ভাষা চিন্তা মন: শারীরিক অবকাঠামো— একটি সহজপাঠ [১৩]

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব প্রসঙ্গ: চিন্তাশক্তির স্বাঙ্গীকরণ

অনুসিদ্ধান্ত

মন ও চিন্তা সংক্রান্ত দুরূহ প্রশ্নটির উত্তর আমরা বিজ্ঞানের কাছে যতটা পেয়েছি তাতে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রেই আমরা অনেক পার্শ্বপ্রশ্নের সমাধান খোঁজার সুযোগ পেয়েছি। শুরুতে আমরা যে সমস্ত সমস্যার উল্লেখ করেছিলাম, এখন সেইসব ক্ষেত্রে কী কী কত দূর জানা গেল তা সংক্ষেপে খানিকটা আলোচনা করে দেখা যাক।

প্রথমত এটা বোঝা গেল, শারীরিক অর্থাৎ, মস্তিষ্ক বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের আঘাত বা রোগজনিত ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ছাড়া, অধিকাংশ মানসিক রোগের আসল উৎস রোগীর বাস্তব ও প্রত্যক্ষ সামাজিক পরিবেশ ও ঘটনাক্রম থেকে খুঁজতে হবে এবং রোগীর নিজেরও সেক্ষেত্রে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার উপযোগী জ্ঞান শিক্ষা দীক্ষা নিজের তরফে সক্রিয় উদ্যোগ ইত্যাদির ভূমিকাও বিচার করতে হবে। মনের বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্য সামাজিক অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই মানুষ যত স্বার্থপর হবে, সমাজ বিমুখ হবে, পরস্পর মিলেমিশে থাকার বদলে যত বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচার চেষ্টা করবে, এবং তার ফলে নিঃসঙ্গতায় ভুগবে, কিংবা সমাজে মানুষের উৎপাদক ভূমিকা যত ক্ষুণ্ণ হতে থাকবে বা অনিশ্চিত অবস্থায় পড়বে, মানুষের মনের স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি ও বিকাশ ততই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।

সকলেই জানেন, আজকের দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশের কল্যাণে যান্ত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা যতই উন্নত হচ্ছে, মানুষে মানুষে আন্তরিক যোগাযোগ ততই যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। আবার বর্তমান শোষণমূলক সমাজে যন্ত্র যত উন্নত ও সহজলভ্য হচ্ছে, ততই উৎপাদনে মানুষের শ্রম লাঘব হওয়া এবং কাজের সময় কমে যাওয়ার বদলে মালিকশ্রেণির তরফে শ্রমিক লাঘব করতে সুবিধা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সামনে চাকরি-বাকরি পাওয়ার সুযোগ কমে আসছে। অর্থনীতিতে, জীবিকা নির্বাহে, জীবনের অস্তিত্বে পলে পলে অনিশ্চয়তা, বেকারি, হতাশা, উদ্বেগ, অস্থিরতা, উত্তেজনা, ক্ষোভ, বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেসবের দৌলতে মানসিক ব্যাধির জমি আরও উর্বর ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। পৃথিবী থেকে মানসিক রোগের প্রকোপ দূর করতে হলে এই সামাজিক বৈষম্যের পরিবেশ থেকে মানুষকে বের করে এনে এক সাম্য ও মৈত্রীর সামাজিক সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে তুলতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আগের আলোচনা থেকে এটাও দেখা গেল, মননক্রিয়া, বুদ্ধি, দক্ষতা, প্রতিভা, মেধা— এইসবের কোনওটাই মানুষ জন্মগত বা বংশগতভাবে নিয়ে জন্মায় না। কবি সাহিত্যিক বিজ্ঞানী বা সঙ্গীতশিল্পী হওয়াটা কিছু বিশেষ ক্ষমতাশালী মানুষের কপালগুণ বা ভাগ্য নয়, এগুলোর পেছনে কোনও জাতিগত, জিনগত, অথবা দৈবী ভিত্তি নেই। দুনিয়ার সমস্ত মানুষই এইরকম যে কোনও ক্ষমতা বিকাশের কেবলমাত্র ন্যূনতম শারীরিক অবকাঠামো নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সেই অর্থে, সকল শিশুই— সুস্থ ও স্বাভাবিক হলে— জন্মমুহূর্তে মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের সমান নিহিত-সম্ভাবনা (potentiality) নিয়ে জীবনের যাত্রা শুরু করে। তারপর প্রাপ্ত সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে তার অন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে তার বাস্তব বিকাশের ফলাফল ক্রমশ নির্ধারিত হয়। এমনকি, এইভাবে তার মন ও মনের শারীরিক অবকাঠামোটিও গড়ে ওঠে, সংরক্ষিত ও বিকশিত হয়।

তৃতীয়ত, মন ও চিন্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলি জানার ফলে শিক্ষাবিজ্ঞানও উপকৃত হচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশ, বিশেষ করে শিশুশিক্ষার পরিবেশ কীভাবে গড়ে তুলতে পারলে তা ছাত্রছাত্রীদের মনের স্বাভাবিক স্ফূরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, উপরে কথিত “আদানপ্রদান” বা “অন্তঃক্রিয়া”-র প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে— এটা একটা নতুন অধীতব্য জ্ঞানের বিষয়। এরই প্রয়োজনে শিক্ষাসম্বন্ধীয় মনস্তত্ত্ব মনোবিজ্ঞানের একটা বিশেষ শাখা হিসাবে গড়ে উঠেছে।

আবার চিন্তা ও ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিকাশের প্রক্রিয়াটি জানার মধ্যে দিয়ে ভাষাশিক্ষার পদ্ধতি ও পাঠক্রম সম্পর্কেও নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। এরই ভিত্তিতে একাধিক ভাষা শিক্ষার বয়স, অ-মাতৃভাষা শিক্ষার পদ্ধতি এবং বেশি বয়সে ক্ষতিপূরক ভাষা শিক্ষা বা বিদেশি ভাষা শিক্ষার পাঠক্রম ইত্যাদি নির্ধারিত হচ্ছে।

দর্শনের জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে আজ আমরা দাবি করতে পারি। যাঁরা এক সময় চেতনাকেই সৃষ্টির আদিতে বা বস্তুর উপরে স্থান দিয়েছেন এবং বস্তুজগৎকে চেতনাসৃষ্ট বা চেতনাসাপেক্ষ সত্তা বলে মনে করেছেন (এইরকম দার্শনিকরাই আজ অবধি দলে ভারি) তাঁদের পক্ষে মন সম্পর্কে উপরে আলোচিত জ্ঞানভাণ্ডার প্রাপ্তি এক ঘোরতর দুঃসংবাদ। মানুষ যদি জীববিবর্তনের পথ বেয়ে এক নির্দিষ্ট সময়ে উদ্ভূত হয়ে থাকে এবং মন যদি প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে মানবমস্তিষ্কের নিরন্তর অন্তঃক্রিয়ার ফলে জন্ম নিয়ে থাকে, তাহলে বস্তুজগতের প্রাথমিক ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বে সন্দেহ করার আর কোনও অবকাশই থাকে না। মানুষের জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াটা হল আসলে সংবেদন ও প্রত্যক্ষণ থেকে ভাষাভিত্তিক অবধারণ এবং একই বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির অবধারণের সংযোজনের মাধ্যমে সাধারণ যুক্তিবৃত্তি ও তথ্যভাণ্ডার নির্মাণ। বহির্জগৎ জ্ঞানের উৎস, মস্তিষ্ক জ্ঞানের আধার এবং চিন্তাশক্তি জ্ঞানের সংগঠক। এই চিন্তাশক্তির সাহায্যে মানুষ তার ইন্দ্রিয়সাপেক্ষতা (sense data)-র সীমা অনেকখানি ভেঙে এগিয়ে যেতে পারে। তার ভিত্তিতেই জ্ঞানের সমৃদ্ধি ঘটে।

মানুষের যে কোনও সময়ে নতুন করে অর্জিত জ্ঞানের তিনটে করে পরীক্ষা দিতে হয়।

এক, একই বিষয়ে ইতিপূর্বে আহরিত ও প্রমাণিত জ্ঞানের সঙ্গে তা মিলছে কিনা, নাকি বিরোধ উপস্থিত হচ্ছে। বিরোধ দেখা দিলে আগে-পরের সমস্ত জ্ঞানকেই আবার নতুন করে যাচাই করে দেখতে হবে।

দুই, অন্য বিষয়ের প্রামাণ্য জ্ঞানের সঙ্গেও তার কোথাও বিরোধাভাস আছে কিনা। এখানে মিলছে কিনা দেখাটা জরুরি নয়, কিন্তু বিরোধ থাকলে তাকে পুনর্বার যাচাই করতে হবে।

তিন, বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য সেই নতুন জ্ঞান কোনওভাবে কাজে লাগছে কিনা, বা তাকে প্রয়োগ করে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে কিনা।

এই সমস্ত যাচাই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে মানুষ শুধু জানতে পারে তাই নয়, জানার সঠিকতাও বিচার করে আয়ত্তাধীন জ্ঞান সম্পর্কে সংশয়মুক্ত হতে পারে।

উপসংহারে বলতে চাই, মানুষ নানা বিষয়ে যত জানতে পারছে, ততই সে শুধু যে জানার পদ্ধতিকেই উন্নত করছে এমন নয়, জানার যে প্রধান হাতিয়ার— তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, তার চিন্তাশক্তি, তার বুদ্ধিবৃত্তি, তার ধীশক্তি— সেই সবকিছুকেও জেনেবুঝে সে ক্রমাগত বিকশিত ও পরিশীলিত করে তুলছে।

 

[সমাপ্ত]


গ্রন্থসূত্র:

বাংলা

  • কার্ল মার্ক্স (১৯৮১, ৬), “পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ১৮৭২ সালের দ্বিতীয় জার্মান সংস্করণের পরিশিষ্ট”; বারো খণ্ডে মার্ক্স-এঙ্গেল্‌স নির্বাচিত রচনাবলি; ৬ষ্ঠ খণ্ড; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
  • এম ইলিন ও ওয়াই সেগাল (১৯৮৫), মানুষ কী করে বড় হল; ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সি, কলকাতা।

ইংরেজি

  • Cantril and W. K. Livingstone (1961), “The Concept of Transaction in Psychology and Neurology”; Journal of Individual Psychology, 19/1961.
  • Paul Chauchard (1964), Language and Thought; Walker Sun Books, New York.
  • Grahame Clark (1946), From Savagery to Civilisation; Cobbett Press, London.
  • M. R. Delgado (1965), Physical Control of the Mind: Towards a psychocivilized society; Harper and Row, New York.
  • Frederick Engels (1974), Dialectics of Nature; Progress Publishers, Moscow.
  • Frederick Engels (1976a), Anti-Dűhring; Foreign Languages Press, Beijing.
  • Frederick Engels (1976b), Ludwig Feuerbach and the end German Classical Philosophy; Foreign Languages Press, Peking.
  • P. Frolov (1962), Work and the Brain; Foreign Languages Publishing House, Moscow.
  • Loren R. Graham (1987), Science, Philosophyand Human Behavior in the Soviet Union; Columbia University Press, New York.
  • E. James (1970), Introduction to Psychology; Granada Publishers, London.
  • H. Leenneberg (1967), Biological Foundation of Language; John Wiley & Sons, New York.
  • I. Lenin (1961), Philosophical Notebooks; Collected Works, Vol. 38; Progress Publishers, Moscow.
  • I. Lenin (1977), Materialism and Empirio-Criticism; Collected Works, Vol. 14; Progress Publishers, Moscow.
  • I. Lenin (1977), What the “Friends Of the People” are And How They fight the Social-Democrats; Collected Works, Vol. I; Progress Publishers, Moscow.
  • Leontyev (1981), Problems of the Development of the Mind; Progress Publishers, Moscow.
  • Karl Marx (1967), Economic and Philosophical Manuscripts of 1844; Progress Publishers, Moscow.
  • Karl Marx (1977), Capital, Vol. I; Progress Publishers, Moscow.
  • Karl Marx and Friedrich Engels (1976), The German Ideology: Progress Publishers, Moscow.
  • P. Pavlov (n. d.a), Selected Works; Foreign Languages Publishing House, Moscow.
  • P. Pavlov (n. d.b), Psychopathology and Psychiatry; Foreign Languages Publishing House, Moscow.
  • Konstantin Ivanovich Platonov (1959), The Word as a Physiological and Therapeutic Factor; Foreign Languages Publishing House, Moscow.
  • K. Prasad (1979), The Language Issue in India; Leeladevi Publications, Delhi.
  • L. Rubinstein (1966), “Problems of Psychological Theory”; in A. Leontyev et al (1966), Psychological Researches in the USSR, Vol. I; Progress Publishers, Moscow.
  • V. Shorokova (1966), “On the Nature of Mental Reflection”; in A. Leontyev et al (1966), Psychological Researches in the USSR, Vol. I; Progress Publishers, Moscow.
  • V. Stalin (1976), Marxism and the Problems of Linguistics; Foreign Languages Press, Peking.
  • S. Vygotsky (1966), “Development of the Higher Mental Functions”; in A. Leontyev et al (1966), Psychological Researches in the USSR, Vol. I; Progress Publishers, Moscow.
  • S. Vygotsky (1978), Mind in Society; Harvard University Press, London. 

 

সহায়ক গ্রন্থ:

বাংলা

  • ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৮৪), পাভলভ পরিচিতি, ১ম-২য় খণ্ড; পাভলভ ইন্সটিটিউট, কলকাতা।
  • জগত জীবন ঘোষ ও রমেন মজুমদার (১৯৯২), মানুষের মস্তিষ্ক; কলকাতা।
  • ভ. তাতারিনোভ (১৯৮৭), মানুষের অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
  • হুমায়ুন কে এম হাই (১৯৯০), মানবমস্তিস্ক; বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

ইংরেজি

  • Chiye Aoki and Philip Siekevitz (1992), “Plasticity in Brain Development”; Scientific American, December 1988.
  • François Clarac and Jean-Gaël Barbara (2011), “Historical concepts on the relations between nerves and muscles”; Brain Research; Vol. 1409 29 August 2011. 
  • R. Damasio and Hanna Damasio (1992), “Brain and Language”; Scientific American, September 1992.
  • B. Denes and E. N. Pinson (1970), The Speech Chain: The physics and biology of spoken language; Anchor Press, New York.
  • Gerald D. Fischbach (1992), “Mind and Brain”; Scientific American, September 1992.
  • Gomathy Gopinath (1990), The Brain: A Precious Possession; National Book Trust, Delhi.
  • Eric R. Kandel and Robert D. Hawkins (1992), “The Biological Basis of Learning and Individuality”; Scientific American, September 1992.
  • Roger Lewin (1992), The Great Brain Race; New Scientist, 5 December 1992.
  • R. Luria (1973), The Working Brain: An introduction to neuropsychology ; Basic Books, London.
  • R. Luria and F. Ia. Yudovich (1959), Speech and the Development of Mental Processes in Child; Staple Press, London.
  • Mariusz Maruszewski (1975), Language Communication and the Brain; De Gruyter Mouton, London.
  • Sunil K. Pandya (1997), Human Behaviour; National Book Trust, Delhi.
  • Jean Piaget (1952), The Language and Thought of the Child; Routledge and Sons, London.
  • Sechenov (n. d.), Selected Physiological and Psychological Works; Foreign Languages Publishing House, Moscow.
  • Carla J. Shatz (1992), “The Developing Brain”; Scientific American, September 1992.
  • S. Thirumalai (1977), Language Acquisition: Thought and Disorder; Central Institute of Indian Languages, Mysore.
  • Harry K. Wells (1956), Ivan P. Pavlov: Towards a scientific psychology and psychiatry; International Publishers, New York.
  • Harry K. Wells (1960), Sigmund Freud: A Pavlovian critique; International Publishers, New York.
  • Mikhail Grigoryevich Yaroshevsky (1990), A History of Psychology; Progress Publishers, Moscow.
  • Henri Pieron – Lecture on Humanization.
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...