পিরিওডিক টেবিল, বিবর্তনবাদ, পরিবেশ বাদ দিয়ে এনসিইআরটি আদতে কী চাইছে?

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 


সত্যপাল সিং-এর বক্তব্যকে সেদিন আমরা তাচ্ছিল্য করেছিলাম। আমরা ভুল করেছিলাম। একটি মারাত্মক, সর্বাত্মক, প্রতিটি মানুষের চিন্তাকোষ অব্দি পৌঁছে যাওয়ার এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থেকে ক্রমাগত এ কথাগুলো প্রচার করা হয়েছে। NCERT-র সিলেবাস পরিবর্তনের ফলে আমরা তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি এখন— অনেকটা সময় পরে

 

গত ৩০ মে, ২০২৩-এ বিশ্ববিশ্রুত নেচার-এর পত্রিকায় (ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ৬৯.৮৩৪) একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে— সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে।[1] সম্পাদকীয়র শুরুতেই বলা হয়েছে যে ১৯৭৬ সালে ভারতের সংবিধান সংশোধনের সময়ে স্পষ্ট করে শিক্ষার লক্ষ্য এবং দেশের মানসিকতার ভিত্তি হিসেবে জানানো হয়েছিল— “বিজ্ঞানমনস্কতার (scientific temper) বিকাশ, ঘটানো, মানবতাবাদ এবং অনুসন্ধানের উদ্দীপনা এবং সে অনযায়ী সংস্কার করা।” এরপরে এই সম্পাদকয়ীতে কীভাবে বর্তমান ভারতে টেক্সট বই এবং সিলেবাস তৈরির নিয়ামক সংস্থা NCERT (National Council of Educational Research and Training) “কোভিডের চাপে” সিলেবাসকে ‘র‍্যাশনালাইজ’ তথা যুক্তিযুক্ত করার জন্য ছোট করে ফেলা হচ্ছে তার বিবরণ রয়েছে। ভারতের প্রায় ১৩.৫ কোটি ১৪ থেকে ১৬ বছরের বাচ্চারা আর পিরিওডিক টেবিল, ডারউইন, বিবর্তনবাদ, পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব এবং বিকাশ নিয়ে গৃহীত আন্তর্জাতিক ধারণার কিছুই জানবে না। কিন্ত ভারতের “নয়া শিক্ষানীতি” অনুযায়ী ভারত কালক্রমে মেধার বিকাশ এবং প্রযুক্তির প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে “বিশ্বগুরু” হয়ে উঠবে এমন প্রত্যয় জ্ঞাপন করা হয়েছে। যাহোক, নেচার-এর আলোচ্য সম্পাদকীয়তে অভিমত দেওয়া হয়েছে—

Researchers who study India’s education policy have told Nature that organizations that are critical of science are advocating for or influencing these changes to textbooks. They point to one organization in particular: the Rashtriya Swayamsevak Sangh, which has close ties to the ruling Bharatiya Janata Party.

এছাড়াও সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে— ভারত একমাত্র উত্তর-উপনিবেশিক দেশ নয় যে পুরনো ঐতিহ্যকে সম্মান এবং স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ক্রমাগত হাঁকড়-পাঁকড় করছে। এক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সে-দেশে ‘মাওরি পদ্ধতিতে’ শিক্ষা দেওয়ার জন্য দেশ জুড়ে বেশ কিছু স্কুল বেছে নেওয়া হয়েছে যেখানে mātauranga Māori শেখানো হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, নেচার-এ এই সম্পাদকীয় ছাপার আগে NCERT-র কাছে এরকম পরিবর্তনের কারণ কী সে বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু NCERT-র তরফে এর কোনও উত্তর দেওয়া হয়নি। সম্ভবত প্রাপ্তিস্বীকারও করা হয়নি।

 

সায়েন্টিফিক টেম্পার

স্বাধীনতা-সংলগ্ন সময়ে নেহেরুর ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধটি ছিল ‘সায়েন্টিফিক টেম্পার”। অর্থাৎ একটি বৈজ্ঞানিক স্পৃহা বা মেজাজ যা করায়ত্ত করলে ভারত পরমাণুকে বোঝার এবং ভাঙার কাণ্ডারি হয়ে উঠতে পারবে। পশ্চিমি সভ্যতার তৈরি করে দেওয়া সিঁড়ি বেয়ে বিশ্বের দরবারে ভারতের অস্তিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।[2] যদিও ১৯৪৭ সালে ভারতীয় সায়েন্স কংগ্রেসে নেহেরু বিজ্ঞানের ব্যবহার নিয়ে সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীদের— “Science has two faces like Jnus: science has its destructive side and a constructive, creative side. Both have gone on side by side and both still go on. […] Hiroshima became a symbol of this conflict.”[3] ইটি আব্রাহামের পর্যবেক্ষণে— “ভারতীয় নাগরিককে প্রকৃত অর্থে আধুনিক হয়ে উঠতে গেলে তাকে বিজ্ঞানের নিয়মাবলিকে আত্তীকরণ করতে হবে, যাকে তথাকথিত ‘সায়েন্টিফিক টেম্পার’ বলা হয় এবং যা ছিল নেহেরুর ভারী ভালবাসার বিষয়। কিন্তু স্পষ্টতই রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুনের মধ্যে এই ‘সায়েন্টিফিক টেম্পার’ বিশেষভাবে এক্তিয়ারভুক্ত (amenable) হয়নি। রাষ্ট্র যেটা করতে পেরেছিল তা হল বিন্দু বিন্দু করে এই ধারণা তৈরি করা যে বিশালাকার, আধুনিক, সম্ভ্রম জাগানো (awesome) বস্তু তৈরি করা সম্ভব— বাঁধ, স্টিলের কারখানা, নতুন নতুন ঝকমকে শহর, নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর। এ বস্তুগুলো এক নতুন ধরনের যুক্তিবোধের জন্ম দেয়, যা ঐতিহ্যবাহী ল্যান্ডস্কেপকে রূপান্তরিত করবে, কেবলমাত্র এদের বিপুল ক্ষমতার বলে— এই আশা নিয়ে যে প্রযুক্তিগত কলাকৌশল মানুষের মাঝে fetish হয়ে যাবে।”[4]

১৯৫৮ সালের ৪ মার্চ ভারতীয় সংসদে ‘সায়েন্টিফিক পলিসি রেজোলিউশন’ গ্রহণ করার সময়ে নেহেরু বলেছিলেন— “It is an inherent obligation of a great country like India with its traditions of scholarship and original thinking and its great cultural heritage, to participate fully in the march of science which is probably mankind’s greatest enterprise today.”[5]

একটু গভীরে ভেবে দেখলে আমরা কতকগুলো বিষয় সহজেই বুঝতে পারব:

(১) নেহেরুর অভীপ্সিত ‘সায়েন্টিকফিক টেম্পার’-এর মাঝে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার তন্নিষ্ঠ আকাঙ্খা রয়েছে.
(২) “বিশ্বগুরু” হওয়ার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের স্তরে ভারতকে নিয়ে যাবার আগ্রহ রয়েছে, যদিও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে পাল্লা ভারী ছিল।
(৩) এরকম আকাঙ্খার অভিমুখ সামনের দিকে, প্রাচীন ভারতের ‘গড়ে নেওয়া’ ছদ্ম বিজ্ঞানের কোনও নিম্নমুখী টান নেই।
(৪) তখনও অব্দি কৃষিনির্ভর এবং সামন্তচেতনার সাথী একটি দেশে কীভাবে এই মেজাজ সমাজের নিম্নবর্গ অবধি পৌঁছবে এ-ব্যাপারে নেহেরু বিশেষ মনো্যোগী ছিলেন বলে মনে হয় না, এবং
(৫) নেহেরু আধুনিক বিজ্ঞানের বন্ধু ছিলেন— অপবিজ্ঞান, ছদ্মবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতিষচর্চার মধ্যেকার পার্থক্য ভালভাবেই বুঝতেন। এদের সজ্ঞানে পরিহার করেছেন।

তিনি বিভিন্ন সময়ে সাথী হিসেবে সঙ্গে পেয়েছিলেন (অনেক বিষয়ে মতান্তর সত্ত্বেও) প্রশান্ত মহলানবিশ, মেঘনাদ সাহা, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, বিক্রম সারাভাই, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর এবং, সর্বোপরি, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমনের মতো বিজ্ঞানীদের। এঁদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মাচরণ করলেও নৈর্বক্তিক, ধর্মমুক্ত এবং অনুসন্ধান-নির্ভর বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ। এবং এদের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে বিজ্ঞানকে যুক্ত করা, ধর্ম বা প্রাচীনত্বের কৃষ্ণগহ্বর খুঁড়ে তুলে আনা কোনও অতিকথা (মিথ) বা গল্পগাছা নয়। সে অর্থে ভারত তখন পশ্চিমি ধারণানুযায়ী প্রকৃত অর্থে সেকুলার পথে যাত্রা করছে।

ঐতিহাসিক এরিক হবসবম রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ট্র্যাডিশন কীভাবে নতুন করে উদ্ভাবন এবং নির্মাণ করা হয় এ নিয়ে বলেছিলেন— “One marked difference between old and invented practices may be observed. The former were specific and strongly binding social practices, the latter tended to be quite unspecific and vague as to the nature of the values, rights and obligations of the group membership they inculcate: ‘patriotism’, ‘loyalty’, ‘duty’, ‘playing the game’, ‘the school spirit’ and the like.”[6] বিপুল বিনিয়োগ করে (সম্ভবত হাজার কোটিতে হিসেব হবে), কয়েক লক্ষ নিবেদিত, আগ্রাসী, হিংস্র এবং দক্ষ ক্যাডার সমগ্র ভারত জুড়ে এই দ্বিতীয় ধরনটি চারিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে আইটি সেল এবং অনুগ্রহ-পুষ্ট মিডিয়া বাহিনি।

 

NCERT এবং বাদ-দেওয়া পাঠ্যক্রম

“List of Rationalised Content in Textbooks for Class X” শিরোনামে “আজাদি কা অমৃত মহোৎসব” (একটি পৃষ্ঠায় শুধু এ শব্দগুলো লেখা হয়েছে) শিরোধার্য করে মে ২০২২ (জ্যৈষ্ঠ ১৯৪৪)-এ— যেমনটা পুস্তিকায় বলা হয়েছে— একগুচ্ছ গাইডলাইন ছাপা হয়। এখানে মনে রাখতে হবে, এ গাইডলাইন ছাপার আগে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক-অভিভাবিকা কিংবা দেশের মান্য শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কোনওরকম আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা হয়নি।

যাহোক, আমরা এবার দেখি কী কী বিষয়— আমি আপাতত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকব, অন্য বিষয়গুলি নয়— বাদ দেওয়া হল সিলেবাস থেকে।[7] এর আগে কেন ‘র‍্যাশনালাইজ’ করা হল তার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে— “In view of the COVID-19 pandemic, it is imperative to reduce content load on students. The National Education Policy 2020, also emphasises reducing the content load and providing opportunities for experiential learning with creative mindset.”[8] শেষে বোল্ড লেটারে লেখা হয়েছে— “This booklet contains information in tabular form about subject-wise contents which have been dropped and hence are not to be assessed.[9]

বিজ্ঞানে চ্যাপ্টার ৫-এ ছিল “Periodic Classification of Elements” (পৃঃ ৭৯-৯২)। পুরো চ্যাপ্টারটি বাদ দেওয়া হয়েছে।[10] যে কোনও শিক্ষিত সাধারণ মানুষ শিহরিত হবেন এই ভেবে যে, পিরিওডিক টেবিল বাদ দিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে কীভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল বিষয় আয়ত্ত করা সম্ভব। সহজ কথায় বললে, মৌলিক পদার্থদের পিরিওডিক টেবিল সমধর্মী চরিত্রের সমস্ত পদার্থকে একটি গ্রুপের মধ্যে রাখে। এর দরুন কেমিস্ট, ন্যানোটেকনোলজিস্ট এবং অন্যান্য শাখার বিজ্ঞানীদের কাছে এটা অত্যন্ত গু্রুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার। যদি পিরিওডিক টেবিল ভালভাবে বোঝা যায় এবং একে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে শেখা যায় তাহলে আগাম বলা সম্ভব যে রাসায়নিক যৌগের চরিত্র কেমন হবে। এক্ষেত্রে স্মরণে রাখা দরকার, মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৮৩৫) পরের বছর কলেজের কেমিস্ট্রির শিক্ষক উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসি (যিনি ১৮৩১ সালে আবিষ্কার করেছিলেন যে স্যালাইন দিয়ে কলেরা রোগীকে বাঁচানো সম্ভব) তাঁর ক্লাসের শুরুতে ছাত্রদের কেমিস্ট্রি বোঝাতেন পিরিওডিক টেবিলের ৫৪টি মৌলের (তখনও অব্দি আবিষ্কৃত) চরিত্র বিশ্লেষণ করে।[11]

১৩ নম্বর চ্যাপ্টারে (পৃঃ ২৩২-২৩৭) “Magnetic Effects of Electric Current” অংশে পুরোপুরি বাদ গেছে “Michael Faraday 3.4 Electric Motor, 3.5 Electromagnetic Induction, 3.6 Electric Generator”।[12] মাইকেল ফ্যারাডে এবং বাদ-যাওয়া অংশগুলো বুঝতে, পড়তে, শিখতে এবং আয়ত্ত করতে না পারলে উচ্চতর শিক্ষার পরবর্তী ধাপে যে শিক্ষার্থী প্রবেশ করছে সে ফিজিক্সের বুনিয়াদি বিষয়গুলো বূঝবে কী করে? কেমিস্ট্রির ছাত্রই বা কী করবে?

চ্যাপ্টার ৯— “Heredity and Evolution”, পৃঃ ১৪৭-১৫৮— পুরো চ্যাপ্টারটি বাদ গেছে। পরিবর্তে “Chapter name replaced with: Heredity”। ১২ পৃষ্ঠার একটি চ্যাপ্টারে কী কী বিষয় বাদ গেল?[13]

Charles Robert Darwin, Origin of life on earth, How do fossils form layer by layer, Molecular phylogeny
9.3 Evolution
9.3.1 An Illustration
9.3.2 Acquired and Inherited Traits
9.4 Speciation
9.5 Evolution and Classification
9.5.1 Tracing Evolutionary Relationships
9.5.2 Fossils
9.5.3 Evolution by Stages
9.6 Evolution Should Not Be Equated With ‘Progress’
9.6.1 Human Evolution

নজরে রাখতে হবে, পূর্বতন সিলেবাসে পরিষ্কার করে বলা ছিল— বিবর্তনের সঙ্গে ‘প্রগ্রতি’কে এক করে দেখলে চলবে না

আরেকটি বড়সড় পরিবর্তন এসেছে পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে। ২ নম্বর চ্যাপ্টারে আলোচিত বিষয় ছিল “Forest and Wildlife Resources”। এ চ্যাপ্টারে “From second paragraph of ‘Flora and Fauna in India’ to ‘The Himalayan Yew in Trouble’ (পৃঃ ১৪-১৮) অংশটি বাদ গেছে।[14] যদি বন্যপ্রাণীর সঙ্গে পরিবেশ এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং মিথষ্ক্রিয়ার গুরুত্বই শিক্ষার্থীরা বুঝতে না শেখে, যদি হিমালয় অঞ্চলে কী সম্পদ রয়েছে এর গভীরতা (সামান্য হলেও) না বোঝে তাহলে নতুন নতুন আইন করে বন-সম্পদ লুণ্ঠন এবং জনজাতির অরণ্যের অধিকার হরণ করে কর্পোরেট কৃষি কী ভয়ঙ্কর সর্বনাশ প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ডেকে আনতে পারে— এ সম্পর্কে কোন বোধই তৈরি হবে না। উল্টোদিকে, নতুন সিলেবাসে (যদি ভবিষ্যতে না পালটায়) শিক্ষিত হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা সরাসরি এই লুণ্ঠনকর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে বিন্দুমাত্র বিবেকের দংশন অনুভব করবে না। আরেকটু প্রসারিত করলে এমনটাও হতে পারে যে, গ্রেটা থুনবার্গের পরিবেশ আন্দোলন ওরই বয়সী ভারতীয় তরুণদের কাছে অনুকম্পা এবং উপহাসের বিষয় হয়ে যাবে। কারণ নতুন সিলেবাসের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের পুনর্লিখন চলছে।

এ ধারণাকেই শক্তিশালী করতে এর সম্প্রসারিত রূপে রূপান্তরিত হল চ্যাপ্টার ৪-এর “এগ্রিকালচার” সংক্রান্ত অধ্যায়টি। ৪৩ থেকে ৪৬ পৃষ্ঠা অবধি বিস্তৃত এই অংশে কেটে/ছেঁটে ফেলা হয়েছে “Contribution of agriculture to the national economy, employment and output, Impact of globalisation on Agriculture”।[15] কৃষির ওপরে গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবের অংশটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এ-কথাই শিক্ষার্থীরা বুঝবে যে, এমন কিছু নেই বা আদপে এমন কিছু থাকতেও পারে না। গ্লোবালাইজেশনের প্রথম ঢেউয়ে যে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর সমারোহ হয়েছিল তার পরিণতিতে যে আজ পাঞ্জাবের ভাটিন্ডা থেকে রোজ রাতে “ক্যান্সার ট্রেন” ছাড়ে— এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র বোধ তৈরি হবে কী করে?[16] এর কোনও ইতিহাস, মানুষের মর্মন্তুদ যন্ত্রণা, রাষ্ট্র-মানুষ-পরিবেশ-কর্পোরেট-নতুন রোগের সৃষ্টির মাঝে যে সুগভীর আন্তঃসম্পর্ক আছে সে বিষয়ে এদের মাঝে কোনও বোধই জন্ম নেবে না, নেওয়া সম্ভবও নয়। সামাজিকভাবে এক সামগ্রিক ‘numbing of collective consciousness’-এর প্রতিটি দৃশ্যের আপাত-সফল চিত্রনাট্য রচিত হয়ে চলছে।

এর আগে বিবর্তন নিয়ে ছুঁয়ে গেছি। এ বিষয়ে এই কাগজে এবং অন্যত্র অনেক আলোচনা হয়েছে। এ কারণে বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে কিছু কথা তো উঠে আসেই। NCERT-র এরকম সিদ্ধান্ত এবং সে অনুযায়ী বই ছাপা হয়ে যাবার পরে কলকাতা-কেন্দ্রিক “ব্রেকথ্রু সায়ান্স সোসাইটি”-র পক্ষ থেকে “অ্যান অ্যাপিল এগেইন্সট এক্সক্লুশন অফ এভোলিউশন ফ্রম কারিকুলাম”-এ (২০ এপ্রিল, ২০২৩) বলা হয়—

An understanding of the process of evolution is also crucial in building a scientific temper and a rational worldview. The way Darwin’s painstaking observations and his keen insights led him to the theory of natural selection educates students about the process of science and the importance of critical thinking. Depriving students, who do not go on to study biology after the 10th standard, of any exposure to this vitally important field is a travesty of education.

We, the undersigned scientists, science teachers, educators, science popularisers and concerned citizens disagree with such dangerous changes in school science education and demand to restore the theory of Darwinian evolution in secondary education.[17]

এতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৪০০০-এর বেশি প্রথম সারির বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানকর্মী এবং সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট। স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় ২য় নাম রাঘবেন্দ্র গদগকর যাঁর আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচিতির বাইরের বিশেষ পরিচয় হল তিনি একজন প্রথমসারির জীববিজ্ঞানী। The Social Biology of Ropalidia marginata: Towards understanding the evolution of eusociality বইটির লেখক এবং বায়োলজিতে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারের প্রাপক। এছাড়াও জার্মানির অসামরিক ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজের সর্বোচ্চ সম্মান Order of Merit of the Federal Republic of Germany পেয়েছেন একজন ভারতীয় হিসেবে।

আমেরিকা থেকে প্রকাশিত সুবিখ্যাত সায়ান্স জার্নালে (ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ৪৭.৭৩) ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল “In India, Hindu pride boosts pseudoscience” শিরোনামে। সে প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে সবচেয়ে বহুল আলোচিত বিষয় “wasn’t about space exploration or information technology, areas in which India has made rapid progress. Instead, the talk celebrated a story in the Hindu epic Mahabharata about a woman who gave birth to 100 children, citing it as evidence that India’s ancient Hindu civilization had developed advanced reproductive technologies.”[18] অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি নাগেশ্বর রাও দাবি করেছিলেন, ভারতে মহাভারতের সময়ে, অন্তত ১০০০ বছর আগে, স্টেম সেল রিসার্চ অত উন্নত অবস্থায় না থাকলে গান্ধারীর ১০০ পুত্রের জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়।

সায়েন্স-এর প্রতিবেদনটি থেকে আমরা জানতে পারি, বিজ্ঞান ভারতী বা VIBHA নামে আরএসএস-এর বিজ্ঞান সংক্রান্ত কার্যকলাপ চালানোর জন্য একটি বিশেষ শাখা রয়েছে। ২০১৯ সালের হিসেবে, ভারতের ২৩টি রাজ্যে এদের শাখা বিস্তৃত এবং ২০,০০০ সদস্য রয়েছে। ২০২৩-এ এসে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে কোনও সন্দেহ নেই। ২০১৮ সালের জুন মাসে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সত্যপাল সিং বলেছিলেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ একটি ধোঁকা এবং স্কুল পাঠ্যবিষয় হিসেবে একে মুছে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী— “Nobody, including our ancestors, in written or oral [texts], has said that they ever saw an ape turning into a human being.[19] মোদ্দা কথা হল, আমাদের বাপ-ঠাকুরদা-চোদ্দোপুরুষ বাঁদর কখনও মানুষ হয়েছে, এমনটা চোখে দ্যাখেনি। ফলে এ কথাগুলো নিতান্তই অবাস্তব।

এ বক্তব্যকে সেদিন আমরা তাচ্ছিল্য করেছিলাম বা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমরা ভুল করেছিলাম— গভীর ভুল। একটি মারাত্মক, সর্বাত্মক, প্রতিটি মানুষের চিন্তাকোষ অব্দি পৌঁছে যাওয়ার এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থেকে ক্রমাগত এ কথাগুলো প্রচার করা হয়েছে। NCERT-র সিলেবাস পরিবর্তনের ফলে আমরা তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি এখন— অনেকটা সময় পরে।

আগে একটি লেখায় সুব্রমনিয়ামের লেখা মোটের ওপরে বৃহৎ পুস্তক Holy Science: The Biopolitics of Hindu Nationalism নিয়ে কিছু আলোচনা করেছি।[20] তারই বিপরীত একটি ধারণাও পৃথিবীর আরেক প্রান্তে বাস্তবায়িত হয়েছে। আমেরিকার উটা প্রদেশে elementary and middle schools থেকে বাইবেল-কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।[21] কিন্তু “The 72,000-student Davis School District north of Salt Lake City removed the Bible from its elementary and middle schools while keeping it in high schools after a committee reviewed the scripture in response to a parental complaint.” অর্থাৎ, অভিভাবকদের আপত্তির পরে হাইস্কুলে বাইবেলকে পাঠ্যসূচিতে রাখার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের এখানে NCERT-র ক্ষেত্রে কী হবে?

আমাদের ভারতবর্ষে তৃতীয় পরিসরকে প্রসারিত ও জীবন্ত রাখা আজ বড় জরুরি— অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।


[1] Why is India dropping evolution and the periodic table from school science? Nature. 30 May, 2023.
[2] বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য, Abraham, Itty. The Making of Indian Atomic Bomb: Science, Secrecy and the Postcolonial State. Delhi: Orient Longman. 1999.
[3] Ibid, 47.
[4] Ibid, 20.
[5] Mohanty, Subodh. Nehru’s Vision and Scientific Temper. Journal of Scientific Temper: vol. 4 (3&4): 154-166. 2016.
[6] Hobsbawm, Eric and Ranger, Terence. The Invention of Tradition (Canto Classics). Reissue. Cambridge: Cambridge University Press. 2012. p.10.
[7] List of Rationalised Content in Textbooks for Class X. Delhi: National Council of Educational Research and Training. 2022.
[8] Ibid, 16.
[9] Ibid.
[10] Ibid, 18.
[11] ভট্টাচার্য, জয়ন্ত। মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাস, ১ম পর্ব, ১৮২২-১৮৬০। কলকাতা: প্রণতি প্রকাশনী। ২০২২।
[12] টীকা ৭, পৃঃ ১৯।
[13] Ibid, 19.
[14] Ibid, 20.
[15] Ibid.
[16] Das, Poulomi. The shocking tale of India’s ‘cancer train’. Business Insider, June 10, 2016.
[17] An appeal by over 4000 scientists and intellectuals against exclusion of Darwin’s theory of evolution from curriculum. SUCI (Communist). May 1, 2023.
[18] Kumar, Sanjay. In India, Hindu pride boosts pseudoscience. Science. 15 February 2029: 679.
[19] Ibid, 680.
[20] ভট্টাচার্য, জয়ন্ত। স্বাধীন বিজ্ঞানচিন্তা এবং মৌলিক আবিষ্কারের দিশারী শম্ভুনাথ দে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। মে, ২০২৩।
[21] Metz, Sam. Utah district bans Bible in elementary and middle schools due to ‘vulgarity or violence’. Associated Press. 3 June 2023.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. লেখাটা অবশ্য সময়োপযোগী এবং ভাবনাটাও ছড়ানো দরকার। ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘোরানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আটকানো দরকার। মন্তব্য লিখছি কিন্তু আমি দেখতে পারছি না। তাই মনের কথা পুরো প্রকাশ করতে পারলাম না।

  2. নেচারে প্রকাশিত সাম্প্রতিকতম আশঙ্কাকে নান্দীমুখ হিসেবে গ্রহণ করে,এই প্রবন্ধটি রাষ্ট্রভাবনা এবং বিজ্ঞানচেতনার জটিল তথা ঘনিষ্ঠ সংযোগকে পুনরাবিষ্কার করতে চেয়েছে। ব্যবস্থার গৈরিকিকরণের পথ ধরে এক সামগ্রিক অন্ধত্ব,বৌদ্ধিক চর্চা এবং আদানপ্রদানের পথ রুদ্ধ করা থেকে শুরু করে চিন্তাশক্তিকেই সম্পুর্ণ অবদমন করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অশনিসংকেত এই লেখার সর্বত্র যুক্তিজাল বিস্তার করে। লেখাটির অন্যতম শক্তিশালী দিক,সদ্যস্বাধীন ভারতের বিজ্ঞানমুখী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে নেহেরুর উদারতা এবং সীমাবদ্ধতার নির্মোহ বীক্ষণ। এই প্রসঙ্গে এরিক হবসবমের ট্র্যাডিশনচিন্তনের উল্লেখ অনবদ্য। সময়ের প্রেক্ষাপটের বিচারে লেখাটি একটি বিশিষ্ট সংযোজন।

আপনার মতামত...