অরাজনৈতিক বন্যজন্তুদের গল্প

উন্মেষ মিত্র

 


নদী বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। হিমবাহ নিলামে উঠেছে। মানুষ হাততালি দিচ্ছে, কেউ কেউ অত্যুৎসাহে সিটি বাজাচ্ছে, কেউ আবার নিছক মজা পেতে ঢেলা ছুড়ে মারছে খাঁচার গায়ে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন একাকী বাঘরোলটা আরও ভয় পাচ্ছে। আরও ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই দ্বীপরাষ্ট্রের মানুষগুলোর মতো

 

চারিদিকে চোর-চোর শোরগোলের মধ্যে মুর্শিদাবাদে খাঁচাবন্দি হয়েছে বাঘরোল। সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যবশত বাঘরোলই আমাদের রাজ্যের রাজ্য পশু। অনেকে একে মেছো বিড়াল বলে থাকেন। মানুষকে কামড়ায় না, নখ মারে না— দোষের মধ্যে একটাই, এদের প্রধান খাদ্য মাছ। WhatsApp University-র পূর্বসূরিরা অনেকদিন আগে রটিয়ে দিয়েছিলেন, বাঘরোল নাকি এত মাছ খেয়ে ফেলে যে মৎস্যজীবীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। কেউ কেউ আবার একধাপ এগিয়ে রটিয়েছিলেন, “এ হেব্বি কচরা জানোয়ার, রাতে এসে বাচ্চা-কাচ্চা তুলে নিয়ে যায়, দেকলেই মেরে দিবি।” ব্যস শুরু হল ভয়ের বিস্ফোরণ! শত্রু হয়ে গেল হাজার হাজার বছর পুরনো প্রতিবেশী। আর জলকে গিলে খেল দৈত্যাকৃতি মাছ ধরার মেশিন। নিমেষে শূন্য হয়ে গেল অনন্ত জলভাণ্ডার। মানুষ আর বাঘরোলের নকল যুদ্ধের মাঝে সর্বস্বান্ত হল দুপক্ষই। একসময়ের জলাভূমি-প্রভূত মুর্শিদাবাদ জেলায় আজ বাঘরোল একটি বিরল প্রাণী। এই দুর্লভ প্রাণীকে দেখার জন্য দিনের সব কাজ ছেড়ে ছুটছেন গ্রামের মানুষ। চারিদিকে এত মানুষ দেখে খাঁচাবন্দি বাঘরোল ভয় পাচ্ছে। ঘাড় উপরে তুলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিজের বিরক্তি জানাচ্ছে। সমবেত জনতাকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে গুটিকয়েক সিভিক ভলেন্টিয়ার। ওদিকে পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। নদী বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। হিমবাহ নিলামে উঠেছে। মানুষ হাততালি দিচ্ছে, কেউ কেউ অত্যুৎসাহে সিটি বাজাচ্ছে, কেউ আবার নিছক মজা পেতে ঢেলা ছুড়ে মারছে খাঁচার গায়ে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন একাকী বাঘরোলটা আরও ভয় পাচ্ছে। আরও ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই দ্বীপরাষ্ট্রের মানুষগুলোর মতো। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে যাদের বাসস্থান ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে, পরিবার হারিয়ে যাচ্ছে। সেই মানুষগুলিও ভয় পাচ্ছে। ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে।

 

দুই.

সরকার বাহাদুরের আনাগোনা হঠাৎ বেড়ে গেল গ্রামে। এত বছরে যারা এপথ মাড়াত না তাদের গাড়ির মোটা টায়ার দাবিয়ে দিয়ে গেল এই ঋতুর প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা গ্রামের মাটির রাস্তাকে। চারিদিকে গুজগুজ ফিসফিস। ওপাড়ার ছোঁড়াটা জুটেছে সরকারি বাবুদের সাথে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে, কীসব মাপ-জোক করে। ছেলেগুলোকে নিজেদের সঙ্গেই রাখে। তারপর একটা কথা কোথা থেকে যেন চাউর হয়ে গেল। Sanctuary হবে। সে আবার কী জিনিস গো? শচীনের সেঞ্চুরি শুনেছি, জমিহাঙরের বন চুরি দেখেছি কিন্তু Sanctuary আবার কী জিনিস বটে? তারপর সরকারি বাবুরা গাঁয়ে এলেন। মোড়লদের সঙ্গে কীসব শলাপরামর্শ হল। তারপর বলল গাঁয়ের উত্তরে গরু চড়াতে যাওয়া চলবে না। সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করল। মোড়লরা বলল স্যাংচুরি হয়ে গেছে, পঞ্চায়েতের নিষেধ আছে। তারপর জানা গেল কী জানি একটা পাখি থাকে গাঁয়ের ওধারে, ওদের জন্যই নাকি এ ব্যবস্থা! গাঁয়ের ওদিকে বন্ধুর গাঁ। পাঁচ মিনিটের রাস্তা এখন ঘুরে যেতে লাগে আধাঘন্টা। তার উপর কাঠ আনতে গেলে বনপুলিশের জ্বালা। পয়সা দাও নাহলে ভোগান্তি। এর চেয়ে ভাল ওই নচ্ছার পাখিগুলোকে মেরে ফেলা। ওরা না থাকলে এই সর্বনাশের স্যাংচুরিও থাকবে না। শুরু হল চোরাগোপ্তা শিকার। সঙ্গে অন্য পশু-পাখিও মারার সুযোগ পেয়ে গেল বন্যপশু ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে গাঁয়ের লোকের এক নতুন জ্বালা হাজির হয়েছে। কোত্থেকে জুটেছে রাজ্যের পোকার দল। চাষের সব্জির একটা পাতা আস্ত রাখছে না সেই বুভুক্ষু কীটেরা। পাখিদের শরীরের প্রোটিনের চাহিদা মেটায় মূলত পোকারা। পাখি সংহার যজ্ঞের সুফলে যারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বংশবিস্তার করেছে। সরকার বাহাদুরের টেবিলে দুটি রিপোর্ট জমা পড়ল। একটি কৃষিদপ্তরের আর অন্যটি বনদপ্তরের। একটিতে লেখা পোকার আক্রমণে সবজি চাষে ব্যাপক ক্ষতি, আর অন্যটিতে কোনও এক Sanctuary থেকে বিলুপ্তপ্রায় পাখির ব্যাপক হারে সংখ্যা হ্রাস। ফাইল দুটো দেখার সময় এই মুহূর্তে সরকার বাহাদুরের নেই। ওঁর সামনে খোলা ফাইলে বন্যভূমিতে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি সংক্রান্ত ফাইল। সরকার বাহাদুরের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চোখ দুটি চকচক করছে। কালো হীরে বলে কথা!

 

তিন.

বন্যপ্রাণীরা মানুষের শত্রু না।
মানুষ বন্যপ্রাণীদের শত্রু না।

ক্লাস ইলেভেনের পরিবেশবিদ্যার ক্লাস চলছে ইস্কুলে। কারও মন ক্লাসের দিকে নেই। এমনিতেই পরীক্ষায় নম্বর যোগ হয় না, তাই না শুনলে কিছু এসে যায় না। তবু ছেলে-মেয়েগুলোকে পড়াবার আকুল চেষ্টা করে যাচ্ছেন শতদলবাবু। তারপর বুঝলেন এ এক বৃথা চেষ্টা। তখন হঠাৎ করেই ঘোষণা করলেন, “আজ আর পড়া নয়, আজ গল্প হবে।” ছেলেমেয়েরা নড়ে-চড়ে বসল। গল্প শুনতে কে না ভালবাসে। ক্লাস চুপ। পিছন থেকে একটা মেয়ে বলল, “কীসের গল্প হবে স্যার?” শতদলবাবু বললেন, “গল্পটা শুনে তোরাই নামকরণ কর দেখি।” শতদলবাবু শুরু করলেন,

এক জঙ্গলের মধ্যে এক গাছে বাস করত একটি পাখি আর একটি কাঠবিড়ালি। দুজনের মধ্যে খুব ভাব। প্রতিদিন সকালে একে অপরকে হোয়াটস্যাপে গুড মর্নিং মেসেজ না পাঠালে তাদের সকাল হয় না। আর গাছটাও খুব ভাল। বেশ সরেস পুরুষ্টু ফল হয়। দুই বন্ধু খায়-দায়, টিভি দেখে, গল্প করে আর ঘুমায়। একদিন সেখানে হাজির কোন এক উটকো চিতা। কাঠবিড়ালি বলে, “তুমি কে হে?” চিতা বলে, “আমি আফ্রিকার রাজা।” পাখি প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, “সে তো সিংহ।” চিতা বলে, “ট্যুইটারে হ্যাশট্যাগ দেখে নিয়েছি #AfricanKingCheeta। ব্যাস! এখন আমিই রাজা।”

তো কাঠবিড়ালি ভারতের রাজাকে খুব ভয় পায় বলে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয় আফ্রিকার রাজার কথা। সে বলে, “রাজামশাই, আজ্ঞা করুন কী সেবা করতে পারি?”

চিতামহারাজ বলেন, “আপাতত আফ্রিকান ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা কর, বাকিটা পরে বলছি।”

কাঠবিড়ালি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করতে বনের ভিতরে চলে গেলে পাখির গা ঘেষে বসেন চিতামহারাজ। পাখি নাক সিঁটকোয়। কী বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধ রে বাবা! কদ্দিন স্নান করে না কে জানে!

চিতামহারাজ গলা নামিয়ে বলেন, “শোনো হে পাখি, তোমাকে একটা গোপন কথা বলি, তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।”

পাখি চমকে ওঠে!

“তোমাকে গাছছাড়া করার ব্যবস্থা হচ্ছে। এখন রাজতন্ত্র নেই, ওই ব্যাটা নেহেরু সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে সব। তবু তোমাদের ভালবাসি তাই বলতে এলাম। কাঠবিড়ালি তোমাদের পাখি জাত নিয়ে তোমার আড়ালে কী বলে তা জানো?”

পাখি আহত স্বরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

চিতামহারাজ গলার স্বর আরও নামিয়ে বললেন, “তোমার যে ডিম দাও, বাচ্চা দাও না, সেই নিয়ে কী নোংরা নোংরা কথা বলে তা শুনেছ?”

পাখির অভিমান ক্রমে বদলে গেল রাগে। পালক খাড়া হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।

চিতা বলে চলল, “তোমাদের ওই কাঠির মতো ঠোঁট  নিয়ে যা কুৎসিত ইঙ্গিত করে, আমার বলতেও লজ্জা করছে।”

পাখির মনে তখন জাত্যাভিমান চরম শিখরে। ডানা দুটো কটকট করছে। পায়ের তীক্ষ্ণ নখগুলো আস্তিন ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।

সেই সময় চিতামহারাজের আফ্রিকান ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির পরিশ্রান্ত কাঠবিড়ালি।

এসেই নিত্যদিনের বন্ধুত্বের অভ্যাসে পাখির মাথায় একটা চাটি মেরে গেল। পাখি রাগে থরথর করে কাঁপছে। ওই দুগ্ধপায়ীটার সাহস হয় কীভাবে তার গায়ে হাত দেওয়ার! কয়েক মহাযুগ আগে তো ওরা আমাদের জাতভাইদের পায়ের তলায় দেবে থাকত। কাঠবিড়ালি তখন চিতামহারাজের সেবায় ব্যস্ত। পা টিপবে নাকি লেজ ধুয়ে দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। আমাদের ভারতীয় মহারাজের জন্মদিনের অতিথি বলে কথা! খেয়ালের আতিশয্যে কাঠবিড়ালি বলল, “ওরে বিহঙ্গ, ওরম পালক খাড়া করে না দাঁড়িয়ে থেকে একটু কাজ কর, মহারাজের সেবা কর।” রাগে চিরিক করে উঠল পাখির মাথা। ওই কাঠবাদামখাওয়াদের জাত আজ আমাদের কাজের হুকুম দিচ্ছে! এত আস্পর্ধা!

পাখি বলল, “মুখ সামলে কথা বল দাঁতউঁচুর দল।”

এহেন অস্বাভাবিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে গেল কাঠবিড়ালি। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পাখি বলল, “কাজ কাকে শেখাচ্ছিস? সেই জুরাসিক যুগ থেকে তো পায়ের নখে বিঁধিয়ে কাজ করাচ্ছি তোদের। একটু পা আলগা করেছি কি বড্ড লায়েক হয়ে গেছিস তোরা।”

এহেন কথা শুনে কাঠবিড়ালি ফুঁসে উঠল।

পাখি আরও বলে চলল, “এই লোমওয়ালাগুলোকে আমার একদম সহ্য হয় না। সারা জাতের ওই পাপোশের মতো লোম, আর টকে যাওয়া গন্ধ। একটা লোমশও প্রতিদিন স্নান করে না।”

এবার চিতা উসকানি দিল, “ওরা আমাদের স্তন্যপায়ীদের জাত্যাভিমানে আঘাত দিয়েছে। আজ দিন এসেছে এই ভিনপ্রজাতিদের হাত থেকে আমাদের সুপ্রাচীন প্রজাতিকে রক্ষা করতে হবে। হে জওয়ান, হও আগুয়ান!”

এসব শুনে কাঠবিড়ালির ল্যাজ খাড়া হয়ে উঠল। এক ঝাঁপে পাখির ওপর, তারপর খণ্ডযুদ্ধ। এ ওকে কামড়ায়, ও একে ঠুকরে দেয়, পাখির পালকে আর কাঠবিড়ালির চিৎকারে মুখরিত হল চারিদিক। তারপর যুদ্ধ শেষে দুই পরাজিত, রক্তাক্ত, ক্লান্ত, আহত প্রজাতিযোদ্ধা ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেল, গাছে সবচেয়ে আরামদায়ক ডালটায় বেশ আয়েশ করে বসে আছেন চিতামহারাজ, উপভোগ করছেন আফ্রিকান স্পেশাল ব্রেকফাস্ট।

তার মানে আমরা বুঝতে পারলাম—

“কে বন্ধু আর কে শত্রু সেটা চিনতে হবে”— শতদলস্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাসের পিছন থেকে বলে উঠল একটা মেয়ে।

ঢং ঢং করে বেজে উঠল ইস্কুল ছুটির ঘন্টা। ২০ বছরের চাকরি জীবনে আজ প্রথমবার সফলভাবে পরিবেশবিদ্যার ক্লাস নিতে পারলেন শতদলবাবু।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...