পথ দেখাচ্ছে ইকুয়েডর

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


বনভূমি, জীবজন্তু, মানুষ, পরিবেশ, এই সমস্ত কিছুকে বাঁচাতে, ইকুয়েডরের সাধারণ মানুষ ও জনজাতিদের প্রতিনিধিস্বরূপ বিরাট জনতা এই গণভোটের মাধ্যমে যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখালেন, বিশ্বের অনেক তাবড় দেশেরই সেই উদাহরণ থেকে শিক্ষালাভ করা উচিত

 

 

দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ছোট্ট এক দেশ ইকুয়েডর। তবু সেই ছোট্টটি হলেও সম্প্রতি সে-দেশের মানুষ বিশেষ এক গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। ২১ আগস্ট ২০২৩, ইকুয়েডরের মানুষ বিশেষ এক গণভোটের মাধ্যমে সে-দেশের আমাজন অববাহিকা অঞ্চলে, ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান এলাকাতে খনিজ তেল উত্তোলন সংক্রান্ত সমস্ত প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৬০ শতাংশ উত্তোলন বন্ধের পক্ষে গেছে, বিপরীতে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে উত্তোলন জারি রাখার পক্ষে। এর ফলে প্রায় ৭২.৬ কোটি ব্যারেলের সমপরিমাণ খনিজ তেল মাটির নিচেই থেকে যাবে। এই গণভোটের ফলাফলের কারণে, সেই তেল উত্তোলনের জন্য আমাজন অববাহিকার এই বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চল, যা ইকুয়েডরের ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত, সেখানে কোনও ধরনের পরিবেশ-ধ্বংসকারী খননকার্য চালানো যাবে না। এর পাশাপাশি, গণভোটের আরও একটি প্রশ্নের জবাবে, ইকুয়েডরের মানুষ সে-দেশের কুইটো প্রদেশের চকো আন্দিনো উচ্চভূমিতে সোনার খনির কাজ বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই রায়ের পক্ষে ভোট পড়েছে ৬৮ শতাংশ, বিপক্ষে ভোটের হার ৩১ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্ব-উষ্ণায়ন ও পরিবেশ পরিবর্তনের এই করাল সময়ে দাঁড়িয়ে এ-ধরনের সাহসী ও কার্যকরী পদক্ষেপ যে কতখানি প্রয়োজনীয় ছিল, তা বোধহয় আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যে কথা সবচেয়ে বেশি করে বলা প্রয়োজন তা হল, বিশ্বের তাবড় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি যে কাজ করে দেখাতে পারেনি, তাদের চেয়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতার নিরিখে অনেক পিছিয়ে থাকা সামান্য দেশ ইকুয়েডর জনতার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সম্মতির মাধ্যমে এমন একটি পদক্ষেপ নিয়ে দেখাল। এই সিদ্ধান্তের ফলে ইকুয়েডর সাধারণ অর্থনীতির তত্ত্বে, ও আন্তর্জাতিক পরিসরে পুঁজিবাদী উন্নাসিকতা ও চক্রান্তের কারণে ঠিক কতখানি ক্ষতি স্বীকার করবে, সেই বিষয়েই বরং আলোচনা করা যাক।

খনিজ তেল ইকুয়েডরের অর্থনীতির একটি বড় উপাদান। ইকুয়েডরের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের ৪০ শতাংশই হল খনিজ তেল অথবা সেই সংক্রান্ত দ্রব্য। এমন বিপুল পরিমাণে খনিজ তেল রপ্তানি করে বলেই, সেই দেশ মোটের উপরে ধনাত্মক একটি বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত পরিসংখ্যান বা trade surplus বজায় রাখতে পারে। বাণিজ্যিক উদ্বৃত্তের বিষয়টিকে যদি সবচেয়ে সহজ করে বোঝাতে হয় তাহলে বলব, কোনও দেশের ক্ষেত্রে যদি আমদানির চেয়ে রপ্তানির পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে সেই দেশ এক ধনাত্মক বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত বা positive trade surplus-এর বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছে বলা হয়ে থাকে। তথ্য বলছে খনিজ তেল অথবা তৈলজাত দ্রব্যের নিরিখে ইকুয়েডর সবসময়েই ধনাত্মক বাণিজ্যিক উদ্বৃত্তের পরিসংখ্যান দাখিল করে এসেছে। বিপরীতে অন্যান্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে ইকুয়েডর রপ্তানির চেয়ে আমদানির উপরেই বেশি নির্ভর করেছে। কাজেই ইকুয়েডরের অর্থনীতির উপর খনিজ তেল বা সেই সংক্রান্ত শিল্পের প্রভাব যে কতখানি তা বোধহয় এই তথ্য পেশের মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে গেল। তথ্য বলছে ইকুয়েডরের মাটির গভীরে মোট সঞ্চিত খনিজ তেলের পরিমাণ প্রায় ৬৫১ কোটি ব্যারেলের সমতুল। ইকুয়েডরে, ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ৪,৩৫,০০০ ব্যারেলের সমপরিমাণ খনিজ তেল উত্তোলিত হয়ে থাকে। ২১ আগস্ট গণভোটের যে রায়, তার প্রেক্ষিতে আজ, অন্ততপক্ষে ৭২.৬ কোটি ব্যারেলের সমপরিমাণ তেল যে অংশে সঞ্চিত রয়েছে, সেই অঞ্চলে সমস্ত ধরনের খননকার্য বন্ধ হয়ে যেতে পারল। অর্থাৎ, মোট সঞ্চিত তেলের প্রায় ১১.১৫ শতাংশ আর কোনওদিনই উত্তোলিত হবে না বলে সে-দেশের মানুষ সরাসরি জানিয়ে দেওয়ার সাহস দেখালেন। এর ফলে পশ্চিমি বিশেষজ্ঞেরা কেমনভাবে ইকুয়েডরের মানুষকে ‘সন্ত্রস্ত’ করেছেন?

গণভোটের অনেক আগে থেকেই অর্থনীতিবিদেরা ইকুয়েডরের মানুষকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, এমন ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া হয়, তাহলে সেদেশের অর্থনীতির উপর চরম প্রভাব নেমে আসবে। ইকুয়েডরে বেকারত্বের হার এই মুহূর্তে প্রায় ৫ শতাংশ (টিপ্পনিতে বলে রাখি, আমাদের দেশে এই মুহূর্তে বেকারত্বের হার প্রায় ৭.৯৫ শতাংশ)। এই মুহূর্তে ইকুয়েডরের মাথার উপরে ঝুলতে থাকা আন্তর্জাতিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫,৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থনীতিকেরা সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যানের যে তৈলভাণ্ডার, সত্যিই যদি তার উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে ইকুয়েডরের অর্থনীতিকে বার্ষিক প্রায় ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের ঘাটতি বইতে হবে। এই সিদ্ধান্তের পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ফিচ সল্যুশনসের তরফে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইকুয়েডরের স্বীকৃতি-সূচক বেশ কয়েক ধাপ নামিয়ে ‘সিসিসি+’ স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর অর্থ হল, বাণিজ্য বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইকুয়েডরকে তারা মোটেই আর ‘সুবিধাজনক’ বা ‘বাণিজ্য-বান্ধব’ বলে মনে করছে না। পরিবেশ-বান্ধব হতে গিয়ে, এভাবেই ইকুয়েডরকে আজ মূল্য চোকাতে বাধ্য করা হচ্ছে।

যদিও ইকুয়েডরের লড়াই থেমে থাকছে না। ২০০৭ সাল থেকেই, এই ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান অঞ্চলে পরিবেশ-বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন হয়ে এসেছে। সেই বছরই ইকুয়েডরের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রাফায়েল ক্যরিয়া সারা পৃথিবীর কাছে আমাজন অববাহিকার এই ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান অঞ্চলে খনিজ তেল উত্তোলন বন্ধের প্রচেষ্টায় এক মৌলিক ও অভূতপূর্ব সমাধান প্রস্তাব রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান অঞ্চলে প্রায় ৮৫ কোটি ব্যারেলের সমপরিমাণ খনিজ তেল সঞ্চিত রয়েছে।” সেই সময়ের বাজারদর হিসেবে যার মূল্য ছিল প্রায় ৭২০ কোটি মার্কিন ডলার। ক্যরিয়া প্রস্তাব দেন, এই বাজারমূল্যের অন্তত ৫০ শতাংশ যদি সারা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি আমাজন অববাহিকা রক্ষার্থে একটি ফান্ড হিসেবে ইকুয়েডরের হাতে তুলে দেয়, তাহলে তিনি সেই অববাহিকা অঞ্চলে খনিজ তেল উত্তোলনের কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দেবেন। কোনও সময়ে, কোনও এক বিখ্যাত মানুষকে বলতে শুনেছিলাম, desperate times call for desperate measures, পরিবেশ পরিবর্তনের এই অভূতপূর্ব সময়ে রাষ্ট্রপতি রাফায়েল তেমনই এক অভূতপূর্ব সমাধানেরই বার্তা দিয়েছিলেন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি, স্বভাবতই এমন সমাধানের প্রস্তাব ‘হজম করে উঠতে পারেনি’। ২০১৩ সালে ক্যরিয়া এই প্রচার বন্ধ করেন, ও প্রায় ২০০০ হেক্টর পরিমাণ বনভূমি অঞ্চলে খনিজ তেল উত্তোলনের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেন।

প্রায় দশক পেরিয়ে ২০২৩-এ আজ, আবারও ইকুয়েডরের মানুষ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে সদর্থক অবদান রাখলেন। আসলে আমাদের ‘উন্নত’ রাষ্ট্রনায়কেরা নিজেদের সুবিধার ক্ষেত্রে সামান্যতম ত্যাগ স্বীকার করতেও অস্বস্তি বোধ করেন। পরিবেশ পরিবর্তন প্রতিরোধের সম্মেলনেও তাই তাঁরা ব্যক্তিগত চার্টার্ড বিমানে করে উড়ে আসেন। সম্প্রতি আবার, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সূনক তাঁর এই চার্টার্ড বিমানসফরের সপক্ষে নির্লজ্জ সাফাই গেয়ে বলেছেন, তাঁদের নাকি ‘অনেএএএক’ কাজ করতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। ভুললে চলবে না, এই নির্লজ্জ মানুষটিই আবার তাঁর গ্রামের খামারবাড়িতে এমনই এক আধুনিক স্যুইমিং পুল বানিয়েছেন, যার সমুদ্র-নীল জলের উষ্ণতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অত্যাধুনিক ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এর প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গোটা বৈদ্যুতিন নেটওয়ার্কটিকেই নতুন করে সব উপড়িয়ে ফেলে নির্মাণ করতে হয়েছে। এঁরা অথবা এঁদের আত্মীয়-বন্ধুরাই আবার পরিবেশ পরিবর্তন প্রতিরোধে লম্বাচওড়া ভাষণ দিয়ে থাকেন। উপদেশ বর্ষণ করেন উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলির উদ্দেশ্যে। নিজেরা আরামে থাকেন চার্টার্ড বিমানে, উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা-সম্বলিত স্যুইমিং পুলের গভীরে গা ভাসান।

ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান অঞ্চল ১৯৮৯ সাল থেকেই ইউনেস্কোর বিধান অনুসারে অন্যতম বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। এই অরণ্যে প্রায় ৬১০ ধরনের পাখি, ১৩৯ ধরনের উভচর প্রাণী ও ১২১ ধরনের সরীসৃপ দেখা যায়। এছাড়াও এই অরণ্যে তাগায়েরি ও তারোমিনানি, এই দুই আদিম জনগোষ্ঠীর বসবাস। পৃথিবীর অন্যতম শেষ দুই প্রজাতি এই তাগায়েরি ও তারোমিনানি, যাদের আধুনিক সভ্যতার বিষ এখনও অবধি স্পর্শ করে উঠতে পারেনি। এই সমস্ত কিছুকে বাঁচাতে, ইকুয়েডরের সাধারণ মানুষ ও জনজাতিদের প্রতিনিধিস্বরূপ বিরাট জনতা এই গণভোটের মাধ্যমে যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখালেন, বিশ্বের অনেক তাবড় দেশেরই সেই উদাহরণ থেকে শিক্ষালাভ করা উচিত।

 

কৃতজ্ঞতা: উপায়ন চট্টোপাধ্যায়

সূত্র:


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...