বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: উপন্যাসের কর্মশালা

বাংলা উপন্যাসের অন্দরমহল: উপন্যাসের কর্মশালা | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পূর্ব প্রসঙ্গ: পাঠকের প্রস্তুতি

এই অধ্যায়কে অতিরিক্ত সংযোজন হিসাবেই দেখতে হবে। কারণ এই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণত সাহিত্যিকদের জন্য রচিত।

বিস্তারিত প্রসঙ্গের আগে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলে নেওয়া ভাল। ঘটনাটা গি দ্য মোপাসাঁ-কে নিয়ে। ছেলেবেলায় তাঁরা যে পাড়ায় থাকতেন, সেই পাড়াতেই থাকতেন বিখ্যাত সাহিত্যিক গুস্তভ ফ্লবেয়র। ছোট্ট মোপাসাঁর খুব আশা ফ্লবেয়রের মতো নামজাদা সাহিত্যিক হয়ে ওঠা। এই নিয়ে মায়ের কাছে বারবার আবদার, যা দাবির পর্যায়ে পৌঁছায়। গি দ্য স্বভাবে ছিলেন তাঁর মা লোর ল্য পোয়াতভাঁ-র মতো। এককথায় মা-ন্যাওটা ছেলে। ছেলের আবদার মায়ের পক্ষে ফেলা সম্ভব হল না। এক রোববার চার্চের পরে লোর তাঁর পুত্রকে নিয়ে গেলেন ফ্লবেয়র-এর বাড়ি। তখন লেখকমশাই কিছু একটা লেখায় ব্যস্ত। মা জানালেন তাঁর পুত্রটির আকাঙ্ক্ষার কথা। আশার কথা। অমনোযোগী সাহিত্যিক হাতের সামনে থাকে একটা ঢাউস বই মোপাসাঁ-র হাতে দিয়ে বললেন, বইটা পড়ে একদিন আসতে, সেদিন তিনি আলাপ করবেন। হপ্তাখানেক পরে মোপাসাঁ গিয়ে দেখা করলেন ফ্লবেয়র-এর সঙ্গে। মনে করালেন তিনি একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন, সেই বইটা পড়া হয়ে গেছে। কৌতূহলী ফ্লবেয়র বইটা হাতে নিয়ে দেখেন সেটা একটা অভিধান। সেই অভিধান বালকটি পড়ে ফেলেছে। তার এই নিষ্ঠা দেখে ফ্লবেয়র চমকিত হন। শুরু হয় তাঁদের মধ্যে আলাপচারিতা। যার খানিকটা এইরকম:

—আচ্ছা বলো তো জানলা দিয়ে তুমি কী দেখতে পাচ্ছ? ফ্লবেয়র জিজ্ঞেস করলেন।
—একটা হলদে বাড়ির ছাদ। মোপাসাঁ-র তাৎক্ষণিক উত্তর।
—হল না। আরও ভাল করে দেখে বলো।
—একটা ছাদ। চিলেকোঠার সবজে জানলা।
—উঁহু হল না। ভাল করে দেখে বলো।
—একটা হলদে বাড়ির ছাদ। সবজে জানলাওলা চিলেকোঠার ছাদ। তার ওপর নীল আকাশ।
—হুম। আর সেই নীল আকাশে কয়েকটা পাখি। এই তো?

মোপাসাঁ বললেন, হ্যাঁ, ঠিক তাই।

তখন ফ্লবেয়রের উত্তর, নীল আকাশটা হল গল্পের বিষয় বা কনটেন্ট। আর ওই হলদে বাড়ি, সবজে জানলাওলা চিলেকোঠা এমনকি আকাশের উড়ন্ত পাখি, এগুলো হল প্লট।

এভাবেই ফ্লবেয়র-এর কাছে মোপাসাঁর গল্প লেখার হাতেখড়ি।

অনেকই মনে করেন মায়ের পেট থেকে পড়ে কবি কিংবা সাহিত্যিক হওয়া যায়। তেমনটা হলে এত কথা, আলোচনা সব আর্বজনার সামিল। শিশুমনে সাহিত্যের প্রতি অদ্যম টান পরবর্তীকালে জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে যদি অটুট না থাকে, তাহলে সাহিত্যজগতে কারও স্থান হয় না। সাহিত্য ফুলটাইম জব বা সর্বক্ষণের কাজ। কিন্তু যেহেতু এখনও আমাদের ভাষায় সাহিত্যকে পেশা করে ওঠা যায় না, সেহেতু অধিকাংশজনকেই পেট চালানোর জন্য অন্য কোনও কাজ করতে হয়। তাদের অবস্থা হয় দু নৌকায় পা রেখে বয়ে যাওয়ার মতো। এর দরুন পেটের দায়ের শিক্ষার সঙ্গে প্রায়শ দেখা যায় সাহিত্যশিক্ষার মিলমিশ ঘটে না। ফলে সাহিত্যশিক্ষার গড়নটা ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে, যার ছাপ পড়ে সাহিত্যকীর্তিতে। কেউ হয়তো এমন বক্তব্যকে যুক্তিহীন ভেবে খারিজ করে দিতে পারেন। উদাহরণ তুলে বলতেই পারেন সাহিত্যশিক্ষাটা অমন অ্যাকাডেমিক নয় যে লিখিয়ে পড়িয়ে করা যাবে। বিশেষত আমাদের ভাষায় যাঁরা বরেণ্য ঔপন্যাসিক, তাঁরা কেউই উপন্যাস শিখে আসেননি। ওভাবে শেখা যায় না। কথাটা ফেলে দেওয়ার নয়। তবে মানতেই হবে যত দিন যাচ্ছে, আমাদের বাংলাভাষায় শিক্ষার মান ক্রমশ নিচে নামছে। একে রোধ করা আমাদের কর্ম নয়। আজকের দিনে যাঁরা শিক্ষক কিংবা অধ্যাপক, তাঁদের ভাষাজ্ঞান এত সামান্য দেখে আশ্চর্য হতে হয়। পাঠ্যপুস্তক থেকে যেহেতু ভাষাশিক্ষাটা খুব জোরালো হয় না, সেইজন্য যাঁরা পরবর্তী সময়ে সাহিত্যকে জীবনের মন্ত্র মেনে নিতে চান, সাহিত্যের সেবা করতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ, তাঁদের সেই ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রয়োজন কর্মশালা।

কর্মশালা একবার কিংবা একদিনের নয়, বরং ধারাবাহিকভাবে এই কর্মশালাগুলো চালাতে হবে, আর উৎসাহীদের অংশগ্রহণ করতে হবে। তবে এখানে স্কুল-কলেজের মতো শিক্ষক-ছাত্র সমীকরণ মানলে চলবে না। বরং পারস্পরিক ভাবনাচিন্তার আদানপ্রদান হবে একমাত্র ভরসা। যেমন ছন্দ। যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের মধ্যে ছন্দ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা খুব দরকার। আবার এই ছন্দ অক্ষরবৃত্ত, মাত্রবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত শিক্ষায় শেষ হলে তা অসম্পূর্ণ। তাঁদের জানতে হবে ত্রিষ্টুপ, গায়ত্রী, অনুষ্টুপ এমন ধরনের ছন্দের প্রকরণ। কিংবা সনেট, ট্রিয়োলেট, লিমেরিক, হাইকু ইত্যাদিও। অনুশীলন করতে হবে। সকলে মিলে বসে বুঝতে হবে ছন্দের কী প্রয়োজন। হাতে বই ধরিয়ে দিলে একাজ হওয়ার নয়।

কর্মশালায় অন্যতম বিষয় হতে পারে ব্যাকরণ। বানানবিধি, যতিচিহ্নের ব্যবহার, এসব। এগুলো অ্যাকেডেমিক স্তরে যেভাবে জানা, সেভাবে নয়, বিশিষ্ট লেখকদের লেখা থেকে উদাহরণ তুলে দেখাতে হবে। তেমনই স্ত্রীলিঙ্গ, পুরুষলিঙ্গের ব্যবহার কোথায়? কেমন? এর সঙ্গে যোগ করতে হবে পাঠ-অভিজ্ঞতার বিষয়। কর্মশালা হবে দেওয়ালহীন, ছাদবিহীন ক্লাসরুমে, যেখানে সকলেই তাদের পাঠ-অভিজ্ঞতার কথা বলবেন। একজন পাঠকের পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে একজন সাহিত্যিকের পাঠ-অভিজ্ঞতা উঁচুস্তরে হওয়াটাই দস্তুর। কারণ সাহিত্যিক পাঠককে পথ দেখান, উলটোটা নয়। যদি সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক, আর সাহিত্যিকদের পাঠ-অভিজ্ঞতা উঁচুস্তরের না হয়, তাহলে উৎকৃষ্ট সাহিত্যচর্চা হতে পারে না। ইচ্ছেপূরণের গল্প, একরৈখিক কাহিনি, এসব থেকে সরে গিয়ে জীবনের গভীরে ঢুকতে গেলে পাঠ-অভিজ্ঞতা খুব জরুরি উপদান। যখনই একজন ঔপন্যাসিকের মধ্যে এই প্রশ্নটা আসবে তিনি কী লিখবেন, তখনই তিনি দেখতে পাবেন জীবনের সেই সব অভিসন্ধিগুলি, যেগুলি এমনিতে তাঁর চোখের আড়ালেই ছিল। কী লিখব উত্তরটা পেয়ে গেলেই, দ্বিতীয় প্রশ্নটা মগজে আসবে কেন লিখব? আর তখনই চোখের ওপর ভেসে উঠবে এতকালের পড়া, চেনাজানা বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম। যে-বিষয় আগেই কেউ যখন লিখে গেছেন, তখন সেই বিষয় পুনরাবৃত্তির কোনও কারণ আর তিনি খুঁজে পাবেন না। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে উন্নত করা, তূণে নতুন নতুন শর সঞ্চয় আর সময়কালে তার ব্যবহাররীতি না জানলে সব আয়োজনই মাটি হয়ে যাবে।

কর্মশালায় আলোচিত হতে পারে সাহিত্যের ধর্ম, তার মূল উদ্দেশ্য। সভ্যতার ধারাবিবরণে সাহিত্যের অবদান। যেমন ফরাসি বিপ্লবে রুশোর ভূমিকা, বা ব্রিটিশ আমলের বাংলা সাহিত্য। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে রূপসী বাংলা-র ভূমিকা। এসব আলোচিত হলে সস্তা জনপ্রিয়তার রাস্তা ছেড়ে সাহিত্যিক আরও গভীরে পৌঁছাতে পারবেন। একটা কথা মনে রাখা দরকার, আমরা যখন কোনও কিছু কিনি, তখন জিনিসটার সঙ্গে দাম আর ব্যবহারের তূল্যমূল্য যাচাই করে নিই। ঠিক তেমনই আমরা যখন পাঠকের হাতে কাঙ্ক্ষিত বইটা তুলে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করব, তখন যেন সেটা পাঠক ঠকানো না হয়ে যায়।

বাংলা সাহিত্যের সার্বিক দুর্ভাগ্য অধিকাংশ লেখক এবং প্রকাশক পাঠক-ঠকানো সাহিত্যচর্চায় মেতে। পাঠকের পাঠ-অভিজ্ঞতা যে স্তরেরই হোক, এমন লোকঠকানো ব্যবসা বেশিদিন টিকতে পারে না। তার হাতে গরম উদাহরণ বর্তমান বাংলা প্রকাশনার দুরবস্থা। এককালে বাকি প্রদেশের ভাষাভাষী মানুষেরা বাঙালির সাহিত্যকে মর্যাদার আসন দিয়েছিল, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম উপাদন ছিল তার সাহিত্য। আজ সেই সাহিত্য প্রায় মরতে বসেছে। এর দায় লেখক, প্রকাশক, সমালোচক, পাঠক সকলের। ফলে সকলকেই এই সচেতনতা আনতে হবে। বাঙালি মেধাচর্চায় সাহিত্য অপাংক্তেয় থাকলে সমাজেরই অকল্যাণ। বানিয়ে তোলা সাহিত্য বানিয়ে তোলা জীবন আর সমাজের মতো সময়ের অপেক্ষা না করেই ধুলিসাৎ হয়।

 

[সমাপ্ত]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অনেক দিন হল পড়ছি লেখাটি। খুবই মূল্যবান প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদটি একটু হতাশাজনক হলেও নিখাদ সত্য।

আপনার মতামত...