অগ্নিদগ্ধ ইউরোপ ও দান্তের ইনফেরনো

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


সার্বেরাস দুরন্ত হয়ে উঠেছে। আবহবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এমন দাপট বজায় থাকলে ইউরোপ জুড়ে নেমে আসবে তীব্র হাহাকার। দক্ষিণের সাহারা মরুভূমি থেকে টেনে আনা গরম বাতাস অনেক অনেক জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে সক্ষম। ফলে কোথাও বাড়ছে শুষ্কতা, আর কোথাও বাড়ছে বৃষ্টি, হড়পা বান। এক অদ্ভুত বৈপরীত্য, দ্বৈধতা। পৃথিবীর বর্ধমান উষ্ণতা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে নিরন্তর ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে

 

উফ, কী গরম! এমন শব্দবন্ধের সঙ্গে আমাদের মানে উষ্ণমণ্ডলের মানুষের পরিচয় মোটেই নতুন নয়। ক্ষণস্থায়ী শীতের প্রকোপ কমতেই শুরু হয়ে যায় গরমে তেতে ওঠার পালা। কলঘরে যাওয়ার অবসরে গায়ে জল ঢেলে গতরের জ্বালা মেটানোর চোরাগোপ্তা প্রচেষ্টা চালালেও গরম আর কমে না। এসব দেখে আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ অবরেসবরে মন্তব্য করে বসেন— ‘আর তো পারি নে বাপু! এর চেয়ে সাহেবসুবোদের দেশে জন্মালে বাপু ভাল হত!’ ভাবখানা এই, সাদা চামড়ার সাহেবদের দেশে গরমের বালাই নেই। ওরা দিব্যি সুখে দিন কাটায়। সত্যিই এমনটা চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। ভূগোলের ক্লাসে ক্লাসে মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা দেওয়ালে ঝোলানো ঢাউস চেহারার পৃথিবীর মানচিত্র দেখিয়ে বলতেন— বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা থেকে ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর আর ২৩.৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বলে পৃথিবীর উষ্ণমণ্ডল, তারপর শুরু হয় না-গরম না-ঠান্ডার নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল যার বিস্তৃতি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৪৩ ডিগ্রি পরিমিত অঞ্চল জুড়ে। আর তারপরই হিমরাজ্যের এলাকা। এমন সব ভৌগোলিক ভাষ্য এবার বোধহয় বদলে ফেলার সময় এসেছে। পৃথিবী জুড়ে উষ্ণতার দাপট যেভাবে বেড়ে চলেছে, যেভাবে এতকালের চেনা ক্ষেত্রীয় পরিসরকে কাঁচকলা দেখিয়ে তাপের দাপট ক্রমশই মধ্যভাগের স্ফীতাংশ থেকে উত্তর আর দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে করে আশঙ্কা হয়ে তাপমণ্ডলের এতকালের চেনা সীমারেখাগুলো না বেবাক লোপাট হয়ে যায়। কেন এমন আতঙ্কিত জল্পনা সেই আলোচনার আগে একবার দুনিয়ার হালচাল দেখে নেওয়া যাক।

 

দুনিয়ার হালহকিকত

পৃথিবী ভাল নেই, পৃথিবী ভাল নেই, পৃথিবী ভাল নেই। একই কথা তিনবার উচ্চারণ করলে কথাটা নাকি সত্যি হয়ে যায়। তাই সকলের নজর টানতেই কথাগুলো তিনবার উচ্চারিত হল। আসুন একবার নয়ন মেলে দেখি পৃথিবীর আনাচেকানাচে কোন কোন ঘটনার ঘনঘটা।

নিজের দেশ থেকেই শুরু করি। এপ্রিল-মে মাসের সুতীব্র দাবদাহের পর্ব শেষ হতে না হতেই নেমেছে প্রলয়ঙ্কর বন্যা-ভূমিধসের আক্রমণ। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল, দিল্লি, উত্তরবঙ্গ, অসম, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি জুড়ে চলছে অতিবৃষ্টির দাপট। দেবভূমি আজ দেবরোষে বিপর্যস্ত। হিমালয়কে ঘিরে এতকাল ধারাবাহিক ধ্যাস্টামোর যে পর্ব চলেছে উন্নয়নকে শিখণ্ডী রেখে, হিমালয় বোধহয় কড়ায় গণ্ডায় তার মাসুল আদায় করছে। লোকক্ষয়, বিপুল সম্পত্তিহানির হাহাকার আজ ভারি করে তুলেছে ওই রাজ্যের বাতাসকে। এমনই সমস্যার ঘনঘটা প্রতিবেশী চিন, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন্স, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়।

এর ঠিক উল্টো অবস্থা এখন পশ্চিম গোলার্ধ জুড়ে। দক্ষিণ ইউরোপের একটা বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে চলছে অভূতপূর্ব গ্রীষ্মের দাবদাহ। তাপ-তরঙ্গ সার্বেরাসের দাপটে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, স্লোভেনিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্যের থরহরি কম্পমান অবস্থা। বিশেষজ্ঞদের মতে সাম্প্রতিক অতীতে কখনও এমন তাপজ্বরে ভুগতে হয়নি সম্পূর্ণভাবে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে থাকা ইউরোপ মহাদেশকে। আবহাওয়া দপ্তরের তরফে অনেক আগে থেকেই সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছিল। ২০২২ সালের সুতীব্র খরা পরিস্থিতির কথা বিজ্ঞানীরা বিস্মৃত হননি। সতর্ক মানুষজন দূর থেকে ভেসে আসা সেই বিপর্যয়ের ছবি দেখে আঁতকে উঠেছি বারংবার। জানুয়ারি মাসে, যখন শীতের আমেজ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি উত্তর গোলার্ধ, তখনই একাধিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র— লিচেনস্টাইন, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, বেলারুশ, নেদারল্যান্ডস, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া— রেকর্ড করেছিল সর্বকালের উষ্ণতম দিন! ভাবা যায়!!

শারীরবৃত্তীয়ভাবেই ইউরোপের মানুষ এমন অসহনীয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম নয়। তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব যত বাড়ছে, ততই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে এই দেশগুলির স্বাভাবিক জীবনছন্দ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলকে এতদিন বলা হত পৃথিবীর ফলের ঝুড়ি— নানান রসালো ফলের জোগান দিয়ে এই অঞ্চল পশ্চিম দুনিয়ার মানুষজনের চাহিদা মিটিয়েছে এতকাল। এখন সেই সাজানো বাগান খরার তাপে শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। এই অঞ্চলের পর্যটনশিল্পের ওপরেও দাঁড়িয়ে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। তার হালও যে নাজেহাল তা বোধহয় বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না।

কিন্তু বিপদ যে কখনও একা আসে না। আর হয়তো তাই এক মহাদেশের আগুনের আঁচ পৌঁছে যায় যোজন দূরত্বে থাকা পাশের মহাদেশের প্রত্যন্ত সীমানায়। আটলান্টিক মহাসাগরের বাধা পেরিয়ে এই তাপপ্রবাহ পৌঁছেছে উত্তর আমেরিকা মহাদেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমে থাকা ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে ফ্লোরিডা, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া সর্বত্রই তাপমান যন্ত্রের পারদ সর্বকালীন তাপীয় পরিস্থিতি নথিবদ্ধ করতে ব্যস্ত। সর্বত্রই এক আওয়াজ— উফফ, কী গরম! প্রাণ যায়, ওষ্ঠ শুকায় অবস্থা। গত ১৪ জুলাই ফিনিক্সের তাপমাত্রা ছিল ৪৬ সেলসিয়াস, লাস ভেগাসে ৪৫ সেলসিয়াস, আর ক্যালিফোর্নিয়ার মৃত্যু উপত্যকায় ৫১ সেলসিয়াস। এসব পড়ে পটলডাঙার টেনিদার মতো কেউ যদি বলে ওঠে— ধুস! এ আবার কী গরম! এমন তো ফি-বছর আমরাই সহ্য করি!— তাহলে বলতে হবে, ঠিক কথা! তবে খেয়াল রাখতে হবে ইউরোপ বা আমেরিকার অঞ্চলগুলো আমাদের থেকে ঢের উত্তরে অবস্থিত। আর তাই এমন অবস্থা সকলকেই ভ্রূকুঞ্চনে বাধ্য করে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এখন পর্যন্ত ২৪ জন মার্কিন নাগরিক প্রচণ্ড গরমে মারা গিয়েছেন। মেক্সিকোতে মারা গিয়েছেন ১০০ জন মানুষ। রক্ষে নেই মহাদেশের একেবারে উত্তরে থাকা কানাডারও। সুতীব্র গরম আর বৃষ্টিহীন শুষ্কতার কারণে দেশের উত্তরাংশের তৈগা বনাঞ্চল দাবানলে দগ্ধ হচ্ছে বারংবার। প্রায় ৯০০ দাবানলের ঘটনা নজরে এসেছে বনবিভাগের আধিকারিকদের। তাপক্লিষ্ট বিশ্বের অন্যত্রও ঘটছে একই দুর্বিপাকের ঘটনা।

তাহলে বিশ্বের হালহকিকত সম্পর্কে কী মালুম হল? কেউ ভাল নেই। তিন-তিনটে মহাদেশ পরিক্রমা করলাম, সর্বত্রই বিপর্যস্ত প্রকৃতি, বিপন্ন মানুষ। এশিয়ার মানুষ এই মুহূর্তে বন্যা, খরা, হড়পা খরা, হড়পা বান, ভূমিধসের মতো বিপর্যয়ের শিকার। আর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা জ্বলছে সুতীব্র দহনে। ভাবছেন বাকি তিন মহাদেশের লোকজন বোধহয় বেবাক স্বস্তিতে আছে! না, নেই। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো, বিশেষত মতক্কো, এখন তাপপ্রবাহে দগ্ধ হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বত-লাগোয়া দেশগুলোর হাল অনেকটাই আমাদের হিমাচল আর উত্তরাখণ্ডের মতো— প্রবল বৃষ্টির প্রলয়ের সঙ্গে সমানতালে সঙ্গত করছে হড়পা বান, ভূমিধসের মতো আকস্মিক ঘটনাগুলো। এ বলে আমায় দ্যাখ, তো বাকিরা বলে আমাদের দ্যাখো! সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় একই সমস্যায় নাকাল হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াও। এতসব ঘটনার মধ্যেও আমরা ব্যস্ত থাকি জাতিদাঙ্গায়, পারস্পরিক ঘৃণা বর্ষণে, ভূখণ্ডের দখলদারি নিয়ে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র জীব আমরা! এমনই সব হা-হুতাশের মধ্যেই আমাদের খুঁজতে হবে তাপক্লিষ্ট দুই মহাদেশের এমন হাল হওয়ার কারণগুলোকে। এবার সেদিকেই নজর দেওয়া যাক।

 

অথ তাপ গম্বুজ কথা

হিট ডোম বা তাপ গম্বুজ বিষয়টি আমাদের খুব পরিচিত এমন নয়। তথ্যাভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের মতে ইউরোপ ও আমেরিকার সাম্প্রতিক তাপ-বিপর্যয়ের পেছনে এই তাপ গম্বুজই মুখ্যত দায়ী। আবহবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর যে-কোনও প্রান্তেই তাপপ্রবাহজনিত বিপর্যয় ঘটুক না কেন, তার পেছনে এই তাপ গম্বুজ সৃষ্টির বিষয়টির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রশ্ন হল এই তাপ গম্বুজ আসলে কী? কীভাবেই বা তার সৃষ্টি হয়? প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে তাপ গম্বুজ একান্তভাবেই একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, এর সঙ্গে মানুষের বা মানুষী কার্যকলাপের কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। আসলে তাপ গম্বুজ হল এক বিশেষ ধরনের উচ্চ বায়ুচাপের অবস্থা যা অনেকটা বড় এলাকা জুড়ে অবস্থান করে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠের অংশ থেকে ঊর্ধ্বগামী উষ্ণ বাতাস ওপরে উঠতে বা ওপরে উঠতে ঠান্ডা হতে পারে না। ফলে এই গরম বাতাস নিচে নেমে এসে অসহনীয় তাপপ্রবাহের সৃষ্টি করে। বিষয়টা একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করা যাক।

আমরা লক্ষ করেছি, যেসব দিনে আকাশ মেঘের চাদরে ঢাকা থাকে সেই সব দিনে রাতের দিকে একটা অস্বস্তিকর গুমোট আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। এখানে আবহমণ্ডলীর তাপ সঞ্চালনের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দিনের বেলা সৌরকিরণ ক্ষুদ্র তাপতরঙ্গের আকারে পৃথিবীপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে এবং ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে। বেলা দুটোর আশেপাশের সময় পর্যন্ত এই তাপ সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তারপর শুরু হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে তাপ বিকিরণের পালা। দীর্ঘ তাপতরঙ্গের আকারে, অবলোহিত রশ্মিরূপে, তাপ মহাশূন্যে পুনরায় বিলীন হয়ে যায়। এই তাপীয় গমনাগমনের দ্বারাই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় উষ্ণতার ভারসাম্য বজায় থাকে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কখনওই অতিরিক্ত পরিমাণে গরম বা ঠান্ডা হতে পারে না। এই অবধি ঠিকঠাকই আছে। সমস্যা বাড়ে তখনই যখন আকাশে থাকা মেঘ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপতরঙ্গকে পরিপূর্ণভাবে মহাশূন্যে ফিরে যেতে না দিয়ে তাকে প্রতিহত করে পুনরায় ভূপৃষ্ঠে ফিরিয়ে দিয়ে এক উষ্ণ অবস্থার সৃষ্টি করে। তবে মাথায় রাখতে হবে তাপ গম্বুজ সৃষ্টির পেছনে মেঘপুঞ্জের উপস্থিতির কোনও সম্পর্ক নেই। বিষয়টিকে বোঝাবার জন্যই এমন অবস্থার কথা বলা হল। তাপ গম্বুজের সৃষ্টির বিষয়টি একদম স্বতন্ত্র এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বায়ুমণ্ডলের একটি বিশেষ অবস্থা যা ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে ছুটতে থাকা গরম বাতাসকে আটকে দেয়। বাধ্য হয়ে এই বায়ু সঙ্কুচিত হয়ে উত্তপ্ত হয়ে যায় এবং একটি গম্বুজাকৃতির আবরণীর সৃষ্টি করে। এই গম্বুজ বিপজ্জনক তাপতরঙ্গের সৃষ্টি করে মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীদের তীব্র অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়— ঠিক যেমন হয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানে।

ইউসিএলএ ইনস্টিটিউট অফ দ্য এনভায়রনমেন্টের বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল সোয়াইনের ভাষায়— তাপ গম্বুজ একটি স্থির এবং শক্তিশালী উচ্চচাপ ব্যবস্থা যা ভূপৃষ্ঠসংলগ্ন অংশের তাপীয় ভারসাম্যকে অস্থিত করে তোলে। এমন অবস্থা সাধারণত গ্রীষ্মকালেই দেখা যায়।

বায়ুমণ্ডলে এমন ঘটনা যে খুব অস্বাভাবিক তা মনে করেন না বিজ্ঞানীরা। অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপেও তাপ গম্বুজের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছে একাধিকবার, তবে এবার তা পরিস্থিতির বিচারে এবং অনেকটা অঞ্চলকে প্রভাবিত করার ফলে আলোচনার কেন্দ্রে স্থান করে নিয়েছে। এবার আসি ইউরোপের সাম্প্রতিক তাপীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে মূল আসামি সার্বেরাসের কথায়।

 

এবং সার্বেরাস

এবার পাঠকদের কাঠগড়ায় হাজির করছি সার্বেরাসকে— সরেজমিন তদন্তসূত্রে যাকে এমন বিপর্যয়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন আবহবিজ্ঞানীরা। ইদানিংকালে ঝড়ের নামকরণের বিষয়টি আমাদের সকলেরই নজরে এসেছে। বিজ্ঞানীদের মতে এভাবে বিশেষ কোনও একটা নামে একটা বিপর্যয়ের ঘটনাকে চিহ্নিত করা হলে তার কার্যকারণ প্রভাব বিষয়ে আলোচনা বা গবেষণার কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এভাবেই ইউরোপীয় তাপপ্রবাহের নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনির অন্যতম চরিত্র সার্বেরাসের কাহিনির অনুসরণে।

গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী সার্বেরাস হল নরকের দেবতা হেডেস-এর তিন মাথাবিশিষ্ট কুকুর। নরকের পাহারাদার। দান্তে তাঁর মহাকাব্য ডিভাইন কমেডির প্রথমাংশ ইনফেরনো বা নরক-এ সার্বেরাসকে কল্পনা করেছেন নরকের তৃতীয় বৃত্তের (থার্ড সার্কেল) রক্ষক হিসেবে। নরকের এই তৃতীয় বৃত্ত উত্তাপ, বর্ষণ, তুষারপাত ইত্যাদি মিলিয়ে এক অসহনীয় আবহিক পরিস্থিতি। বোঝাই যাচ্ছে, কী চমৎকার রূপকল্প নিহিত রয়েছে এই নামকরণের মধ্যে।

 

শেষ কথা

এই মুহূর্তে যখন কলম চালিয়ে তাপদগ্ধ পৃথিবী তথা ইউরোপের তথা লিখছি তখন টেবিলের ওপর রাখা দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় উঁকি দিচ্ছে অগ্নিবিদ্ধ বিশ্বের কিছু শহরের পরিসংখ্যান। পারসিয়ান গালফ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট লাগোয়া অঞ্চলের তাপমাত্রা রবিবার স্থানীয় সময় সাড়ে বারোটায় কয়েক লহমার জন্য পৌঁছেছিল ৬৬.৭ সেলসিয়াসে! পিছিয়ে ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেথ ভ্যালি (৫৫ সেলসিয়াস), চিনের জিনজিয়াং (৫২ সেলসিয়াস), সিসিলিতে (ইতালি) নথিভুক্ত তাপমান হল ৪৮° সেলসিয়াস, এবং কানাডার অন্টারিও শহরের তাপমাত্রা ছিল ৪২° সেলসিয়াস। গোটা বিশ্ব জুড়ে চলেছে এক আজব প্রতিযোগিতা— গরম হওয়ার প্রতিযোগিতা!

সার্বেরাস দুরন্ত হয়ে উঠেছে। আবহবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এমন দাপট বজায় থাকলে ইউরোপ জুড়ে নেমে আসবে তীব্র হাহাকার। দক্ষিণের সাহারা মরুভূমি থেকে টেনে আনা গরম বাতাস অনেক অনেক জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে সক্ষম। ফলে কোথাও বাড়ছে শুষ্কতা, আর কোথাও বাড়ছে বৃষ্টি, হড়পা বান। এক অদ্ভুত বৈপরীত্য, দ্বৈধতা। পৃথিবীর বর্ধমান উষ্ণতা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে নিরন্তর ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। তাপ গম্বুজ সৃষ্টি হয় কতগুলো আবহিক উপাদানের কার্যকারণের ফলে। তাই একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে জলবায়ুর পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে প্রশমিত করতে পারলে হয়তো এমন ঘটনার পৌনপুনিক পুনরাবৃত্তির ভয়াবহ পরিণতি থেকে খানিকটা স্বস্তি মিলবে। এখন সেই আশা নিয়েই থাকতে হবে আমাদের।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...