হ্যারি বেলাফন্টে: যে-পথে আমি হেঁটেছি

দেবাশিস মৈত্র

 



গদ্যকার, ঔপন্যাসিক, অধ্যাপক

 

 

 

প্রথাগত অবিচুয়ারি নয়, নিছক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ।

দেশ-কাল-ভাষা-ধর্মের বিশাল ব্যবধান পেরিয়ে এক অচেনা মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, এবং গত চার দশক ধরে পরতে পরতে তাঁকে আবিষ্কারের স্মৃতিচারণ।

দিনক্ষণ পুরোটা মনে নেই, ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসের কোনও একটি দিন। দুপুরবেলা প্রতিবেশী এক যুবক এসে হাজির হল আমাদের বাড়ি। তার হাতে একটি লং-প্লেয়িং রেকর্ড, ডাবল অ্যালবাম। অফিসের এক সহকর্মীর কাছ থেকে ধার নিয়ে এসেছে সে। তার নিজের রেকর্ড প্লেয়ার নেই বলে আমাদের বাড়িতে তার আগমন। গানগুলো সে টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে নিতে চায়।

অ্যালবামখানা হাতে নিয়ে দেখলাম, কোন এক বিদেশি গায়কের ইংরেজি গান। একটি প্রোগ্রামের লাইভ রেকর্ডিং। কভারের উপর মাইক্রোফোন হাতে সেই গায়কের ছবি।

আজন্ম বাংলা মাধ্যমের ছাত্র আমি। কলেজে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছি বটে, কিন্তু ইংরেজি গল্পের বই-টই তেমন বাগে আনতে পারি না, ইংরেজি সিনেমার ডায়ালগ মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়, সর্বোপরি ইংরেজি গান থেকে শত হস্ত দূরে থাকি। সেইসব গানেরও যে রয়েছে কত অজস্র ঘরানা, সে-বিষয়ে তখনও আমার কিছুই জানা নেই। আমার ধারণা সব ইংরেজি গান মোটের উপর একইরকম, সেখানে বড় বেশি জগঝম্প বাজনা থাকে, বেদম ড্রামের বিট থাকে, সিম্বালের মুহুর্মুহু ঝঙ্কার থাকে। গানের কথা আর সুরকে ছাপিয়ে সেই ধ্বনি বুকে এসে বড় ধাক্কা মারে। ওসব গান যারা শুনতে চায় শুনুক, আমি আমার বাংলা-হিন্দি গান নিয়ে দিব্যি আছি! সঙ্গীতজ্ঞ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তো আর আমার নেই, সঙ্গীত আমার কাছে নেহাতই বিনোদন। ইংরেজি গানের মধ্যে বিনোদন তো দূরের কথা, অশান্তি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাই না আমি।

কিন্তু কী আর করা, বন্ধুকে তো আর ফিরিয়ে দেওয়া যায় না! অতএব ক্যাসেটে গান রেকর্ড হতে থাকে। কিন্তু অপছন্দের বস্তুকে তাচ্ছিল্য করার অভ্যাস তো মানুষের মজ্জাগত। তাই বন্ধুটি যখন মন দিয়ে গান শুনছে, আমি তখন বিরক্তি চেপে বিছানায় আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাই। ঘরের হাওয়ায় গানের সুর ভেসে বেড়ায়। শোনার ইচ্ছা থাক বা না-থাক, সেই সুর প্রথমে আমার কানে আসে, তারপর মরমে পৌঁছায়। তারও পরে একসময় সে-গান আমার মনোযোগ কেড়ে নিতে থাকে। অবাক হয়ে ভাবি, এ আবার কেমন ইংরেজি গান? ধুন্ধুমার অর্কেস্ট্রা নেই, ড্রামের বিট নেই, সামান্য একটি স্প্যানিশ গিটারের মূর্ছনা ছাড়া আর কোনও যন্ত্রের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। তার বদলে শুনছি এই অচেনা গায়কের মসৃণ কণ্ঠে মন ছুঁয়ে-যাওয়া একটি সুর। গানের সব কথা বুঝতে পারছি না বটে, কিন্তু এ-গান আমাকে উদাসীন থাকতে দিচ্ছে না।

প্রথমে মনে হয়েছিল এমন ইংরেজি গান আমি কোনওদিন শুনিনি। একটু পরে বুঝলাম, এমন কোনও গানই আমি কোনওদিন শুনিনি।

চার দশক পেরিয়ে এসে আজও মনে আছে, দ্বিতীয় গান শেষ হওয়ার আগেই আমার সব অযৌক্তিক মানসিক প্রতিরোধ ভেসে গিয়েছিল। আর প্রথম রেকর্ডের শেষ গানটি শুনতে শুনতে বুঝলাম, আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। গানের বিষয়টি বড় অদ্ভুত। নামগোত্রহীন এক বৃদ্ধা মারা গেছেন, শবানুগামী হবে তাঁর ছেলে। কফিনে পেরেক পোঁতা হচ্ছে। গায়ক যেন দর্শকের ভূমিকায়, ঘটনাটি তিনি শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন এইভাবে:

I think I heard him saying
When they were nailing in the nails
I think I heard him saying,
“Take my mother home.”

গান শুনে কারও চোখে জল আসতে পারে? এমন অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয়নি। কার কথা বলছে এই গায়ক? আমারই নিজের মায়ের কথা নয় কি?

আজ মনে হয়, প্রত্যাখ্যানের পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলাম বলেই বোধহয় সেদিন অত সম্পূর্ণ হয়েছিল আমার সমর্পণ। হ্যারি বেলাফন্টের একটি ডাবল অ্যালবাম— “বেলাফন্টে অ্যাট কার্নেগি হল”— চিরকালের মতো বদলে দিয়ে গেল আমার গান শোনার অভ্যাস।

 

কিন্তু একটিমাত্র রেকর্ড শুনেই থেমে গেলে তো চলবে না, আরো অনেক গান শুনতে চাই আমি। এই গায়কই না বলেছিলেন, রেকর্ডের সেই দ্বিতীয় গানটিতে— “Little drops of water wouldn’t satisfy me”? কোথায় পাওয়া যাবে হ্যারি বেলাফন্টের অন্য সব রেকর্ড? অনেক আশা নিয়ে গেলাম আশির দশকের কলকাতার বিখ্যাত রেকর্ডের দোকানগুলিতে— ধর্মতলার সিম্ফনি, রাসবিহারীর মেলোডি, গড়িয়াহাটের আনন্দলোক, এলগিন সুরলহরী। হ্যারি বেলাফন্টে? না, অমন কোনও গায়কের রেকর্ড বা ক্যাসেট নেই কোথাও।

আমার বন্ধুবৃত্তে তখন ইংরেজি গানের সমঝদার শ্রোতা একজনও নেই, এমন কাউকে চিনি না যে আমাকে একটু পথ দেখাতে পারে। অগত্যা অন্ধের মতো একাই আমি খুঁজে বেড়াই বেলাফন্টেকে। যেসব লোককে সঙ্গীতরসিক বলে জানি, তাদের কাছে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে হাজির হই। আর এইভাবে হাতড়াতে হাতড়াতে একসময় ফ্রি স্কুল স্ট্রিট আর ওয়েলিংটনের পুরনো রেকর্ডের দোকানের সন্ধান পেয়ে যাই। দ্বিতীয় যে-জায়গাটির সন্ধান পাই সে তো নেহাতই সোনার খনি— পার্ক স্ট্রিট আর লিটল রাসেল স্ট্রিটের নিলামের দোকানগুলি। তখন ভিনাইল রেকর্ডের দিন ফুরিয়ে ক্যাসেটের যুগ শুরু হয়ে গেছে। কলকাতার অনেক ধনী পরিবার, সম্ভবত তাদের মধ্যে অনেকেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, তাদের ইমপোর্টেড ইংরেজি গানের রেকর্ডের সম্ভার জলের দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রতি শনি-রবিবার সেইসব দোকানে তীর্থের কাকের মতো হাজির হই, যদি বেলাফন্টের একখানা পুরনো রেকর্ড পাওয়া যায়।

তা, পুরনো রেকর্ডের আড়তে আর নিলামদারদের ঘাঁটিতে দিনের পর দিন হামলা চালিয়ে, হাজার হাজার পুরনো রেকর্ডের ধুলো ঝেড়ে, বেলাফন্টের আরও কয়েকটি রেকর্ড খুঁজে পাওয়া গেল। আর অমন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতেই একসময় আমি বুঝলাম, অক্টোবর মাসের সেই দিনটিতে সূর্যালোকিত যে-দ্বীপের সন্ধান আমি পেয়েছিলাম, আসলে সেটি বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ নয়, এক বিশাল মহাদেশের অংশবিশেষ। এক অচেনা গায়ককে চেনার চেষ্টা করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি সন্ধান পেয়ে যাই আমেরিকার লোকসঙ্গীতের বিশাল ভাণ্ডারের। একে একে খুঁজে পাই পল রোবসন, উডি গাথরি, পিট সিগার, লেড বেলি, জোন বায়েজ, ওডেটা, মিরিয়াম মাকেবা, মাহালিয়া জ্যাকসন, জুডি কলিন্সকে। এঁদের মধ্যে একমাত্র পল রোবসনের কথাই আমি আগে শুনেছি, যদিও তাঁর স্বকণ্ঠে একটিও গানের রেকর্ডিং শোনার সুযোগ তখনও পাইনি। সাত, আট বা নয়ের দশকের কলকাতায় প্রায় প্রতিটি বামপন্থী মিটিং-মিছিলে শোনা যেত নাজিম হিকমতের লেখা একটি গানের বাংলা অনুবাদ— “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না/নিগ্রো ভাই আমার পল রোবসন।” কে এই পল রোবসন? কে তাঁকে গান গাইতে দিল না? এমন কী ছিল তাঁর গানে যে তাঁর গান গাওয়া বন্ধ করে দিতে হল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না আমার।

সে-যুগে কলকাতার এক দারুণ জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। কয়েক হাজার শ্রোতাকে দেড়-দু ঘন্টা ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার কায়দা তিনি জানতেন। নিজের প্রতিটি একক অনুষ্ঠান তিনি ঘোষণা করতেন, পল রোবসন তাঁর গুরু, এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি পল রোবসনের তিনটি বিশেষ গানের অংশবিশেষ গেয়ে শোনাতেন। অনেক বছর পরে জেনেছি যে পল রোবসন সম্পর্কে যা বলতেন ভূপেন হাজারিকা তাতে কিছু ভ্রান্তি ছিল এবং ওই তিনটি গানের মধ্যে দুটি আদৌ পল রোবসনের গান নয়। তবুও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রোবসন সম্পর্কে বাঙালি শ্রোতার ঔৎসুক্য জাগিয়ে তোলার পিছনে ভূপেন হাজারিকার যথেষ্ট অবদান ছিল।

কিন্তু রোবসন নন, আমার অনুসন্ধানের বিষয় তখন মূলত হ্যারি বেলাফন্টে। এই দুজনের মধ্যে যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সে-কথা তখন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। তা, বেলাফন্টে এবং তাঁরই ঘরানার আরও অনেক গায়ক-গায়িকাকে আবিষ্কার করতে করতে একসময় বুঝলাম, একদা মূর্খের মতো “ইংরেজি গান” বলে যে-সঙ্গীতকে ছাপ্পা মেরে দিয়েছিলাম, সেটি মনোলিথিক কোনও বস্তু নয়, সেখানে রয়েছে অনেক প্রকারভেদ, অনেক স্তর, আর প্রতিটি স্তরে রয়েছে অজস্র মণিমাণিক্য। ফোক মিউজিক, কান্ট্রি সং, প্রোটেস্ট সং, ক্যালিপসো, রেগে, গোস্পেল, সোল, জ্যাজ, ব্লুগ্রাস, স্পিরিচুয়াল, রক-অ্যান্ড-রোল…. স্বশিক্ষিত ছাত্র হিসেবেই ক্রমশ একটু একটু করে চিনতে শিখলাম। সেই শিক্ষার কতটা ঠিক আর কতটা ভুল, তা আমি জানি না। আর নিজেরই মতো ঝাড়াই-বাছাই করে সঙ্গীতের জনপ্রিয় ধারাগুলিকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল বৈচিত্র্যময় লোকসঙ্গীতের ছাত্রই রয়ে গেলাম চিরকাল।

 

কিন্তু শুধু গান শুনে তো তৃষ্ণা মিটবে না, বেলাফন্টের জীবনের কথাও তো জানা চাই। কীভাবে জানব? ততদিনে নিশ্চিতভাবে বুঝে গেছি যে বেলাফন্টে ঠিক মূল ধারার গায়ক নন, এমন কোনও জনপ্রিয় ব্যক্তি তিনি নন যে কলকাতায় বসেই তাঁর সম্পর্কে কোনও বই কিনতে পাওয়া যাবে। রেকর্ডই পাওয়া যায় না, তো বই! আর সেটা তো এমন এক যুগ যখন কম্পিউটার বলতে আমরা বুঝি যাদবপুরের আরসিসি-র মেইনফ্রেম কম্পিউটার, যেখানে কার্ড পাঞ্চিং করে বড় বড় প্রোগ্রাম চালিয়ে জটিল ক্যালকুলেশনের রেজাল্ট পাওয়া যায়, আর পরে সেইসব পাঞ্চ-করা কার্ড দিয়ে তৈরি হয় প্রাইভেট বাসের টিকিট। পিসি আর ল্যাপটপ তখন সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে, সাদাকালো টেলিভিশনে দুটি মাত্র সরকারি চ্যানেল, এফএম রেডিও দূর অস্ত, ইন্টারনেট নামক বস্তুটির কথা কোনও বিজ্ঞানীর কল্পনাতেও নেই, আজকের এই বিশ্বজোড়া তথ্যভাণ্ডারের অস্তিত্বই নেই তখন। এই পরিস্থিতিতে কলকাতার এক মধ্যবিত্ত কলেজ-ছাত্র, যার কোনও আত্মীয় বা বন্ধু আমেরিকায় বাস করে না, সে কীভাবে জানবে সেদেশের এক গায়কের কথা, তাঁর আরও সব সঙ্গীসাথীদের কথা, কী করে শিখবে সেদেশের লোকসঙ্গীতের ইতিহাস?

অনেক বছর সময় লাগল, কিন্তু একটু একটু করে কিছু তথ্য পাওয়া গেল ঠিকই। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে খুঁজে পেলাম পল রোবসনের সম্বন্ধে দুটি বই, তার মধ্যে একটি তাঁর আত্মজীবনী— “হিয়ার আই স্ট্যান্ড” (পরে কমলেশ সেন বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, নাম ছিল “যে মাটিতে দাঁড়িয়ে”)। আটের দশকের কোনও এক সময় অনীশ দেবের অনুবাদ-করা হাওয়ার্ড ফাস্টের “পিকস্কিল— ইউএসএ” বইটি হাতে এল। ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে পেলাম সিডনি পয়টিয়ারের আত্মজীবনী “দিস লাইফ”, সেখানে হ্যারি বেলাফন্টের সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেল। সেই প্রথম জানলাম, হ্যারি বেলাফন্টেকে নিছক গায়ক হিসাবে দেখা কত বড় বাতুলতা। বেলাফন্টের প্রধান পরিচয় হল তিনি মানুষের শিল্পী, এবং তিনি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী।

আরও পরে নয়ের দশকের শুরুতে নন্দনে দেখলাম বেলাফন্টে এবং সিডনি পয়টিয়ার অভিনীত চলচ্চিত্র, “বাক অ্যান্ড দ্য প্রিচার”। বেলাফন্টে সারা জীবনে যত ছবিতে অভিনয় করেছেন, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তার সবগুলিই এখন আমার সংগ্রহে আছে, কিন্ত সিনেমার পর্দায় প্রিয় গায়ককে প্রথম দেখার সেই অভিজ্ঞতার কথা কোনওদিন ভোলার নয়।

বাক অ্যান্ড দ্য প্রিচার ছবিতে

আরও বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল আমাদের জন্য। ১৯৯৬ সালে স্বয়ং পিট সিগার এলেন কলকাতায়। ১৯৬৩ সালের পর এই দ্বিতীয়বার। বৃদ্ধ সিগারের সেই অতুলনীয় গানের গলা তখন নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁকে সহায়তা করেছিলেন তাঁরই নাতি টাও রডরিগেজ। মনে আছে, নজরুল মঞ্চের অনুষ্ঠানে গান গাইতে গাইতে এক সময় পিট বলেছিলেন, “সারা পৃথিবীতে এখনও আমার মতো অনেক গায়ক আছে, যারা ইলেকট্রনিক মিউজিকে বিশ্বাস করে না।” আর সেকথা শুনে দর্শকাসনে বসে আমার মতো এক সঙ্গীতের অ-আ-ক-খ জ্ঞানহীন অর্বাচীন শ্রোতা বড় খুশি হয়ে ভেবেছিল, “হ্যাঁ, আমিও ইলেকট্রনিক মিউজিকে বিশ্বাস করি না। ১৯৮২ সালে জীবনে প্রথম হ্যারি বেলাফন্টের গান শোনার সময়ও করতাম না, আজও করি না।”

 

তারপর এল ইন্টারনেট। তথ্যভাণ্ডার তখনও আজকের মতো এত সমৃদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু হ্যারি বেলাফন্টের নাম লেখা আমার ফাইলটির কলেবর ক্রমশ স্ফীত হয়ে উঠতে থাকল। বেলাফন্টে, এবং তাঁর অগ্রজ ও অনুজ সমধর্মী গায়কদের সম্পর্কে নিত্যনতুন তথ্য জানতে জানতে একদিন আমি উপলব্ধি করলাম, কোন গায়ক কতটা প্রতিভার অধিকারী, তার চেয়েও বড় কথা হল, কে কেমন মাপের মানুষ। আমার বদ্ধমূল ধারণা জন্মাল যে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীদেরও পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একদলের কাজ সুমধুর সঙ্গীতের মাধ্যমে শ্রোতাদের মুগ্ধ করা; অন্যদল সঙ্গীতকে ব্যবহার করেন যাবতীয় সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে, জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের অস্ত্র হিসাবে। প্রথম দল রাষ্টযন্ত্র এবং তার চালকদের প্রিয়পাত্র; দ্বিতীয় দল তাদের চক্ষুশূল। প্রথম দলের বাস পেন্টহাউসের চূড়ায়, দ্বিতীয় দল মানুষের মিছিলে মিশে রাস্তায় হেঁটে চলেন। হ্যারি বেলাফন্টে দ্বিতীয় দলের লোক। তাঁর গুরু পল রোবসনের মতো তিনিও সারা জীবন ধরেই নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এবং কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অক্লান্ত কর্মী। হয়তো সেইজন্যেই তাঁর একটি রেকর্ডের নাম তিনি রেখেছিলেন, “Streets I have walked”।

বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালদের কাছে, এমনকি বহু বামপন্থীদের কাছেও, বেলাফন্টের প্রধান পরিচয় হল এই যে, তিনি “জামাইকা ফেয়ারওয়েল” নামে একটি মিষ্টি গানের শিল্পী। তাঁর জীবনের অন্য দিকগুলির খবর হয় আমরা রাখি না, অথবা ভুলে থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। নইলে হিসেব মেলাতে অসুবিধা হয় আমাদের। এদেশের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পীরা কিঞ্চিৎ প্রসাদের লোভে আভূমিপ্রণত হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকদের দাসত্ব করবেন, অথবা যাবতীয় সামাজিক অন্যায়ের প্রেক্ষিতে নীরব এবং নির্বিকার রয়ে যাবেন, প্রয়োজনে সরাসরি রাষ্ট্রের পক্ষ নেবেন, নবতিপর বিখ্যাত গায়িকা— জীবনে যাঁর পাওয়ার কিছু বাকি নেই— তিনিও রাষ্ট্রনায়কের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন, এমনটাই দেখতে আমরা অভ্যস্ত। সেখানে বেলাফন্টে যে নিজের সঙ্গীতচর্চা শিকেয় তুলে রেখে আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলিতে ঘুরে ঘুরে খাবার আর ওষুধ সরবরাহ করে বেড়াবেন, ভেনিজুয়েলায় গিয়ে হুগো শ্যাভেজের পাশটিতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে প্রকাশ্যে ঘোষণা করবেন যে বুশ হলেন “…the greatest terrorist of the world,” অথবা জোন বায়েজ যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে খোদ ওয়াশিংটনের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য সভায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্বরাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জারকে বলবেন “…the killer Kissinger,” বলবেন “that stinking Kissinger,” এসব আমাদের ঠিক হজম হয় না!

ফিরে আসি হ্যারি বেলাফন্টের কথায়। শিল্পী হিসাবে, এবং মানুষ হিসাবে, তাঁর গড়ে ওঠার কাহিনিটুকু একবার জেনে নেওয়া যাক।

 

জন্ম ১৯২৭ সালের ১ মার্চ। পুরো নাম Harold George Bellanfanti। বেলানফান্টি থেকে বেলাফন্টে-তে রূপান্তর অনেক পরের কথা। বেলাফন্টের বাবা ও মা, দুজনেরই আদি বাসস্থান ওয়েস্ট ইন্ডিজে। বাবা ছিলেন ফরাসিভাষী মার্টিনিক দ্বীপের বাসিন্দা, মায়ের বাস ছিল ইংরেজিভাষী জামাইকাতে। দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে তাঁরা জীবিকার সন্ধানে আমেরিকায় চলে আসেন এবং নিউ ইয়র্কের কৃষ্ণাঙ্গ মহল্লা হার্লেমে মাথা গোঁজার মতো একটু আশ্রয় করে নেন। বাবা পাচকের কাজ করতেন, মা ছিলেন লোকের বাড়ির পরিচারিকা। হ্যারির বয়স যখন ছ বছর, তখন তাঁর বাবা চলে যান স্ত্রী-পুত্রকে ছেড়ে। মেলভিন বেলাফন্টে তাঁর নিজের সামান্য আয়টুকু সম্বল করে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে দিন গুজরানের চেষ্টা করে যেতে থাকেন। পরিবারটির কোনও বৈধ পরিচয়পত্র ছিল না। সে-যুগে সোশ্যাল সিকিউরিটির বাঁধন তেমন শক্ত ছিল না বলেই তাঁরা আমেরিকায় বাস করতে পারছিলেন। তবু মাঝে মাঝে পুলিশ এসে হার্লেমের শ্রমিক বস্তিতে এসে হানা দিত অবৈধ নাগরিকদের খোঁজে। সে-খবর পাওয়া মাত্রই মেলভিন তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে কোনও প্রতিবেশীর বাড়িতে লুকিয়ে পড়তেন।

আর্থিক লড়াই বেশিদিন চালাতে পারেননি মেলভিন। হ্যারির বয়স যখন আট, তখন দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি ফিরে যান তাঁর নিজের দেশ জামাইকায়। সেখানে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে তিনি সংসার পেতে বসেন।

আট থেকে তেরো— কৈশোরের এই বছরগুলি হ্যারি কাটিয়েছিলেন জামাইকায়। কীভাবে? ১৯৫৯ সালে কার্নেগি হলের কনসার্টে জামাইকা ফেয়ারওয়েল গানটি গাওয়ার আগে বেলাফন্টে বলেছিলেন, “…প্রধানত অন্য ছেলেদের সঙ্গে মিশে সমুদ্রে সাঁতার কেটে। আর সেই সঙ্গে বন্দরে নাবিকদের কাছে নানা গল্প আর গান শুনে।” উডি গাথরি জীবনে প্রথম সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন এক জুতো-পালিশওয়ালা কিশোরের কাছে, আর বেলাফন্টের প্রথম শিক্ষাগুরু বন্দরের এইসব নাবিকের দল। পরবর্তীকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যালিপসো গানকে তিনি সারা বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় করে তুলবেন, এবং সে-গানের প্রথাগত চটুল বিষয়বস্তুর মধ্যেই শুধু আবদ্ধ না-থেকে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবনকেও করে তুলবেন তাঁর গানের উপজীব্য।

জামাইকায় কোনওভাবেই দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি না-পেয়ে ১৯৪০ সালে মেলভিন বেলাফন্টে সপরিবারে আবার চলে আসেন আমেরিকায়। আবার নিউ ইয়র্ক এবং আবার হার্লেম। সেখানেও যে পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হল তা নয়। পরিচারিকার কাজের পাশাপাশি টুকটাক সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ করে দুই সন্তানকে বড় করতে থাকলেন মেলভিন। পরিণত বয়সে হ্যারির মধ্যে যে অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং হাজার প্রতিকূলতাতেও হার না-মানার জেদ আমরা দেখতে পাই, সেগুলি হয়তো মায়ের কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন।

১৯৪০ সাল। বেলাফন্টে তখন তেরো বছরের কিশোর। তিনের দশকের ভয়াবহ মন্দার প্রভাব তখনও মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে গ্রাস করে রেখেছে। হার্লেমের দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পল্লীর আরও দশজন কিশোরের মতো হ্যারিও তাঁর কৈশোর এবং প্রথম যৌবন অতিবাহিত করেন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। বর্ণবিদ্বেষের নৃশংস চেহারা স্বচক্ষে দেখতে দেখতে, প্রতিনিয়ত নিজে তার শিকার হতে হতে, হ্যারি বড় হয়ে উঠতে থাকেন। পড়াশোনায় তাঁর স্পৃহা ছিল না, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষাটুকুর পর আর তিনি স্কুলের ছায়া মাড়াননি। জীবনে কোনও লক্ষ্য নেই, উচ্চাশা নেই, এ-জীবন নিয়ে কী করবেন কিছুই জানেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ যৌবনে পা দিয়ে, মাত্র সতেরো বছর বয়সে, তিনি নাম লেখালেন নৌবাহিনিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে তখনও কিছু দেরি আছে। সেনাবাহিনিতে প্রচুর লোক প্রয়োজন, কার বৈধ পরিচয়পত্র আছে আর কার নেই— সেসব দেখার সময় কোথায় তখন? সেইজন্যেই হয়তো সেনাবাহিনির সামান্য চাকরিটি তাঁর জুটে গিয়েছিল।

কিন্তু যুদ্ধ তো আর চিরদিন চলবে না। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে হ্যারি তাঁর চাকরিটি খুইয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। কয়েক মাস বেকার থাকার পর নতুন একটি চাকরি জুটল। নিউ ইয়র্কের এক অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙে দারোয়ানের চাকরি।

তখনও পর্যন্ত বেলাফন্টের জীবনে সঙ্গীত বা শিল্পকলার কোনও স্থান নেই। কিন্তু ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে একটি নাটক দেখার পর হঠাৎই তাঁর জীবনের ধারা আমূল বদলে যায়। হার্লেমের “আমেরিকান নিগ্রো থিয়েটার” নামে একটি দলের নাটক— “হোম ইজ দ্য হান্টার”। নাটকটি দেখে এতই মুগ্ধ হন বেলাফন্টে যে তৎক্ষণাৎ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, অভিনেতা হওয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই।

অতঃপর আমেরিকান নিগ্রো থিয়েটারের রিহার্সাল রুমের আশেপাশে তাঁর ঘোরাফেরা শুরু হয়। ক্রমে অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি মেলে। প্রথম শুধুই তল্পিবাহক, তারপর ছোটখাট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ। অভিনয়ের ব্যাকরণ শেখার তাগিদে আরউইন পিসকাটোরের বিখ্যাত ড্রামাটিক ওয়ার্কশপে তিনি শিক্ষার্থী হিসাবে নাম লেখান। এই ওয়ার্কশপে তার সহ-শিক্ষার্থী ছিলেন ভবিষ্যতের দুই দিকপাল অভিনেতা— মার্লন ব্র্যান্ডো ও সিডনি পয়টিয়ার। হ্যারির মতো সিডনিও আদতে জামাইকার মানুষ। পরবর্তীকালের দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু, অথচ সেই প্রথম যৌবনে দুজনের মধ্যে বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। সিডনি পরে লিখেছেন:

[I] didn’t trust him one bit, but I kind of liked him because he seemed very complex. On the one hand he could kill you; on the other hand he could be very outgoing, very open, very giving and very helpful. The trick was, you never knew which was which on what days.

সিডনি পয়টিয়ারের সঙ্গে

থিয়েটারে অভিনয় করতে আসার অল্পদিনের মধ্যেই হ্যারি দলের আরও কয়েকজন তরুণকে জুটিয়ে নিয়ে দিব্যি একটা শৌখিন গানের দল তৈরি করে ফেলেন। রিহার্সালের মাঝখানে একটু সময় পেলেই তাঁরা দল বেঁধে চলে যেতেন চিলেকোঠার ঘরে, আর গলা ছেড়ে গান গাইতেন। উদ্দেশ্য আদৌ সঙ্গীতচর্চা নয়, নিছক ফুর্তি।

কর্মজীবনে এই সময় বেলাফন্টের কিছু উন্নতি ঘটে। ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ানের কাজ ছেড়ে এবার তিনি হলেন এক পোশাকের দোকানের ঠেলাওয়ালা! ১৯৪৮ সালের জুন মাসে, বছর-দুয়েকের পূর্বরাগের পর, তিনি বিয়েটাও সেরে ফেললেন। স্ত্রীর নাম ফ্রান্সেস।

এই সময়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল বেলাফন্টের জীবনে। নাটকে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে মঞ্চে তাঁকে একটি গান গাইতে হয়েছিল। একদিন সেই নাটক দেখতে এলেন ব্রডওয়ের “রয়্যাল রুস্ট” নামে একটি ক্লাবের মালিক। দিনকয়েক বাদে তিনি এক অভিনব প্রস্তাব নিয়ে বেলাফন্টের কাছে হাজির হলেন— ক্লাবের সদস্যদের মনোরঞ্জনের জন্য বেলাফন্টেকে সেখানে গান গাইতে হবে। এক-আধদিন নয়, টানা দু সপ্তাহের জন্য বেলাফন্টের সঙ্গে চুক্তি করতে চান তিনি।

নেহাতই শখের গায়ক বেলাফন্টে। সঙ্গীতের সামান্যতম তালিমটুকুও তিনি কোথাও পাননি। তাই বলে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানও করেননি অবশ্য। রয়্যাল রুস্ট ক্লাবের বাদ্যযন্ত্রীদের সঙ্গে বারকয়েক রিহার্সাল দেওয়ার পর দিব্যি পেশাদার গায়কের ভূমিকায় তিনি নেমে পড়লেন!

১৯৪৯-এর জানুয়ারিতে দু সপ্তাহের কড়ারে শুরু হল যে-অনুষ্ঠান, সেটা থামল পাক্কা কুড়ি সপ্তাহ পরে। সেই অনুষ্ঠানের গায়ক ছিলেন অন্য এক হ্যারি বেলাফন্টে, যাঁকে আজকের দিনে আমরা চিনি না। কোনও ধরনের লোকসঙ্গীত নয়, নিছকই প্রচলিত সব পপ গান গাইতেন তিনি। শ্রোতারা দিব্যি সে-গানের তারিফ করত।

কুড়ি হপ্তা পর রয়্যাল রুস্টের পালা যখন শেষ হল, ততদিনে বেলাফন্টে বুঝে গেছেন যে গায়ক হিসাবে তাঁর ভবিষ্যৎ খুব অন্ধকার নয়। কিন্তু গান তিনি গাইবেন কোথায়, কোন শ্রোতাদের সামনে? আর কেউ তো তাঁকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়নি। বেশ, শ্রোতারা যদি তাঁর কাছে না-আসে তাহলে তাঁকেই হাজির হতে হবে শ্রোতাদের সামনে। অতএব চাকরিটি ছাড়লেন বেলাফন্টে, আর দুই বন্ধুকে সঙ্গী করে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। বিভিন্ন শহরের ছোট ছোট নাইট ক্লাব আর রেস্তোরাঁয় গান গেয়ে তিন বন্ধুর সামান্য কিছু অর্থোপার্জন হতে থাকল। ঈষৎ নামযশও হল, আর তারই ফলে আত্মপ্রকাশ করল পর পর দুটি এস-পি রেকর্ড। প্রতিটি রেকর্ডের দুই পিঠে দুটি করে গান। অখ্যাত রেকর্ডিং কোম্পানি, ততোধিক অখ্যাত শিল্পী— হাজার রেকর্ডের ভিড়ে অচিরাৎ সেগুলি হারিয়ে যায়। লাভ হয় শুধু এটুকুই যে অভিনয়ের বদলে সঙ্গীতকেই পেশা হিসাবে নেওয়ার বিষয়ে মনস্থির করে ফেলেন বেলাফন্টে। রেকর্ডের বিক্রি যত খারাপই হোক না কেন, নাইটক্লাবের গায়ক হিসাবে তাঁর জনপ্রিয়তা তো খুব খারাপ নয়।

কিন্তু জনপ্রিয়তা যত বাড়ছে, রাগী যুবক বেলাফন্টের মনে তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। নাইটক্লাবের আসরে চটুল পপ গান গাইতে মন থেকে বিন্দুমাত্র সাড়া পাচ্ছেন না তিনি। অতএব, পেশাদার গায়ক হিসাবে পায়ের নিচের জমি যখন বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে, এমনকি বিখ্যাত “ক্যাপিটল” রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে নতুন রেকর্ড বার করার জন্য একটি চুক্তিতেও তাঁর সই করা সারা, তখনই একদিন বেলাফন্টে সিদ্ধান্ত নিলেন— গান গাওয়ার পালা শেষ, বিদায় সঙ্গীত!

এতদিনে গান গেয়ে সামান্য টাকা জমেছে। দুই বন্ধুর সঙ্গে মিলে বেলাফন্টে এবার ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁ খুলে বসলেন। নাম রাখা হল, “The Sage”। রেস্তোরাঁর চরিত্র অবশ্য ঠিক সাধুসন্তসুলভ নয়, আসলে সেটি হয়ে উঠেছিল যত রাজ্যের বোহেমিয়ান গায়কদের— বিশেষত লোকসঙ্গীত গায়কদের— নির্ভেজাল এক আড্ডাস্থল। প্রচুর খদ্দের আসত রেস্তোরাঁয়, বেশিরভাগই বন্ধুবান্ধব, কিন্তু তাদের কাছ থেকে যে পাওনাগণ্ডা ঠিকঠাক বুঝে নিতে হয়, এবং আয়ব্যয়ের হিসেবও যে রাখতে হয় নিয়মিত, সেকথা তিন মালিকের মাথায় ছিল না! ফলত আট মাস পর “দ্য সেজ” দেহ রাখল।

কিন্তু ততদিনে বেলাফন্টে খুঁজে পেয়েছেন তাঁর নিজের কাজের সঠিক ক্ষেত্র— লোকসঙ্গীত। এই আট মাস তিনি মোটেই হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। প্রতিটি সপ্তাহান্তে নিয়ম করে তিনি চলে যেতেন দুশো কিলোমিটার দূরের ওয়াশিংটনে। সেখানে লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে রয়েছে দেশবিদেশের লোকসঙ্গীতের রেকর্ডের বিপুল সম্ভার; আছে লোকসঙ্গীত বিষয়ে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত প্রতিটি বই আর পত্রপত্রিকা। শনি আর রবিবার বেলাফন্টে ওয়াশিংটনে থাকতেন। গান শোনা আর পড়াশোনা চলত একই সঙ্গে। সোম থেকে শুক্র অন্য রুটিন। মুমূর্ষু রেস্তোরাঁটিতে বসে সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল গানবাজনার আসর; রাত্রে নিজের বাড়িতে বসে একাকী অনুশীলন। ভবিষ্যতে লোকসঙ্গীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক বলে যিনি পরিচিত হবেন, এখন প্রায় সবার অলক্ষ্যে চলছে তাঁর নিজেকে গড়ে তোলার পালা।

 

এই সময়ের একটি ঘটনার কথা বেলাফন্টে তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি মজার না দুঃখের তা আমার ঠিক জানা নেই। পাঠকরা বিচার করবেন।

লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের এক গ্রন্থাগারিকের সামনে একদিন এসে দাঁড়ালেন বেলাফন্টে। গ্রন্থাগারিক এই যুবককে চেনেন। প্রতি শনিবার আর রবিবার সে আসে, সন্ধ্যাবেলা লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত বসে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনে, অথবা বই পড়ে। যুবক যে নিউ ইয়র্ক থেকে এতটা পথ পেরিয়ে এখানে আসে, সেকথা অবশ্য তাঁর জানার কথা নয়।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কী চাই?”
যুবক কুণ্ঠিতভাবে বলল, “একজন লেখকের বই লাইব্রেরিতে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। যদি একটু সাহায্য করেন।”
“কোন লেখক? নাম কী?”
যুবক বলল, “ইবিড।”
“ইবিড?” বেশ মজা পেয়ে গ্রন্থাগারিক জানতে চাইলেন, “এ-নাম তুমি কোথায় পেলে?”
যুবক বলল, “অনেক জায়গায়। আমি যত বই পড়ছি তার প্রত্যেকটার শেষে রেফারেন্স লিস্টে ইবিডের নাম রয়েছে। কিন্তু আমি ইবিডের লেখা বই কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”

গ্রন্থাগারিক বুঝলেন, যুবক নিতান্ত অশিক্ষিত। ধৈর্য ধরে তিনি যুবককে বোঝালেন “ইবিড” কথাটির অর্থ। রেফারেন্স লিস্টের কোথাও ibid কথাটি থাকার মানে হল, এর ঠিক আগের রেফারেন্স যে-বই থেকে নেওয়া হয়েছে, বর্তমান রেফারেন্সটিও সেই একই বইয়ের। ইবিড কোনও লেখকের নাম নয়, কোনও বইয়ের নামও নয়।

ভারি লজ্জা পেয়ে যুবক বলল, “কিছু মনে করবেন না। আমি তো লেখাপড়া তেমন শিখিনি, নিজে নিজেই যতটা পারি পড়ার চেষ্টা করছি। এত সব আমি জানতাম না।”

সেই গ্রন্থাগারিক কোনওদিনই যেকথা জানতে পারেননি তা হল, যুবকের দৃষ্টিশক্তি খুব ভাল নয়। তার একটি চোখ পাথরের। খুব ছোটবেলায় ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে চোখের মণির ভিতর কাঁচির ফলা ঢুকে গিয়েছিল, এখন সেখানে রয়েছে পাথরের চোখ। উপরন্তু যুবক ডিসলেক্সিয়ার রোগী, যার ফলে বইয়ের পাতায় বিভিন্ন অক্ষর, শব্দ বা বাক্যকে ঠিকঠাক পড়ে উঠতে তার খুব অসুবিধা হয়। বই পড়া তার কাছে অত্যন্ত কঠিন কাজ, কিন্তু তার সাধনায় কোনও ফাঁকি নেই।

 

হ্যারি বেলাফন্টের নতুন জীবন শুরু হল ১৯৫১ সাল থেকে। এখন তাঁর রেপার্টরিতে রয়েছে শুধুই লোকগানের ডালি। সঙ্গী দুই পুরনো বন্ধু— মিলার্ড টমাস আর ক্রেগ ওয়র্ক। তিনজনেরই হাতে স্প্যানিশ গিটার, কিন্তু গানে কণ্ঠ দেন একা বেলাফন্টে। একদিন তিনজনে মিলে আবার বেরিয়ে পড়লেন দেশটা একটু ঘুরে দেখতে।

তখন আমেরিকায় লোকসঙ্গীতের জগৎ বহুদিন ঝিমিয়ে থাকার পর আবার ক্রমশ উজ্জীবিত হয়ে উঠছে। উডি গাথরির This land is your land গানটি তখন বিপুল জনপ্রিয়। বিভিন্ন ইস্কুলে বাচ্চাদের গানটি শেখানো হয়। কোনও কোনও মহল থেকে গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করার জোরালো দাবি উঠেছে। যাঁরা সেই দাবি তুলছেন তাঁরা খবরও রাখেন না যে গানটির প্রথমাংশে যেমন ইউএসএ নামক দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দীর্ঘ প্রশস্তি রয়েছে, শেষাংশে তেমনি রয়েছে ইউএসএ নামক রাষ্ট্রের নির্মম সমালোচনা, কারণ বহুদিন পর্যন্ত গানের শেষ তিনটি স্তবক কেউ রেকর্ডই করেনি। অন্যদিকে পল রোবসনের খ্যাতি তো অনেকদিন আগেই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অল্পদিন আগে ঘটে গেছে পিকস্কিলের ঘটনা। প্রবল শক্তিশালী বর্ণবিদ্বেষী সংগঠন কু-ক্লুক্স-ক্ল্যানের হত্যার হুমকি অগ্রাহ্য করে পিকস্কিলে তিরিশ হাজার লোকের জমায়েতে গান গেয়েছেন পল রোবসন। সেই আসরে তাঁর গানের সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন উডি গাথরি এবং পিট সিগার, আর দর্শকদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষানবিশ গায়ক হ্যারি বেলাফন্টে। উডি গাথরি-পিট সিগারদের গানের দল “অ্যালমানাক সিঙ্গার্স” রাজনৈতিক কারণে তখন বন্ধ করে দিতে হয়েছে বটে, কিন্তু তাদেরই উত্তরসূরি হিসাবে গড়ে উঠেছে নতুন দল “দ্য উইভার্স”। বহু জনপ্রিয় গায়ক এবং ব্যান্ডকে ছাপিয়ে টপ-সেলিং চার্টের একদম উপরের দিকে তখন উইভার্সের নাম; তাদের রেকর্ডিঙে হাডি লেডবেটার ওরফে লেড বেলির “আইরিন গুডনাইট” গানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। নেপথ্যে তখন আসরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আরও অনেক লোকগানের শিল্পীরা— ওডেটা, মালভিনা রেনল্ডস, জুডি কলিন্স, বব ডিলান, জোন বায়েজ, কিংস্টন ট্রায়ো এবং পিটার, পল অ্যান্ড মেরি।

 

একদিকে যখন লোকসঙ্গীতের মরা গাঙে বান ডেকেছে, অন্যদিকে ঠিক তখনই গোটা আমেরিকা জুড়ে শুরু হয়েছে রেড স্কেয়ার, কারণ মার্কিন সরকার সর্বত্র কমিউনিজমের ছায়া দেখছে। কুখ্যাত সেনেটর ম্যাকারথির নেতৃত্বে, প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের প্রত্যক্ষ মদতে, এবং ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সক্রিয় সহযোগিতায় মার্কিন সেনেটের পুরোনো কমিটি HUAC (House Un-American Committee) অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের স্ক্যানারের নিচে রোবসন, গাথরি এবং সিগার তো রয়েছেনই, আরও রয়েছেন চার্লি চ্যাপলিন, বেরটোল্ট ব্রেশট, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, অরসন ওয়েলস, হাওয়ার্ড ফাস্ট, ল্যাংস্টন হিউজ, লেনা হর্ন প্রমুখ। অশীতিপর বৃদ্ধা হেলেন কেলারকে পর্যন্ত HUAC ছাড় দেয়নি। আর কয়েক বছরের মধ্যে চ্যাপলিন আর ব্রেশটকে তারা দেশছাড়া করবে, পল রোবসনের গান গাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেবে, হলিউডের বহু প্রথিতযশা শিল্পীর কেরিয়ার চিরকালের মতো ধ্বংস করে দেবে তারা, শুধু কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাদের সংস্রব আছে— এই অজুহাতে।

পল রোবসন, উডি গাথরি, পিট সিগার

এই পরিস্থিতির মধ্যেই ফোক সিঙ্গার হিসাবে তাঁর নতুন জীবন শুরু করতে এলেন হ্যারি বেলাফন্টে। প্রথমে খুব নিচু পর্দায়। আগের মতোই তিনি নাইট ক্লাব আর রেস্তোরাঁর বাঁধা গায়ক। তারপর হার্লেমের আশেপাশে ছোট কোনও হল ভাড়া করে নিজের গানের প্রোগ্রাম। সেরকমই এক প্রোগ্রামে একদিন তার গান শুনতে এল দৈত্যের মতো চেহারার এক মাঝবয়সী লোক। একেবারে দেশদ্রোহী লোক সে, সরকার বাহাদুর তার গান-টান গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তখন। তা, সেই দৈত্যটির নাম ছিল পল রোবসন। সে এসে এই তরুণ গায়ককে প্রচুর উৎসাহ দিয়ে গেল, আর বলল, “তোমার নিজের গান গাও। তবেই তো প্রথমে ওরা তোমার গান শুনবে, আর তারপর জানতে চাইবে— কে তুমি?”

নিজের গান? বেলাফন্টে শিরোধার্য করে নিলেন তাঁর এই নতুন গুরুর বাণী। প্রচলিত লোকগানের পাশাপাশি বন্ধুদের সহায়তায় নতুন নতুন গান সৃষ্টি করতে থাকলেন তিনি, তার মধ্যে রইল তাঁর “নিজের গান”, মাতৃভূমি ওয়েস্ট ইণ্ডিজের ক্যালিপসো। শ্রোতারা প্রথমে সে-গান শুনল, তারপর জানতে চাইল— কে এই গায়ক? ক্রমশ গড়ে উঠতে থাকল বেলাফন্টের নিজস্ব আইডেন্টিটি। তারই ফলস্বরূপ প্রথমে রুপোলি পর্দায় নায়ক হওয়ার ডাক পেলেন তিনি, তারপর এল বিখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি থেকে গানের রেকর্ড প্রকাশ করার আহ্বান।

১৯৫৩ সালে Bright Road ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন বেলাফন্টে। তাঁর বিপরীতে ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গী অভিনেত্রী ডরোথি ড্যানড্রিজ, যাঁর সঙ্গে পরেও একাধিক ছবিতে বেলাফন্টে অভিনয় করবেন। পঞ্চাশের দশকের সেই দিনগুলিতে বহুলাংশে বর্ণবিদ্বেষী আমেরিকার চলচ্চিত্র ও নাটকের মূল স্রোতে, হলিউড এবং ব্রডওয়েতে, কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের সুযোগ পাওয়াই ছিল কঠিন। পল রোবসন সেই ট্র্যাডিশন অনেকটাই ভাঙতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু তারপর অবস্থা আবার যথাপূর্বং। অনেকদিন পর কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সেই অধিকার আবার আদায় করে নিলেন দুই বন্ধু— হ্যারি বেলাফন্টে ও সিডনি পয়টিয়ার, তৎসহ ডরোথি ড্যানড্রিজ।

ডরোথি ড্যানড্রিজের সঙ্গে ‘কারমেন জোন্স’ ছবিতে

ঠিক পরের বছরই তৈরি হল অটো প্রেমিঙ্গারের পরিচালনায় বেলাফন্টে আর ড্যানড্রিজের ফিল্ম Carmen Jones। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেলাফন্টের গানের অনুষ্ঠানও পুরোদমে চলছে। নাইটক্লাবের বদলে এবার তাঁর ডাক আসছে একটু বড় জায়গা থেকে। নিউ ইয়র্ক, লাস ভেগাস, এমনকি সানফ্রান্সিস্কো থেকে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পাচ্ছেন তিনি। কনসার্ট-গায়ক হিসাবে তাঁর জনপ্রিয়তা হু-হু করে বাড়ছে। শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেই নয়, বহু শ্বেতাঙ্গ শ্রোতাও তাঁর গান শুনতে ভিড় জমাচ্ছেন।

১৯৫৪ সালে আরসিএ কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হল বেলাফন্টের প্রথম লং-প্লেইং রেকর্ড: Mark Twain and other Folk Favourites। ১৯৫৫ সালের ২৩ জুন টেলিভিশনের পর্দায় তাঁর প্রথম আগমন। সিবিএস নেটওয়ার্কের ওই একটি প্রোগ্রামই দেশ জুড়ে তাঁকে সুপারস্টারের মর্যাদা এনে দেয়। পরের বছর প্রকাশিত হয় বেলাফন্টের তৃতীয় এলপি রেকর্ড “Calypso”। এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল সেই রেকর্ডটি, যা এর আগে পৃথিবীর কোনও দেশের কোনও গায়ক অথবা গায়িকার ক্ষেত্রে ঘটেনি। রেকর্ডের বিক্রি দশ লক্ষ ছাড়িয়ে গেল! এক মিলিয়ন! সোলো গানের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এই প্রথম! রাতারাতি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়কদের মধ্যে একজন হয়ে উঠলেন বেলাফন্টে। এবার আর নাইটক্লাব নয়, নামীদামী হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে তাঁর গান গাওয়ার ডাক আসতে শুরু করল, বহু প্রেক্ষাগৃহে তাঁর একক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে থাকল। কিন্তু গায়ের রংটি তো তাঁর বদলায়নি, কৃষ্ণাঙ্গই রয়ে গেছেন তিনি। রাত্রিবেলা হোটেলের বিশাল ব্যাঙ্কোয়েট হলে সাদা চামড়ার সব নারী-পুরুষদের সামনে গান গেয়ে তিনি আসর মাতান, আর পরের দিন সকাল হওয়ার আগে সেই হোটেলে ছেড়ে তাঁকে বেরিয়ে যেতে হয়। অন্যথায় খুব পরিষ্কার করে তাঁকে বলে দেওয়া হয় যে নিগ্রোদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।

 

রাতের পর রাত ঘুমোতে পারতেন না বেলাফন্টে। কখনও রাগে ফুঁসতেন, কখনও ঝরঝর করে কাঁদতেন; আর বুঝতেন যে গুরু পল রোবসনের মতো তাঁরও এই অপমানের হাত থেকে রেহাই নেই, কারণ তিনি এই দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। বিনোদনের জগতে এর আগেও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছেন আরও অনেক কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক-গায়িকা, যেমন লুই আর্মস্ট্রং অথবা এলা ফিটজেরাল্ড। কিন্তু যাবতীয় অপমান, নিজের এবং স্বজাতির, তাঁরা কেবল মুখ বুজে সয়েই গেছেন। বেলাফন্টে অন্য ধাতুতে গড়া। রেকর্ড, কনসার্ট আর চলচ্চিত্রের সুবাদে তিনি তখন বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক। চৌরাস্তার মোড়ে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। তাঁর সামনে দুটি রাস্তা। প্রথমটি বেছে নিলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে আরও অনেক খ্যাতি-সম্মান-সম্পদ… কিন্তু সেজন্য বিশেষ কিছু বিতর্কিত বিষয়ে তাঁকে চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। দ্বিতীয় রাস্তাটি বড় বিপদসঙ্কুল, সে-পথে হাঁটলে রাষ্ট্রযন্ত্রের চক্ষুশূল হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা। জ্বলন্ত উদাহরণ স্বয়ং রোবসন। বেলাফন্টে দ্বিতীয় রাস্তাটি বেছে নিলেন। কৃষ্ণাঙ্গদের লাঞ্ছনা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাজ করছে যেসব সংগঠন, তাদের সদস্য হলেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলির সঙ্গে গড়ে উঠল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। দু হাতে টাকা রোজগার করতে থাকলেন তিনি, আর দু হাতেই টাকা জোগাতে থাকলেন এইসব সংগঠনের নানা প্রোগ্রামে।

মনে আছে, নজরুল মঞ্চে তাঁর গানের অনুষ্ঠানটিতে পিট সিগার বলেছিলেন, “Martin Luther King, Jr., with his non-violence tactics, has changed the face Ameraca.” এই মার্টিন লুথার কিং-এর জীবদ্দশায় বেলাফন্টে হয়ে উঠেছিলেন প্রায় তাঁর ডান হাত। সেই দিনগুলির কথা স্মরণ করে সিডনি পয়টিয়ার পরে লিখবেন, “Harry at that time was deeply involved in the Civil Rights movement on every level.”

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সঙ্গে

ততদিনে এফবিআইয়ের অফিসে হ্যারি বেলাফন্টের নামে ফাইল খোলা হয়েছে, কিন্তু অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী বেলাফন্টের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও পদক্ষেপ করার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না তারা।

পাঁচের দশকে যিনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ম্যাটিনি আইডল, ছয় ও সাতের দশকে তাঁর পরিচয় হয়ে দাঁড়াল নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক বিশ্বস্ত যোদ্ধা, আটের দশকে আফ্রিকার নিরন্ন মানুষের সাহায্যার্থে নিবেদিত “ইউএসএ ফর আফ্রিকা” কর্মসূচির প্রধান সংগঠক, নয়ের দশকে ইউনিসেফের বিশেষ দূত হিসাবে দেশে দেশে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করার প্রক্রিয়ার প্রধান কাণ্ডারী। এইসব কর্মসূচির নিচে ক্রমশ চাপা পড়ে যেতে থাকে তাঁর গায়ক ও অভিনেতার পরিচয়।

আটের দশকে বেলাফন্টের কাছে এক সাংবাদিক একবার জানতে চেয়েছিলেন যে জনপ্রিয়তায় ভাঁটার টান, নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কমে আসা, অথবা বেস্ট-সেলিং চার্ট থেকে নিজের নামের অনুপস্থিতি— এগুলিকে তিনি কীভাবে গ্রহণ করছেন? বেলাফন্টের সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল এইরকম:

I’ve been on enough charts and played that game. But I wasn’t won over by the game. I haven’t lost the vitality because I haven’t been burnt out by the industry. I haven’t played their game.

 

কেমন গায়ক ছিলেন হ্যারি বেলাফন্টে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক, সঙ্গীতকে তিনি নিজে কী চোখে দেখতেন।

As one crosses the length and breadth of this country, each region reflects its own unique styles, whether it be in ways of dress, language, tastes in food, and, most significantly, in music. What most people are not aware of are the vast riches that can be found in America in what I call ‘hidden’ cultures. I believe the music of these hidden cultures is gar richer and more reflective of what America really is, than what is suggested by much of the music we hear blazing across the air-waves.

এই সুপ্ত সংস্কৃতির সন্ধানেই কেটেছে গায়ক বেলাফন্টের সুদীর্ঘ জীবন। একসময় তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল, “ক্যালিপসো কিং”। এই বিশেষণ তাঁর পছন্দ হয়নি। কোনও একটি ঘরানায় আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাননি তিনি। স্বদেশের, এবং বিশ্বের, নানা অঞ্চলের সঙ্গীতকে মানুষের দরবারে হাজির করাই ছিল তাঁর ব্রত। বেলাফন্টে সত্যিই ‘ফোকসিঙ্গার’ কিনা, সে-বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক সঙ্গীতবিশারদ। সত্যিই তো, উডি গাথরি, চার্লস সিগার বা পিট সিগারের মতো বেলাফন্টে কোনওদিন গোটা দেশ চষে বেড়িয়ে সাধারণ মানুষের মেঠো সুর সংগ্রহ করেননি; আবার লেড বেলির মতো গ্রামের মাটি থেকে জন্মাবধি দেহাতি সুর শুনতে শুনতেও তিনি উঠে আসেননি। পাশাপাশি একথাও সত্যি যে, ফোকসিঙ্গার বলে নিজেকে তিনি দাবিও করেননি কখনও। নিজেকে তিনি বলতেন ‘ইন্টারপ্রেটার’। বিভিন্ন ঘরানার লোকসঙ্গীতের নিজস্ব ইন্টারপ্রিটেশন শ্রোতার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি।

আজ সেই ইন্টারপ্রিটেশন শুনতে শুনতে দুটি জিনিস আমার নজর কাড়ে। এক, প্রতিটি গানের ডিজাইন। শুধু সুর নয়, শুধু গানের কথা, গানের তাল-লয় অথবা যন্ত্রানুষঙ্গ নয়, এই সব কিছুর সুষম বিন্যাসে গঠিত প্রতিটি গানের ইউনিক ডিজাইন। দুই, এইসব গানে কোরাসের ব্যবহার। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া একা গান গাইতে বিশেষ পছন্দ করেন না বেলাফন্টে, প্রায়শই তাঁর গানে মিশে থাকে সম্মিলিত কণ্ঠের কোরাস। কোন গানে কীভাবে তিনি কোরাস ব্যবহার করেছেন, শুধু তাই নিয়েই একটি বিশাল প্রবন্ধ লেখা যায়। Island in the sun গানটিতে ধরতাইয়ের অংশটুকু ছাড়া একটিমাত্র লাইনে শুধু কোরাস রয়েছে, লাইনটি হল: Never let me miss carnival। অথবা ধরা যাক Swing Dat Hammer গানটির কথা। সেখানে ধরতাইয়ের পর কোরাস ব্যবহার করা হয়েছে দুটি মাত্র লাইনে। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু অকারণে ডেটাবেস বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। মন দিয়ে বেলাফন্টের গানগুলি শুনলেই পাঠক বুঝতে পারবেন, কোরাসের কী সুচিন্তিত, বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার ছড়িয়ে রয়েছে সেসব গানের ছত্রে ছত্রে।

দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে অনেক নতুন গায়ক-গায়িকাকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনার চেষ্টা করেছেন বেলাফন্টে। ১৯৫৯ সালে Belafonte at Carnegie Hall নামের লাইভ রেকর্ডিঙের বিপুল সাফল্যের দু বছর পর আবার কার্নেগি হলে ফিরে এসেছিলেন বেলাফন্টে। এবারের ডাবল অ্যালবামটির নাম ছিল Belafonte returns to Carnegie Hall। সেই প্রোগ্রামে বেলাফন্টে নিজে খুব বেশি গান করেননি, তার বদলে তিনি একে একে দর্শকদের সামনে উপস্থিত করেছিলেন ওডেটা, মিরিয়াম মাকেবা, চাদ মিচেল ট্রায়ো এবং বেলাফন্টে ফোক সিঙ্গারসকে। ১৯৬২ সালে বেলাফন্টের Midnight special রেকর্ডের ওই একই নামের গানটিতে (প্রসঙ্গত, গানটির রচয়িতা লেড বেলি) হারমোনিকা বাজানোর মধ্য দিয়েই রেকর্ডিঙের জগতে প্রথম পা রেখেছিলেন বব ডিলান। টেলিভিশনে “Tonight with Belafonte” প্রোগ্রামটির একের পর এক এপিসোডে বেলাফন্টে নতুন নতুন গায়ক-গায়িকাদের দর্শকদের সামনে উপস্থিত করেছেন। পাশাপাশি একথাও সত্যি যে বর্ণবিদ্বেষের গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন সেই সময়ের আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ শ্রোতাদের বিরাগভাজন হওয়ার তোয়াক্কা না-করে কৃষ্ণাঙ্গ বেলাফন্টের সঙ্গে দ্বৈত গানের স্টেজ প্রোগ্রাম করেছিলেন অন্তত দুজন শ্বেতাঙ্গিনী গায়িকা— জুলি অ্যান্ড্রিউজ এবং নানা মুস্কাউরি। আর এক প্রতিবাদী গায়িকা জোন বায়েজ কোনওদিন বেলাফন্টের সঙ্গে দ্বৈত গান না-করলেও তিনি তো বরাবরই ঘোষিত বেলাফন্টেভক্ত। বেলাফন্টের দীর্ঘদিনের বন্ধু অড্রে হেপবার্ন আফ্রিকায় খাবার আর ওষুধ সরবরাহের ক্লান্তিকর কাজে তাঁর সহকারীর কাজ করেছিলেন।

অড্রে হেপবার্নের সঙ্গে

বাঙালির বোধহয় দুর্ভাগ্য, জামাইকা ফেয়ারওয়েলের মতো মিষ্টি গানের শিল্পী হিসাবেই তারা বেলাফন্টেকে মনে রাখল। একই রকম মন-কেমন-করা অন্য গানগুলি (Come back Liza, Kingston market, Lucy’s door) আমাদের মন ছুঁতে পারল না। বেলাফন্টের রাজনৈতিক গানগুলির (Those three are on my mind, John Henry, Pastures of plenty) খবরও আমরা রাখলাম না। কাকে বলে Prison song (Water boy, Swing Dat Hammer), কোনটাই বা ব্যালাড (Scarlett ribbons, My old Paint), কোনটা নিগ্রো স্পিরিচুয়াল (My Lord, what a morning’, Swing low, sweet chariot)— সেসব বৃত্তান্ত নিয়ে আমরা মাথাও ঘামালাম না কোনওদিন।

বাকি রইল বেলাফন্টের হাসির গান। সেখানে তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বোধহয় নেই। Man Piaba, Darling go home, Scratch Scratch, A hole in the bucket— আহা, সে যে কী সব গান এক-একটি! সবচেয়ে বড় রসিক মানুষ হল সে-ই, যে নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে পারে। বেলাফন্টে পারতেন। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, “আমি যতটা ভালো গায়ক, তার চেয়ে অনেক ভালো অভিনেতা। নইলে গান গাইতে না-জেনেও সারা জীবন ধরে কি গায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে পারতাম?”

অনেক কিছুই হয়তো আমরা জানি না বেলাফন্টের সম্পর্কে। তবু, এটুকুই বা কম কী? মৃত্যুর পর কয়েক হাজার মাইল দূরের এক দেশে তাঁকে নিয়ে যে এত চর্চা হবে, সেকথা কি বেলাফন্টে ভাবতে পেরেছিলেন কোনওদিন?

 

হ্যারি বেলাফন্টের সম্পর্কে এই লেখাটা শুরু হয়েছিল ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার ঢঙে, সেভাবেই না-হয় শেষ হোক। ছোট্ট একটা গল্প শুনিয়ে এই লেখায় ইতি টানি।

আটের দশকে যখন বেলাফন্টের গানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, তখন ছোকরা এক বেলাফন্টে-ভক্তকে চিনতাম। সে আবার নিজেকে ফিল্মমেকার বলে দাবি করত। সারা জীবনে একটাই মাত্র ডকুমেন্টারি করেছে সে, তা-ও আবার আট মিলিমিটারে। নিছকই শখ মেটানোর প্রচেষ্টা বোধহয়। ওসব ফিল্মকে আমরা পাত্তাও দিতাম না।

তা, সেই ছোকরার এতই দুঃসাহস যে ছবিটা বেলাফন্টেকে উৎসর্গ করবে বলে ঠিক করল সে। কিন্তু কোনও ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া কি ক্রেডিট টাইটেলে তাঁর নাম দেওয়া উচিত? এই দুশ্চিন্তা মাথায় ঢুকে পড়ায় সে পুরনো রেকর্ডের কভার থেকে বেলাফন্টের ঠিকানা জোগাড় করে সরাসরি তাঁকে চিঠি লিখে বসল। সে লিখল, “আমার সমস্ত সঞ্চয়ের ভাণ্ডার নিঃশেষ করে, আমার জীবনের সাত-সাতটা বছর ব্যয় করে, আমার দেশের এক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন নিয়ে তৈরি-করা এই ছবিটি আমি তোমাকে উৎসর্গ করতে চাই। কারণ তোমার গানই আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার উৎস। এই সামান্য উপচার গ্রহণ করতে তোমার কি আপত্তি আছে?”

যেভাবে সে চিঠিটি পাঠিয়েছিল, মাস দুয়েক পরে ঠিক সেই অবস্থাতেই সেটি তার কাছে ফিরে এল। খামের উপর আমেরিকার কোন এক পোস্টাপিসের রাবার স্ট্যাম্প, সেখানে লেখা আছে: Moved. Left no address.

গল্পটা এখনও শেষ হয়নি, অল্পই বাকি রয়েছে। সেদিনের সেই ছোকরা আজও বেঁচে আছে, এখন বার্ধক্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে সে। তার খুব ইচ্ছে, বেলাফন্টের একটা জীবনী লিখবে, বাঙালি পাঠকের সঙ্গে প্রিয় গায়কের পরিচয় করিয়ে দেবে। সেই বইয়ের একটি বর্ণও বেলাফন্টে পড়তে পারবেন না। না-পারুন, তাতে কী যায়-আসে? এই ইন্টারনেটের যুগে কারও সঠিক ঠিকানা জোগাড় করা তো আর কঠিন কিছু নয়। এক কপি বই সে বেলাফন্টেকে উপহার পাঠাবে, প্রচ্ছদে নিজের ছবিটি দেখবেন বেলাফন্টে, তাঁর বইয়ের র‍্যাকের এক কোণে সাজানো থাকবে বইটি— অনেকদিন ধরে এরকম একটা সুপ্ত বাসনা সে মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল।

কিন্তু… বড্ড দেরি হয়ে গেল যে! বইয়ের কাজ শেষ হওয়ার আগেই বেলাফন্টে চলে গেলেন, কোনও ঠিকানা রেখে গেলেন না।

 


তথ্যসূত্র:
  • Belafonte, Harry and Shnayerson Michael. My Song: A Memoir of Art, Race, and Defiance. Vintage. 2012.
  • Shaw, Arnold. Belafonte, an unauthorised biography. Cilton & Co. 1960.
  • Poitier, Sydney. This life. Balantine Books. 1981.
  • মৈত্র, দেবাশিস। সূর্যালোকিত এক দ্বীপ। জলার্ক। এপ্রিল-জুন, ১৯৯৭।
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...