পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবাঞ্ছিত মৃত্যু, নির্বাচনের ফলাফল এবং আরও কথা

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 


পঞ্চায়েতের মধুভাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রতিবার নির্বাচনের সময় এরই পৌনঃপুনিক পুনরাবৃত্তি আমরা বারংবার দেখব। যদি একটি শক্তিশালী নাগরিক তথা তৃতীয় পরিসর গড়ে তুলতে পারি তাহলে হয়তো এরকম ঘটনাকে অনেকাংশে প্রতিহত করা যাবে

 

লিও তলস্তয়ের ১৮৮৬ সালে লেখা “How Much Land Does a Man Need?” (একজন মানুষের কতটা জমি প্রয়োজন?) আন্তর্জাতিকভাবে (এবং বাংলাতেও) বহুল পঠিত, আলোচিত এবং প্রায় ১৫০ বছর ধরে মানুষকে ভাবিয়েছে। আমাদের বর্তমান অবস্থার থেকে বিপুলভাবে পৃথক জারের শ্রেণিবৈষম্যে জর্জরিত গ্রামীণ রাশিয়ায় পাহোম (Pahóm) তার কেনা বিশাল জমির চারপাশ ঘুরে দেখতে দেখতে একসময় জমির ধারেই জীবনীশক্তি হারিয়ে মৃত্যুতে ঢলে পড়ে। “His servant picked up the spade and dug a grave long enough for Pahóm to lie in, and buried him in it. Six feet from his head to his heels was all he needed”— ওর ভৃত্য কোদাল তুলে নেয় এবং পাহোমের শুয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট একটি কবর খোঁড়ে এবং পাহোমকে কবর দেয়। তার মাথা থেকে গোড়ালি অব্দি ৬ ফুট কবরের জমি, এতটুকুই জমিই তার প্রয়োজন ছিল।

পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের উৎসব বা বহ্ন্যুৎসবে প্রায় জনা পঞ্চাশেক মানুষের অবান্তর মৃত্যু হল, তারা তো কেউই নিজের জমির পরিমাণ ঘুরে দেখতে গিয়ে মারা যায়নি। কিন্তু ৬ ফুট জমি বা কয়েক মণ কাঠই এদের জন্য শেষ অব্দি বরাদ্দ হয়েছে। অপরাধ? হয়তো কোনও না কোনও দল করত, কিংবা কিছুই করত না। কেবলমাত্র ভোটের সময় একটি ভোটের মালিক। সর্বোপরি হয়তো আছে আমাদের জীবনের বীজমন্ত্র—

আমরা তো অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।

আমরা তো এতেই খুশি; বলো আর অধিক কে চায়?
হেসে খেলে, কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায়।

নিচের দুটি পরিসংখ্যান এবারের নির্বাচনের সামগ্রিক চিত্র বুঝতে কিছুটা সাহায্য করবে। এর মাঝে অন্তর্লীন আরও অনেক স্তর আছে, “আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি, মাস্টারমশাই” আছে, গোপন অস্ত্রের মজুত ভাণ্ডার আছে, রাজনীতি-প্রশাসন-নির্বাচন কমিশনের মধ্যেকার বিভিন্ন দেখা-অদেখা রসায়নও আছে।

সহজ কথা হল, ২০১৮-তে প্রধান শক্তি এবং শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের যেরকম আধিপত্য ছিল, ২০২৩-এর নির্বাচনেও খাতায়কলমে, সরকারি পরিসংখ্যানে তা বেড়েছে বৈ কমেনি। বিজেপি, বামশক্তি এবং কংগ্রেসের ভোটের প্রাপ্ত শতকরা হারে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। বিজেপি-র ভোট শতাংশ কমেছে, প্রায় সম পরিমাণ ভোট শতাংশ বেড়েছে বামশক্তির। কিন্তু এতে বিজেপি-র ‘বঙ্গ বিজয়’-এর ঢক্কা-নিনাদ কিছুটা স্তিমিত হলেও, শেষ অবধি বাম শক্তি বা কংগ্রেসের কতটা লাভ হবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত নই। তবে একটা সম্ভাবনা থাকছে বৃহত্তর ভাল ফলের— অন্তত ভোটবাক্সের নিরিখে।

আরেকটু ভেঙে বললে— ২০টি জেলা পরিষদের সবকটিতে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস, ৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতির ৩১৭টিতে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস এবং ৩,৩১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২,৬৬৪টিতে জয়ী তৃণমূল। ৬১,৬৩৬টি বুথের ৬৯৭টিতে পুনর্নিবাচন হয়েছে— ভোটে কারচুপি, সন্ত্রাস এবং অরাজকতার জন্য।

 

সবই কি আমাদের অগোচরে ছিল?

নিজেদেরকে আমরা প্রশ্ন করতে পারি— এরকম হিংস্রতা, রক্তপাত, অবান্তর মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তির ধ্বংস আমাদের কাছে খুব অজানা বা অপ্রত্যাশিত ছিল কি? নির্বাচনে হিংসা এবং হিংস্রতার যে ছবি আমরা সমস্ত ধরনের মিডিয়ায় যখনতখন দেখে থাকি তারপরেও আমাদের স্নায়ু বা চিন্তার ওপরে আরও আরও হিংসার ছবি আদৌ কোনও ছাপ ফেলে কি? আমরা তো সইয়ে নিয়েছি, সইয়ে নিতে শিখেছি। সইয়ে/মানিয়ে নেওয়ার কৃৎকৌশলও আমরা সযত্নে শিখে ফেলেছি। আমাদের স্নায়ুতন্ত্র, মনন, অনুভূতি বা, একটু বাড়িয়ে বললে, আমাদের সুকুমার প্রবৃত্তি এগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। Numbing of our collective consciousness— আমাদের সামূহিক চেতনার বিবশতা। কিন্তু এগুলো তো একদিনে হয়নি। ধাপে ধাপে, প্রতি মুহূর্তে সমস্ত রকমের মিডিয়ার অপার মহিমায়, ছাপার অক্ষরে এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় (যদি কখনও কিছু হয়ে থাকে) আমরা একটি অসংবেদনশীল পিণ্ডে পরিণত হচ্ছি? যদি সমাজতত্ত্ব এবং আমাদের পারিবারিক জীবনের প্রেক্ষিতে দেখি তাহলে সবচেয়ে ক্ষতিকারক যে ফলাফল জন্ম নিচ্ছে তার চরিত্র হল শিশু থেকে কিশোর এবং সদ্য যৌবনে পা-রাখা (বাংলা শুধু নয়, সমগ্র ভারত জুড়েই) প্রজন্ম একে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিচ্ছে। এমনকি হিংস্রতার মাঝে আমোদও পাচ্ছে।

তর্কযোগ্যভাবে, ভারত ভূখণ্ডের ‘imagined communities’ ঢোঁড়াই চরিত মানস-এর ‘মহাৎমাজীর’ মাকড়সার জালের মতো পলকা সুতোর জাল বাঁধা হয় তিনটি প্রধান শক্তির উপরে ভর করে— (১) হিন্দি সিনেমা (একেবারে হালে আমরা ‘পাঠান’ বা ‘আদিপুরুষ’-এর মতো ফিল্মের পৌরুষ তো জমিয়ে উপভোগ করেছি), (২) ক্রিকেট, এবং (৩) হিন্দি ভাষা।

প্রসঙ্গত মনে পড়ে, ইরাক যুদ্ধের সময়ে (২০০৩) আমরা বিভিন্ন মিসাইলের যে জ্বলজ্বলে চিত্র দেখেছিলাম সেগুলোকে ডোনা হারাওয়ে আমাদের ‘spectacle of violence’-কে সইয়ে নেওয়ার একটি উদাহরণ হিসেবে দেখেছিলেন। আরেকটি উদাহরণ, সাদ্দাম হুসেইনের ফাঁসিকে (২০০৪) প্রিন্স চার্লসের অভিষেকের মতো করে দীর্ঘ সময় ধরে টিভিতে দেখানো হয়েছিল। এবং আমরা দেদার উপভোগ করেছিলাম। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ফাঁসির ভিডিওশুদ্ধ প্রতিবেদন ছিল।[1]

নির্বাচনের আগে রাজ্য পুলিশ নাকি কেন্দ্রীয় বাহিনি এ বিতর্ক গড়িয়েছে হাইকোর্ট অব্দি। পরবর্তী বিতর্ক ছিল নির্বাচন কমিশনের (রাজ্য) ভূমিকা নিয়ে। সঙ্গে জুড়েছিল একদিকে রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকার, অন্যদিকে রাজ্যপাল বনাম রাজ্য নির্বাচনী কমিশনার। এছাড়া শাসক দল এবং বিরোধী পক্ষ নিয়ে বিতর্কের ওপরে বিতর্ক, তার ওপরে আরও বিতর্ক তো দিনের পর দিন আমাদের “ঘন্টাখানেক” উদ্ব্যস্ত করে রেখেছিল। আমরা মনে মনে গালি দিয়েছি হয়তো, আবার তেমনি শিশুদের কার্টুন দেখার মতো এসব বিতর্ক ক্রমাগত গিলেছিও তো! সহজ কথা হল, আমরা জানতাম— পঞ্চায়েত নির্বাচন মানে একটি প্রাণঘাতী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে— অস্ত্রসজ্জায়, টাকার থলিতে, রণকৌশল তৈরিতে, প্রতিটি পঞ্চায়েত এবং বুথের জন্য উপযুক্ত ‘সেনা’ নির্বাচনে। আমাদের নীরব মৌনতা একে সমর্থন জুগিয়েছে। আমাদের সম্মিলিত কোনও প্রশ্ন ছিল না— এত রক্ত কেন? প্রশ্ন ছিল না— এত হিংসা কেন? এত অস্ত্র কেন? এত টাকা কেন? এত রক্তপাতের প্রস্তুতি কেন?

১৯৪৭-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে ভারত রাষ্ট্রের একটি ফেডারেল কাঠামো জন্ম নিল, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হল। কিন্তু একেবারে গ্রাম স্তর পর্যন্ত এ বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেনি। ১৯৪১ সালে লেখা ঢোঁড়াই চরিত মানস-এও ঔপনিবেশিক দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের টুকরো বর্ণনা আছে, রয়েছে পঞ্চায়েতেরও— “গাঁয়ে আছে কেবল ‘পঞ্চায়তি’ আর ‘পঞ্চায়তি’ আর ‘পঞ্চায়তি’।” ঢোঁড়াই-এ “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’”-এর ভেতরের ছবিও রয়েছে—

মাগনা কচ্চুরি পাও খেয়ে নিও
মাগনা গাড়ি পাও চড়ে নিও
পয়সা পাও বটু্য়াতে ভরে নিও
কিন্তু মন্দিরে গিয়ে বদলে যেও ভাই হামারা
‘সাদা বাক্স’ মহাৎমাজীর সাদা বাক্স!

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ১৯৩৪-এ যা ছিল মানবক, ২০২৩-এ সেটাই আলাদিনের দৈত্য। গান্ধির রাজনৈতিক চিন্তার অনেক সমস্যা থাকলেও যে বিষয়টিকে তিনি কংগ্রেস সহ সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের সামনে এনেছিলেন তা হল “গ্রাম স্বরাজ্য”-র ধারণা। রবীন্দ্রনাথের বিস্তৃত ভুবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে ছিল গ্রামসভা এবং গ্রামের মানুষ। এদের স্থানিকভাবে উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ কথা আমার মতো পল্লবগ্রাহিতা নিয়েও যাঁরা রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন, তাঁরাও খবর রাখেন আশা করি।

যাহোক, সংবিধানের ৩৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী একটি রাজ্যের উন্নয়নের ক্ষমতা রাজ্যের হাতে দেওয়া হল। ৪০ নম্বর ধারায় স্পষ্টতই উল্লেখ করা হল— “the State shall take steps to organise village panchayats and endow them with such powers and authority as may be necessary to enable them to function as units of self-government.” কিন্তু নতুন ভারত গড়ে তোলার জন্য যখন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেওয়া শুরু হল তখন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল আমলাদের হাতে। জনগণের অংশগ্রহণ ‘ঐ যে সুদূর নীহারিকা’ হয়ে রইল।

১৯৭৭ পর্যন্ত পঞ্চায়েতের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতো স্থানীয় ভূস্বামী, অর্থবান মানুষ এবং মূলত এদের প্রভাবে চলা বিডিও সহ স্থানীয় সরকারি আমলাতন্ত্র। সেখানে টাকা, পেশিশক্তি, উৎকোচ এবং ক্ষমতার খেলা চলত।

মূলত তেভাগা আন্দোলন এবং বিহারে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিসংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বামপন্থীদের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল গ্রামের একেবারে প্রান্তিক কৃষকের মাঝেও। ১৯৭৭ সালে আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী অবিস্মরণীয় গণ আন্দোলনের ঢেউয়ের চুড়োয় অদম্য শক্তিতে (আমি সাংগঠনিক শক্তিকেও সম গুরুত্ব দিচ্ছি) যেদিন বামফ্রন্ট সরকার বাংলার ক্ষমতায় এল, সেসময় বামফ্রন্টের তরফে দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গণ-ঘোষণা করা হয়েছিল— (১) রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি, এবং (২) পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার সংস্কার করে ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের পাট্টা দেওয়া এবং ‘অপারেশন বর্গা’। এর ফলে গ্রামীণ পঞ্চায়েতগুলো জোতদার, জমিদার, ভূস্বামী, অর্থবান মানুষ এবং আমলাদের বেষ্টনি থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন, নিজেদের মত অবাধে প্রকাশ এবং ক্ষমতাকে ব্যবহার করার মাধ্যম হিসেবে মুখের ভাষা, বুকের আশা, অস্তিত্বের শক্তি খুঁজে পেল। গ্রামীণ জীবনে এবং জীবনচর্যায় অনেকখানি গণতান্ত্রিকীকরণ ঘটে গেল।

এই পঞ্চায়েত সংস্কার ও নিয়মিত নির্বাচন ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটিকে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করে তোলে। এর ফলে ব্যাপক হারে জনসাধারণ সরকারি কাজে অংশগ্রহণের সুবিধা অর্জন করে। ফলে তাদের মধ্যে উৎসাহ ও সাহস অনেক বৃদ্ধি পায়। অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়ের দ্য পঞ্চায়ত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল গ্রন্থে মন্তব্য করা হয়েছে— “সাধারণ গ্রামবাসীরা আর সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে দাক্ষিণ্য প্রার্থনা করতে যান না, বরং যান যা তাঁদের প্রাপ্য তার দাবি নিয়ে। নয়া গণতন্ত্রে মানুষের রাজনৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি কম গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব নয়।”[2]

কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের রাজত্বে পরের দিকে পঞ্চায়েতগুলো পার্টিব্যবস্থা শক্তিশালী করার ছোট ছোট ক্ষমতাকেন্দ্র হয়ে ওঠে। আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ— পঞ্চায়েতে কেন্দ্র এবং রাজ্যের তরফে অসংখ্য উন্নয়নমূলক খাতে এত টাকা আসে যে পঞ্চায়েত আসলে কৌশলী মানুষদের কাছে হয়ে ওঠে একটি মধুভাণ্ড। যে কারণে আমরা ২০১১-র পরে তো দেখেইছি, ১৯৮৭-পরবর্তী সময়েও দরিদ্র অভাগা গ্রামের মাঝে বিসদৃশ, বিশাল, বেখাপ্পা বড়িগুলো হয় চাক্ষুষ করেছি, কিংবা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি। এই মধুভাণ্ডের ভাগ পাওয়ার জন্য শক্তিশালী সবকটি রাজনৈতিক দলই তাদের ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’-এর ঘুঁটি সাজায়। পঞ্চায়েতের দখল নিতে চায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে এত হিংসা, সংঘর্ষ, অস্ত্রের ব্যবহার এবং রক্তপাতের চালিকাশক্তি হল একেবারে তৃণমূল স্তরে ক্ষমতা এবং অর্থের ওপরে নিরঙ্কুশ আধিপত্য রক্ষা করা। এর সঙ্গে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি তো রয়েইছে।

এখানে একটি কথা আমাদের নজরে রাখতে পারি। আমাদের মস্তিষ্কে নিউরোনের পাশাপাশি রয়েছে গ্লায়াল কোষ। নিউরোনের কাজ প্রধানত তাৎক্ষণিক আবেগ, ক্রোধ ইত্যাদির জন্ম দেয়। গ্লায়াল কোষ গভীরে গিয়ে ভাবা, সৃজনশীল কাজ ইত্যাদির উৎস। টিভির ‘সোপ সিরিয়াল’, বিজ্ঞাপনের কুহকী মায়া— সুকুমার বাচ্চা কিংবা সুন্দরী মহিলাদের জন্য হরলিক্সের অসীম প্রয়োজনীয়তা, সাবানে মুখের ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে প্রেমের আকর্ষণের বান ডাকানো, ‘ঘন্টা খানেক’-এর সুগম্ভীর তাৎক্ষণিক আক্রমণের শরীরী ভাষায় আলোচনা ইত্যাদি সবই সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়কেও কাজে লাগায় এই নিউরোনগুলোকে সবল সজীব রাখার জন্য। পণ্যদুনিয়ার বাজার আরও প্রসারিত হয়। কিনতে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়! এরকম অবস্থায় শীতঘুমে চলে যায় গ্লায়াল কোষ, এবং এসবের মাঝে কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে গভীরে ভাবার চেষ্টা।

এই মানুষেরাই সামাজিকভাবে আমাদের সঙ্গে বসবাস করে। এ ধরনের চিন্তাহীন, তাৎক্ষণিকতা-নির্ভর মানুষেরা স্বাভাবিকভাবেই পার্টিরও সম্পদ। আবার বহুলাংশে একই ধরনের মস্তিষ্কগত ক্রিয়াকর্মে আমরাও তো মজে থাকি। এভাবেই শাসকদের তরফে জনসমাজের ওপরে তৈরি হয়ে যায় এক ধরনের মানসিক hegemony— হুবহু গ্রামসির ব্যাখ্যানুযায়ী না হলেও। এ-সময়ে কেন হিংসা হচ্ছে— এ-প্রশ্ন বারংবার করা কার্যত অর্থহীন। কারণ সামাজিকভাবে আমাদের বৌদ্ধিক ও মানসিকতার অস্তিত্ব এরকম চিন্তার পরিসরের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে আছে— যেমনটা ওপরে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছি।

 

আমাদের যাপিত গণতন্ত্রের আরেক দিক

রেবেকা চপ তাঁর দ্য প্রাক্সিস অফ সাফারিং গ্রন্থে লিখছেন—

ইতিহাস কেঁপে কেঁপে ওঠে, অতিবৃহৎ সব ঘটনা দিয়ে বিদ্ধ হয় জনতার যন্ত্রণা, স্মৃতিকে তাড়া করে ফেরে ইতিহাসের বলির পশুদের চুপিসার পদক্ষেপ… বুভুক্ষু মানুষের আর্তনাদ, রাজনৈতিক বন্দিদের সুতীক্ষ্ণ চিৎকার এবং নিপীড়িতের নিঃশব্দ স্বর আমাদের প্রাত্যহিক যাপনে ধীর গতিতে, যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।

যখন কেন্দ্র বা রাজ্যের শাসকের মুখে শুনি বিরোধীশূন্য রাজনীতি হবে তখন সামান্য চিন্তাও যাঁরা করেন, যাঁদের মনন এখনও ফসিল হয়ে যায়নি, তাঁরা শিউড়ে ওঠেন। গণতন্ত্র মানে ঐতিহাসিকভাবে বহু স্বর, বিভিন্নমুখী মত, মতদ্বৈধতা, তীব্র রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-দর্শনগত বিতর্কের প্রাণবন্ত পরিবেশ। এ বিতর্ক জনসমাজে তথা নাগরিক সমাজে হয়ে থাকে। আধুনিকতার একটি জন্মচিহ্ন এই বিতর্কের পরিবেশ। এই বিতর্ক সজীব চেহারা নেবে সংসদে বা গণভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশনে। যদি এই প্রবাহটি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ভাবতে হবে গণতন্ত্র কি সান্তাক্লজের মতো পোশাকের আড়ালে নিজের রূপ বদলে নিচ্ছে? নাকি নতুন করে গণতন্ত্রের অভ্যুদয় প্রয়োজন?

আমেরিকান সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান বহুদিন আগে তাঁর এ প্রিফেস টু পলিটিক্স গ্রন্থে বলেছিলেন— “আমাদের সমস্যা হল এমন এক সময়ে আমরা বাস করছি যখন ভাঁওতা এবং প্রতারণা সংগঠিত এবং শক্তিশালী হয়েছে, যেখানে গোড়া থেকে সত্য বিষাক্ত হয়ে গেছে, এটা সেই সময় যখন ধূর্ততম মস্তিষ্ক নিবেদিত হচ্ছে বিভ্রান্ত জনতাকে ভ্রষ্ট পথে চালানোর কাজে।”[3] বর্তমান সময়ে এ কথাগুলো দৈববাণীর মতো শোনায়।

“এনগ্রাফটেড” (বাইরে থেকে রোপন করা) আধুনিকতার যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সবাই মানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠল নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষ্যণীয় যে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে যে ব্রিটিশ জাত প্রায় ৩৫০ বছর ধরে ধীরে ধীরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে, ভারত সে-সমস্ত ধাপ অতিক্রম করার জন্য পেয়েছে কয়েক দশক মাত্র। ফলে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ দেশগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথমে ব্যক্তির অভ্যুদয়, পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজজীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (সেক্যুলারিজম) যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা ভারতে হয়নি। ইউরোপের দেশগুলোতে যেভাবে দেশগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সামাজিক ও শ্রেণিসম্পর্কের মানুষের একটি পাবলিক ডিসকোর্সের পরিসর তৈরি হয়েছে, যেভাবে চার্চ এবং রাষ্ট্র পৃথক হয়েছে, যেভাবে সমাজজীবন থেকে অপসৃত হয়ে ধর্মানুগত্য ব্যক্তিগত রুচি এবং পরিসরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার আগে ঐতিহাসিকভাবে সেসব প্রক্রিয়া অসমাপ্ত ছিল বা হয়নি বললেই চলে।

শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হল ফেডারালিজম— যেখানে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে গড়ে ওঠা কেন্দ্র সবকিছু নির্ধারণ করে না। বিভিন্ন স্টেট বা রাজ্য তাদের নিজস্বতাকে গুরুত্ব দিয়ে সামরিক ক্ষমতা, পররাষ্ট্রনীতি এবং করব্যবস্থা ছাড়া প্রায় সবকিছুই নিজেদের মতো নির্ধারণ করতে পারে। একটি উদাহরণ হল, আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিভিন্ন স্টেট তাদের নিজস্ব অবস্থান গ্রহণ করেছে। সে দেশের ২৪টি স্টেটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী হলেও ২৩টি স্টেট একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ-সমস্ত হিসেবই ২০২১ সালের মার্চ মাস অবধি।

বিভিন্ন সামন্তরাজ্যে বিভক্ত ভারত নামের ভৌগোলিক ভূখণ্ডে সামন্তরাজা, উদীয়মান বৃহৎ শিল্পপতিশ্রেণি, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ওকালতি ও ডাক্তারির মতো বিভিন্ন স্বাধীন পেশার ব্যক্তিদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগ্রামের বিভিন্ন সফলতা ও ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করেছে ১৯৪৭-পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষ। এ-ধরনের বিভিন্ন সময়-চিহ্নের স্থায়ী ছাপ নিয়ে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হল সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের ক্ষমতাচিহ্ন। এরকম এক ঐতিহাসিকতায় প্রধানত কৃষিসম্পর্কে আবদ্ধ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রে আধুনিকতা প্রকৃত অর্থে “এনগ্রাফটেড” হয়ে যায়। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার যে সম্পর্ক নতুন করে রচিত হয় ১৯৪৭-পরবর্তী ভারতবর্ষে তা প্রায়-সম্পূর্ণ ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংবিধানের ধারায় তৈরি হওয়া।

আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর, কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে— “অশ্রুত” থেকে “শ্রুত” হয়ে ওঠে, “অদৃশ্য” থেকে “দৃশ্যমানতার” স্তরে উঠে আসে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-৭০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্রবিদ্রোহ, আমেরিকায় প্রায় সর্বব্যাপী তীব্র ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিককালের “অন্য এক পৃথিবী সম্ভব” এবং “অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট” বা গ্রেটা থুর্নবার্গের এককভাবে জন্ম দেওয়া পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এরকম একটা পরিসরে বহু ভাষ্যের নির্মাণ হতে থাকে। কিন্তু সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটাই যদি ভিন্নধর্মী হয়? যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় প্রভুত্বকারী সামন্তরাজা ও তার উপযোগী পরিব্যাপ্ত মানসিকতা, কৃষি শ্রম, শিল্পীয় শ্রম, শিক্ষিত জায়মান নাগরিক সমাজ, বৃহৎ পুঁজি এবং জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ পর্বে গড়ে ওঠা ছোট বা স্বাধীন পুঁজির মধ্যেকার অসংখ্য বাস্তব দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে? যদি গড়ে ওঠে জাতিসত্তার প্রশ্নকে সমাধানের আওতায় না এনে (হাতেগরম উদাহরণ মণিপুর)? তাহলে ঐতিহাসিকভাবে, এবং খানিকটা অনিবার্যভাবেই, ঔপনিবেশিক শাসনের মতো একদিকে শক্তিশালী কেন্দ্র, এবং অন্যদিকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রমুখিনতার দিকে রাজনৈতিক স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে। শেষ অবধি যার পরিণতি, একজন শক্তিমান রাষ্ট্রনায়ক যার হাতে আমাদের হয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা তুলে দেওয়া যায়। প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং “কেন” বলে প্রশ্ন করা অপসৃত হতে থাকে সামাজিক মনস্তত্ত্ব থেকে। কতকগুলো ক্ষমতার চিহ্ন মান্যতা লাভ করে।

আমাদের স্মৃতি থেকে কি ক্রমশ বিলীয়মান হবে যে গান্ধিজি বলে একজনের নেতৃত্বে সে-সময়ের আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ ইংরেজের বিরুদ্ধে “ভারত ছাড়ো” আন্দোলন করেছে। এ-স্মৃতিগুলো না থাকলে অন্য আরও অনেক একেবারে হালে নির্মিত ভিন্ন স্মৃতি সে স্থানে প্রবেশ করবে। এবং করছেও সেটা।

বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা এবং ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণের জোরেই হাথরাস বা বিলকিস বানো আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের যাপিত সময়ের জাগ্রত বিবেক শঙ্খ ঘোষ স্মরণ করিয়ে দেন—

আর সব উন্নয়ন পরিত্রাণ ঘূর্ণমান অগণ্য বিপণি দেশ জুড়ে
যা দেয় তা নেবার যোগ্য নয়
আমাদের চেতনাই ক্রমে অস্পষ্ট করে সাহায্যের হাত…
লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।

সর্বশেষ উদাহরণ হল নয়া শিক্ষানীতি, যেখানে ফেডারেলিজম-এর মূল কাঠামোটিকেই বিধ্বস্ত করেছে। সংবিধানের সপ্তম তফসিল অনুযায়ী শিক্ষা যেখানে যৌথ তালিকায় পড়ে তাকে সরিয়ে পূর্ণত কেন্দ্রের আওতায় আনা হল। এবং উত্তরোত্তর এ প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ফেডারালিজম আক্রান্ত। একে বাঁচানো গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জরুরি।

পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে ভাবতে গেলে আরও গভীরে ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা এবং ভারতীয় সংবিধান ও ফেডারেল কাঠামোর অন্তর্নিহিত চেহারাটিও ভেবে দেখতে হবে বৈকি। নাহলে কেবলমাত্র পশিমবাংলার নির্বাচনী হিংসায় আমাদের চিন্তার জীবনীশক্তি পূর্ণত ব্যয়িত হয়ে যাবে। ভারতের দিকে আর তাকানো হবে না।

 

শেষ কথা

পঞ্চায়েতের মধুভাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রতিবার নির্বাচনের সময় এরই পৌনঃপুনিক পুনরাবৃত্তি আমরা বারংবার দেখব। যদি একটি শক্তিশালী নাগরিক তথা তৃতীয় পরিসর গড়ে তুলতে পারি তাহলে হয়তো এরকম ঘটনাকে অনেকাংশে প্রতিহত করা যাবে।

ভারতের ফেডারেলিজম, সংবিধান, আইনি ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে সামাজিক হিংসা, আইনের শাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ বসানো বিচারের জন্য— এ-সমস্ত ঘটনা বারংবার ঘটবে। আমাদেরই সঙ্গে কয়েক দশক ধরে বাস করা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশী ‘অপর’ বলে সংবিধান-অতিরিক্ত বিচারের খাপ পঞ্চায়েতে কুরবানি হবে।

একটি জীবন্ত নাগরিক/তৃতীয় পরিসর (যদিও এই মুহূর্তে ক্রমক্ষীয়মান) এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়ানোর শক্তি রাখে, যেমনটা ১৯৭৭-এর ভারতে হয়েছিল। আমরা কি পারব এ কাজটি করতে বর্তমান সময়ে?


[1] Stanley, Alessandra. An Overnight Death Watch, and Then Images of the Hangman’s Noose. NYT. Dec 31, 2006.
[2] পৃঃ ১৫২।
[3] পৃঃ ১০৫।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...