একবিংশ শতাব্দীর এই বিবর্তিত সমাজে সারোগেসির ভূমিকা

একবিংশ শতাব্দীর এই বিবর্তিত সমাজে সারোগেসির ভূমিকা | নুপূর রায়চৌধুরী

নুপূর রায়চৌধুরী

 


এই বিশ্বায়নের যুগে, সকলের জন্য আরও প্রজনন অধিকারের উপায় হিসাবে, সারোগেসি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে কথাবার্তা হওয়া খুব প্রয়োজনীয়। সারোগেসি ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ঐকমত্য অনুসরণ করা এবং একটি সর্বজনগ্রাহ্য আইনি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কার্যকর হলেই সারোগেসিকে ঘিরে বেড়ে ওঠা নানা প্রকারের শোষণ, এবং দুর্বলের অধিকার লঙ্ঘনের কলঙ্ক ও লজ্জা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি

 

আজকের ফার্টিলিটি ট্ৰিটমেন্টের দুনিয়ায় সবচেয়ে আলোড়ন তোলা, সবচেয়ে কার্যকর, সবচেয়ে উন্নত সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তির নাম সারোগেসি, যেখানে একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক নারী পরোপকারীভাবে বা আর্থিক লাভের জন্য তার জরায়ুতে অন্য কোনও ব্যক্তি বা দম্পতির হয়ে সন্তান ধারণ করেন ও জন্ম দেন। এ পদ্ধতিতে গর্ভধারণের কাজটি যে নারী করেন, তাকে ‘সারোগেট মা’ বলা হয় আর যাঁরা বাবা-মা হতে চান তাঁরা হলেন জেনেটিক বা কমিশনিং কাপল বা ইচ্ছুক (অভিপ্রেত) দম্পতি।

সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি-র একটি আধুনিক রূপ বলে সারোগেসিকে নিয়ে আমরা নাচানাচি করলেও, এই প্রথা কিছু নতুন নয়। “দি বুক অফ জেনেসিস”-এ সারা এবং আব্রাহামের গল্পে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। সারা এবং আব্রাহাম বিবাহিত ছিলেন কিন্তু সারার পেটে কোনও সন্তান আসছিল না, তাই আব্রাহামের সন্তানের মা হওয়ার জন্য সারা তার দাসী হাগারের দ্বারস্থ হন এবং হাগার তখন তার গর্ভে আব্রাহামের পুত্র ইসমাইলকে ধারণ করেন। প্রাচীন রোমেও এর চল ছিল: একজন স্বামী তাঁর উর্বরা স্ত্রীর গর্ভ অস্থায়ীভাবে ভাড়া দিত, অন্য পুরুষের মৃতবৎসা স্ত্রীর সন্তানধারণের কাজে।

ভাবছেন তাহলে সেই পুরাকালের সাথে সারোগেসির বর্তমান ধারণার তফাৎ কোথায়? উপরে উল্লিখিত দুই ক্ষেত্রেই শুক্রাণু-ডিম্বাণুর নিষেক সাধিত হত পুরুষ নারীর স্বাভাবিক সহবাসের ফলে; কিন্তু একালে যৌনমিলন ছাড়াই, আইইউআই বা আইভিএফ-এর মাধ্যমে নিষিক্তকরণের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। একালে আরও নিশ্চিন্তির ব্যাপার এই যে, ইচ্ছুক দম্পতিদের নিজস্ব স্পার্ম বা এগ পাওয়ার অসুবিধা থাকলে তাঁদের সাহায্যার্থে রয়েছে স্পার্ম ব্যাঙ্ক, এগ ব্যাঙ্ক মায় ভ্রূণ (এমব্রায়ো) ব্যাঙ্ক।

দেখুন, সারোগেসির মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম শিশু ‘বেবি এম’-এর জন্ম হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেই ১৯৮৫ সালে, আর তারপর থেকে, সারোগেসির প্রতি মানুষের আগ্রহ উত্তরোত্তর বেড়েছে বই কমেনি। সুতরাং, এটা এখন আর নতুন কিছু ব্যাপার নয়, এ সম্বন্ধে সকলেই অল্পবিস্তর জানেন। কিন্তু একবিংশ শতকের এই বিশ্বায়নের যুগে, চিকিৎসাপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের কালে, আজকের লিঙ্গবৈচিত্র্যের দুনিয়ায় সারোগেসির ভূমিকাটা ঠিক কীরকম, সে সম্বন্ধে কিন্তু এখনও অনেক ধোয়াঁশা আছে, অনেক বাদানুবাদ রয়েছে। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সেটা হলে কেমন হয়? অবশ্য সে প্রসঙ্গে যাবার আগে সারোগেসি সম্বন্ধে আমাদের জানা কিছু তথ্য আরও একবার ঝালাই করে নিলে ব্যাপারটা নিয়ে এগোতে সুবিধে হবে!

সারোগেসির দুটি রূপ রয়েছে: ‘ট্রাডিশনাল’ বা প্রথাগত এবং ‘জেস্টেশনাল’ বা গর্ভকালীন। ট্রাডিশনাল সারোগেসিতে গর্ভধারণের জন্য সারোগেট মায়ের নিজের ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়। সাধারণত, আইইউআই-এর মাধ্যমে ইচ্ছুক পিতার শুক্রাণু দিয়ে সরাসরি জরায়ুতেই সারোগেট মায়ের ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে তা গর্ভধারণে ব্যবহৃত হয়। ইচ্ছুক পিতার শুক্রাণু যদি ঠিকঠাক কাজ করে তাহলে অতি উত্তম, অন্যথায় অন্য দাতার শুক্রাণু দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা হয়। সারোগেট মাই এখানে সন্তানের জৈবিক (জেনেটিক) মা এবং তাঁর নামটি ইচ্ছুক পিতার নামের সঙ্গে আসল জন্ম শংসাপত্রে উপস্থিত হবে। জন্ম শংসাপত্রে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য ইচ্ছুক মাকে একটি ‘সৎ পিতামাতা’র (স্টেপ পেরেন্ট) দত্তক নিতে হতে পারে।

গর্ভকালীন সারোগেসিতে মায়ের ডিম্বাণুকে বাবার শুক্রাণু দিয়ে আইভিএফ-এর মাধ্যমে নিষিক্ত করে, তারপরে তা সারোগেট মায়ের জরায়ুর মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে ডিম্বাণুপ্রদানকারী মাই সন্তানের জৈবিক মা। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় সারোগেসির পদ্ধতি। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সঙ্গেই সন্তানের জিনগত মিল থাকে।

এটা অনস্বীকার্য যে গর্ভধারণ এবং গর্ভাবস্থা একজন মহিলার জন্য নানা ধরনের মানসিক চাপ এবং স্বাস্থ্যের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। তাই সারোগেট মায়ের পরিষেবার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে অর্থপ্রদানের ভিত্তিতেও সারোগেসির দুটি প্রকার হতে পারে। ‘অলট্রুয়িস্টিক’ বা পরার্থপর সারোগেসি যেখানে কোনওরকম ক্ষতিপূরণ না পেয়ে, কেবলমাত্র অন্যকে সাহায্য করার জন্যই, একজন মহিলা স্বেচ্ছায়, নিজের গর্ভে অন্যের সন্তান ধারণ করেন। অন্যদিকে ‘কমার্শিয়াল’ বা বাণিজ্যিক সারোগেসিতে একজন মহিলাকে তার চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য ক্ষতিপূরণের বাইরেও তার সময়, শক্তি ও ত্যাগের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

ঐতিহ্যগত ধ্যানধারণা অনুযায়ী মনুষ্যসমাজ মূলত দুটি লিঙ্গে বিভক্ত: পুরুষ এবং মহিলা, এই শ্রেণিবিভাগকে আমরা বলি লিঙ্গ বাইনারি। নারী, পুরুষের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট ভূমিকা এবং আচরণ বেঁধে দিয়েছে আমাদের সমাজ। দিনে দিনে মনুষ্য-সমাজের অনেক বিবর্তন হয়েছে, আজকের সমাজে, মানুষের যৌন ভূমিকা ও লিঙ্গ ধারণার অনেক জটিলতা লক্ষিত হয়। জন্মের সময় একজন মানুষের যে লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়েছিল তার সঙ্গেই যদি তিনি নিজেকে সনাক্ত করেন, তবে তিনি হলেন গিয়ে ‘সিস-জেন্ডার’। অন্যদিকে যে সকল মানুষের লিঙ্গপরিচয় তাঁদের জন্মগত লিঙ্গ থেকে আলাদা, তাঁরা হলেন ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা রূপান্তরকামী, চলতি কথায় যাঁদের নাম ‘হিজড়া’। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ট্রান্সজেন্ডাররাও কিন্তু নিজেদের হয় পুরুষ (ট্রান্স পুরুষ), নয় মহিলা (ট্রান্স মহিলা) বলেই সনাক্ত করেন, তাই এঁদেরকে অনেক সময় ‘বাইনারি ট্রান্স’ বলা হয়। কিন্তু এমন অনেক লোক আছেন যাঁরা নিজেদের বাহ্যিক শরীর-গঠন, লিঙ্গ পরিচয় এবং লিঙ্গ অভিব্যক্তিকে বাঁধাধরা লিঙ্গ-বাইনারির সঙ্গে মেলাতে পারেন না। এককথায় ‘নন-বাইনারি’ আখ্যা দিলেও এঁদের কিন্তু অনেক রকমফের আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তাঁদের মধ্যে পুরুষ এবং মহিলা দুইয়েরই লিঙ্গভিত্তিক মিশ্র গুণাগুণ রয়েছে, সুতরাং তাঁরা মধ্যবর্তী; কেউ আবার পুরুষ বা মহিলা এই দুয়ের থেকেই আলাদা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেন; কিছু লোক কোনওরকম লিঙ্গের সঙ্গেই নিজেদের সনাক্ত করেন না; কেউ কেউ আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গ পরিবর্তন করেন। ‘সিস-জেন্ডার’ নন, এমন সকলকে, একই ছাতার তলায় আনার জন্য, অনেক সময় এক ব্যাপ্তিময় পরিভাষা ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তা হলো ‘জেন্ডার কুইয়ার’।

এখানে বলে রাখা ভাল যে, লিঙ্গ পরিচয় আর যৌন বা রোমান্টিক অভিযোজন কিন্তু এক জিনিস নয়। একজন ব্যক্তি কীভাবে নিজেকে সনাক্ত করেন সেটা হল তাঁর লিঙ্গ এবং তিনি যে লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, তা নির্দেশ করে তাঁর যৌন অভিযোজন। মানুষের যৌনাকর্ষণ বিপরীত লিঙ্গ, সমলিঙ্গ, অথবা উভয়লিঙ্গের প্রতি হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী অধিকাংশ মানুষকে তিন শ্রেণিতে যথাক্রমে ভাগ করা যায়: বিষমকামী (স্ট্রেইট), সমকামী (গে) ও উভকামী (বাইসেক্সুয়াল)।

একটু আগেই স্ট্রেইট কাপল বা বিষমকামী দম্পতিদের জন্য সারোগেসির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথাবার্তাই  হয়ে থাকে, আমরা সকলেই সে সম্পর্কে কমবেশি অবহিতও বটে। একক পুরুষ, একক মহিলা, সমকামী দম্পতি (লেসবিয়ান বা গে কাপল), ট্রান্স পুরুষ ও ট্রান্স মহিলা এবং নন-বাইনারি মানুষদের জন্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রজননের পন্থা হিসাবে সারোগেসি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটাই আমাদের আজকের নিবন্ধে প্রতিভাত হবে। এটা বলা বাহুল্য যে, ট্রান্সজেন্ডার এবং নন-বাইনারি মানুষেরা, যারা গর্ভবতী হতে চান বা ইতোমধ্যেই গর্ভবতী, তারা সামাজিক, চিকিৎসাগত, আইনি এবং মানসিক— এই সবকটি ক্ষেত্রেই গভীর উদ্বেগের সম্মুখীন হন। সারোগেসি কীভাবে তাঁদের পরিবার গঠনের উপায় হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে কী কী শারীরিক ও চিকিৎসাগত সমস্যা তাঁদের সামনে উপস্থিত হতে পারে সেগুলো নিয়েই আমরা নাড়াচাড়া করব।

প্রথমে বলি সমকামী সারোগেসি নিয়ে: লেসবিয়ান কাপলের একজন হয়ত নিজের ডিম্বাণু প্রদান করলেন, স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করলেন, তারপর আইভিএফ-এর মাধ্যমে ভ্রূণ তৈরি করে গর্ভকালীন সারোগেসির সাহায্য নিলেন; অনুরূপভাবে, গে কাপলের একজন নিজের স্পার্ম দিলেন, আর এগ ব্যাঙ্ক থেকে ওভাম জোগাড় করলেন, তারপর সারোগেট মায়ের গর্ভে নিজেদের সন্তান বড় করলেন।

ট্রান্সজেন্ডার সারোগেসি সম্বন্ধে কিছু বলার আগে প্রথমে আসুন, কিছু পরিভাষার সংজ্ঞা জেনে নেওয়া যাক! রূপান্তরিত পুরুষ বা ট্রান্স পুরুষ হলেন এমন একজন মানুষ যিনি জন্মের সময় মহিলা হিসাবে সনাক্ত হলেও নিজেকে একজন পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেন (ফিমেল টু মেল, সংক্ষেপে এফটিএম) এবং সেইরকম জীবনযাপন করেন। ট্রান্স পুরুষদের জন্মের সময় থেকেই জরায়ু বা গর্ভাশয় থাকে, পরবর্তীতে এঁদের কেউ কেউ সেটা অক্ষতই রেখে দেন, আবার অন্যরা  হিস্টেরেক্টমি অস্ত্রোপচার-এর মাধ্যমে জরায়ুর অপসারণ করে ফেলেন। এখানে একটা কথা প্রাসঙ্গিক যে, হিস্টেরেক্টমি সম্পূর্ণ বা আংশিক হতে পারে। সম্পূর্ণ হিস্টেরেক্টমিতে জরায়ু-মুখ (সার্ভিক্স) এবং জরায়ুর মূল উপরের অংশ দুটোই সম্পূর্ণরূপে সরানো হয়; আংশিক হিস্টেরেক্টমিতে জরায়ু-মুখ অক্ষত রেখে বাকিটার অপসারণ করা হয়। আংশিক হিস্টেরেক্টমিতে শরীরের হরমোনাল সামঞ্জস্য আগের মতোই থাকে, সম্পূর্ণতে কিন্তু তা পাল্টে যায়। যেসব ট্রান্স পুরুষরা হিস্টেরেক্টমির আগে তাঁদের ডিম্বাণু হিমায়িত করে সংরক্ষণে রেখে দেন, তাদের জন্য গর্ভকালীন সারোগেসি একটি ভাল বিকল্প। ডিম্বাণু বা ভ্রূণ দানও অবশ্য পাওয়া যায়। হিস্টেরেক্টমি করা হয়নি, এমন ট্রান্স পুরুষরা অবশ্য নিজেরাই সারোগেট হিসাবে গর্ভধারণের কথা বিবেচনা করতে পারেন, যেমন করেছিলেন আইনসিদ্ধ ট্রান্স পুরুষ টমাস বিটি। ২০০৮ সালে, টমাস অরেগনের এক হাসপাতালে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। পূর্বের হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি চিকিত্সা-নির্বিশেষে, এফটিএমদের গর্ভাবস্থার অগ্রগতি এবং প্রসবের পদ্ধতি সাধারণত ‘সিস-জেন্ডার’ মহিলাদের মতোই হয়। অনেক ট্রান্স পুরুষ অবশ্য এভাবে গর্ভধারণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন, যেহেতু তাঁরা মনে করেন নারী পরিচয়ের সঙ্গে গর্ভাবস্থার একটা যোগ আছে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে সন্তানলাভের জন্য, অবশ্যই অন্য একজন সারোগেট খুঁজে বের করতে হবে।

অনুরূপে একজন রূপান্তরিত নারী বা ট্রান্স নারীকে জন্মের সময় পুরুষ হিসেবে গণ্য করা হলেও তিনি নিজেকে একজন নারী হিসেবে চিহ্নিত করেন (মেল-টু-ফিমেল বা সংক্ষেপে এমটিএফ)। জন্মের সময়ে এঁদের কোনও জরায়ু থাকে না। বুঝতেই পারছেন, এঁদের সন্তানধারণের প্রসঙ্গ উঠলেই যে প্রশ্নটি সবার আগে মনে আসে, তা হল জরায়ু না থাকলে নিষিক্ত ভ্রূণ বেড়ে উঠবে কোথায়? সুতরাং, ‘এই মুহূর্তে’ সারোগেসিই তাঁদের সন্তান লাভের বড় এক উপায়। ‘এই মুহূর্তে’ কথাটা বললাম, তার পিছনে কিন্তু একটা সুপ্ত কারণ আছে। ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলা যাক! সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ক্লিনিক্যাল সায়েন্সেসের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান বিজ্ঞানপ্রবর ডক্টর ম্যাটস ব্রানস্ট্রম-এর তত্ত্বাবধানে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, বিশ্বের প্রথম জরায়ু প্রতিস্থাপিত ‘সিস-জেন্ডার’ মহিলার গর্ভে একটি সুস্থ এবং স্বাভাবিক শিশুর জন্ম হয়েছে। ব্রানস্ট্রমের এই অভাবনীয় সাফল্য শুধু ‘সিস-জেন্ডার’ নারীদের নয়, দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছে ট্রান্স নারীদেরও মধ্যে, আশায় আশায় বুক বাঁধছেন তাঁরা: হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তাঁরাও নিজেদের সন্তান ধারণ করতে সক্ষম হবেন! ভাবছেন এ শুধু বিজ্ঞানের কল্পকাহিনিতেই সম্ভব, যত্ত সব আকাশ-কুসুম রচনা! দাঁড়ান, দাঁড়ান, অত তাড়াতাড়ি উপসংহারে আসবেন না! গবেষকরা কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই, এই তো সেদিন, ২০১৯ সালে, ওহাইও-র ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক একজন মৃত দাতার কাছ থেকে প্রতিস্থাপিত জরায়ু ব্যবহার করে উত্তর আমেরিকায় প্রথম শিশুর জন্ম দিল— প্রজনন জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরেক যুগান্তকারী সাফল্য! সুতরাং সুধীবৃন্দ, কে বলতে পারে, খুব তাড়াতাড়িই ট্রান্স নারীদের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবে না!

হ্যাঁ, পুরো ব্যাপারটাতে একটা ‘কিন্তু’ অবশ্যই রয়েছে, সেটা অতিক্রম করাটা যে সে ব্যাপার নয়। দেখুন, ট্রান্স মানুষেরা অনেকেই জেন্ডার কনফার্মেশন সার্জারি বা লিঙ্গ নিশ্চিতকরণ অস্ত্রোপচারের দিকে ঝোঁকেন, কারণ এই পদ্ধতি তাঁদের স্ব-পরিচিত লিঙ্গে স্থানান্তর করতে সহায়তা করে। দেখা গেছে যে, এই সার্জারির পর মানসিকভাবে তাঁরা অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তাঁদের জীবনযাত্রার মানেরও অনেক উন্নতি হয়। এই পদ্ধতির মধ্যে মুখ, বুক বা যৌনাঙ্গের অস্ত্রপ্রচার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ট্রান্স নারীদের ক্ষেত্রে জরায়ুর প্রতিস্থাপন চাট্টিখানি কথা নয়— এই অস্ত্রোপচার শুধু যে অত্যন্ত জটিল এবং প্রচুর খরচ-সাপেক্ষ তাই নয়, কয়েক ডজন স্বাস্থ্যকর্মীর সতর্ক কর্ম সমন্বয়ের মাধ্যমেই কেবল এটা সম্পন্ন হওয়া সম্ভব। যদি অস্ত্রোপচার ঠিকঠাকও হয়, তবু, হরমোনের কাজকর্মের সাফল্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কে বলতে পারে গর্ভের শিশুর উপর তা কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে না; এ ব্যাপারে সার্জন এবং এন্ডোক্রিনোলজিস্টরাও হলফ করে কিছু বলতে অসক্ষম। ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োএথিক্সের অধ্যাপক উইলকিনসন-এর উক্তির সঙ্গে আমরা একমত— “এই পদ্ধতিটি যে নিরাপদ এবং কার্যকর তা নিশ্চিত করার জন্য, কম্পিউটার, প্রাণী এবং ক্যাডেভারিক মডেলগুলিতে প্রচুর গবেষণা করা দরকার।” একটি প্রতিস্থাপিত জরায়ু একজন ট্রান্স মহিলাকে স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করতে সাহায্য করে না, কারণ গর্ভাশয়ের সঙ্গে ফ্যালোপিয়ান টিউবের কোনও সংযোগ থাকে না। সুতরাং, তত্ত্বগতভাবে তিনি আইভিএফ-এর মাধ্যমে গর্ভবতী হতেই পারেন, কিন্তু বাস্তবে তা সুকঠিন। বিশ্বের প্রথম নথিভুক্ত লিঙ্গ রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারিটি করা হয় ডেনিশ চিত্রশিল্পী লিলি এলবে-র উপর। এলবেকে জন্মের সময় পুরুষ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে লিঙ্গ ডিসফোরিয়ার কারণে নিজেকে তিনি একজন ট্রান্স মহিলা বলে সনাক্ত করেন। ১৯৩১ সালে তাঁর শরীরে জরায়ু প্রতিস্থাপন করা হয়, কিন্তু তিন মাস পরেই অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের জটিলতার কারণে তিনি মারা যান। আপনাদের নিশ্চয়ই এখন অস্কার বিজয়ী সেই চলচ্চিত্রটির কথা মনে পড়ছে— “দ্য ডেনিশ গার্ল”। হ্যাঁ, এই ছবিটি এলবের জীবন নিয়েই তৈরি; এলবে চরিত্রে সেখানে অভিনয় করেছিলেন এডি রেডমাইন।

লিলি এলবে

যাইহোক, এবার আসি নন-বাইনারি মানুষদের প্রসঙ্গে: এঁরা  কিন্তু নানা ধরনের যৌন অভিমুখিতা প্রদর্শন করে থাকতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী তাঁরা প্রথাগত বা গর্ভকালীন সারোগেসি বেছে নিতে পারেন। এখানে একটা সমস্যার সম্ভাবনা আছে, পরিবার গঠনে ইচ্ছুক নন-বাইনারি দম্পতির মধ্যে যিনি স্ত্রী, তিনি ফলিকুলার স্টিমুলেশনে ঠিকমতো সাড়া নাও দিতে পারেন; এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ডিম্বাণু সংগৃহীত হয় এবং সেটা আইভিএফ-এর সফলতাকে প্রতিকূল অবস্থার মুখে ঠেলে দিতে পারে। মূলত মহিলাটির বয়স বেশি হলে এই সমস্যা এড়ানো কঠিন। এসব ক্ষেত্রে ডিম্বাণু বা ভ্রূণ অন্য দাতার কাছ থেকে নিয়ে সারোগেসিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি অবশ্য বয়স্ক মহিলামাত্রেরই মাথাব্যথার কারণ— সে তিনি যে লিঙ্গেরই হোন না কেন, বা যে যৌন অভিমুখিতাই প্রদর্শন করে থাকুন না কেন।

আমাদের চারপাশে অনেক ট্রান্স-জেন্ডার ও নন-বাইনারি মানুষ আছেন যাঁদের বাহ্যিক শরীর-গঠন, লিঙ্গ পরিচয় এবং লিঙ্গ অভিব্যক্তি বাঁধাধরা লিঙ্গ-বাইনারির সঙ্গে মেলে না। তাঁদের জন্মকালীন লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে সমাজ যদি আশা করে যে, তাঁরা সেই লিঙ্গ ভূমিকাতেই মাপসই হবেন, তা কিন্তু হওয়ার নয়। সেই কারণে অনেক সময়েই সমাজ তাঁদের ব্রাত্য করে রেখে দেয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি মানুষেরা তাঁদের প্রজনন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, উর্বরতা সংরক্ষণ, এবং পরিবার তৈরির ব্যাপারে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হন। পরিবার গঠনের সময় তাঁরা যখন সারোগেসি বা দত্তক ব্যবস্থার দ্বারস্থ হন, তখন সমাজে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়। কিন্তু কেন এমনটি হবে? এই সমাজটা তো সকলের। প্রত্যেক মানুষের— সে ‘সিস-জেন্ডার’ বা ‘ট্রান্স-জেন্ডার’ বা নন-বাইনারি যাই হোন না কেন, প্রজনন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা সকলের থাকা উচিত এবং লিঙ্গ সম্পর্কিত স্টিরিওটাইপ কলঙ্ক বিশেষ করে, যা একজন মানুষের প্রজনন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ সাধে সেই সবের, মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্রের আইনকে সদা জাগ্রত থাকতে হবে।

এই বিশ্বায়নের যুগে, সকলের জন্য আরও প্রজনন অধিকারের উপায় হিসাবে, সারোগেসি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে কথাবার্তা হওয়া খুব প্রয়োজনীয়। যদিও প্রতিটি জায়গার সংস্কৃতি, জীবন-যাপনের ঢং, লোকেদের মূল্যবোধ, সমাজব্যবস্থা, শোষণের সংজ্ঞা এবং অধিকারের মাত্রা অনেকটাই আলাদা, তবু, সারোগেসি ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ঐকমত্য অনুসরণ করা এবং একটি সর্বজনগ্রাহ্য আইনি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কার্যকর হলেই সারোগেসিকে ঘিরে বেড়ে ওঠা নানা প্রকারের শোষণ, এবং দুর্বলের অধিকার লঙ্ঘনের কলঙ্ক ও লজ্জা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। আমাদের সকলেরই লক্ষ রাখা উচিত যে সারোগেসি-আইন, প্রবিধান এবং নীতি— এ সবই যেন ‘সারোগেসি ত্রয়ী’ মানে সারোগেট, অভিপ্রেত পিতামাতা এবং শিশুদের সুরক্ষার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে।

 

তথ্যঋণ:

  1. Goldberg, A. E. and Gartrell, N. K. LGB-Parent Families: The Current State of the Research and Directions for the Future. Advances in Child Development and Behavior. 2014 May, 46:57-88.
  2. Maron, D. F. How a Transgender Woman Could Get Pregnant. Scientific American. 2016. June 15.
  3. Duncan, F. E. et al, Fertility Preservation. Yen and Jaffe’s Reproductive Endocrinology (7th Edition), 2019. pp.791-821.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...