বাঙালির মনন-ভুবন এবং লোকনাথ ভট্টাচার্য

বাঙালির মনন-ভুবন এবং লোকনাথ ভট্টাচার্য | বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

 



সাহিত্য-গবেষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

 

 

 

 

প্রকৃত চিন্তকের পদবাচ্য তিনিই, যিনি চিন্তা করার পাশাপাশি স্বীয় চিন্তাকে পাঠকের সামনে পেশ করে পাঠককেও চিন্তিত হতে বাধ্য করবেন। লোকনাথ ভট্টাচার্য ঠিক এভাবেই সমকালের এক বিশিষ্ট চিন্তক। প্রশ্ন একটাই, এহেন প্রতিভাবান ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত সাহিত্যিক পশ্চিমবঙ্গে পূর্ণ বিস্মৃত না হলেও প্রায় অবহেলিত একটি নাম হয়ে কেন রইলেন

 

এক স্বল্পাংশ বাংলাভাষী পাঠকই লোকনাথ ভট্টাচার্যের নামমাত্র শুনে থাকবেন। অল্পতর অংশ তাঁর লেখা বাংলা বইগুলির কথা জানেন। সবচেয়ে স্বল্পাংশ তাঁরাই, যাঁরা তাঁর বিরলদৃষ্ট দুই-একটি বইয়ের পাতা বোধহয় উল্টেপাল্টে দেখেছিলেন। অথচ এতে তাঁর গ্রন্থপাঠের সৌভাগ্য হয়েছে যাঁদের, তাঁরা গোয়েন্দা কাহিনি পড়ার আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। কোনও লেখা পড়ার আগে পাঠকেরও যে সম্যক প্রস্তুতি প্রয়োজন, তাঁর লেখা পড়লে বারবার তাই বোধ হয়। পাঠককে মননের দরজাগুলি সবসময় খুলে রাখতে হয় ‘হাট’ করে, ‘স্বরাজ’ মেলে ঠিক, তাঁর লেখা ভাল করে পড়লে, অনুধাবন করলে, লেখার অন্তর্লীন পরিসরে কী রয়েছে তা বুঝতে পারলে। ‘চিন্তক’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল ‘চিন্তাকারী’ বা ‘যে চিন্তা করে’। তবে অভিধানের অর্থের বাইরেও শব্দটির বাচ্যাতিরিক্তের ব্যঞ্জনা রয়েছে বলেই মনে হওয়া সঙ্গত। প্রকৃত চিন্তকের পদবাচ্য তিনিই, যিনি চিন্তা করার পাশাপাশি স্বীয় চিন্তাকে পাঠকের সামনে পেশ করে পাঠককেও চিন্তিত হতে বাধ্য করবেন। লোকনাথ ভট্টাচার্য ঠিক এভাবেই সমকালের এক বিশিষ্ট চিন্তক।

বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে শুরু করে একুশ শতকের প্রারম্ভিককাল পর্যন্ত লোকনাথ ভট্টাচার্য সাহিত্যসৃজনের মাধ্যমে বাঙালি পাঠককে আবিষ্ট রেখেছিলেন। এই সাহিত্যের একদিকে সৃজনশীল সংরূপ যেমন কথাসাহিত্য (উপন্যাস ও ছোটগল্প), কবিতা ও নাটক ছিল; অন্যদিকে ছিল মননশীল সাহিত্যের ধারাও। অর্থাৎ প্রবন্ধ ও অনুবাদের কথাই বলা হচ্ছে। দুটি ধারাতেই তিনি ছিলেন স্বাতন্ত্র্যের অভিলাষী। লেখার মধ্যে প্রচলিত ধারার এক প্রতিস্পর্ধী স্বর তিনি তৈরি করেছেন। উত্তর-শরৎচন্দ্র পর্বে যখন বাংলা উপন্যাসে নিটোল কাহিনি বর্ণনার ঢল নেমেছে; তখন কাহিনিকেই আটটি উপন্যাসে একরকম বর্জন করেছেন। তাঁর রচনাবলির নবম খণ্ড সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এই খণ্ডে তাঁর গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত আরও দুটি উপন্যাস (ধূলায় ঈশ্বরীর পা এবং তিমির তরাই-এ পক্ষাঘাত) গ্রন্থিত হয়েছে। এই পরিসরে তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে দশটি। প্রাসঙ্গিকতার সূত্রে আসবেন কমলকুমার মজুমদার, দেবেশ রায় প্রমুখেরা। দেবেশ রায়-এর ‘উপন্যাস’ প্রচলিত ‘উপন্যাস’ নয় ঠিক, তা ‘আখ্যান’ গোত্রীয়। উপন্যাসের শিরোনামে ‘বৃত্তান্ত’ (তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত, মফস্বলী বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, আত্মীয় বৃত্তান্ত), ‘প্রতিবেদন’ (শিল্পায়নের প্রতিবেদন, দাঙ্গার প্রতিবেদন, খরার প্রতিবেদন, একটি ইচ্ছামৃত্যুর প্রতিবেদন), ‘লোকজন’ (ইতিহাসের লোকজন), এমন সব অদ্ভুত শব্দের আমদানি করেছেন তিনি। লোকনাথের উপন্যাসকে আমরা এই গোত্রেই রাখব। তা এক অনবদ্য ‘আখ্যান’ হয়ে উঠেছে। পুরাণ, ইতিহাস, সমসময় আর রূপক— তাঁর আখ্যানের পরিচিত উপাদান (‘অশ্বমেধ’ এবং গঙ্গাবতরণ— পুরাণ প্রসঙ্গ ও সমসময়; এবং রূপক— ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’)।

তাঁর বারোটি ছোটগল্প এবং ফ্রাঁক আঁদ্রে জামকে লেখা ‘নাচ অথবা একটি রহস্যের সম্ভব উদ্ধার’ (চতুরঙ্গ পত্রিকার মার্চ ১৯৮৯ সংখ্যাতে প্রকাশিত) নামক একটি ছোটগল্পেও এহেন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। তুলনার পরিসরে আসতে পারে সুবিমল মিশ্র, কমলকুমার মজুমদার প্রমুখের ছোটগল্প। ইংরেজি কবিতার ধরনে বাংলা কবিতা যখন রোমাণ্টিক কবিতার পরিসর গড়ে তুলেছে, সেখানে তিনি ফরাসি প্রতীকবাদী কবিতার ধরনকে স্বীয় কাব্যভাষায় আত্মস্থ করে নিলেন তাঁর ছটি কাব্যগ্রন্থে এবং আরও কিছু অগ্রন্থিত কবিতায়। আধুনিক গদ্যকবিতার আঙ্গিকও তাঁর কাব্যকৃতির অন্যতম পরিসর—

গৌরচন্দ্রিকা নয়, কারণ এ-কীর্তনের হে অধীশ্বর দেবতা কে-কোথায় আছো, তোমরা রক্ষা না করো যদি আমায় মিথ্যা হতে, দুঃখ নয় দুঃখকে নিয়ে আমার বেশ্যাবৃত্তি হতে, স্বপ্ন নয় স্বপ্নের রাংতা হতে— আমায় রক্ষা না করো যদি সারা-গায়ে তুচ্ছতার থুথু-মাখা কাপড় বা কপটতার হোক-না কিংখাবই হতে, যে-আমি আজকালকার সকালে-সন্ধ্যায় সাতচল্লিশ বছরের জনৈক লোকনাথ ভট্টাচার্য বই নই…”

(গুম্ভা ও জনৈক লোকনাথ, ‘ঘর’ কাব্য)

সচেতন পাঠকের কবি অরুণ মিত্রকে মনে পড়বেই। ষাটের দশকের শেষদিকে তাঁর লেখা ছটি নাটকের মধ্যে বাংলাতে স্বল্প পরিসরে তিনি অ্যাবসার্ড নাটকের আবেশ নিয়ে এলেন। অ্যাবসার্ড নাটক বলতেই বাংলাতে যে বাদল সরকার বা মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাম উচ্চারিত হয়; তাঁদের পাশে লোকনাথ ভট্টাচার্য সম্ভ্রম জাগানো একটি নাম। দুঃখের বিষয়, তাঁর নাটক বিষয়ে বিশেষ চর্চা এযাবৎ হয়নি।

আমি যে কী করে আরম্ভ করব ভাই জানি না, সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এ-শহরটা এমনিতেই অপরিচিত আজ, আমার এই শহর, যেখানে আমি বাস করেছি একদিন, যেখানে বড় হয়েছি, যাকে নিজের বোলে জানতে চাই। কিন্তু সব যেন আমার হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে, যেন আমি কিছুই জানতে পারছি না, (হঠাৎ ধোঁয়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে) এই যে— ধোঁয়াটা দেখছ, ঐ দোকান থেকে আসছে, যেন ঠিক সেইরকম একটা ধোঁয়ায় আমার ভিতরটা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। যেন এক ধূসরতায় আমার সমস্ত অস্তিত্ব পর্যবসিত হতে চলেছে।”

(শ্রী শ্রী কালীমাতা রেশন ভাণ্ডার)

সচেতন পাঠক লোকনাথের নাট্যচর্চার অভিপ্রায়কে উপলব্ধি করতে পারবেন। স্পষ্টত, জীবনের একটি বিশেষ পর্বে, ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্তই নাটক লিখেছেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে ছটি নাটক প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। জীবনের বাকি পর্বে আর লেখেননি নাটক। সমকালীন উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশ, কংগ্রেস সরকারের অনাচারে যুক্তফ্রন্টের আগমন, যুক্তফ্রন্টের অবক্ষয়ের মধ্যে নবজাগ্রত অতি বামপন্থার আবেশে বাংলা তখন উত্তাল। এই ত্রস্ত সময়ের অভিঘাতকে অ্যাবসার্ডের মোড়কে পেশ করে নাট্যভাষার নির্মাণ করেছিলেন লোকনাথ। চেনা মানুষের আগন্তুক হয়ে ওঠার ভাষ্য হয়েছিল তাঁর নাটক।

এবারে মননশীল সাহিত্যের পরিসরে আসা যাক। ফরাসি সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়ে বাংলাভাষায় বেশি প্রবন্ধ লেখা হয়নি। এক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র। ফরাসি সাহিত্যের মূল সুর বাংলাভাষায় অনুধাবনের জন্য তাঁর প্রবন্ধাবলি অবশ্যপাঠ্য। গত শতকের পাঁচের দশকের শেষদিকে আধুনিক ফরাসি কবিতা বিষয়ে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। পরে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ‘এক দিগন্ত দিনান্তের’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ফরাসি কবিতা বিষয়ে দু-চারটি বিক্ষিপ্ত প্রবন্ধ তার আগে কারও কারও লেখা থাকলেও প্রণালীবদ্ধভাবে তাঁর গ্রন্থেই প্রথম আধুনিক ফরাসি কবিতার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। বাঙালির ফরাসিচর্চার ভিড়ে লোকনাথ ভট্টাচার্য তাই এক উজ্জ্বল নাম।

প্রবন্ধের কথা বলতেই অনুবাদের কথা চলে আসে। বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে তিনি প্রথম ‘কবিতা’ পত্রিকার ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৯৫২) পৌষ সংখ্যায় র‌্যাঁবোর Voyelles, L’ Eternite এবং La Bateau Ivre কবিতা তিনটির অনুবাদ করেন যথাক্রমে স্বরবর্ণ, শাশ্বতী এবং মাতাল তরণী নামে। পরে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে র‍্যাঁবোর জন্মশতবর্ষে বুদ্ধদেব বসুর নির্দেশেই তাঁর কাব্যগ্রন্থ Une Saison En Enfer-এর বঙ্গানুবাদ ‘নরকে এক ঋতু’ সম্পূর্ণ করেন। বাঙালির ফরাসি চর্চার কয়েকটি ধারা আছে— ১) ফরাসি ভাষা শেখা, পড়া। এর দুটি ভাগ— বাড়িতে ব্যাকরণ, অভিধান, বই এনে নিজে শেখা অথবা ফরাসি শিক্ষকের কাছে তালিম। ২) ফরাসি শিখে বাংলায় অনুবাদ, বাংলায় ফরাসি সংস্কৃতি, শিল্প নিয়ে আলোচনা। ৩) ফরাসি দেশে ভ্রমণ এবং অনুশীলন ইত্যাদি সূত্রে আগ্রহ বাড়ানো বা সেসব নিয়ে লেখা এবং ৪) ফরাসি সাহিত্য সংস্কৃতিতে আগ্রহ, চর্চা, ইংরেজি মাধ্যমে অথবা, অন্য কোনও দর্শন, রাজনীতি, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস পাঠের সূত্রে ফরাসি প্রাসঙ্গিকতায় নজর দেওয়া। লোকনাথ ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্রের মতো দীর্ঘদিন ফরাসি চর্চা করেছেন, কতকাল আগে র‍্যাঁবোর কাব্য ‘নরকে এক ঋতু’ নামে অনুবাদ করেছেন, তারপরে আঁরি মিশো, সার্ত্র্‌ অনুবাদ এবং ফরাসি সাহিত্য বিষয়ে মূল্যবান একগুচ্ছ প্রবন্ধ, যাতে অনুবাদের অংশও আছে। অরুণ এবং লোকনাথ উভয়েই সৃজনশিল্পী, প্রাবন্ধিক এমনকি উপন্যাস রচয়িতা। পাশাপাশি, ফরাসি উচ্চারণ প্রয়োগেও উভয়ের পারঙ্গমতার কথা জানা যায়। অবশ্য, দুজনেই ভিন্ন ঘরানায় বিকশিত। কখনও কাছে, আবার কখনও সুদূরের পিয়াসী। ইংরেজি চর্চার সূত্রপাতের পরেই বাঙালির ফরাসিচর্চার সূচনা এবং সেই আবহে চাকরি এবং শাসকপ্রীতি অপেক্ষা সংস্কৃতিপ্রীতিই প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য স্কুল ইন্সপেক্টর উড্রোসাহেবকে ফরাসি বই পড়ে শোনাতেন। তাঁর উচ্চারণের প্রশংসা হত (১৮৬০-৬১ নাগাদ)। তিনি ফরাসি থেকে ‘পল বর্জিনিয়া’ অনুবাদ করেছিলেন। ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই অনুবাদ। ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় জ্যোতিদাদা ভাল করে ফরাসি শিখে ব্যাপক অনুবাদ শুরু করেছিলেন। আশুতোষ চৌধুরী এবং প্রিয়নাথ সেন, ভাল ফরাসি জানতেন। প্রমথ চৌধুরীর ফরাসিপ্রীতি, ‘ফরাসি সাহিত্যের বর্ণপরিচয়’ প্রবন্ধ এবং মেরিমের গল্প অনুবাদের কথা পাঠকের অবগতির কথা। অরবিন্দ, পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত, সমীরকান্তি গুপ্তের লেখায় সেই অর্জনের অল্প পরিচয় আছে। পরবর্তী পর্বে চিত্র এবং সাহিত্যে ধারাবাহিক আগ্রহে ভ্রমণের সূত্রে সৈয়দ মুজতবা আলি, সতীনাথ ভাদুড়ি, কমলকুমার মজুমদার, নীরদ মজুমদার, পরিতোষ সেন, চিন্তামণি কর প্রমুখ বিখ্যাত লেখক-শিল্পীদের ফরাসিপ্রীতি এবং ফরাসি পারঙ্গমতার কথা মনে আসবেই। শান্তিনিকেতনেও রেনোয়াঁ, লেভি প্রমুখ পণ্ডিতেরা ফরাসি চর্চা করতেন বলে জানা যায়। বিষ্ণু দে ফরাসি জানতেন বলে জানা যায়। অরুণ মিত্রের পারম্পর্যময় ফরাসি চর্চা, শিক্ষকতা, অনুবাদ এবং প্রবন্ধ রচনা গুরুত্বপূর্ণ। কমলকুমার, নীরদ, বিষ্ণু প্রমুখের বন্ধু, সমকালীন সৃজনশিল্পী লোকনাথ ভট্টাচার্য, যিনি আগ্রহ এবং বিবাহের সূত্রে ফরাসিমনস্ক।

সাহিত্যের যে কোনও সংরূপেই ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্থান। বস্তুত, ভাষা হল প্রকাশভঙ্গি। তাকে সম্বল করেই সাহিত্যিক তাঁর ভাবনাকে বিকশিত করেন। সাহিত্যিকের অভিপ্রায়ের তলকে পাঠক ভাষার মাধ্যমেই খুঁজে নিতে পারেন। উপন্যাসের নির্বাচিত কয়েকটি ভাষাচয়ন দেখলেই লেখকের অভিপ্রায় সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়—

১. আচ্ছা (ছবির) ভদ্রমহিলার মাথায় ঘোমটা নেই কেন?
২. এবং হয়ত হাসপাতালও আছে কাছেই কোথাও, যেখান থেকে রেডক্রশ মার্কা ঐ ঝকঝকে ভ্যানটা আসে।
৩. সভ্যজগতের সঙ্গে আমাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন বহুকাল ধরে, আলপিনটা সেই সভ্যজগতের প্রতীক
৪. যেন এইমাত্র মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের, সেই সর্বনাশের অনিবার্য লিখন তাদের গালে-কপালে-চোখের চাওয়ায়।
৫. এ পৃথিবীটা এক, এ সময়টা এক, আমরা শুধু নিজের সুবিধা বা অসুবিধার জন্যই ভাগ করেছি দেশ, পেন্সিল দিয়ে এক অখণ্ড সময়ের শাদা কাগজটাকে আজ-কাল-পরশুতে চিহ্নিত করেছি লম্বা লম্বা দাঁড়িতে। (বাবুঘাটের কুমারী মাছ)।
৬. এত দূরে বসেও আমার পক্ষে অনুমান করা সহজ যে, ওর ঐ পিঠটায় পাছাটায় আগুনের জ্বলন্ত অক্ষরে মরণই লিখছে এক নৃশংসতার পাণ্ডুলিপি
৭. আমাদের অনেকগুলো বাড়ি এ-পৃথিবীতে পড়ে রইলো, অনেক ঘরদোর-বিছানাপত্র-জলের কুঁজো-জানালার ওপর সারি সারি কত মুখ ঠোঁটের হাসি, কত দিন-মাস-বছরের ঘনীভূত গাথাকাব্য আমাদের মত মানুষের সমাজ, যেখানে আর পৌঁছাতে পারবে না কেউ। (থিয়েটার আরম্ভ সাড়ে সাতটায়)।

প্রশ্ন একটাই, এহেন প্রতিভাবান ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত সাহিত্যিক পশ্চিমবঙ্গে পূর্ণ বিস্মৃত না হলেও প্রায় অবহেলিত একটি নাম হয়ে কেন রইলেন। নেপথ্যে মুখ্যত দুটি কারণ রয়েছে বলেই মনে করেন বর্তমান লেখক:

প্রথমত, তিনি সাহিত্যের তথাকথিত বড় গোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট নন। এই গোষ্ঠীর পত্র-পত্রিকায় তাঁর কোনও লেখা প্রকাশিত হয়নি। অবশ্য, সেখানে তাঁর লেখা এবং তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়েছে। বর্তমান প্রাবন্ধিক ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় (মে, ২০১৯) তাঁর নাটক বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। “আনন্দবাজার পত্রিকা”র ‘কলকাতার কড়চা’ বিভাগে প্রাবন্ধিকের নাম সহ লেখাটির উল্লেখ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর অতি স্বল্পকালীন শারীরিক উপস্থিতি। মানসপ্রবণতায় বাংলা সাহিত্য ও ঐতিহ্যের প্রতি আসক্ত হলেও তাঁর জীবনের একটা বিরাট পর্ব ফ্রান্সে কেটেছে। প্রথমে গবেষণার কাজ ও পরে বিবাহসূত্রে ফ্রান্স তাঁর কর্মভূমি হয়ে উঠেছিল। বাংলাভাষায় ধারাবাহিকভাবে সাহিত্য রচনা করলেও তিনি এখানে অল্পই থেকেছেন। বরং, প্রথমে সাহিত্য অকাদেমি (সাহিত্য অকাদেমি কর্তৃক প্রকাশিত Indian Literature পত্রিকার সম্পাদনা) এবং পরে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-এর প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলানোর জন্য কলকাতার থেকেও তাঁর দিল্লিতে অধিক সময় কেটেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, বিদ্যাচর্চার এক উল্লেখযোগ্য সংরূপ Diaspora Studies তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেল। অভিবাসনের মূল অর্থে রয়েছে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসন। অবশ্য, উত্তরাধুনিক ভাবনাবিশ্বে ভুবনায়নের অনিবার্য দ্যোতনায় শব্দটির অর্থপ্রসার ঘটেছে। জীবিকা এবং গবেষণার নিমিত্ত মাতৃভূমি থেকে দূরে নিঃসঙ্গ প্রবাসজীবনও আজ অভিবাসন তত্ত্বের আওতাভুক্ত। লোকনাথ ভট্টাচার্য এদিক থেকে তাই ‘বাংলা ডায়াস্পোরা’ সংরূপের এক উল্লেখযোগ্য লেখক।

কেন পড়া উচিত লোকনাথ ভট্টাচার্যের সাহিত্য, আশা করি পাঠকমহোদয় বুঝতে পারছেন। মননের স্পর্শ পেতে পড়া জরুরি। যে ‘মননে স্বরাজ’ আনার কথা দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেছেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে চন্দননগর শহরে একটি বক্তৃতায়, বছর ত্রিশেক পরে আরেক বাঙালি লেখক লোকনাথ ভট্টাচার্য সেই কাজই করেছেন বাংলা ভাষায় তাঁর মৌলিক সাহিত্যসৃজনের মাধ্যমে। উপন্যাস-ছোটগল্প মানে শুধু তরল কাহিনি নয়, তাতেও যে পড়াশোনা প্রয়োজন, মেধা দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন তাই। তাঁর সাহিত্যসৃজনের সর্বত্র এই ‘বোধি’র বিকাশ। বাংলা ভাষায় ফরাসিচর্চার উপেক্ষিত অথচ উর্বর ধারাকে গতি দিয়েছেন তিনি। বুদ্ধদেব বসুর তাগিদে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে র‍্যাঁবোর জন্মশতবর্ষে, তাঁর কাব্যের বঙ্গানুবাদ ‘নরকে এক ঋতু’ দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ক্রমশ তা পর্যবসিত হয়েছিল মৌলিক প্রবন্ধের পরিসরে। ফরাসি কবিদের কাব্যকৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম প্রণালীবদ্ধ চর্চা তিনিই করেছেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘এক দিগন্ত দিনান্তের’ গ্রন্থে প্রথম এই নিদর্শন দেখা গেছে। এই ধারায় তাঁর সহধর্মিনী অধ্যাপক ফ্রাসঁ ভট্টাচার্য গুরুত্বপূর্ণ এক নাম। তাঁর যাত্রাপথ অবশ্য উলটপুরাণের। বাংলা ভাষা শিখে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অনেক সাহিত্যকর্ম ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’, ‘নষ্ট নীড়’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’, ‘অশনি সঙ্কেত’, জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’, তাঁর অনুবাদ-মুকুটের কয়েকটি উজ্জ্বল পালক। প্রাসঙ্গিক আবহে ‘এবং মুশায়েরা’ প্রকাশনীর কর্ণধার মাননীয় শ্রী সুবল সামন্ত মহাশয় আন্তরিক ধন্যবাদার্হ। লোকনাথ ভট্টাচার্যের মতো বিরল, ব্যতিক্রমী এক মননশীল লেখকের লেখার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করানোর জন্যে। প্রথমে তাঁকে নিয়ে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ও ‘লোকনাথ ভট্টাচার্য: জীবন ও সাহিত্য’ শীর্ষক মনোজ্ঞ গ্রন্থ প্রকাশ এবং নয়টি খণ্ডে প্রকাশিত লোকনাথবাবুর যাবতীয় লেখার সংকলন প্রকাশের সূত্রে তিনি কৃতজ্ঞতাভাজন অবশ্যই। তাঁর সূত্রেই লোকনাথ সাহিত্যের গহনে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে বাংলাভাষী পাঠক। অলমিতি…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...