‘ব্রতচারী হয়ে দ্যাখো…’

‘ব্রতচারী হয়ে দ্যাখো…’ | প্রবুদ্ধ বাগচী

প্রবুদ্ধ বাগচী

 


আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে তাদেরই ঠিক করে দেওয়া পদে বসে এইভাবে কি একটা পরাধীন দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ‘সামাজিক আন্দোলন’ তৈরি করা যায়? নাকি এর বেশিটাই একটা ‘স্পনসর’ করা ‘জাগরণ’, যার একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক অভিসন্ধি আছে? আরএসএস-ও কিন্তু তাদের ‘সামাজিক আন্দোলন’-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি কোনও প্রকৃত বিরোধের প্রতিস্পর্ধী বার্তা কখনও দেয়নি। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণআন্দোলনকে বিপথে চালিত করে শাসকের সুবিধে করে দেওয়ার যেসব কদর্য উদাহরণ আমাদের ইতিহাসের কিছু পাতায় কালি ঢেলে দিয়েছে, ‘ব্রতচারী আন্দোলন’ কি আদপে তেমনই এক মুখোশ-পরা নাশকতার নীল নকশা ছিল?

 

সে অনেককাল আগের কথা। আমাদের এক ধূসর মফস্বলে ছিল একটা ক্লাব। বাড়ির কাছেই। ছোট একটা টালির চালের ঘর। সামনের এক চিলতে মাঠের একদিকে ঠাকুরদালান। অবশিষ্ট এবড়োখেবড়ো জায়গাটায় বিকেলে বসত খেলাধুলোর আসর। ক্লাবের নামটি একদিক দিয়ে খুবই আধুনিক— ’নাট্যম’। ওই সময়কালে পাড়ার ক্লাবের নাম সচরাচর হত রামকৃষ্ণ স্মৃতি সংঘ বা নেতাজি ক্লাব অথবা সুকান্ত সমিতি— বামফ্রন্টের প্রথমদিকের জমানায় কবি হিসেবে সুকান্তের কদর বেড়ে গিয়েছিল অনেকটাই। এই ‘নাট্যম’-এর অঙ্গনেই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল ব্রতচারীর সঙ্গে। বৈকালিক আসরে পিটি প্যারেড, ড্রাম বাজানোর পাশাপাশি সেখানে চর্চা হত ব্রতচারীর। কার্যত, ব্রতচারীর মৌলিক সব গান, অঙ্গভঙ্গিমা ও নানা অনুষঙ্গ আমার শিখে নিচ্ছিলাম ওইখানেই। অনুশীলনের গোড়াতেই হত শপথ, তারপর ভঙ্গিমানৃত্য সহ ব্রতচারীর গান— ‘ব্রতচারী হয়ে দ্যাখো/ জীবনে কী মজা ভাই’ বা ‘চল কোদাল চালাই/ ভুলে মানের বালাই’ এইসব বিখ্যাত ছড়াগান। এতটাই মজে গিয়েছিলাম সেই অভ্যাসে যে সেই দূর ফেলে-আসা অতীতের ভাবনা রোমন্থন করে দেখতে পাই, বাড়িতে পড়াশোনা বা দৈনন্দিনের অবসরে নিজেদের মনে গেয়ে উঠছি ওইসব গান— হয়তো তাদের সহজ অনাড়ম্বর কথা ও সুর এতটাই ভরিয়ে রেখেছিল আমাদের।

কিন্তু ব্রতচারীর সঙ্গে এই প্রতিদিনের সংযোগ, আমাদের যতটা ব্রতচারীর মাহাত্ম্য শিখিয়েছিল ঠিক ততটাই আড়ালে রেখেছিল তার ইতিহাসকে। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গুরুসদয় দত্তের নাম আমরা জানতাম। তবে তিনি কে, কী এবং কেন, সে বিষয়ে ওই শৈশবের ভোরে কোনও ধারণাই ছিল না আমাদের। না থাকারই কথা। তবে মনে পড়ে, ব্রতচারী অনুশীলনের শুরুতে দুটি শপথ সোচ্চারে বলতে হত আমাদের। জ-সো-বা অর্থাৎ জয় সোনার বাংলার। জ-সো-ভা অর্থাৎ জয় সোনার ভারতের। তখন জানতাম না, পরে জেনেছি, বাংলায় ব্রতচারী আন্দোলনের মাধ্যমে একটা সামাজিক আন্দোলনের ভাবনাই মূলত ছিল এর প্রতিষ্ঠাতার। সেই সঙ্গে বাংলার পল্লী-সংস্কৃতির নানা উপাদানকে সংগ্রহ করায় উদ্যোগী ছিলেন গুরুসদয় দত্ত। নিজের জীবৎকালের শেষদিকে আজকের দক্ষিণ শহরতলির জোকা এলাকায় (তখন জোকা একটি অজ পাড়াগাঁ) সম্ভবত ১২৮ বিঘা জমি কিনে তিনি ‘ব্রতচারী গ্রাম’ স্থাপন করেন। সেই জনপদের আজকে কোনও অস্তিত্ব আছে কি না জানা নেই, তবে আজকে জীর্ণপ্রায় হলেও জোকায় আছে ‘গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালা’। পশ্চিমবাংলার বাইরেও সেকালের পুববাংলাতেও এই ব্রতচারী আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল বলে জানা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি পোর্টালে খেয়াল করলাম, সেদেশের ব্রতচারী আন্দোলনের ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদক আক্ষেপ করেছেন। এপারেও আজ ক্লাবপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই, কিন্তু কেউ আর ব্রতচারী চর্চা করেন বলে শোনা যায় না। ব্রতচারী আজকে একটি মৃত বিষয়, কিন্তু ইতিহাসের চর্চার বাইরে নয়।

একটা সামাজিক আন্দোলনের কাঠামো তৈরি করতে গেলে তার একটা কর্মসূচিগত রূপরেখা তৈরি করতে হয়। ‘ব্রতচারী আন্দোলন’-এর ক্ষেত্রে সেই লিখিত বইটির নাম ‘ব্রতচারী-সখা’ যাতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলা হয়েছে ব্রতচারী আন্দোলনের মধ্যে যাঁরা কর্মী বা ‘ব্রতচারী’ হবেন তাঁদের কী কী করণীয়। ওই বইতে ‘ব্রতচারী কর্মী’রা কীভাবে নিজেদের তৈরি করবেন, কীভাবে ‘ব্রতচারী সঙ্ঘ’-র মাধ্যমে ‘দেশসেবা’ করবেন, কীভাবে নতুন দেশ ‘গড়ে তুলবেন’ এই সব কিছু বিশদে লেখা আছে। আপাতভাবে, এইসব নির্দেশ অসাম্প্রদায়িক, হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের কথা এখানে আছে। ব্রতচারীর একটা প্রার্থনা-গান শুরু হচ্ছে এইভাবে ‘ভগবান হে! খোদাতালা হে!’— এটা নিশ্চয়ই খেয়াল করার মতো প্রসঙ্গ। উল্লেখ না করে উপায় নেই, ‘ব্রতচারী গান’-এর যে সঙ্কলন করা হয়েছে ‘ব্রতচারী-সখা’ বইতে তাতে সামাজিকভাবে অবনত কৃষক (চাষা)-কেও স্বীকৃতির কথা মেনে নেওয়া হয়েছে। আর ব্রতচারীর মূল জোর হচ্ছে ‘দেহগঠন’, দেহের পরিপোষণের জন্য ব্যায়াম, লাঠিখেলা, ভঙ্গিমানৃত্য— উল্লেখ্য এইটাই যে এখানে নারীরাও সমান অংশীদার। তাঁদের গানে বলা হয়েছে ‘বাংলার ছেলে-মেয়ে লভুক দেহের শক্তি, মনের জ্ঞান’। যদিও দু-একটা খটকা যে নেই তা নয়। ব্রতচারীর শপথবাচক যে ‘ষোলো পণ’-এর ম্যানিফেস্টো— সেখানে অবশ্যকর্তব্য হিসেবে বলা হয়েছে ‘বিয়ের আগে উপার্জ্জন’, কিন্তু এটা মেয়েদের ক্ষেত্রে বদলে গিয়ে বলতে হবে ‘বিনয় নম্র আচরণ’। একইভাবে ‘লেখাপড়া’ শীর্ষক গানটির দুটি রূপভেদ— একটি ছেলেদের, অন্যটি মেয়েদের। ছেলেদের জন্য নির্ধারিত গানে বলা হচ্ছে, ‘লেখাপড়া’ শিখে ‘সকল দৈন্য দূর করে সে/ চড়ে গাড়ী ঘোড়া’— অথচ মেয়েদের জন্য নির্ধারিত গানে লেখা হয়েছে, ‘লেখাপড়া শিখে সে যে সুগৃহিণী হয়’! ব্যস এইটুকুই?

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে যে দেহগঠন-ব্যায়াম-কুস্তি-লাঠিখেলা সহ নানারকম ব্যবস্থা দরকার এটা প্রথম ভাবা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ বছরগুলিতে, যখন গোটা বাংলা জুড়েই ‘গুপ্ত সমিতি’গুলি তৈরি হচ্ছিল। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর গোষ্ঠী সহ ঢাকার পুলিন দাসের ‘আখড়া’ সব জায়গাতেই এর প্রতিটির চর্চা হত। স্বামী বিবেকানন্দও তাঁর লেখায় দেশসেবার ক্ষেত্রে উপযুক্ত শরীর গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের অনুষঙ্গে যে ‘স্বদেশি’ বিপ্লবী ধারার সূত্রপাত হল, তার মধ্যে লাঠির চেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছিল বোমা, বন্দুক ইত্যাদি। গোপন ষড়যন্ত্র ও নাশকতা বা ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি একদিন তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলল সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনের কঠোর দমন-পীড়নের মধ্যে দিয়ে। তারপর একটা বড় সময় বাংলার রাজনীতিতে আর এই ধরনের তথাকথিত ‘দেহগঠন’ বা সশস্ত্র আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। কিন্তু  কথাটা হল, ১৯৩২-এ শুরু হওয়া ‘ব্রতচারী আন্দোলন’-এ এইসব প্রসঙ্গগুলো আবার ফিরে এল কেন?

কথাটা ওঠার সুযোগ পায় এই কারণে যে, ‘ব্রতচারী আন্দোলন’-এর প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত কিন্তু ছিলেন সেকালের একজন দুঁদে আইসিএস অফিসার এবং কার্যত ব্রিটিশ সরকারের আস্থাভাজন। বাংলার নানা জেলায় তিনি জেলাশাসক হিসেবে পোস্টিং ছিলেন— মূলত সেই সূত্রেই তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন। আজকের ‘ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’-এর আওতায় থাকা জেলাশাসকদের সঙ্গে প্রাক-স্বাধীনতা যুগের জেলাশাসকের দাপটের কোনও তুলনাই হয় না। জেলাশাসক হিসেবে জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন ডাকসাইটে ‘দত্ত সাহেব’ হিসেবে। সন হিসেবে ১৯৩২-এর গুরুত্ব এইখানেই যে, এই সময়কালে শুরু হয়েছে তৃতীয় দফার ‘অসহযোগ আন্দোলন’ যার অবিসংবাদী নেতা গান্ধিজি। এই বছরেই ইতিহাস-খ্যাত ‘পুনা চুক্তি’র মাধ্যমে দেশের দলিত সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা হচ্ছে আঞ্চলিক শাসনসভার পদ। খেয়াল রাখতে হবে, দ্বিতীয় পর্যায়ের যে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়েছিল মূলত প্রথম দফার ‘অসহযোগ আন্দোলন’-এর অকাল পরিসমাপ্তির হতাশায় এই সময়কালে তা-ও অনেকটাই স্তিমিত। চট্টগ্রামের জালালাবাদে স্বাধীন সরকারের ঘোষণা ও গান্ধিজির ‘ডান্ডি অভিযান’ একই সনের ঘটনা (১৯৩০), বিনয় বাদল দীনেশের রাইটার্সের অলিন্দ যুদ্ধ-ও ওই একই বছরে। ১৯৩২-এর আগেই দীনেশের ফাঁসি হয়ে গেছে, সূর্য সেন পলাতক। এই রাজনৈতিক ‘আকালে’ স্বাধীনতাকামী মানুষ বুঝতে পারছেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ‘গণ-আন্দোলন’ তৈরি না করলে প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত নড়ানো যাবে না। ওদিকে ১৯২৫ সালে যেমন গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), তেমনই ভারতের কমিউনিস্ট দলেরও আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ঘটেছে ওই একই বছরে। যদিও তখনও জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে কাজ-করা বামপন্থী অংশ বিশ দশকের শেষের দিক থেকে শ্রমজীবী মানুষকেও টেনে আনতে চাইছেন গণআন্দোলনের আঙিনায়— ১৯২৭-২৯-এর মধ্যে রেলপথ, সুতোকল ও চটকলগুলিতে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ ও আন্দোলন ঘটে, ঘটে যায় বারদৌলির কৃষক অভ্যুত্থান। তিরিশের দশকের গোড়ায় আর্থিক মন্দার হার এত বেশি হয়ে ওঠে যে তার প্রভাব পড়তে থাকে জনজীবনে— মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা সরাসরি আক্রান্ত হন— তৈরি হতে থাকে ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ। এর একটা দৃষ্টান্ত হল, আউশ ধানের বিক্রয়মূল্যকে যদি ১৯২৯-এর সূচকে ১০০ টাকা ধরা হয় তাহলে ১৯৩১-এ তা নেমে আসে ৪৫ টাকা ৯০ পয়সায়, একই জিনিস ঘটে বাংলার আরেক অর্থকরী ফসল পাটের ক্ষেত্রেও। এই মন্দা মানুষের সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলবে এইই কি স্বাভাবিক নয়?

তাহলে এমন এক বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘ব্রতচারী কর্মী’-রা ঠিক কোন দেশের স্বপ্ন দেখতে চাইছিলেন তাঁদের ‘সামাজিক আন্দোলন’-এর মধ্যে? কোন দেশ-কে নতুনভাবে গড়ার কথা ভাবছিলেন ব্রতচারীর তাত্ত্বিক প্রাণপুরুষ? যে-দেশের অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট, যে-দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ জোট বেঁধেছেন উপনিবেশের শাসন থেকে মুক্তি পেতে, যে-দেশের মানুষের মুক্তির জোয়ারকে শাসক অবদমিত করতে চাইছে তাদের বুটের তলায়, নিপীড়নে— সেখানে ‘কোদাল চালিয়ে’ বা ‘পাড়ার পুকুরের কচুরিপানা’ পরিষ্কার করে বা ব্রতচারী-র ‘নাচনকোঁদন’ করে কোন ‘সোনার বাংলা’ বা ‘সোনার ভারত’ গড়া সম্ভব? তথ্য বলছে, ১৯২৮-২৯ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ধর্মঘটের সংখ্যা ২০৩, আর এই সময়ে সরকারি হিসেবে মাথাপিছু জাতীয় আয় ষাট টাকার কিছু বেশি— তিরিশের দশকের গোড়ায় তা প্রায় অপরিবর্তিত। এর পরেও ‘সোনার বাংলা’ তৈরি করা যায়?

আসলে সেই সময় এই প্রশ্নটা যে ওঠেনি তা নয়। স্বয়ং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি গান্ধিজির অনুগামী হিসেবে ‘অসহযোগ আন্দোলন’-এ অংশ নিয়ে জেল খাটেন, তিনি লিখছেন, ‘রায়বেঁশে নৃত্য, ব্রতচারী দল বাংলার সংস্কৃতিকে যেটুকু সমৃদ্ধ করেছে— তা স্বীকার করেও বলব যে সেদিন এই মাতনটি যাঁরা দেশকর্মী তাঁদের চোখে ভাল ঠেকেনি। এই মাতনটি সেদিন দেশের মানুষের দৃষ্টিকে কংগ্রেস আন্দোলন থেকে ফিরিয়ে অন্যদিকে নিবদ্ধ করবার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। এবং এই রায়বেঁশে বা ব্রতচারী আন্দোলন প্রচার করতে তিনি যে শাসকের প্রতাপ প্রয়োগ করেছিলেন— তাতেই এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গেছে।’ বীরভূম জেলার জেলাশাসক হিসেবে গুরুসদয় দত্ত তার প্রতাপ কেমনভাবে ‘কাজে লাগিয়েছিলেন’ সেদিকেও একটা ইঙ্গিত করেছেন তারাশঙ্কর। তাঁর কথায়, ‘দত্তসাহেব বলেই তিনি খ্যাত ছিলেন তাঁর প্রতাপে— ইস্কুলে ইস্কুলে গ্রামে গ্রামে তখন রায়বেঁশে নৃত্যের ঢোল বাজতে লেগেছে। উকীল নাচছে, মোক্তার নাচছে, ডেপুটি নাচছে, দারোগা নাচছে, চৌকিদার নাচছে, হাকিম নাচছে, আসামী নাচছে, রায়বাহাদুর নাচছে, রায়সাহেব নাচছে, জমিদার নাচছে, ধনী নাচছে, সেকেন্ড মাস্টার নাচছে, ছাত্র নাচছে— সে এক অত্যদ্ভুত কাণ্ড। না নেচে পরিত্রাণ নেই। হাত ধরে টেনে এনে বলেন— নাচুন রায়বাহাদুর! তেমনি ছিল তাঁর অসহিষ্ণুতা। আইসিএস-সুলভ অসহিষ্ণুতা কী বস্তু যাঁরা জানেন— তাঁরাই বুঝবেন সে কথা।’ এরপরে তো আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে তাদেরই ঠিক করে দেওয়া পদে বসে আর সেই পদেরই ‘প্রতাপ’ কাজে লাগিয়ে এইভাবে কি একটা পরাধীন দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ‘সামাজিক আন্দোলন’ তৈরি করা যায়? নাকি এর বেশিটাই একটা ‘স্পনসর’ করা ‘জাগরণ’, যার একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক অভিসন্ধি আছে? বিতর্ক উঠলেও এটা বলা দরকার, আরএসএস-ও কিন্তু তাদের ‘সামাজিক আন্দোলন’-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি কোনও প্রকৃত বিরোধের প্রতিস্পর্ধী বার্তা কখনও দেয়নি। এইসব ঘটনার প্রায় সমকালে যখন ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ বিকশিত হচ্ছিল, আরএসএস-এর নেতারা সেখানে গিয়ে তাদের সামরিক শিক্ষাপ্রণালী শিখে তাদের বাহবা দিয়ে এসেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ‘বীর’ সাভারকর দেশের ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিজে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁদের মতাদর্শের সমর্থকরা স্বেচ্ছায় ব্রিটিশের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে যেতে চায়, রাজি থাকলে তার ব্যবস্থা তাঁরা করবেন। এগুলো জানা তথ্য ঠিকই। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণআন্দোলনকে বিপথে চালিত করে শাসকের সুবিধে করে দেওয়ার যেসব ‘কদর্য’ উদাহরণ আমাদের ইতিহাসের কিছু পাতায় কালি ঢেলে দিয়েছে, ‘ব্রতচারী আন্দোলন’ কি আদপে তেমনই এক মুখোশ-পরা নাশকতার নীল নকশা ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরেকবার দেখে নিই ব্রতচারীর প্রতিষ্ঠাতা-পুরুষের ‘দাপ-কাহিনি’। ঘটনাটা তারাশঙ্কর বিস্তারিত লিখলেও এটা আমরা শুনব একটু সংক্ষিপ্ততর বয়ানে। বীরভূমে জেলাশাসক থাকার সময় তিনি যেখানে যত মূর্তি, পট, দারুশিল্প পেয়েছিলেন সব সংগ্রহ করে এনেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় গ্রামবাসীদের ক্ষোভ থাকলেও তারা প্রতিবাদ করতে সাহস করেনি। রায়পুর নামক গ্রামে একটি প্রাচীন মূর্তি একইভাবে তিনি জোর করে তুলে নিয়ে চলে যান। এই ঘটনার প্রতিবাদে ব্যোমকেশ চট্টোপাধ্যায় নামক এক স্থানীয় কংগ্রেসকর্মী, নিজের নাম উল্লেখ না-করে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় একটি চিঠি লেখেন। ক্ষুব্ধ ‘দত্তসাহেব’ এই ঘটনায় স্থানীয় এক সাহিত্যপ্রেমী-কে সন্দেহ করেন এবং তাঁকে ‘কিঞ্চিৎ শাসন’-ও করেন। পরে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে কিছু বশংবদ গ্রামবাসীকে দিয়ে ওই প্রতিবাদপত্রের বিরুদ্ধে নিজের কোলে ঝোল টেনে আরেকটি চিঠি প্রকাশ করেন। এই ঘটনার পরে অকুতোভয় সেই কংগ্রেসকর্মী স্থানীয় একটি প্রেস থেকে এই বিষয়ে একটি ‘ব্যঙ্গ কবিতা’ ছাপিয়ে ‘বিয়ের পদ্য’ নাম দিয়ে সেই কপি সারা জেলায় ছড়িয়ে দেন। ওই প্রেসটির সঙ্গে তখন যুক্ত ছিলেন স্বয়ং তারাশঙ্কর ও তাঁর মেজভাই। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা ‘দত্তসাহেব’ অবিলম্বে পুলিশ পাঠিয়ে প্রেস তল্লাশি করিয়ে থানায় ডেকে পাঠালেন কম্পোজিটর ও প্রেসমালিক তারাশঙ্করকে। আইনমাফিক এই প্রকাশনার জন্য ‘রাজদ্রোহের’ অভিযোগ আনা সম্ভব ছিল না কারণ ওটি আদপে একটি ‘বিয়ের পদ্য’— ‘আমার বিয়েয় যেমন তেমন/ দাদার বিয়েয় রায়বেঁশে/ আয় ঢকাঢক মদ খে-সে’— তাই প্রেসমালিকের জরিমানা হল দু-হাজার টাকা (যে আমলে মাথা পিছু গড় জাতীয় আয় ষাট টাকা)। কিন্তু ‘আহত শার্দুল’ জেলাশাসকের তাতেও তৃপ্তি নেই— এরপর কংগ্রেসকর্মী ব্যোমকেশের জন্য নির্দেশ এল, তিনি কোনও সভাসমিতিতে যোগ দিতে পারবেন না। একজন রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে এর চেয়ে বড় সাজা আর কী হতে পারে? এখানেও শেষ নয়। স্থানীয় দারোগার ওপর জেলাশাসকের হুকুম হল, যেভাবেই হোক ওই কংগ্রেসকর্মীকে গ্রেফতার করতে হবে। পুলিশ আর দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না, এবারেও হল না। কৌশল করে ‘ফাঁসানো’ হল ওই কংগ্রেস নেতাকে— বিচারে তার ছ মাস জেল হয়ে গেল। ‘ব্রতচারী আন্দোলন’-এর মাধ্যমে যিনি বাঙালি জাতির নৈতিক, চারিত্রিক, আত্মিক সমুন্নতির ভাবনা ভেবেছেন সেই তিনিই এতদূর পর্যন্ত অসহিষ্ণু হতে পারেন ব্যক্তিগত আচরণে? নিজের জাতির মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করা সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের ওপর তাঁর এমন চণ্ড-ক্রোধ? এমন স্বৈরাচারী প্রতিশোধস্পৃহা?

এই এপিসোডের পরিণতিটুকু জানিয়েই ফুরিয়ে যাবে আমাদের প্রতিবেদন। প্রেসমালিক হিসেবে তারাশঙ্করের ওপর প্রশাসনিক জুলুম চলেছিল এর পরেও— অথচ এই সময়কালে তিনি লেখার সূত্রে কিছুটা যে পরিচিত হননি, তা নয়। তাঁকে বাধ্য করার চেষ্টা হচ্ছিল হয় তিনি সরকারের কাছে মুচলেকা দিন, নয়তো জামিন নিয়ে আদালতে লড়াই করুন। যাই হোক, এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোনও একটি বৈঠক করতে একদিন সুভাষচন্দ্র এলেন শান্তিনিকেতনে। তিনি যখন বিকেলের ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরে যাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হল তারাশঙ্করের— উভয়েই ছিলেন পূর্ব-পরিচিত। তাঁর মুখে ঘটনাপরম্পরা শুনে সুভাষচন্দ্র বললেন, আপনি বন্ড-ও দেবেন না, জামিনও নেবেন না। দরকার হলে প্রেস বন্ধ করে কলকাতায় চলে আসুন। হয়েছিল ঠিক তাই। নিজের ‘চৈতালি ঘূর্ণী’ উপন্যাস যাঁকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর কথার কি অন্যথা করা যায়। এইসব মহতী ঘটনার পটভূমিতে যদি রাখা যায় ‘ব্রতচারী’র প্রবাদপুরুষকে, তবে কি তাঁর কোনও উজ্জ্বলতর ছবি ধরা পড়ে আমাদের চোখে?

 

প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যগুলি পাওয়া যাবে:

  • দত্ত, গুরুসদয়। ব্রতচারী সখা। বাংলার ব্রতচারী সমিতি প্রকাশনা। শ্রাবণ, ১৩৪৭।
  • সরকার, সুমিত। আধুনিক ভারত। কেপি বাগচী। ২০১৩।
  • বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর। আমার সাহিত্যজীবন। বেঙ্গল পাবলিশার্স। বৈশাখ, ১৩৬৪।

*লেখায় উদ্ধৃতি-চিহ্নের মধ্যে পুরনো বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. A very interesting take. I have been studying the movement for sometime, but I have to admit that I was not aware of this conflict with the congress party member. I have actually wondered about the ” Aye dhokadhok mod khe-she part for a long time”. Thank you for this

আপনার মতামত...