নোলানের ‘ওপেনহাইমার’: অভিশপ্ত প্রমিথিউস

প্রদীপ দত্ত

 


পৃথিবীর মানুষের উপর পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছে আমেরিকা। সে কাজ ক্ষমার অযোগ্য। ওপেনহাইমার ছিলেন পরমাণু বোমা তৈরির মুখ্য কারিগর। বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত তাঁর না হলেও তিনি মনুষ্যবসতি অঞ্চলে বোমা ফেলার সমর্থক ছিলেন। মনে করতেন, তারপর সব যুদ্ধ চিরকালের মতো থেমে যাবে। ম্যানহাটন প্রকল্পের কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মানুষের উপর বোমা না ফেলার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে তিনি সামিল হননি। এমন একজন মানুষের জীবন নিয়ে ছবি করা অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ

 

কাই বার্ড ও মার্টিন জে শেরউইন-এর যৌথভাবে লেখা পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী জীবনীগ্রন্থ ‘আমেরিকান প্রমিথিউস: দ্য ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্রাজেডি অফ জে রবার্ট ওপেনহাইমার’ অবলম্বন করে পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান ‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি নির্মাণ করেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন প্রজেক্টে পরমাণু বোমা তৈরিতে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই পদার্থবিদের জীবন নিয়ে তৈরি ছবিটি যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। অত্যন্ত দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে মানুষ হিসাবে জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার (কিলিয়ান মার্ফি) কেমন ছিলেন, তাঁর নৈতিক সংশয়, অন্যান্য বিষয়ে আগ্রহ, পরমাণু বোমার জন্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, বিশের শতকে পর্থবিদ্যায় বিপ্লব, পরমাণু বোমার অসীম ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এবং ১৯৫০-এর দশকে সন্দেহভাজন কমিউনিস্ট বলে তাঁকে বিপদে ফেলার চেষ্টার কথা পরিচালক তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞানের বেশ কয়েকজন মহারথী আমেরিকার ম্যানহাটন প্রজেক্টে বোমা তৈরির কাজে জড়িয়ে থাকলেও আর কোনও বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের মতো অমন রাষ্ট্রীয় রোষের শিকার হননি।

ছবিটি ওপেনহাইমারের যন্ত্রণাবিদ্ধ সফলতার গল্প। তিনি নিঃসঙ্গতা ও আবেগের দাস। ছোট মাথায় বসানো চোখদুটি, গগনভেদী দৃষ্টি, মুখে পাইপ, মাথায় টুপি— ওপেনহাইমারের ভূমিকায় কিলিয়ান মার্ফির অভিনয় মনের গভীরে দাগ কেটে যায়। এমনভাবে ছবিটি তৈরি করা হয়েছে, যেন দর্শক বোঝে মুখ্য চরিত্র কোন অসীম প্রতিভা, ক্ষমতা ও বিশৃঙ্খলায় নিজেকে “ডেথ, ডেস্ট্রয়ার অফ ওয়ার্ল্ডস” মনে করতে পারেন।

 

নিঃসঙ্গ যুবক ওপেনহাইমার পদার্থবিজ্ঞানের নতুন বিষয় কোয়ান্টাম মেকানিকসের উন্নয়নে একেবারে তড়িদাহত হয়েছিলেন। ‘ওপেনহাইমার’ ছবিতে তাঁর মনের দোলাচল, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন তুলে ধরা হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও তিনি ছিলেন বামপন্থী। ক্রাইস্ট কলেজ কেম্ব্রিজের অসুখী গ্র্যাজুয়েট ওপেনহাইমার নিলস বোরের বক্তৃতা শুনতে গিয়ে, রাতে না ঘুমিয়ে পরের দিন ল্যাবরেটরিতে সামান্য ভুল করে ফেলেছিলেন। সেই কারণে সুপারভাইজার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট তাঁকে চূড়ান্ত হেনস্থা করেন। অহেতুক অপমানের শোধ তুলতে টেবিলে ব্ল্যাকেটের খাবার জন্য রাখা সবুজ আপেলে তিনি ইঞ্জেক্ট করে বিষ মিশিয়ে রাখেন। ছবিতে এই ঘটনা আমাদের রীতিমতো চমকে দেয়। তিনি একরোখা, অপমানের শোধ তুলতে চরম পদক্ষেপও নিতে পারেন, মানুষ সাধারণত এমন হয় না। সৌভাগ্যবশত ব্ল্যাকেট আপেলটা খাননি। কিন্তু পরের দিন সেখানে নিলস বোর তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই বিষাক্ত আপেলে কামড় দিতে গেলে ওপেনহাইমার হাত থেকে তা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলেন। একটুর জন্য বোর প্রাণে বাঁচলেন।

এই ঘটনার অনেক আগে, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ব্যাখ্যা করেন যে, প্রকৃতি সুচতুরভাবে পদার্থের পরমাণুর কেন্দ্রে অকল্পনীয় শক্তি লুকিয়ে রেখেছে (E=mc2)। ১৯১১ সালে হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর ভারী কেন্দ্রীয় অন্তস্থল ও তার চারপাশে আবর্তিত ইলেক্ট্রনের গঠন প্রমাণ করেন। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটির তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগ থেকে কয়েক বছরের মধ্যে ব্রিটেনে রাদারফোর্ড, ফ্রান্সে ক্যুরি দম্পতি এবং ডেনমার্কে নিলস বোরের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় পরমাণু-কেন্দ্রকের বিভাজন সম্ভব। ১৯২০-র দশকে পদার্থবিদ্যা বিভাগের বেশিরভাগ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী জড়ো হয়েছিলেন তিনটি গবেষণাকেন্দ্রে। ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অফ কেম্ব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরি, সেখানে ছিলেন রাদারফোর্ড। ২০২০ সালে তৈরি ডেনমার্কের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিকাল ফিজিক্স (নিলস বোর ইন্সটিটিউট), সেখানে ছিলেন নিলস বোর। আর জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ গয়টিংগেন। সেখানে ছিলেন ম্যাক্স বর্ন, জেমস ফ্র্যাঙ্ক ইতাদি বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম থিওরির জন্য ১৯১৮ সালে এবং ডেনমার্কের নিলস বোর পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করার জন্য ১৯২২ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে জার্মানির ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ২৩ বছর বয়েসে কোয়ান্টাম মেকানিকসের অঙ্কের মডেল প্রকাশ করেন। পরে ১৯৩২ সালে হাইজেনবার্গ পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান।

২০২০-র দশকেই কোয়ান্টাম ফিজিক্স বিকশিত হয়। সেই সময়ই ওপেনহাইমার জার্মানিতে কোয়ান্টাম ফিজিক্স শেখেন। পরের দশকে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে অধ্যাপক হিসাবে প্রতিভায় অন্যদের ছাপিয়ে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কেন্দ্র গড়ে তোলার দায়িত্ব পান। আমেরিকায় তিনিই কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে এসেছিলেন। নোলানের ছবিতে বিজ্ঞানের এই যুগের উদ্দীপনাও দর্শকদের মধ্যে চারিত হয়। সেই যুগে নানা বৈজ্ঞানিক বিতর্ক ছিল। ছবিতে চকবোর্ডে নানা জটিল ক্যালকুলেশন দেখা যায়, যার কিছুটা নোলান নানা কৌশলে দর্শকের বোঝার মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।

হিটলার ক্ষমতায় এসেই ম্যাক্স বর্ন সহ সাতজন বড় বিজ্ঞানীকে ছাঁটাই করেন। এরপর বহু ইহুদি বিজ্ঞানী ব্রিটেন, ডেনমার্ক ও আমেরিকায় আশ্রয় নেন। সেই বছরই আইনস্টাইন জার্মানি ছেড়ে আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে চলে গিয়েছিলেন। প্রতিভা ও সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ওদিকে ১৯৩৯ সালে জার্মানিতে অটো হান পরমাণুর কেন্দ্রকের বিভাজন ঘটালেন। অর্থাৎ পরমাণুর কেন্দ্রে লুকানো অকল্পনীয় শক্তি বাইরে বার করে আনার সম্ভাবনা তৈরি হল। এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের পর থেকেই জার্মানি সহ কয়েকটি দেশে প্রবলভাবে পরমাণু অস্ত্র তৈরির ভাবনা শুরু হয়।

ওপেনহাইমার আমেরিকাকে এমন অস্ত্র তুলে দিয়েছেন যা দিয়ে মানবসভ্যতা ধ্বংস করে ফেলা যায়। তবে বিচ্ছিন্নভাবে এই কথাটি ভাবলে চলবে না। নাৎসিরা যদি আগেই বোমা তৈরি করে ফেলে তাহলে কী হতে পারে তা নিয়ে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা সেই সময় খুবই চিন্তিত ছিলেন। কারণ অনেক বিজ্ঞানী আমেরিকা সহ নানা দেশে আশ্রয় নিলেও জার্মানিতে তখনও সেই প্রতিভা এবং জার্মানির সেই বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা ছিল। আইনস্টাইন, জিলার্ড সহ অনেকেই চেয়েছিলেন আমেরিকাই পরমাণু বোমা বানাক। নাৎসি জার্মানির পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে লিও জিলার্ডের উদ্বেগ ও দরবারের ফলে আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লেখেন (২ অগস্ট, ১৯৩৯)। চিঠিতে বিস্তারিতভাবে কোন কোন পদক্ষেপ নিলে আমেরিকা এগিয়ে যাবে তা জানানো হয়। তিনি জানান: ই ফের্মি এবং এল জিলার্ডের সাম্প্রতিক কাজের যে পাণ্ডুলিপি আমার কাছে পৌঁছেছে তা থেকে আমার মনে হয় ইউরেনিয়াম মৌলটি অদূর ভবিষ্যতেই নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তির উৎসে পরিণত হবে।… ফ্রান্সে জোলিও, আমেরিকায় ফের্মি এবং জিলার্ডের গত চার মাসের কাজের পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে বিশাল এক তাল ইউরেনিয়ামে পারমাণবিক শৃঙ্খল বিক্রিয়া সঙ্ঘটন সম্ভব হতে পারে… এই নতুন প্রক্রিয়া বোমা বানানোর কাজে লাগানো যেতে পারে।… এই পরিপ্রক্ষিতে প্রশাসন এবং শৃঙ্খল বিক্রিয়া নিয়ে আমেরিকায় কর্মরত পদার্থবিদদের মধ্যে এক অস্থায়ী যোগাযোগ বাঞ্ছনীয়…।

সে বছরই সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের খবরের পর বার্কলেতে ওপেনহাইমারের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এল। নাৎসিরা যদি বোমা আগেই তৈরি করে ফেলে তাহলে কী হতে পারে সে কথা ভেবে তিনি চিন্তিত ছিলেন। ততদিনে তিনি আর্নেস্ট লরেন্সের মতো অনেকেরই সান্নিধ্যে এসেছেন। পদার্থবিদ লরেন্স পার্টিকেল অ্যাক্সিলেটর সাইক্লোট্রন আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে তিনি ম্যানহাটন প্রকল্পে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৩ সালে বার্কলেতেই ওই প্রকল্পের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল লেসলি গ্রোভস ওপেনহাইমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর বামপন্থী যোগাযোগ, তাঁর ভাই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পরমাণু বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ওই প্রকল্পের লস অ্যালামস ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর নির্বাচিত করেন। গ্রোভস বলেছিলেন তা এক বছরের মধ্যে করতে হবে। ওপেনহাইমার আঠেরো মাস সময় চেয়ে নিয়েছিলেন (বাস্তবে দু বছর লেগেছিল)। এরপর তিনি নানা দেশ থেকে আমেরিকায় আশ্রিত বেশ কয়েকজন পৃথিবীসেরা বিজ্ঞানীকে নিয়ে অধিকর্তা হিসাবে লস অ্যালামসে পরমাণু বোমা তৈরি করার সাধনায় মগ্ন হলেন। তুমুল উদ্যমে কাজ শুরু হল। ছবির পরিচালক নোলান ওপেনহাইমারকে নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি কথা বলেছেন। তবে ম্যানহাটন প্রকল্পের হ্যানফোর্ড (ওয়াশিংটন) এবং ওক রিজে (টেনেসি) বড় বড় বিজ্ঞানীরা যেসব কাজে জড়িয়ে ছিলেন তার গুরুত্ব ও বিশালত্বের আঁচ ছবিটিতে পাওয়া যায়নি।

ওদিকে ১৯৪৪ সালের মে মাসে নিলস বোর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে পারমাণবিক প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন: কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকা পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলবে, যুদ্ধের পর রাশিয়াও বানিয়ে ফেলবে। এই ভয়াবহ অস্ত্র প্রতিযোগিতা এড়ানোর একমাত্র উপায় হল ম্যানহাটন প্রকল্পের গোপন কাজের অগ্রগতি রুশদের জানানো। চার্চিল রাশিয়াকে জার্মানির চেয়েও বড় শত্রু বলে মনে করতেন। তাই বোরের এই প্রস্তাব তাঁর কাছে ছিল অর্থহীন। তিনি ভাবলেন, নিলস বোর রাশিয়ার গুপ্তচর হতে পারেন। বোরের উদ্বেগ কিন্তু বাড়তেই থাকল। শেষে তিনি মার্কিন প্রসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে গেলেন। ওই প্রকল্পের গোপন তথ্য রাশিয়াকে জানানোর ইচ্ছে রুজভেল্টেরও ছিল না। তিনি মনে করলেন, ওই প্রকল্পের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার পক্ষে নিলস বোর বিপজ্জনক। অবশ্য এসব কথা ছবিতে বলা হয়নি।

জার্মানি পারমাণবিক গবেষণার দৌড়ে কতটা এগিয়েছে তা বুঝতে লেসলি গ্রোভস ‘অলসোস’ নামে একটি কমান্ডো দল গঠন করেন। এই দলে পদার্থবিদ স্যামুয়েল গাউডস্মিট ছিলেন। ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসে অলসোস দল জার্মানির বিজ্ঞানী কার্ল ভন ভিজসাকারকে গ্রেপ্তার করতে জার্মানির স্ট্রসবার্গে আসে। ভিজসাকার ও হাইজেনবার্গই ছিলেন সে দেশের সবচেয়ে অগ্রগণ্য পরমাণু গবেষক। গাউডস্মিট জানতেন স্ট্রসবার্গই ছিল জার্মানির পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের প্রধানস্থল। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখেন তিন মাস আগেই ভিজসাকার সে জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন। ফেলে যাওয়া কাগজপত্র পরীক্ষা করে তিনি বুঝলেন যে, জার্মানি পারমাণবিক গবেষণায় এগিয়ে আছে এই ধারণা ভুল। তারা আমেরিকার চেয়ে অন্তত দু বছর পিছিয়ে ছিল। অলসোসের এই আবিষ্কারে ম্যানহাটন প্রকল্পের বোমা বানানোর নৈতিকতা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। অলসোসের রিপোর্ট চূড়ান্ত গোপন বলে চিহ্নিত করে তা আটকে রাখলেও ওই প্রকল্পের মুখ্য বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ তা জেনে প্রশ্ন তুলেছিলেন, জার্মানির যদি পরমাণু প্রকল্প নাই থাকে, তাহলে আমরা পরমাণু বোমা বানাব কেন? উত্তরে গ্রোভস প্রকল্পের কাজ তরান্বিত করেন।

ছবিটির অন্যতম প্রধান ঘটনা হল ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই মাসে নিউ মেক্সিকোর আলমাগোর্দে ভয়াবহ প্রথম পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ‘ট্রিনিটি’ (তার দু মাস আগেই ৮ মে মধ্যরাতে ইউরোপে যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল)। বোমাটি ছিল প্লুটোনিয়াম বোমা। বিজ্ঞানীরা যতটা ভেবেছিলেন বোমাটি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে সূর্য ওঠার আগে দিগন্ত থেকে হঠাৎ চোখ অন্ধ করে দেওয়ার মতো উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। তারপর আকাশে যেন আগুন ধরে গেল। গোটা স্ক্রিন জুড়ে সহস্র সূর্যের আলো জ্বলে ওঠার কয়েক সেকেন্ড পরে বিস্ফোরণের তুমুল গর্জন শোনা গেল, তারপর বাতাসের ধাক্কা এসে পৌঁছল। তবে বিস্ফোরণে যে বিশাল ব্যাঙের ছাতার মতো মেঘ (মাশরুম ক্লাউড) তৈরি হয় এবং বেড়ে ওঠে তা তেমন দেখা গেল না। অবশ্য এক চিলতে আগুন-রঙা ব্যাঙের ছাতা ছিল। তবে বেশিরভাগ দর্শকের চোখেই এই ত্রুটি এড়িয়ে যাবে।

পরমাণু বিস্ফোরণে বায়ুমণ্ডলে আগুন ধরে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কি না তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগের কথাও ছবিতে বলা হয়েছে। হিসাব কষে দেখা গিয়েছিল তা হবে না। হ্যান্স বেথেই প্রথম হিসাব করে বলেছিলেন যে, পরমাণু বিস্ফোরণের জন্য বায়ুমণ্ডলের জ্বলে ওঠা এবং পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।

বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করতে যেসব প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীরা এসেছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই চোখে সানগ্লাস, মুখে সানস্ক্রিম লাগিয়ে নিয়েছিলেন। ফাইনম্যান তা করেননি। তিনি কাচ তুলে দিয়ে গাড়ির মধ্যে বসেছিলেন। বললেন, কাচ আল্ট্রাভায়োলেট রে আটকে দেয়। ওপেনহাইমার এবং জেনারেল গ্রোভস সহ কয়েকজন ছিলেন মোটা মোটা কাঠের ব্লকের উঁচু দেওয়ালের আড়ালে। এই হল ট্রিনিটি পরমাণু অস্ত্রপরীক্ষা। হল বিশ্বে পারমাণবিক যুগের উদ্বোধন। বিস্ফোরণের পর ওপেনহাইমার নাকি ভাগবৎ গীতা থেকে ভগবান বিষ্ণুর কয়েকটি লাইন নীরবে মনে করেছিলেন— নাউ আই বিকাম ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অফ ওয়ার্ল্ডস…।

তবে ছবিতে ওই বাক্যটি ওপেনহাইমার প্রথম বলেছেন তাঁর সঙ্গিনী কমিউনিস্ট জঁ টেটলককে (টেটলক ছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক এবং আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য)। সঙ্গমের পর সঙ্গিনী তাঁর বইয়ের তাক থেকে ‘ভাগবৎ গীতা’ বার করে, অবাক হয়ে ওপেনহাইমারকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে সংস্কৃত শিখছেন। কথাটা টেটলকের বিশ্বাস হয়নি, তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে একটা পাতা বার করে পড়তে বলেন। তখনই তিনি বইয়ে লেখা ওই বাক্যটি পড়ে শোনান। সংস্কৃত ও হিন্দু ধর্মীয় ট্র্যাডিশন সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান অনেক খামখেয়ালি শখের একটি। ‘ট্রিনিটি’ নামটিও পছন্দ করেছিলেন জন ডোনের কবিতা থেকে। আমেরিকার মানুষ হলেও মার্ক্সের তিন খণ্ড ‘দাস ক্যাপিটাল’-ই তিনি মূল জার্মানিতে পড়েছিলেন (তাঁর বাবা অভিবাসী হয়ে জার্মানি থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন)। তিনি ছিলেন চিন্তাভাবনায় এরকমই গভীর, প্রাগ্রসর এবং কিছুটা রহস্যময়। পবর্তীকালে টেটলক আত্মহত্যা করলে ভেঙে পড়া ওপেনহাইমারকে তাঁর স্ত্রী কিটি বললেন, “ইউ ডোন্ট গেট টু কমিট আ সিন অ্যান্ড মেক আস ফিল সরি হোয়েন দেয়ার আর কনসিকোয়েন্সেস।”

ফের একটু ইতিহাসের কথায় আসি। ওদিকে ঠিক সেই সময় বার্লিনের পটসডামে যুদ্ধকালীন আমেরিকা, ব্রিটেন ও রাশিয়ার শেষ ত্রিদেশীয় মিটিং চলছে। তখন চার্চিল ও স্তালিনের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত হ্যারি ট্রুম্যান একটি বার্তা পেলেন— ‘অপারেটেড অন দিস মর্নিং। ডায়াগনোসিস নট ইয়েট কমপ্লিট বাট রেজাল্টস সিম স্যাটিসফ্যাক্টরি অ্যান্ড অলরেডি এক্সিড এক্সপেকটেশন।’ এই সংবাদের প্রতীক্ষাতেই তিনি অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মনে মনে আহ্লাদে আটখানা হলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।

নীতিগত কারণেই পারমাণবিক বোমা ফেলার বিরুদ্ধে প্রথম আপত্তি জানান বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড। তিনি জানতেন আরও কিছু বিজ্ঞানী মানুষের উপর এই বোমা প্রয়োগের বিরোধী। বোমা ব্যবহার করলে যুদ্ধপরবর্তী পৃথিবীতে ভয়াবহ অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। তাই বিরোধিতার কারণ সংক্ষেপে উল্লেখ করে তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে বোমা ফেলার বিরুদ্ধে আবেদন করেছিলেন। সেই চিঠি পড়বার আগেই ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল রুজভেল্ট মারা যান। নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও জিলার্ড দেখা করতে পারেননি।

মে মাসের প্রথমদিকে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটি (অন্তর্বর্তী কমিটি) গঠিত হয়। এই কমিটিই পারমাণবিক বোমা বিষয়ে পরামর্শ দেবে। তবে বোমা নিক্ষেপ করা আদৌ উচিত হবে কি না তার বিচার করা ছিল কমিটির এক্তিয়ারবহির্ভূত। ওই মাসের শেষে কমিটির বৈঠকে বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন কমিটির সভাপতি স্টিমসনকে অনুরোধ করেন, পারমাণবিক বোমার আক্রমণ ছাড়া জাপানকে পরাজিত করার অন্য কোনও পথ আছে কি না বিবেচনা করতে। বিকল্প হিসাবে তিনি বলেন, সমুদ্রে কিংবা কোনও মনুষ্যহীন নির্জন দ্বীপে বিস্ফোরণ ঘটানো যেতে পারে। তা থেকে জাপান নতুন অস্ত্রের ক্ষমতা উপলব্ধি করে ভয় পাবে। কমিটির বিজ্ঞান উপদেষ্টা কম্পটন, ফার্মির বক্তব্যে জেনারেল লেসলি গ্রোভস বিরক্ত, উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তার বক্তব্য, লক্ষ্যস্থল নির্বাচন নিয়ে বিজ্ঞানীদের কথা বলা ঠিক নয়, তা ঠিক করবে সামরিক বাহিনি।

জুন মাসে বিজ্ঞানী জেমস ফ্র্যাঙ্কের নেতৃত্বে ম্যানহাটন প্রকল্পের অর্ন্তগত শিকাগোর ছয়জন বিজ্ঞানী আবেদন করেন যে মনুষ্যবসতিহীন স্থানে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েই জাপানকে বোমার ভয়াবহ শক্তি বোঝানো উচিত, জাপানের উপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা উচিত নয়। সেক্ষত্রে যুদ্ধ পরবর্তীকালে হাজার হাজার নাগরিকের হত্যাকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্বন্ধে মানুষের মনে বিরূপতা তৈরি হবে। বোমার আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাতেও বাধা তৈরি হবে। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের অধিকার সমরবিদদের উপর ছেড়ে রাখা ঠিক নয়। অন্তর্বর্তী কমিটির কাছে পাঠানো আবেদনটি ট্রুম্যানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ট্রুম্যান ওই আবেদনে গুরুত্ব দেননি।

কার্যত পরাজিত জাপানকে লক্ষ্যস্থল হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। জার্মানির পরাজয় এবং ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলারের মৃত্যুর পরেও হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে বোমা ফেলায় কিন্তু ওপেনহাইমারের সমর্থন ছিল (অবশ্য বিস্ফোরণের পর তাঁর তীব্র অনুশোচনা হয়)। তাঁর ধারণা ছিল তারপর সব যুদ্ধই চিরকালের মতো থেমে যাবে। সেই কারণে জিলার্ড তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এলেও তিনি তাঁকে আমল দেননি, তিনি এতটাই উদ্ধত। অগস্ট মাসের ৬ ও ৯ তারিখে জাপানের দুই শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ হল। ঐতিহাসিকরা বলেন, জাপানের আত্মসমর্পনের জন্য বোমা ফেলার কোনওই প্রয়োজন ছিল না। স্তালিনের রাশিয়াকে ভয় দেখাতে এবং যুদ্ধপরবর্তী পৃথিবীতে তাদের কোনঠাসা করতে তার প্রয়োজন ছিল। এসব কথা অবশ্য ছবিতে বলা হয়নি।

দর্শকরা লস অ্যালামসে ছবিটির একটি দৃশ্যে দেখছেন যে, বিজ্ঞানীরা বোমা পড়ার পর হিরোশিমা ও নাগাসাকি থেকে ধ্বংসের ছবির স্লাইড শো দেখছেন। দর্শককে কোনও ছবিই দেখানো হয়নি। তার বদলে আমরা সেই ছবি দেখে ওপেনহাইমারের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। সেই স্লাইড প্রেজেন্টেশন ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে গিয়ে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে পুড়ে যাওয়া কালো লাশের ওপর পা পড়ে ওপেনহাইমারের। মনে হবে পরিচালক নোলানের মতো আর কেউ এমন নির্ভুলভাবে তা ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকির মানুষের জীবনে পরমাণু বোমার ভয়াবহ বিপর্যয় না দেখিয়েও তিনি বোমা ফেলার সমর্থক ওপেনহাইমারের জীবনযন্ত্রণা নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

হিরোশিমায় সফলভাবে বোমা ফেলার সংবাদ আসার পর ওপেনহাইমার মানসিকভাবে বিপুল ধাক্কা খেলেও জানতেন লস অ্যালামসের অধিকর্তা হিসাবে তাঁর সবাইকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত এবং প্রফুল্ল থাকা উচিত। বুঝেছিলেন তাঁর উল্লসিত সহকর্মী ও অধস্তনদের সামনে তাঁকে বক্তৃতা দিতে হবে। কিন্তু ‘জাপানিরা হয়তো এটা আশা করেনি’ জাতীয় কিছু বোকা কথা তুতলিয়ে বলেই বুঝলেন কথাগুলো ঠিক হচ্ছে না। এরপরই তাঁর জাপানে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণের বিভীষিকার হ্যালুসিনেশন শুরু হয়ে যায়। ওই বিভীষিকার গুড়গুড় শব্দ যেন তাঁর দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দেয়। বিষয়টা তখনই পরিষ্কার হল যখন তিনি ভাবছিলেন, এই সাদা চামড়ার মার্কিনরা যে লস অ্যালামসে তাঁর ‘জয়’-এর জন্য উৎসব করছে, তাদের উপর যদি আঘাতটা আসত কী হাল হত। পরিচালক নোলানের সিদ্ধান্ত জাপানে বিস্ফোরণের বিভীষিকা দেখাবেন না, আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবেন। তাঁর জীবনের বিয়োগান্তক ঘটনার সঙ্গে থাকবেন। তাই জাপানের সেই বিভীষিকার কথা বলা হয়েছে খুবই কম।

যুদ্ধের পর সাপ্তাহিক টাইম পত্রিকায় ওপেনহাইমারকে নিয়ে প্রচ্ছদ নিবন্ধ লেখা হয়। এরপর হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ওপেনহাইমারের মুখোমুখি হন। ট্রুম্যানের সামনে ওপেনহাইমারকে দেখে যেন মনে হয় তিনি সেখান থেকে মুক্তি চাইছিলেন, বলছিলেন, “আমার হাতে রক্ত লেগে রয়েছে।” বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ ট্রুম্যান কড়াভাবে তাঁকে বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসাবে সমস্ত কিছুর দায় তাঁর। তিনি ওপেনহাইমারকে জিজ্ঞেস করেন, “তিনি কি মনে করেন জাপানিরা ভাবছে কে বোমা বানাল? না, তারা শুধু জানতে চায় কে বোমা ফেলেছে।” বিরক্ত ট্রুম্যান তাঁর রাষ্ট্রসচিব ডিন অ্যাচেসনকে তখনই বলেন, তিনি আর কখনও এই ক্রাই বেবিকে দেখতে চান না।

বোমা ফেলার আট দিনের মাথায় পরমাণু বোমা তৈরির মুখ্য কারিগর ওপেনহাইমার আমেরিকার যুদ্ধসচিবকে এক চিঠিতে ক্রমাগত পরমাণু অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি আনা সম্ভব কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এরপর অক্টোবর মাসেই তিনি লস অ্যালামসের কাজ ছেড়ে দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজের ডিরেক্টর হন। নতুন তৈরি হওয়া মার্কিন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রভাবশালী জেনারেল অ্যাডভাইসরি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৪৯-৫০ সালে হাইড্রোজেন বোমা তৈরির বিরোধিতা করেন, যার জন্য মার্কিন প্রশাসন ও কিছু সামরিক কর্তার বিরাগভাজন হন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকার অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ায় তাঁর উদ্বেগ শুরু হয়। তাঁর ইউটোপিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙে যায় যখন সহবিজ্ঞানী এডয়ার্ড টেলরের উদ্যোগে হাজারগুণ বেশি ধ্বংসাত্মক হাইড্রোজেন বোমা তৈরি হয়।

পঞ্চাশের দশকে তিনি মোহমুক্ত, আপসকারী প্রশাসক। সেলিব্রিটি হওয়ার জন্য তাঁর মন তেতো হয়ে রয়েছে। জার্মানি আত্মসমর্পন করার পরও পরাজিত জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকিতে বোমা ফেলা হয়েছে রাশিয়াকে বোঝাতে যে আমেরিকার হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে— এই চিন্তাও তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে।

পরবর্তীকালে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে যে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয় তা থামাতে ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি সাবধান করেন যে, এই নতুন অস্ত্র তৈরি করাকে উপলক্ষ করে প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। তা থেকে অনেকের আর্থিক লাভ হবে ঠিকই, তবে ‘শান্তিপূর্ণ পরমাণু’ অতিকথা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং সভ্যতার অস্তিত্বও ক্রমাগত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। ৭০ বছর পর আজ কিন্তু ওপেনহাইমারের সেই উদ্বেগ সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে বছরই জুলাই মাসে ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ এবং পরে ‘দ্য বুলেটিন অফ দ্য অ্যাটোমিক সায়েন্টিস্টস’-এ পুনঃপ্রকাশিত এক প্রবন্ধে যুদ্ধ-পরবর্তীকালে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধিমূলক প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। বলেন, এইসব অস্ত্রের দ্রুত বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়। এর ফল এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও বেড়ে চলা পরমাণু অস্ত্রের ক্ষমতা সম্বন্ধে প্রতিটি মানুষের গভীরভাবে জানা উচিত। তিনি আরও লেখেন, পরমাণু অস্ত্রের উন্নয়ন ঘিরে যে গোপনীয়তা, সন্দেহ ও শত্রুতা থাকে তা থেকে যাদের এই অস্ত্র রয়েছে তাদের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়ে। নানা উপলক্ষে বারেবারে বক্তৃতা, প্রবন্ধের মাধ্যমে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য তিনি সক্রিয় হয়েছেন, পারমাণবিক বোমার বিপদ নিয়ে বলেছেন। কিন্তু যে রাষ্ট্র পরমাণু বোমা থেকে পৃথিবী জয়ের নতুন ক্ষমতা অর্জন করেছে সে কিন্তু তাঁকে ভাল চোখে দেখেনি।

রাষ্ট্র, সরকার ও নাগরিকের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ও সম্মানের জন্য আমেরিকার অ্যাটমিক কমিশনের চেয়ারম্যান লিউইস স্ট্রস অনেক আগে থেকেই তাঁকে ইর্ষা করতেন। হয়তো এর জন্য ওপেনহাইমারের অসৌজন্য, ঔদ্ধত্তও কিছুটা দায়ী। স্ট্রসের কারসাজিতেই যৌবনে তাঁর ভাই ফ্র্যাঙ্ক, স্ত্রী কিটি এবং প্রাক্তন প্রেমিকা জঁ টেটলকের মাধ্যমে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত এবং তিনি রাশিয়ার জন্য গোয়েন্দাগিরি ছাড়াও বোমা তৈরিতে তাদের সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। ওপেনহাইমারের প্রতিভা, তাঁর কাজ, আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং যুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রজেক্টে তাঁর ভূমিকা— কিছুই তাঁকে রাজনৈতিকভাবে নাস্তানাবুদ হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেনি। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেনেটর জোসেফ ম্যাককার্থির নেতৃত্বে প্রচার চলে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানে কমিউনিস্ট এবং সোভিয়েতের প্রভাব ও গুপ্তচরবৃত্তি চলছে। ম্যাককার্থাইটসরা অ্যান্টি-কমিউনিস্ট জিগির তুলে তাঁকে রাজনৈতিক নিপীড়ন করেছে, তাঁর পিছনে লেগে চরম হেনস্থা করেছে। ১৯৫৪ সালে রাজনৈতিকভাবে এইসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ নিয়ে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স হিয়ারিং হল, যাকে ডাইনি খোঁজা বলা যেতে পারে। দীর্ঘ শুনানির পর তিনি অভিযোগমুক্ত হলেও তাঁর নিরাপত্তা-ছাড় তুলে নেওয়া হয়। লিউইস স্ট্রস তাঁর সুনামকে কিছুটা কলঙ্কিত করতে এবং সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স আটকাতে সমর্থ হলেন। দেখা গেল, ওপেনহাইমার আমেরিকাকে পৃথিবীর অধীশ্বর বানানোর পরও সে দেশের শাসকরা এই মুক্তমনের বুদ্ধিজীবীকে হজম করতে পারছে না।

গল্প বলতে বলতে ছবিটি কখনও এগিয়ে পিছিয়ে গেছে। কিন্তু পাশাপাশি ওপেনহাইমারের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন সিকিউরিটি হিয়ারিং (১৯৫৪ সালে) এবং লিউইস স্ট্রসের কংগিগ্রেশনাল কনফার্মেশন হিয়ারিং হচ্ছে (১৯৫৯ সালে) দেখে দর্শক ভাববেন তা বোধহয় কাছাকাছি সময়ে সমান্তরালভাবে চলেছিল। প্রথমটি ছিল ওপেনহাইমারকে কলঙ্কিত করার জন্য লিউইস স্ট্রসের চাল। দ্বিতীয়টি লিউইস স্ট্রসের ক্যাবিনেটে স্থান পাওয়ার (অ্যাকটিং সেক্রেটারি অফ কমার্স) জন্য শুনানি। দুটিই পাশাপাশি চলেছে দেখে দর্শক ভুল বুঝতে পারেন। হয়তো মনে করবেন দুটি শুনানি একই বছর হয়েছিল। হিয়ারিং-এ স্ট্রসের ভূমিকা এবং ওপেনহাইমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং অন্য সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় ওপেনহাইমার সহ যেসব বিজ্ঞানীরা ম্যানহাটন প্রজেক্টে ছিলেন তাঁরা কেউই স্ট্রসকে পছন্দ করতেন না।

 

ছবির শেষে দেখা যায় ১৯৪৭ সালে ওপেনহাইমার আইনস্টাইনকে বলছেন, আমি যখন আপনার কাছে ওই হিসাব নিয়ে এসেছিলাম, আমরা ভেবেছিলাম এমন শৃঙ্খল বিক্রিয়া শুরু হবে যে তাতে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আইনস্টাইন বলেন, কী হল তারপর? ওপেনহাইমার বিষন্ন স্বরে বললেন, আমার বিশ্বাস আমরা তা করেছি।

তারপরই সারি সারি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র। ছুটে যাওয়া ওই ক্ষেপণাস্ত্রের বাষ্প আকাশকে ছিন্ন করে দিচ্ছে, এই গ্রহে যেন আগুন লেগে গেছে, আর অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন ওপেনহাইমার। এমনই নাটকীয় দৃশ্য দিয়ে ছবিটি শেষ হয়। চিত্রপরিচালকের দক্ষ হাতে দৃশ্যটি এমন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে যে তা দর্শককে তাড়া করে ফেরে।

১৯৪৫ সালের পর থেকে আরও আটটি দেশ এই অস্ত্র তৈরি করেছে। পৃথিবী কিন্তু বেশি নিরাপদ হয়নি। ওপেনহাইমার যেমন বলেছিলেন ঠিক তাই ঘটেছে, পরমাণু অস্ত্রাগার বেড়ে ওঠায় বিশ্বশান্তি নিশ্চিত হয়নি। সেই সময় যা ভাবা যেত না, আজ ইউরোপেও ওই ভয়ানক অস্ত্র ব্যবহারের ভয় রয়েছে।

পৃথিবীর মানুষের উপর পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছে আমেরিকা। সে কাজ ক্ষমার অযোগ্য। ওপেনহাইমার ছিলেন পরমাণু বোমা তৈরির মুখ্য কারিগর। বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত তাঁর না হলেও তিনি মনুষ্যবসতি অঞ্চলে বোমা ফেলার সমর্থক ছিলেন। মনে করতেন, তারপর সব যুদ্ধ চিরকালের মতো থেমে যাবে। ম্যানহাটন প্রকল্পের কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মানুষের উপর বোমা না ফেলার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে তিনি সামিল হননি। এমন একজন মানুষের জীবন নিয়ে ছবি করা অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আসল কথাটাই লিখলেন না;
    জাপানকে বেছে নেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাদের বাদামী চামড়া।সেই কারনে সাদা চামড়ার জার্মানী বা ইতালিকে না বেছে বাদামী চামড়ার দেশ জাপানকে পরীক্ষাগার হিসাবে বেছে মানব জাতির অন্যতম শত্রু আমেরিকা।
    সেই বিষয়টাকে ধামা চাপা দিতে আরেক ঘৃন্য অপরাধীকে মহান বিজ্ঞানী প্রতিপন্ন করার মার্কিনি অপচেষ্টার উদাহরণ এই সিনেমাটি।

আপনার মতামত...