ডারউইনবাদ এবং হিন্দুত্বের বিবর্তন

সুব্রত রায়

 


প্রাবন্ধিক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির নেতৃস্থানীয় কর্মী

 

 

 

 

ইতিহাসের শিক্ষা এটাই, সভ্যতার অগ্রগামিতার চাকা গা-জোয়ারিভাবে পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। মৌলবাদ যত আগ্রাসীই হোক না কেন, সভ্যতার গতিপথে সাময়িক বিচলন ঘটানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। এদেশে বিজ্ঞানমনস্ক ও ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, তাঁরাও ওদের একেবারে ‘ওয়াক ওভার’ দিয়ে দেবেন না। ফলে পরিস্থিতি কঠিন হলেও নৈরাশ্যের কারণ নেই

 

Today, the theory of evolution is an accepted fact for everyone but a fundamentalist minority, whose objections are based not on reasoning but on doctrinaire adherence to religious principles.

—JAMES WATSON (নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী ও ডিএনএ গঠনের সহ-আবিষ্কর্তা)

 

‘ব্যাদে’ আছে কি নেই সেই প্রশ্ন

১৯৩৮ সালে শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত মেঘনাদ সাহার বক্তৃতা, তাকে কেন্দ্র করে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় জমাটি বিতর্ক এবং বেদ সম্পর্কে শিক্ষিত হিন্দুর মনোভাব নিয়ে মেঘনাদের বক্রোক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিটি অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারই ভারতীয় মুনিঋষিদের অধীত সহস্রাব্দপ্রাচীন জ্ঞানের চর্বিতচর্বণ মাত্র— এরকম অদ্ভুত যুক্তি মেঘনাদ মানতে পারেননি। মেঘনাদের অন্যতম সমালোচক অনিলবরণ রায় তো বটেই, তাঁকে সমর্থন করতে গিয়ে মোহিনীমোহন দত্তও ডারউইনের প্রসঙ্গ এনেছেন (দ্বিতীয়োক্তজন আসলে ছদ্মনামের আড়ালে প্রথমজনই, যদিও)। সেখানে যুক্তি ছিল এই যে, জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের কথা হিন্দু দর্শনে বলা আছে এবং বিষ্ণুর দশ অবতার নাকি এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ! মোটের ওপর, জীববিবর্তন তথা আধুনিক বিজ্ঞান এবং বেদ সম্পর্কে সনাতন হিন্দুর এরকম একটা মনোভাব অনেককাল ধরেই বেশ প্রচলিত। এরই বলে বলীয়ান হয়ে আব্রাহামীয় ধর্মগুলির সঙ্গে তুলনায় হিন্দুধর্মকে গোঁড়ামিমুক্ত এক উদার ধর্ম বলে দাবি করা হয়, আধুনিক বিজ্ঞানকে ধারণ করার ক্ষমতা নাকি একমাত্র এরই আছে। ইসলাম আর খ্রিস্টধর্ম গোঁড়া বলেই নাকি তাদের সঙ্গে এত যুদ্ধ করে আধুনিক বিজ্ঞানকে এগোতে হয়েছে, আর হিন্দুধর্ম উদার বলেই, এবং এমনকি, তার মধ্যে এক গভীর অন্তর্নিহিত বৈজ্ঞানিক ভাব আছে বলেই, সে নাকি প্রথম থেকেই আধুনিক বিজ্ঞানকে অন্তরে স্থান দিতে পেরেছে। এ ধরনের কথাবার্তা কতদূর অযৌক্তিক এবং হাস্যকর, সে আলোচনা মেঘনাদ করেছিলেন, এবং তারপরেও অনেকেই করেছেন। কিন্তু তবুও, এর মধ্যে ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে এক ধরনের মনোভাব লক্ষণীয়। মনোভাবটা হচ্ছে এইরকম যে, ধর্মকে তো রক্ষা করতেই হবে, তবে আজকের যুগে আর ধর্মের অজুহাতে বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে লাভ নেই, বরং বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সঙ্গতি প্রতিপাদন করেই ধর্মের মান্যতা বজায় রাখতে হবে। বলা বাহুল্য, এ আসলে হিন্দুধর্মের উদারতা নয়, যুগের বাধ্যবাধকতা মাত্র।

মেঘনাদ সাহা

কিন্তু, পৃথিবী বোধহয় পেরিয়ে এসেছে সে যুগ, বিশ শতকের শেষ পাদে প্রায় সমস্ত প্রধান ধর্মগুলোরই মধ্যে ঘটেছে মৌলবাদী রূপান্তর। ধর্মের মাথাদের এক বড় অংশ আজ মনে করছেন, আধুনিক পৃথিবীর বিজ্ঞান যুক্তিবাদ গণতন্ত্র মানবাধিকার জাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে আপস করে নয়, সরাসরি সংঘাতে গিয়েই ধর্মকে টিঁকিয়ে রাখতে হবে। তাই, উদারতার মুখোশ খসে পড়েছে আজ।

সম্প্রতি ভারতে হিন্দুত্ববাদী কেন্দ্রীয় সরকার এনসিইআরটি-র স্কুলপাঠ্য জীববিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে ডারউইনকে ছেঁটে ফেলেছেন, দেওয়া হয়েছে সিলেবাস কমানোর ‘ছাত্রদরদি’ অজুহাত। একই ‘যুক্তি’-তে ইতিহাসের পাঠ্যসূচি থেকে মুঘল শাসনকাল বাদ পড়েছে, বাতিল হয়েছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরেপক্ষতা বিষয়ক অধ্যায়, হিন্দুত্বের জন্য অস্বস্তিকর গান্ধিহত্যা ও গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গেও কাঁচি পড়েছে। ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে বর্তমান শাসক দলের অভিসন্ধিটি কোনও গোপন অ্যাজেন্ডা নয়। ডারউইনকে ছেঁটে ফেলার প্রস্তুতি হিসেবে নেতামন্ত্রীরা বিগত কয়েক বছর ধরেই ডারউইনের তত্ত্বের প্রতি বিষোদ্গার করে চলছিলেন।

 

ডারউইন ও হিন্দুত্ব

ডারউইন নিয়ে অনিলবরণ ও মোহিনীমোহনের মতামতে হিন্দুসমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিদের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছিল। এর মধ্যে সর্বাগ্রে আসবে ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের নাম। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি নিচুশ্রেণির প্রাণীর অবয়ব থেকে ক্রমে আধুনিক মানুষের অবয়বে আবির্ভাব ঘটা বিষ্ণুর দশাবতার কাহিনির মধ্যে কেশবচন্দ্র ডারউইনের বিবর্তনবাদকে খুঁজে পেয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ কেশবের নববিধান সমাজে একসময়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন, কাজেই, তাঁর ওপর শেষোক্ত ব্যক্তিটির প্রভাব থাকা খুবই সম্ভব। বিবেকানন্দ অদ্বৈত বেদান্তকে আশ্রয় করে ধর্মতত্ত্ব গড়ে তোলেন, বিবর্তন বিষয়েও তিনি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন। তিনি অবতারবাদের সঙ্গে বিবর্তনবাদের সাযুজ্য খুঁজতে আগ্রহী না হলেও ডারউইনের মতবাদকে একেবারে উড়িয়ে দেননি, যদিও তাকে একেবারে ভোঁতা করে দিয়েছেন। ডারউইনীয় বিবর্তন সত্য, তবে নিতান্তই ‘নিচুস্তরের সত্য’— আধ্যাত্মিক স্তরে ঘটা প্রকৃত বিবর্তনের চেহারাকে তা ধরতে পারে না। বিবেকানন্দের ভাষায়, অ্যামিবা বিবর্তিত হয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যৌন নির্বাচনের মাধ্যমে বুদ্ধের মতো মহামানবে পরিণত হতে পারে, কিন্তু এককোষী প্রাণীটির মধ্যে বুদ্ধের সম্ভাবনা নিহিত না থাকলে তা সম্ভব হত না। কাজেই, আসল ব্যাপার হল শরীরমধ্যস্থ ‘আত্মা’, যা বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে এবং গোটা প্রক্রিয়াটি নির্ধারিত হয় পূর্বজন্মের কর্মফল দ্বারা। কর্মফল অনুযায়ী আত্মা বিভিন্ন শরীর খুঁজে নেয়, এবং এই প্রক্রিয়া উপর্যুপরি চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সর্বোৎকৃষ্ট রূপটি উদ্ভূত হয় ও পরমাত্মার সঙ্গে মিলন ঘটে। আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী আবার জীবজগতের বিবর্তনে একেবারেই বিশ্বাস করতেন না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপাল সিং-এরই মতোই তিনি বানর থেকে মানুষে রূপান্তর স্বচক্ষে দেখার বাসনা পোষণ করতেন! স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে ‘ঋষি’-তে পরিবর্তিত হওয়া অরবিন্দ ঘোষ আরেক ধাপ এগিয়ে বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানীমহলের সাময়িক ‘ফ্যাশন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি ছোট ছোট ধাপের শারীরিক পরিবর্তনকে (‘মাইক্রোইভোলিউশন’) মেনে নিলেও এভাবে নতুন প্রজাতির উদ্ভব (‘ম্যাক্রোইভোলিউশন’) সম্ভব নয় বলেই মনে করতেন। এ ব্যাপারে সমকালীন মার্কিন ‘ক্রিয়েশনিস্ট’ বা বাইবেলীয় সৃষ্টিতত্ত্বের সমর্থকদের সঙ্গে তাঁর মিল লক্ষণীয়।

এই আলোচনায় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে তা হল, ব্রিটিশরা এদেশে পা রাখার আগে ‘হিন্দু’ শব্দটি তত পরিচিত ছিল না, এবং হিন্দু ধর্মের কোনও জাতীয় ও রাজনৈতিক অস্তিত্বও ছিল না। ছিল হরেক দর্শন, হরেক ধর্মমত। ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, বেদান্ত, চার্বাক। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, তন্ত্র, সহজিয়া। বৌদ্ধ, জৈন, শিখদের বাদ রাখলেও বাকি বিপুল জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একেকটি মতবাদ আবার নানা শাখা-উপশাখায় বিভাজিত ছিল। উনিশ শতকে এদেশে হিন্দু ধর্মকে তার জাতীয় ও রাজনৈতিক পরিচয়সহ সযত্নে নির্মাণ করার প্রকল্পটি মাথা তুলতে শুরু করেছিল, খানিকটা পাশ্চাত্য প্রাচ্যবিদ্যাচর্চাকারীদের একাংশের রোমান্টিক তাগিদে, আর খানিকটা এদেশীয় উচ্চবর্গের তরফে ইউরোপের পালটা এক জাতীয় পরিচিতি তৈরির তাড়নায়। এবং এরই ফলস্বরূপ, প্রাচ্য মরমিয়াবাদের সঙ্গে পাশ্চাত্য ধর্মচিন্তার মেলবন্ধনে আমেরিকা-ইউরোপে ‘নিউ এজ’ ধর্মসমূহ গড়ে উঠতে থাকে। সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক ভারতীয় যোগগুরু ‘ভাগ্যান্বেষণে’ পাশ্চাত্যে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। বিবেকানন্দের আমেরিকা গমন, ইসকন-এর প্রতিষ্ঠা এই সময়েরই ফসল। অনেকের কাছেই এই তথ্যটি অজানা যে, কেশবচন্দ্র সেনের আগেই হিন্দু অবতারবাদের সঙ্গে বিবর্তন তত্ত্বের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলেন যিনি, তিনি কোনও ভারতীয় মদগর্বী হিন্দু ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তিনি ছিলেন থিওসফিক্যাল সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাদাম ব্লাভাৎস্কি, জন্মসূত্রে রুশ হলেও আমেরিকানিবাসী। অর্থাৎ, হিন্দুধর্মে ডারউইনবাদ ‘আবিষ্কার’ মূলত ‘নিউ এজ’ ভাবধারার ফসল, যে ভাবধারায় হিন্দুধর্মকে একটি প্রগতিশীল ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল।

ব্লাভাৎস্কি-কথিত ‘আত্মা’ একান্তভাবেই উপনিষদীয়, তাকে উৎকর্ষে পৌঁছে দিতে তিনিও বৈদান্তিকদের মতোই পুনর্জন্ম ও কর্মফলের ধারণাকে আশ্রয় করেছিলেন। ‘আত্মা’ কর্মফল অনুযায়ী নানা প্রাণীদেহে পরিভ্রমণে রত থেকে জন্মের পর জন্ম ধরে চক্রাকারে উৎকর্ষসাধনের প্রয়াস চালিয়ে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ‘ব্রাহ্মণ’-এ উপনীত হতে পারে। ব্লাভাৎস্কি-র অভীষ্ট ছিল বিজ্ঞানের আলোকে হিন্দু পুরাণগুলির নতুন নতুন ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করা এবং নিজস্ব ধর্মচিন্তায় তাকে কাজে লাগানো। বিষ্ণুপুরাণে থাকা অবতারবাদ তাঁর কাছে আকর্ষণীয় লেগেছিল, ডারউইনের মতবাদের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর নিউ ইয়র্কের বাসগৃহে একটি স্টাফ করা বেবুন ছিল, আধুনিক সাজসজ্জায় সজ্জিত ও চশমা পরিহিত যে মৃত প্রাণীটির হাতে নাকি ডারউইন লিখিত অরিজিন অব স্পিসিস-এর একটি কপি শোভা পেত! বিবেকানন্দ কিন্তু থিওসফিস্টদের ওপর খাপ্পা ছিলেন, বিশ্বধর্মসভায় যোগদানের সুপারিশপত্রের বন্দোবস্ত করে দেননি তাঁরা। তাঁর অদ্বৈত বেদান্তশ্রয়ী ধর্মমতও মূলত উপনিষদ-নির্ভর, তাতে পতঞ্জলির যোগ দর্শনেরও কিছু বিশিষ্ট জায়গা ছিল। আমেরিকা ভ্রমণকালে তিনি যে ‘রাজ যোগ’-এর ধারণা দিয়েছিলেন, তা যোগদর্শন থেকেই গৃহীত হয়েছিল। এমনকি, বিবেকানন্দ যোগসূত্রের রচয়িতা পতঞ্জলিকে বিবর্তনবাদের জনক বলেও চিহ্নিত করেছেন। থিওসফিক্যাল সোসাইটির ভারতে আগমনের পেছনে আর্য সমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও অল্প কিছুকালের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। বৈদিক ভারতের স্বর্ণযুগের মিথটি নির্মাণে যে সকল ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দের নাম সর্বাগ্রে আসবে। প্রাচীন মুনিঋষিরা স্টিম ইঞ্জিন থেকে টেলিগ্রাফ অবধি জানতেন বলে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় ‘বিদ্যুৎ’ ও ‘অগ্নি’ শব্দ দুটিতে তিনি উল্লসিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, প্রাচীন ভারতে ইলেক্ট্রিসিটির প্রচলন ছিল। আজকের হিন্দুত্ববাদী নেতামন্ত্রীরা বৈদিক বিমান, স্টেম সেল, টেলিভিশন ইত্যাকার আবিষ্কারের পেছনে যেভাবে প্রাচীন ভারতের কৃতিত্ব দাবি করেছেন ও করে চলেছেন, সে ব্যাপারে দয়ানন্দকে স্বচ্ছন্দে তাদের পূর্বসূরি বলা চলে।

ঐতিহাসিক কারণেই হিন্দুধর্মে কোনও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা সম্ভব ছিল না। কাজেই, হিন্দুসমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনায় বৈচিত্র্য কতকটা স্বাভাবিক। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয়তবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্য প্রাচীন ভারতের গৌরবগাথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে যেভাবে প্রচার করা হয়েছিল, তাতে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের বিপরীতে বৈদিক সমাজের অগ্রগতিকে দেখানোর দরকার পড়ে। প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার সত্যিকারের সাফল্যগুলি তখনও অনেকটাই অনাবিষ্কৃত ছিল। ফলত, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে খাটো করবার বাসনায় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সকল চিহ্নই বেদে লিখিত আছে বলে দাবি করা শুরু হয়। ডারউইনও বাদ পড়েননি। এরকম মনোভাব জনমতকে সহজেই প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানকে সরাসরি অস্বীকারের পরিবর্তে, উনিশ শতকেও যা একপ্রকার অসম্ভবই ছিল, নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে তার দিকে প্রশ্ন উত্থাপন করা কিংবা তাকে ‘প্রাচীন জ্ঞানের পুনরাবিষ্কার’ বলে দেখানো বেশ ভাল কৌশল। পাশ্চাত্যে বিশ শতকে যখন চার্চ ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করল এবং পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মও তাকে অনুসরণ করে, তার বিপরীতে হিন্দুধর্ম ঔদার্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে পারল। ধর্মনেতাদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি ডারউইনের তত্ত্বকে নাকচ করে দিলেও ওই মুহূর্তে ঐতিহাসিকভাবে ওরকম মতামত কর্তৃত্ব করতে সক্ষম হয়নি। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মৌলবাদী চরিত্র প্রকট হয়ে উঠল, ততক্ষণ পর্যন্তই হিন্দুধর্মের এরকম একটি উদারপন্থী মুখোশ মোটের ওপর বজায় রইল।

 

ডারউইনবাদ ও তার অভিঘাত

ডারউইন কিন্তু কেবল খ্রিস্টধর্মই নয়, অন্যান্য ধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বগুলিকেও খুঁটিয়ে পড়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন যে, বিভিন্ন ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব কাহিনিতে এত ফারাক কেন? বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব, যাতে মানুষ সহ তাবৎ জীবজগৎ একসঙ্গে সৃষ্টি হওয়ার কথা লেখা আছে, তা নিয়ে কিন্তু ডারউইনের আগেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। উনিশ শতকের গোড়ায় ফরাসি বিজ্ঞানী জর্জেস কুভিয়ে, যাঁকে জীবাশ্মচর্চার জনক বলে অভিহিত করা হয়, লক্ষ করেছিলেন যে, মাটি খুঁড়ে গভীরে নামতে থাকলে প্রাপ্ত জীবাশ্মগুলির সঙ্গে বর্তমানে বিদ্যমান প্রাণীদের চেহারার ফারাক ক্রমশই বাড়তে থাকে। বস্তুত, অতীতের অনেক প্রাণীই পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে, এবং তাদের সঙ্গে সমসাময়িক পৃথিবীর জীবদের আদৌ কোনও মিলই নেই! ভূতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে উঠে আসে যে, পৃথিবীর বয়সও অন্তত কয়েকশো কোটি বছর, যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এসব পর্যবেক্ষণ স্পষ্টতই বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গে মিলছে না। কাজেই, জীবজগৎ যে সৃষ্টির গোড়া থেকে অবিকৃত নেই এবং তা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে চলেছে, তা অনেকেই বুঝতে পারেন। কিন্তু এটি কীভাবে ঘটছে, তা দীর্ঘকাল ধরে অজানা ছিল। ডারউইনের কৃতিত্ব হল এই জীববিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করা। তাঁর আগে ল্যামার্কের মতো অনেকেই এর ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেগুলি ডারউইনবাদের মতো বাস্তবসম্মত ছিল না।

জর্জেস কুভিয়ে

ডারউইন প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চার টানে একটানা পাঁচ বছর ব্যাপী এক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সমুদ্রযাত্রায় গিয়েছিলেন। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্র উপকূল ও দ্বীপগুলিতে অনুসন্ধান করে তিনি প্রচুর জীবাশ্মের খোঁজ পান। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের জৈববৈচিত্র্য, যা থেকে তিনি প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটার পেছনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমিকা বুঝতে পারেন। দেশে ফিরে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ সবিস্তারে তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কিন্তু ওই সময় জানতে পারেন যে, অ্যালফ্রেড রাসেল ওয়ালেস নামক আরেক ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী ভারত মহাসাগরে অভিযান চালিয়ে তাঁর মতোই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। বন্ধুদের সহায়তায় এরপর তিনি ও ওয়ালেস একত্রে ১৮৫৮ সালে লিনিয়ান সোসাইটিতে বিবর্তন বিষয়ক প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং পরের বছর তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ফলাফলরূপে ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ প্রকাশিত হয়।

অ্যালফ্রেড রাসেল ওয়ালেস

ডারউইন কয়েকটি সরল নিয়মের মধ্যে দিয়ে বিবর্তনের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন:

(১) প্রাকৃতিক পরিবেশে বংশবৃদ্ধির নির্দিষ্ট সীমা আছে।

(২) বংশধরদের পরস্পরের মধ্যে টিকে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা চলে, যাতে কেউ বেঁচে যায় কেউ মারা পড়ে।

(৩) প্রত্যেক প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে নানা পার্থক্য থাকে। বাঘের বাচ্চার তুলনায় হরিণের বাচ্চারা অনেকটাই একরকম, কিন্তু কখনওই দুটি হরিণের বাচ্চা হুবহু এক হয় না। হরিণের নানা প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য আছে, যার জন্য আমরা যে কোনও হরিণকে ‘হরিণ’ বলে চিনতে পারি। কিন্তু আবার, একই প্রজাতির হরিণের ভেতরেও প্রত্যেকটি ব্যক্তি-হরিণের মধ্যেই আবার ব্যক্তিগত নানা তফাতও আছে। সবল-দুর্বল, লম্বা-বেঁটে, দ্রুতগতি-ধীরগতি, শিংয়ের রকমফের, ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রাবল্যের কমবেশি, ইত্যাদি। এরকম ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যসূচক পার্থক্যগুলিকে বলে প্রকরণ (variation)। কোনও কোনও প্রকরণ বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। বাঘের তাড়া খেয়ে ধীরগতি হরিণের চেয়ে দ্রুতগতি হরিণের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে ‘যোগ্য’রা জয়ী হয়, একেই হারবার্ট স্পেনসার বলেছিলেন ‘সারভাইভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’।

(৪) কিছু কিছু প্রকরণ বংশগত (hereditary) হয়, অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। যেমন, লম্বা বাবা-মায়ের সন্তানরা লম্বা হয়, তাদের চেহারাতেও বাবা-মায়ের চেহারার সুস্পষ্ট ছাপ থাকে। হরেক বংশগত প্রকরণের মধ্যে যেগুলি পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে, সেগুলি প্রজন্মবাহিত হয়ে একই বৈশিষ্ট্যের জীবের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তোলে। একেই বলা হয় ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ (natural selection)। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি প্রকরণ নির্বাচিত হয়।

(৫) এইভাবে, কোনও একটি নির্দিষ্ট প্রজাতিতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নানা বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জড়ো হতে হতে প্রজাতিটিকে মূল প্রজাতিটি থেকে এতখানি পৃথক করে তোলে যে, আচরণ ও স্বভাবগতভাবে পৃথক একটি নতুন প্রজাতি আত্মপ্রকাশ করে। ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়লে এই বিভাজন ত্বরান্বিত হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচন, এভাবে, নতুন নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়। জীবজগতে বিবর্তন (evolution) ঘটে।

ধর্মতত্ত্বে পৃথিবীর জীব-বৈচিত্র্যকে ভাবা হত ‘ঐশ্বরিক লীলা’। অর্থাৎ, মানুষ হল গিয়ে ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’, তাই মানুষের জন্য ঈশ্বর প্রকৃতিকে ফুল-ফল-পশু-পাখি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন। আর এই সজ্জার মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে এক ‘ঐশ্বরিক নকশা’। হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বের হরেক বৈচিত্র্য ও ব্যাখ্যান থাকলেও প্রাথমিক এই নকশার ধারণাটি সেখানেও উপস্থিত। ডারউইনের পূর্ববর্তী বিবর্তনবাদীদের মধ্যে যাঁরা ধর্মগ্রন্থে আস্থাশীল ছিলেন, তাঁরা বিবর্তন তথা ‘ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য’ ও ‘নকশা’ রূপায়ণের জন্য একটি একরৈখিক গতিপথ (‘Chain of Being’) নির্দেশ করেছিলেন। ডারউইন দেখান যে, বিবর্তনের কোনও ‘ব্লু প্রিন্ট’ হয় না। তার গতিও একমুখী নয়, তা নানা দিকে প্রবাহিত হয়। এজন্যই তিনি বিবর্তনের গতিপথ বোঝাতে গাছের ডালপালার রূপকল্প ব্যবহার করেছিলেন। কেবল এটুকুই নয়, ডারউইনবাদ দেখিয়েছিল যে, বিবর্তনের গতিপথে মানুষের জন্যও এমন কোনও বিশেষ স্থান নির্দিষ্ট করা যায় না, যাতে তাকে ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কাজেই, ধর্মতাত্ত্বিকরা ডারউইনের ওপরে খুবই চটেছিলেন। সমসাময়িক ব্রিটিশ সমাজে ডারউইনকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল, পত্রপত্রিকায় প্রায়শই তাঁকে বানর সাজিয়ে কার্টুন প্রকাশিত হত। আমেরিকায় মৌলবাদ জন্ম নেওয়ার পর ডারউইনকে তারাও প্রধান শত্রু হিসেবে সাব্যস্ত করে। স্কুল সিলেবাস থেকে ডারউইনকে ছেঁটে ফেলার দাবিতে প্রাদেশিক আদালতগুলিতে একের পর এক মামলা চলতে থাকে। অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে বিশ শতকের মাঝামাঝি ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা সারা দেশে অভিন্নভাবে কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি ঘটে। অবশ্য ১৯৮০-র দশকে বিবর্তন-বিরোধীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজ়াইন’-এর ছদ্মবেশে ‘ঐশ্বরিক নকশা’-র তত্ত্বকে নতুনভাবে হাজির করার মাধ্যমে শোরগোল করার চেষ্টা শুরু হয়। ওই অপচেষ্টা এখনও জারি আছে।

 

মৌলবাদের চাঁদমারিতে ডারউইন

জীববিজ্ঞানে ডারউইনবাদ সর্বসম্মত বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে গৃহীত হওয়ার আগে ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রধান রণক্ষেত্র ছিল বিশ্বতত্ত্ব। ষোড়শ শতকে কোপারনিকাস এবং পররবর্তীকালে নিউটন, কেপলার প্রমুখ বিজ্ঞানীর কাজের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হয়ে এক মামুলি গ্রহে পরিণত হয় এবং বলবিদ্যার নিয়ম দিয়ে জ্যোতিষ্কদের চলাচল সম্পর্কিত ধাঁধাগুলির উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। এতে মহাবিশ্বে ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’ হিসেবে মানুষের বিশেষ অবস্থানটি টলে যায়। বিজ্ঞানকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া ধর্মের কাছে আর উপায় থাকে না। তাকে নিয়ে ধর্মের মুশকিল হল, ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত স্বতঃসিদ্ধগুলিকে বিজ্ঞান কেবলই প্রশ্ন করে চলে। শুধুমাত্র অনালোকিত জায়গাগুলোতেই ধর্মের প্রাধান্য বজায় থাকে, যে জায়গাগুলিও আবার সংখ্যায় ক্রমাগত কমতে থাকে। ধর্মকে কেবলই পিছু হঠতে হয়। এভাবে, বিজ্ঞানের অভিঘাতে ধর্মের জায়গা যখন ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে উঠতে লাগল, ধর্মবেত্তারা আসন্ন বিপদ অনুধাবন করতে পারলেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে আমেরিকায় প্রোটেস্ট্যান্টদের উদ্যোগে ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখার এক মরিয়া এবং আগ্রাসী প্রকল্প রচিত হল। বিজ্ঞানকে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি নির্দেশ ও বাণীকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করে বিজ্ঞান ও আধুনিকতাকে সহিংসভাবে প্রতিরোধ করার এক মরিয়া প্রচেষ্টা নেওয়া শুরু হল। একেই আমরা আজকে মৌলবাদ বলে অভিহিত করি (এর শিকড় আরও অনেক পুরনো যদিও)। অল্পকালের মধ্যেই ইসলাম ধর্মের কাছেও তা গ্রহণীয় হয়ে উঠল। একে একে সমস্ত প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মৌলবাদের পতাকার নিচে নিজেদের সামিল করতে লাগল। আমাদের খেয়াল করতে হবে যে, এই সময়েই ভারতে আরএসএস জন্ম নিয়েছিল (১৯২৫)।

কোপারনিকাস-নিউটন-কেপলার

ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাসীরা কিছুতেই মানতে চায় না যে, প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ও তার উপরে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে মানুষ তাকে ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রচনা করে। মহাকর্ষ তত্ত্ব, আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, বিবর্তনবাদ— সবই প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টামাত্র, এগুলি কোনও অমোঘ নিয়মের ভাষ্য নয়। তাই, বিজ্ঞানীরা জগতের মধ্যে কোনও ‘ঐশ্বরিক নিয়ম’ খুঁজে বেড়ান না। আর ‘ঐশ্বরিক নিয়ম’ ব্যাপারটাই যদি না থাকে, তাহলে আবার ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপেই তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘অলৌকিক’ ঘটনা ঘটার আর কোনও পরিসরই থাকছে না। যৌক্তিক অস্বচ্ছতা ও প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকেই ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাসীরা প্রকৃতিতে অনেক রকম ‘মিরাক্‌ল্’ ঘটতে দেখে: (১) গ্রহনক্ষত্রের চলন সংক্রান্ত ‘মিরাক্‌ল্’, (২) পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব সংক্রান্ত ‘মিরাক্‌ল্’ ও (৩) ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ‘মিরাক্‌ল্’। বলা বাহুল্য যে, প্রথম দুটি ‘মিরাক্‌ল্’ অপসারিত হলে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল তৃতীয় ‘মিরাক্‌ল্’টি আর ততখানি বিস্ময় জাগাতে পারে না। কোপারনিকাস-নিউটন-কেপলারের যান্ত্রিক বিশ্বতত্ত্ব প্রথম ‘মিরাক্‌ল্’টিকে ধসিয়ে দিয়েছিল। এখন, দ্বিতীয় ‘মিরাক্‌ল্’টিকে না বাঁচাতে পারলে, তৃতীয় ‘মিরাক্‌ল্’টির অবলুপ্তি কেবল সময়ের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। এখানেই ডারউইনের গুরুত্ব, তিনি দ্বিতীয় ‘মিরাক্‌ল্’টিকেই একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ গ্রহনক্ষত্রের দুনিয়া থেকে অপসৃত ঈশ্বরকে তিনি জৈবজগৎ থেকেও উৎখাত করেন। স্বাভাবিকভাবে, ডারউইন মৌলবাদের প্রধান নিশানা হয়ে ওঠেন।

 

হিন্দুত্বের বিবর্তন

প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ভারতীয় কোনও দর্শনই জীবজগতের বিবর্তনের কোনও ইঙ্গিতই দেয় না। সাংখ্য ও যোগ দর্শনে যে বিবর্তনের কথা আছে, তা জাগতিক নয়, ভাবজগতের ব্যাপার। বেদান্তে জগতের অস্তিত্বকেই ভ্রমাত্মক বলে মনে করা হয়। কাজেই, সেখানেও এ সমস্ত আশা করা বৃথা। বিষ্ণুর দশাবতারও বিবর্তন সংক্রান্ত কোনও চিন্তাভাবনার সাক্ষ্য দেয় না। ‘দুষ্টের দমন’ ও ‘শিষ্টের পালন’-এর জন্য বিষ্ণু বিভিন্ন রূপ ধরে হাজির হচ্ছেন। হাজির হচ্ছেন ভাল মানুষদের বাঁচানোর জন্য। কাজেই, তা মানুষের উদ্ভবের আগেকার কোনও প্রাণীর বিবরণ দিচ্ছে না, নিশ্চিতভাবেই! এসব কুযুক্তিগুলি উঠে এসেছিল বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে, যখন হিন্দুধর্মকে পাশ্চাত্য ধর্মগুলির তুলনায় এক উদার ও সহনশীল ধর্ম হিসেবে তুলে ধরার দরকার পড়েছিল। বৈদিক জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানকে একাত্ম করে দেখার বিষয়টি এই নবোদ্ভূত হিন্দুত্বের গরিমার সময়োচিত প্রকাশমাত্র।

আজকে পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডারউইন নিয়ে হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিও বদলেছে। হিন্দুত্ব আগ্রাসী মৌলবাদে পরিণত হওয়ার সুবাদে আজ ধর্মগ্রন্থের মর্মার্থ ও নির্দেশগুলিকে ‘পালন’ করতে বদ্ধপরিকর, অন্তত কোনও এক প্রতীকী ও আলঙ্কারিক অর্থে। এখন তার পক্ষে আর ডারউইনের বিবর্তনবাদকে মেনে নিয়ে ধর্মের জায়গাকে আরও সঙ্কুচিত করে তোলা সম্ভব নয়, বরং তার লক্ষ্য একে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করা। এক ‘অখ্রিস্টীয় ইন্টেলিজেন্ট ডিজ়াইন’ নির্মাণের দিকে সে ঝুঁকছে, আব্রাহামীয় ধর্মের সাপেক্ষে উদারতার ভেকটি এখন আর তত প্রাসঙ্গিক নয়। সিলেবাস থেকে ডারউইনকে বাদ দেওয়াটা এই তাড়নারই প্রকাশ।

যদিও ইতিহাসের শিক্ষা এটাই যে, সভ্যতার অগ্রগামিতার চাকা ওরকম গা-জোয়ারিভাবে পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। মৌলবাদ যত আগ্রাসীই হোক না কেন, সভ্যতার গতিপথে সাময়িক বিচলন ঘটানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। উপরন্তু, এদেশে বিজ্ঞানমনস্ক ও ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, তাঁরাও নিশ্চয়ই ওদের একেবারে ‘ওয়াক ওভার’ দিয়ে দেবেন না। ইতিমধ্যে দেশের চার হাজার বিজ্ঞানী এনসিইআরটি-কে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন রেখেছেন। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনগুলিও সাধারণ মানুষকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি কঠিন; তবু নৈরাশ্যের কারণ নেই। হিন্দুত্ববাদী শক্তি আজ অমিত-শক্তিশালী, সর্বগ্রাসী, দৃঢ়সংকল্প বটে। কিন্তু, যুক্তি আর বিজ্ঞানের শক্তিও কি কিছু কম? হিন্দুত্ববাদীরা হয়তো আজ ক্ষমতার জোরে রাষ্ট্র ও প্রশাসন দখল করতে পারেন, গণমাধ্যমকে বশ করতে পারেন, বিচারকে প্রভাবিত করতে পারেন, শিক্ষাদীক্ষা আমূল বদলে দিতে পারেন, অসন্তোষকে অবাধে কারাবন্দি করতে পারেন।

কিন্তু, সূর্যকে পশ্চিমে ওঠাতে পারেন কি?

 

গ্রন্থপঞ্জী

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...