রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর বস্তুবাদ চর্চা

শুভেন্দু সরকার

 



ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, গবেষক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

বস্তুবাদ সম্পর্কে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (১৯৪৭-২০২২)-র আগ্রহ জেগেছিল মার্কসবাদ চর্চার সূত্রে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে যে মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা গড়ে উঠেছে, সেখানে শ্রেণিহীন সমাজ, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ইত্যাদির ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু ঘটনা হল, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার করলে বোঝা যাবে, বস্তুবাদের সঙ্গে সেসবের যোগ গড়ে উঠেছে অনেক পরে। জড়জগৎ পেরিয়ে পরিবর্তন ও খেটে-খাওয়া মানুষের দিক দিয়ে সমাজ ও রাজনীতির দুনিয়াকে বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দেখতে সময় লেগেছে বিস্তর। এছাড়া, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারায় দেখা গেছে নানা পর্ব। তাই বস্তুবাদকে সামগ্রিকভাবে মার্কসীয় বস্তুবাদের নিরিখে দেখলে ভুল হবে। প্রাচীনকাল থেকে উনিশ শতক অব্দি বস্তুবাদী দর্শনের বিবর্তনকে বিশ্লেষণ করলেই বরং মার্কস (ও এঙ্গেলস)-এর অবদান ও তার প্রেক্ষাপট বোঝা যায় সঠিকভাবে। কীভাবে একটা নির্দিষ্ট কালে অনেকগুলি ধারা মার্কসবাদে এসে মিলল আর তা হয়ে উঠল সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার— তা বিচার করাই ছিল রামকৃষ্ণবাবুর উদ্দেশ্য। সঠিকভাবে বললে, বস্তুবাদের বিবর্তন আর সেইসঙ্গে মার্কসবাদের উদ্ভবকে তিনি দেখেছেন ঐতিহাসিকভাবে; একইসঙ্গে বিচার করেছেন বৈজ্ঞানিক চেতনা ও শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সম্পর্ক।

রামকৃষ্ণবাবু মনে করিয়েছেন, ভাববাদের মতো প্রাচীনকালের বস্তুবাদী দর্শনও— সে গ্রিসের হোক বা ভারতের— গড়ে উঠেছিল পরজীবী শাসকশ্রেণির হাতে। খেটে-খাওয়া মানুষের সঙ্গে দার্শনিক বাদ-প্রতিবাদের কোনও যোগ ছিল না। পরবর্তীকালে, তেরো থেকে সতেরো শতকের মধ্যে ইওরোপে যে বস্তুবাদের নতুন অধ্যায় দেখা দিল তখনও এই ধারার হেরফের হয়নি। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬)— যাঁকে নির্দ্বিধায় ইংরেজ বস্তুবাদ ও সমস্ত আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়— জোর দেন প্রত্যক্ষভিত্তিক জ্ঞানের ওপর, গড়ে তোলেন আরোহী তর্কবিদ্যা, কিন্তু জনগণের মুক্তি নিয়ে তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। অভিজাত বংশের মানুষ বেকন রাজদরবারের কাজে যোগ দিয়েছিলেন রানি এলিজাবেথের আমলে; লর্ড চ্যান্সেলর হয়েছিলেন রাজা প্রথম জেম্‌সের কালে। ধর্ম সম্বন্ধে বেকনের শ্রদ্ধা ছিল না-থাকলেও মনে রাখা দরকার, কোপার্নিকাস-গালিলেও-র সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব তাঁর সমর্থন পায়নি। অথচ বেকন-কেই ‘বস্তুবাদের প্রথম স্রষ্টা’-র মর্যাদা দেন মার্কস। সহজেই স্পষ্ট হয়ে যায়, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ব্যক্তির খামতি নয়, বরং তার প্রগতিশীল ভূমিকাকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন মার্কস।

ফ্রান্সিস বেকনের বস্তুবাদকে প্রণালীবদ্ধ করেন টমাস হব্‌স্‌ (১৫৮৮-১৬৭৯)। কিন্তু রাজনীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন খোলাখুলিভাবে রাজতন্ত্রী। জনসাধারণকে দাবিয়ে রাখতে রাজাকে একচেটিয়া ক্ষমতা দিতে চেয়েছেন হব্‌স্‌।

বেকনের ইন্দ্রিয়গত জ্ঞানের ধারণা জন লক্‌ (১৬৩২-১৭০৪)-ও এগিয়ে নিয়ে যান। হবসের মতো তিনি সরাসরি রাজতন্ত্রর পক্ষে দাঁড়াননি ঠিকই, এমনকি, মানুষের ‘স্বাভাবিক অধিকার’ নিয়েও সোচ্চার হয়েছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ছিল লক্‌-এর চিন্তাভাবনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সতেরো শতকে ইংল্যান্ডের উঠ্‌তি বুর্জোয়াশ্রেণি ধর্মদ্রোহী বস্তুবাদী দর্শনকে মনে করত সামন্ত-অভিজাত সম্প্রদায়ের দর্শন। তাই তারা ঝুঁকেছিল প্রটেস্টান্ট অন্দোলনের দিকে।

সতেরো শতকে ফ্রান্সে রনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০)-এর হাত ধরে প্রকৃতিবিজ্ঞানের সঙ্গে বস্তুবাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, দেকার্তের মধ্যে দেখা দেয় চরম স্ববিরোধিতা— পদার্থবিদ্যা ও শারীরবিদ্যা নিয়ে গবেষণায় তিনি খাঁটি বস্তুবাদী, অন্যদিকে, তাঁর অধিবিদ্যামূলক ধ্যানধারণায় জায়গা পেয়েছিল অশরীরী আত্মার মতো নিখাদ ভাববাদী উপাদান। সুতরাং নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে, সতেরো-আঠেরো শতকে দেকার্ত-প্রভাবিত ফরাসি বস্তুবাদী ধারা ছিল প্রকৃতিবিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মানবসমাজ ও তার গতিপ্রকৃতি নিয়ে তা সম্পূর্ণ নীরব থেকেছে। আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) ছিলেন এই ধারার অনুসারী।

উল্টোদিকে, লক্‌-প্রভাবিত ফরাসি বস্তুবাদী ঘরানায় গুরুত্ব পেল সামাজিক জীবন ও নৈতিকতার প্রশ্ন। বলা হলো, নিরীশ্বরবাদ অসম্মানজনক ব্যাপার নয়, বরং কুসংস্কার ও মূর্তিপুজোই মানুষকে অধঃপতিত করে। দ্যনি দিরেরো (১৭১৩-৮৪) প্রমুখ দীপায়ন যুগের দার্শনিকরা তাঁদের সমালোচনা স্রেফ ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আটকে রাখলেন না, তৎকালীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকেও যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করলেন। দেববাদ (ডিইজিম)-এর এলাকা পেরিয়ে বস্তুবাদ তখন খোলাখুলিভাবে নিরীশ্বরবাদকে গ্রহণ করল। সতেরো শতকে ইংল্যান্ডে বস্তুবাদ হয়ে উঠেছিল অভিজাতদের দর্শন। কিন্তু আঠেরো শতকে ফ্রান্সে বিপ্লবের ফলে অভিজাততন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রর বিরুদ্ধে বুর্জোয়াশ্রেণির পরিপূর্ণ বিজয়ের সময় বস্তুবাদ গণতন্ত্রীদের দর্শন হয়ে দাঁড়াল। আগের তুলনায় বিপ্লবী চরিত্রে দেখা দিলেও বস্তুবাদের সঙ্গে সমাজবাদ ও কমিউনিজমের যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি আঠেরো শতকে।

খেয়াল রাখা দরকার, আঠেরো শতকের বস্তুবাদ ছিল একবারে যান্ত্রিক— জগৎ-প্রকৃতি ও মানুষের দেহমনকে একই ধাঁচের যন্ত্র বলে ধরা হয়েছিল সেখানে। সে-সময়ে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা নেহাতই অনুন্নত; প্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির জোগান দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়নি সেসবের। তাই দ্বান্দ্বিক তথা পরিবর্তনশীলতার ধারণা আঠেরো শতকে আশা করা ভুল। তবু দীপায়ন যুগের চিন্তাবিদ্‌রা ছিলেন বিপ্লবী। বেশিরভাগের জন্ম অভিজাত বংশে হলেও তাঁদের দর্শন সমাজে প্রগতিশীল ভূমিকা নেয়। গির্জা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁরা চালিয়েছেন আপসহীন লড়াই।

দেখা যাচ্ছে, প্রথমে বস্তুবাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল অভিজাততন্ত্র ও/বা রাজতন্ত্রর সঙ্গে, পরবর্তীকালে বুর্জোয়াশ্রেণি সেই জায়গা দখল নিল। বস্তুবাদের সঙ্গে সমাজবাদ ও কমিউনিজমের যোগ আদতে ঘটে অনেক পরে— আঠেরো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের গোড়ায়। এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য:

মূর্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের পটভূতিতে রাখলে বোঝা যায়: জন্মলগ্ন থেকেই আধুনিক বস্তুবাদের লড়াই ছিল অলৌকিকতা ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলি গোড়ায় ওঠেইনি। দর্শন আর রাজনীতি তখনও একতালে পা ফেলত না। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ক্রমেই দুটি প্রধান শ্রেণি: বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত— এই দুই-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠল। গেওর্গ লুকাচ (১৮৮৫-১৯৭১) একবার বলেছিলেন: পুঁজিবাদের আগের যুগে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত-এর মতো দুটি ‘বিশুদ্ধ শ্রেণি’ তৈরি হয়নি। নানা ধরনের জটিল ও নিহিত সম্পর্ক সে যুগে সক্রিয় থাকে। তাই শ্রেণিচেতনাকে ঢেকে রাখে সামাজিক অবস্থান বা স্টেটাস-গঠিত চেতনা। আমাদের দেশে জাতপাত যেমন শ্রেণিচেতনা গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে আছে, ইওরোপেও তেমনি গোটা মধ্যযুগ জুড়ে অলিখিত জাতপাত গড়ে উঠেছিল। তার নাম স্টেটাস। হয়ত এই ঐতিহাসিক সত্যর আলোয় বলা যায়: শ্রেণিসংগ্রাম দুটি প্রধান শ্রেণির মধ্যে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলেই দর্শনের জগতে বস্তুবাদ ও ভাববাদ-এর দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট রূপ নিল; ভাববাদ আর ধর্ম আশ্রয় নিল এক শিবিরে, বস্তুবাদ আর বিজ্ঞান যোগ দিল অন্য শিবিরে। (পৃ. ৩৬-৩৭)

যুক্তিকে সম্বল করে অভিজাতদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক লড়াইয়ে দীপায়ন যুগের মনীষীরা হাজির করেছিলেন মানবমুক্তির এক বৈপ্লবিক দর্শন। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের পর ক্রমশ বোঝা গেল, সেসব অধর্মীয় ও যুক্তিপ্রধান ধ্যানধারণা শেষ অব্দি বুর্জোয়াশ্রেণির কাজে লাগছে। বুর্জোয়াদের সঙ্গে মিলে শহর ও গ্রামের গরিব খেটে-খাওয়া জনগণের আঁতাতে যে তৃতীয় এস্টেট গড়ে উঠেছিল, পরে তা ভেঙে গেল। তৈরি হল শোষক আর শোষিতের পরস্পরবিরোধী দুটি শ্রেণি।

ফরাসি বিপ্লবের আশাভঙ্গের পর দেখা দিয়েছিলেন ইউটোপীয় সমাজবাদীরা। কিন্তু লক্ষ করার ব্যাপার, কোনও বিশেষ শ্রেণি নয়, দীপায়ন যুগের দার্শনিকদের মতো স্যাঁ সিমঁ, শার্ল ফুরিএ, রবার্ট আওয়েন-ও চাইতেন গোটা মানবজাতির মুক্তি। যুক্তি ও ন্যায়বিচারের ওপর নির্ভরশীল তাঁদের ঈপ্সিত সমাজ অবশ্য কল্পনার জগতেই থাকল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ (যেমন আওয়েন) দৃষ্টান্ত হিসেবে আবার কৃত্রিমভাবে গড়ে তুলতে চাইলেন আদর্শ সমাজবাদী উপনিবেশ। এটি ছিল সমাজবাদের মননগত ধারা। কিন্তু ভুললে চলবে না, বাস্তবে বহাল শোষণভিত্তিক বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থাকে তাঁরা কখনওই মেনে নেননি। এখানেই ইউটোপীয় সমাজবাদীদের বিপ্লবী চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। রামকৃষ্ণবাবু সঠিকভাবেই এই বিষয়টি নজর করেছেন:

ঐতিহাসিক বিচারের ধারায় যে-সর্বহারা শ্রেণি ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে ইউটোপীয় সমাজবাদীরা তার স্বার্থর প্রতিনিধি হয়ে দেখা দেননি। তবু দীপায়ন পর্বর দার্শনিকদের নীতির ওপর যে-বুর্জোয়া জগৎ গড়ে উঠেছিল ইউটোপীয় সমাজবাদীরা সেটিকে অযৌক্তিক ও অন্যায় বলে মনে করতেন। (পৃ. ৪০)

দ্বান্দ্বিক-এর ধারণা প্রাচীনকাল থেকেই নজরে আসে। কিন্তু উনিশ শতকে জার্মানিতে তা নতুনভাবে ফিরে এল গেওর্গ হেগেল (১৭৭০-১৮৩১)-এর হাত ধরে। প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গতি ও/বা পরিবর্তনের ধারণা তার আগেই এসেছিল কিন্তু ঐতিহাসিক ও মননগত গোটা জগৎকে দ্বান্দ্বিকতার নিরিখে প্রথম হাজির করলেন হেগেল। অথচ তিনি ছিলেন রাজনৈতিক দিক দিয়ে রক্ষণশীল, দার্শনিক অবস্থানে ভাববাদী।

দেখার ব্যাপার, এই দ্বান্দ্বিক-এর ধারণাই পরবর্তীককালে মানবজগতে প্রয়োগ করা হল অন্যভাবে। এর পেছনে নিঃসন্দেহে কাজ করেছিল চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২)-এর অভিব্যক্তিবাদ। উৎপত্তি, বিবর্তন আর পরিণতির ধারণা ভূতত্ত্ব ও জীববিজ্ঞানের সীমানা পেরিয়ে ক্রমে প্রভাব ফেলল ইতিহাস থেকে রাজনীতি ও অর্থনীতির দুনিয়ায়। হেগেলের সময় এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঘটেনি; কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) সেটি পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের উদ্ভবকে রামকৃষ্ণবাবু দেখেছেন সঠিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে। ব্যক্তির ভূমিকাকে দেশ-কাল-পরিস্থিতির মাপকাঠিতে বিচার করাই যুক্তিসঙ্গত।

মার্কস-এর হাতেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ-এর পত্তন হল কেন? স্যাঁ-সিমঁ বা হেগেল কি মার্কস-এর চেয়ে কম বুদ্ধিমান বা কম বিদ্বান ছিলেন? এঙ্গেলস দেখিয়েছেন: এর জন্যেও এক ঐতিহাসিক পরিবেশের দরকার ছিল। আঠেরো শতকের শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিবিজ্ঞান ছিল প্রধানত তথ্য সংগ্রহর বিজ্ঞান, তৈরি জিনিসের বিজ্ঞান। উনিশ শতকে এসে এটি হল একান্তভাবেই প্রণালীবদ্ধ করার বিজ্ঞান; সেই সব জিনিসের প্রক্রিয়া, তাদের উৎপত্তি ও বিকাশ, এবং যে আন্তঃসম্পর্ক এইসব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে এক বিরাট সমগ্রতায় বেঁধে রেখেছে তার বিজ্ঞান। এ-যুগের তিনটি বিরাট আবিষ্কার ছিল: (ক) গাছপালা ও জীবদেহ-র একক হিসেবে কোষ, (খ) শক্তির রূপান্তর, আর (গ) ডারউইন-এর অভিব্যক্তিবাদ। স্যাঁ-সিমঁ বা হেগেল-এর সময়ে এর কোনওটিই জানা ছিল না। এগুলি জানার সুযোগ পেয়েছিলেন মার্কস। (পৃ. ৫৩)

ভাববাদী দর্শনের উল্টোদিকে যান্ত্রিক বস্তুবাদ বলেছিল মানুষ-নিরপেক্ষ বাস্তবজতের কথা; সেখানে বিষয়ী/জ্ঞাতা-র কোনও ভূমিকা ছিল না। অন্যদিকে, উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠিত হল জ্ঞেয় আর জ্ঞাতার মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। মার্কসীয় দর্শনের গোড়ার কথাই হল, চেতনাও বস্তুর ওপর প্রভাব ফেলে। রামকৃষ্ণবাবুর কথায়:

মার্কস-এঙ্গেলস-এর আগে পর্যন্ত বস্তুবাদ-এর ধরনটি ছিল যান্ত্রিক। সেখানে চৈতন্য-র নিজস্ব ভূমিকা স্বীকার করা হত না। চৈতন্য মানেই বস্তুজগতের প্রতিচ্ছবি। ফয়েরবাখ বিষয়ে তৃতীয় থিসিস-এ মার্কস এই দুর্বলতার কথা বিশেষ করে উল্লেখ করেছিলেন। বস্তুজগৎ চৈতন্যকে নিয়ন্ত্রণ করে, এর উল্‌টোটা ঘটে না— একমুখী যান্ত্রিক চিন্তা থেকে, ফরাসি বস্তুবাদীরা মানুষকে শুধু তার পরিবেশ ও শিক্ষার উৎপাদন বলে ধরে নিয়েছিলেন। মার্কস বললেন: মানুষই যে তার পরিস্থিতি পাল্‌টাবে— এই কথাটা ভুলে যাওয়া হয়েছে। মানুষ আর পরিবেশ— এদের দ্বৈততা ছেড়ে মার্কস-ই প্রথম এ দু-এর মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা তুললেন। পরিবেশ মানুষকে গড়ে— এ হল জ্ঞানের প্রথম ভাগ। মানুষ আবার একই সঙ্গে তার পরিবেশ গড়ে— এ হল দ্বিতীয় ভাগ। মার্কস যখন এইভাবে জিনিসটি হাজির করেন তখন তিনি আর প্রথাগত বস্তুবাদী থাকেন না, পত্তন করেন নতুন এক বস্তুবাদ-এর। (পৃ. ৬৩)

গতিশীলতা তথা পরিবর্তনের ধারণা— প্রাচীনকালে যার আভাস পাওয়া যায় হেরাক্লিতাস-এ— হেগেল মারফৎ মার্কসের চিন্তায় চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল। তেমনি শ্রেণিসংগ্রামের ধারণাটি মার্কসের আগেও ছিল। কিন্তু কোন্‌ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে প্রাক্‌-পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটে আর সেইসঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কেন অবধারিতভাবে সমাজবাদী ব্যবস্থার দিকে যায়— তার গতিসূত্র আবিষ্কার করেন মার্কস। নির্দিষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ছাড়া উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানো যায় না;  সমাজব্যবস্থায় বৈপ্লবিক রূপান্তর সম্ভব উপযুক্ত কার্য-কারণ সম্পর্ক মেনেই।

দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে রামকৃষ্ণবাবু তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক নিরিখে— কীভাবে বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে উনিশ শতকের বাস্তব পরিস্থিতিতে তার গোড়াপত্তন ঘটল মার্কসের দর্শনচিন্তায়। নিরন্তর পরিবর্তনের আলোকে প্রকৃতি ও তার অংশ মানবসমাজকে দেখা এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। রামকৃষ্ণবাবু লিখেছেন:

শুধু হেগেল নন, মার্কস-এর আগের যাবতীয় বস্তুবাদী ও কয়েকজন ভাববাদী দার্শনিকও মার্কসবাদের ভিত তৈরি করেছিলেন। মার্কসবাদ-কেও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় রেখে বিচার করতে হবে। এঙ্গেলস নিজেই দেখিয়েছিলেন: মার্কসবাদ-এর জন্ম হয়েছে ইওরোপের দর্শনচিন্তার বিকাশ ও সমাজবিকাশের এক বিশেষ স্তরে। ফরাসি বস্তুবাদ, সমাজবাদ, জার্মান দর্শনের দ্বান্দ্বিক চিন্তা, চার্টিস্ট আন্দোলন— এসবই মার্কসবাদ-এর ঐতিহাসিক পৃষ্ঠপট। লেনিন-ও মার্কসবাদ-এর তিনটি উৎস ও তিনটি অঙ্গ-র কথা বলেছিলেন। চার্টিস্ট আন্দোলনের বদলে সেখানে আছে ইংরেজ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কথা। (পৃ. ৭১)

বস্তুবাদের সঙ্গে খেটে-খাওয়া মানুষের যোগ স্বতঃসিদ্ধ কি না— তা খতিয়ে দেখাই রামকৃষ্ণবাবুর বস্তুবাদ চর্চার সূচনাবিন্দু ছিল। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তিনি দেখিয়েছেন, প্রাক্‌-পুঁজিবাদী পর্বে তো বটেই, এমনকি পুঁজিবাদী পর্বের গোড়াতেও যে তা জনগণের দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রাচীনকালের গ্রিস ও ভারত থেকে মার্কস-এঙ্গেলস পর্যন্ত বস্তুবাদী দর্শনে দেখা গেছে নানা অধ্যায়— প্রাকৃতিক ও মানবসমাজ নিয়ে নিছক ব্যক্তিগত মতামত শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার অনুযায়ী ধ্যানধারণা। এই বিবর্তন কোনও খামখেয়ালিপনার ফল নয়; বস্তুবাদের সঙ্গে নিরীশ্বরবাদ আর জনগণের যোগও তৈরি হয়েছে এক বিশেষ সময়, এক বিশেষ বাস্তব পরিস্থিতিতে।

কিন্তু এও মনে রাখার, মার্কস-এঙ্গেলস-এ এসে বস্তুবাদ শেষ হয়ে যায় না। যদিও এখনও অব্দি তাঁরাই বস্তুবাদী দর্শনের শেষ বিপ্লব ঘটিয়েছেন। রামকৃষ্ণবাবু মনে করিয়েছেন:

মার্কস-এঙ্গেলস-এর সঙ্গে সঙ্গে বস্তুবাদ-এর ইতিহাস শেষ হতে পারে না। বিজ্ঞান ও মানবসমাজের নতুন নতুন বিপ্লবের ফলে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ আরও বিকশিত হয়েছে। একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববীক্ষা হিসেবে এখনও সেটি বিকশিত হচ্ছে। (পৃ. ৭৭)

পরিবর্তনকে মেনে নিয়ে দুনিয়া পাল্টানোর কাজ মার্কস-এঙ্গেলসের পর এগিয়ে নিয়ে গেছেন অন্যান্যরা। লেনিন, লুকাচ, এর্নস্ট ব্লশ, গ্রামশি, মেসজারোস প্রমুখ সেই অখণ্ড বিশ্ববীক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন। আরও অনেক নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরিও হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। নতুন নতুন বিরোধ আর সেসব দ্বান্দ্বিকের সমাধান করাই আগামী দিনের বস্তুবাদীদের কাজ। বস্তুবাদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষতের হদিস এভাবেই মেলে ধরেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।

 

সূত্র:

ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। বস্তুবাদ জিজ্ঞাসা। অবভাস, ২০১৩

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...