ের এই অংশের সমস্ত ক্ষেত্র জুড়ে বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্য বিস্তৃত। ভৌগোলিক অবস্থান অবশ্যই এর অন্যতম কারণ। প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া সনাতন হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পামার রাজাদের সাহায্য নিলেন শঙ্করাচার্য। লোকগাথা বলে অলকানন্দার বুক থেকে খুঁজে পাওয়া বিষ্ণুমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে তিনি চলে আসেন ভারত-তিব্বত সীমান্তের এক জনপদে। ক্ষিপ্র অলকানন্দার তীরে তপ্তকুণ্ড পরিবেষ্টিত এই জনপদের চারিদিকে রয়েছে বরফের পাহাড়। বছরে ছমাস তুষারাবৃত হয়ে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকে এই জনপদ। নীলকণ্ঠ পাহাড়ের কোলে নানা রঙে রঞ্জিত এক মন্দিরে বিষ্ণুমূর্তি স্থাপন করলেন আদিগুরু। ভারতের বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের মতে এই মন্দিরের শিল্পকলা, নির্মাণশৈলীতে বৌদ্ধবিহারের (মনাস্ট্রি) ছাপ সুস্পষ্ট। বদ্রি বা কুলগাছের প্রাচুর্য এই জনপদকে বদ্রিনাথ নামে চিহ্নিত করে। বদ্রিনাথের মন্দিরে অধিষ্ঠিত ভগবান বিষ্ণু পরিচিত হন বদ্রিনারায়ণ রূপে। তৈলাক্ত কষ্টিপাথরের এই বিশাল মূর্তি ভক্তকুলের জয়ধ্বনিতে হয়ে ওঠেন বদ্রিবিশাল। ভগবান বিষ্ণুর মহিমা প্রচারিত হতে হতে বদ্রিনাথ হয়ে ওঠে বদ্রিনাথ ধাম।

জীবনের বিভিন্ন সময়ে বার তিনেক যাওয়ার সুযোগ হয়েছে বদ্রিনাথ। বয়সের সঙ্গে দেখার চোখ, উপলব্ধির মন বদলেছে ঠিকই কিন্তু বদল চোখে পড়েছে বড় নির্মমভাবে। প্রথম যখন বদ্রিনাথ যাই তখন আমার বয়স বছর তেরো। হরিদ্বার থেকে বাসে করে গিয়েছিলাম কেদার-বদ্রি। ওই বয়সে জানলার ধারে বসার জন্য ছিল স্বাভাবিক আগ্রহ। মনে পড়ে রাস্তা এতটাই দুর্গম ছিল যে বাসের চালক, সহায়করা কোনও বাচ্চাকে জানলার ধারে বসার অনুমতি দেয়নি। বাবার কাছে গল্প শুনেছিলাম বদ্রিনাথ যাওয়ার রাস্তা এত সরু ছিল যে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে বাসের একটি চাকা প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় থাকত। অলকানন্দার তীব্র গর্জনে পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা যেত না, বোল্ডারে ছিটকে আসা জল গায়ে এসে লাগত। তপ্তকুণ্ডে স্নান করে বদ্রিনাথের মন্দির দর্শনের জন্য খুব একটা কসরত করতে হয়নি।

দ্বিতীয়বার যখন যাই তখন আমি বছর পঁয়ত্রিশ। অলকানন্দার তীরে বেশ চওড়া রাস্তা। পাশাপাশি দুটো গাড়ি অনায়াসে যেতে পারে। তবে জায়গায় জায়গায় সতর্কবাণী চোখে পড়েছিল— ধসপ্রবণ এলাকা। সেবার বদ্রিনারায়ণ মন্দিরের ভক্তের লাইন চলে গিয়েছিল কয়েক কিলোমিটার। ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় সেবার আর বদ্রিবিশালের দর্শন মেলেনি।

বসুধারা জলপ্রপাত দেখার উদ্দেশ্যে কয়েকবছর পর আবার গিয়েছিলাম বদ্রিনাথ। সেসময় অলকানন্দাকে দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল। যে নদীর গর্জনে মিলিয়ে যেত মানুষের কথার আওয়াজ, সে নদীটার গলা টিপে তার গর্জনই বন্ধ করে দিয়েছে মানুষ। সমস্ত নদীখাত জুড়ে ছোট ছোট টিলার সমান বোল্ডার। গায়ে তাদের রকমারি আলপনা। যে আলপনা সযত্নে তাদের গায়ে এঁকে দিয়েছে বছরের পর বছর বয়ে চলা নদীর অবিরাম স্রোত। চিকচিকে বালির মাঝে এক বুক হতাশা নিয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছড়িয়ে আছে ছোট বড় হাজার হাজার বোল্ডার। শুনেছিলাম জোশিমঠের আশেপাশে বাঁধ দিয়ে রুখে দেওয়া হয়েছে অলকানন্দার মতো খরস্রোতা নদীর স্রোত। প্রমাদ গুনেছিলাম সেদিন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই অসম লড়াই নিজের খেয়ালে চলা প্রকৃতি মেনে নেবে কি?

জোশিমঠ তথা বদ্রিক্ষেত্রে হিমালয়প্রেমী মানুষের আনাগোনা কয়েক শতাব্দী ধরে। কয়েক প্রজন্ম ধরে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের গাড়োয়ালি বাসিন্দারা সেই সব হিমালয়প্রেমীদের বিভিন্নরকম পরিষেবা দিয়েছে। কখনও আশ্রয় দিয়ে, পথপ্রদর্শক হয়ে, কখনও বা মালবাহক হিসাবে। নিজেদের মতো করে বেঁচে ছিল এই পাহাড়ি মানুষের দল, যাদের সবিশেষ উন্নয়ন হয়নি। উন্নয়নের প্রয়োজন তো ছিলই। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের প্রয়োজন, চাষাভুষো মানুষগুলোর বেচাকেনার জন্য বাজারের প্রয়োজন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজন স্কুলকলেজ। আর যাতায়াতের জন্য রাস্তার। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। পাহাড়ের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিদ্যুৎ– তারও প্রয়োজন ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সেজন্য এমন সর্বগ্রাসী রাক্ষুসে প্রকল্পের কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? পাহাড়টাকে ভেঙে ফাটিয়ে তার ভিতরকার নিজস্ব সম্পদ লুঠপাট করে তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুৎ মেগাওয়াটের পর মেগাওয়াট। এই আত্মঘাতী উন্নয়নের কি সত্যিই প্রয়োজন এই মানুষগুলোর?

হিমালয় পর্বতের সমস্ত শরীরটা ডিনামাইটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তার দগদগে ঘা। দার্জিলিং থেকে মেঘালয়, গাড়োয়াল থেকে কুমায়ুন, উত্তরাখণ্ড থেকে হিমাচলপ্রদেশ— কোথাও এমন জায়গা নেই, যেখানে হিমালয়ের রক্ত ঝরে না। আবহমানকাল ধরে ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির ঐতিহ্য বুকে করে আগলে রাখার পুরস্কার এই রক্ত। উন্নয়নের ধ্বজাধারী, অহঙ্কারী, অর্থলোলুপ মানুষের দল গিরিরাজের উন্নত শির টেনে নামাতে চায় নিজেদের পায়ের তলায়। সে কি স্থানীয় বাসিন্দাদের উন্নতির জন্য? তা বোধহয় নয়। এসব কিছু প্রয়োজন সেইসব মানুষের যারা হিমালয়প্রেমী নয়, শুধুমাত্র, হিমালয়ে বেড়াতে আসে। আর এই বেড়াতে আসা মানুষগুলোর শখ, স্বাচ্ছন্দ্য পূরণের পসরা সাজিয়ে রাখে একদল ব্যবসায়ী। এ উন্নয়ন তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করে প্রকৃতির ধ্বংসের বিনিময়ে। পাহাড়ের নিসর্গ উপভোগ করার থেকেও পাহাড়ি জনপদে সমতলের স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে বেড়ানো ‘ট্যুরিস্ট’-এর সংখ্যা এখন অনেক বেশি। বারান্দায় বসে ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতে দিতে দুই নদীর সঙ্গম দেখতে চায়  এই ট্যুরিস্টরা। ‘ভিউ’ তৈরি করার জন্য বহতা নদীর সাময়িক শুকিয়ে যাওয়া খাতে বহুতল বিলাসবহুল হোটেল গজিয়ে ওঠে। নদীর স্রোত অবাক হয়ে দেখে কেমন করে রুদ্ধ হয়ে যায় তার সাবলীল গতিতে ছুটে চলার পথখানা। অসহনীয় ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে নদীখাতের নরম মাটি। সে যে জলের ভার বওয়ার জন্য তৈরি। টন টন কংক্রিটের ভারে তার সমস্ত শরীর ব্যথায় টনটন করে। প্রত্যন্ত হিমালয়কে চিনতে নয়, হিমালয়ের দুর্গম পথে হেঁটে— ‘কিছু করে দেখানোর’ অহঙ্কার নিয়ে আসে শখের ট্রেকাররা, যাদের হিমালয়কে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা বা প্রশিক্ষণ কোনওটাই নেই।

জোশিমঠ এমনই এক জনপদ যেখানে সাময়িক আস্তানা গাড়ে ধর্মগুরু এবং ভক্তের দল, পরিবার নিয়ে আউলি, নন্দাদেবীর জঙ্গল দেখতে আসা সাধারণ পর্যটক, পিঠে স্যাক নিয়ে কুমারী পাস, কাকভূষুণ্ডিতাল, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার, হেমকুণ্ড যাওয়ার ট্রেকাররা। তাই হরেক কিসিমের নজরানা সাজিয়ে রাখতে হয় জোশিমঠকে। নদীর তীরে আকর্ষণীয় তাঁবু থেকে, স্থানীয় মানুষের কম খরচের হোমস্টে। মধ্যবিত্ত ভক্তদের জন্য সাধারণ মানের হোটেল থেকে উচ্চবিত্ত তীর্থযাত্রীর জন্য বিলাসবহুল বহুতল। হরিহরের ভক্তদের চারধাম যাত্রা সুখপ্রদ করার জন্য প্রায় সমতলের হাইওয়ের মতো ফোর লেন রাস্তা খুব জরুরি। ছোট থেকে বড়, দেশি-বিদেশি সব ধরনের গাড়ি চড়ে আরাম করে গিয়ে যাতে ভক্তরা তাদের ভগবানের চরণস্পর্শ করতে পারেন। বদ্রিনাথের রাস্তায় ধস নেমে পর্যটকরা বিপদে পড়েছেন এমন খবর হামেশাই পাওয়া যায়। পরিবেশবিদদের সমস্ত সতর্কবার্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জলবিদ্যুৎ নির্মাণসংস্থাগুলো পাহাড় কেটে চলেছে নিরন্তর। নির্মাণের আড়ালে ছোবল মেরেছে প্রকৃতির বুকে। উন্নয়নের নামে এই সার্কাসের রিংমাস্টারের অঙ্গুলিহেলনে আজ জোকারের মতো সর্বস্ব খোয়াতে বসেছে সেই মানুষগুলো, যাদের শিকড় গাঁথা আছে এই পাহাড়ের প্রতিটি পাথরের খাঁজে। এ কি শুধুই প্রয়োজন না আস্ফালন!! একে বোধহয় উন্নয়ন না বলে আত্মহনন বলা উচিত।

তবে এমনটা যে হবে সে কথা সবার জানা ছিল। পরিবেশবিদ থেকে ভূপর্যটক, ইঞ্জিনিয়ার থেকে রাজনৈতিক নেতা— সবার। শুধু এদেরই নয়। মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া ইতিহাস বলে, হিমালয়ের এই অঙ্গনে যুগ যুগ ধরে বাস করে আসা মানুষের জানা ছিল এই বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী। এমনকি সেই সময়েও জানা ছিল, যখন প্রকৃতির গায়ে আঁচড় কাটার কথা মানুষ স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। ধ্বংস যে একদিন হবে সে কথা জানা ছিল বটে, কিন্তু জানা ছিল না ধ্বংসের পরে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনও উপায়। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে ভগবানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। এ কথা বুঝেছিলেন সে যুগের প্রকৃতিশিক্ষায় পণ্ডিত মানুষগুলো।

বদ্রিনাথ ছাড়া বদ্রিক্ষেত্রে আরও ছটি বিষ্ণুমন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে নারায়ণ স্বয়ং অধিষ্ঠান করেন বলে ভক্তকুলের বিশ্বাস। আদি বদ্রি, বৃদ্ধ বদ্রি, যোগধ্যান বদ্রি, অর্ধ বদ্রি, ধ্যান বদ্রি, ভবিষ্য বদ্রি। বদ্রিক্ষেত্রের এই সাতটি মন্দির একত্রে সপ্তবদ্রি নামে পরিচিত। এর মধ্যে ভবিষ্য বদ্রি জোশিমঠ থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে সুবেইনে অবস্থিত। ভবিষ্য বদ্রি মন্দিরের ইতিহাস বড়ই চিত্তাকর্ষক। লোকগাথা অনুযায়ী বদ্রিবিশালকে বিষ্ণুপ্রয়াগ ক্ষেত্র থেকে তুলে যখন বদ্রিনাথের দিকে পাড়ি দিলেন আদিগুরু, তখন তাঁকে বদ্রিনাথের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া হয়। বলা হয় বিষ্ণুপ্রয়াগের পাটমিলা অঞ্চলে ভূমিধসের জন্য জয় বিজয় পাহাড়দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং বদ্রিনাথে পৌঁছানোর রাস্তা চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। এরপর ভগবান বিষ্ণু এই বদ্রিক্ষেত্রেই বিরাজ করবেন যাকে আজ বদ্রিনারায়ণের ভবিষ্যৎ বা ভবিষ্য বদ্রি বলে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। সেখানে বানিয়েও রাখা হয়েছে ছোট্ট একটি গ্রাম্য মন্দির। এই মন্দিরে এখন একটি নরসিংহ মূর্তি আছে। ঘন জঙ্গলের পথে প্রায় তিন-সাড়ে তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পৌঁছতে হয় সে মন্দিরে। ভক্তদের বিশ্বাস এই নরসিংহ দমনেই ভগবান বিষ্ণু প্রকট হবেন এই মন্দিরে এবং বিরাজ করবেন ভবিষ্যতের বদ্রিনাথ রূপে। এই মন্দিরের পাথরের দেওয়ালে ফুটে উঠবে ভগবান বিষ্ণুর আগমনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন।

প্রকৃতির মগ্ন উপাসকরা এই মহাজাগতিক ঘটনাকে একটি যুগের সমাপতন হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতিকে নিজের করায়ত্ত করার উদ্যাম নেশায় মত্ত মানুষ সে নির্ঘন্টের পরোয়া করেনি। বেপরোয়া উন্মত্ততা এলোমেলো করে দিল প্রকৃতির কোলে জন্ম নেওয়া মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ। সদ্যোজাত শিশুকে কোলে নিয়ে ভিটেহারা হলেন মা। সময়ের অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসল সুপ্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী এক জনপদ। মানুষের তৈরি মন্দিরে হয়তো সুরক্ষিত থাকবেন তাদের হৃদয়ের দেবতা। হাজারো তীর্থযাত্রীর জয়ধ্বনি হয়তো আবার প্রতিধ্বনিত হবে নতুন এক তীর্থধামের আঙিনায়। স্বজনহারানো, স্বভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন, জীবনের সুতো ছিঁড়ে যাওয়া মানুষগুলোর হৃদয়ে ভগবানের অবস্থান একইরকম মজবুত থাকবে তো! এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় শুধু ভবিষ্যৎই দিতে পারবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...