ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন

অমিতাভ গুপ্ত

 


মাইকেল কলিন্স লক্ষ রাখছিলেন, ৫০ বছর বা তারও কিছু বেশি সময় আগে, ঈগল ল্যান্ডার-যানে চড়ে, নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করতে চলেছেন। তার পরবর্তীতে চন্দ্রপৃষ্ঠে একাধিক, অভিযাত্রী-সহ অথবা অভিযাত্রী-বিহীন রকেট অবতরণ করেছে। মহাকাশ গবেষণায় অগ্রগণ্য একাধিক দেশের তরফে, তাদের মধ্যে আমাদের দেশও রয়েছে, চন্দ্রপৃষ্ঠে অভিযাত্রী-বিহীন ল্যান্ডার বা উপগ্রহের নিখুঁত অবতরণের বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে নাসার মতো সাফল্য অর্জন করতে আর কোনও দেশই পারেনি। তাহলে নিল আর্মস্ট্রংয়ের সহায়তা ছাড়া, কোনও ঈগল ল্যান্ডারকে অভিযাত্রী-বিহীন অবস্থায় চন্দ্রপৃষ্ঠে নামিয়ে আনার বিষয়টিকে কোনদিক থেকে দেখলে এত বেশি পরিমাণে জটিল বলে মনে হয়?

 

শিরোনাম দেখে অনেকেই ধরে ফেলতে পারেন সেটি ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত জুল ভার্নের একই নামের যে কালজয়ী উপন্যাস, তার অনুপ্রেরণাতেই লেখা। এর কারণ কেবল এই নয় যে, আমি তাঁর লেখার একজন বড় ভক্ত। তার চেয়েও বড় কারণ যেভাবে ভার্ন আইজ্যাক নিউটনের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য চন্দ্র-অভিযানের বিষয়ে ধারণা দিয়েছিলেন তা সবসময়ে আমাকে, বিশেষত ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে, অরবাইটাল মেকানিক্স বা কক্ষপথে ঘূর্ণনের ধারণা বা সেই সম্পর্কিত গতিবিদ্যার তত্ত্বের মুখবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে।

যাঁরা উল্লিখিত বইটি পড়েছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে বাল্টিমোর গান ক্লাবের সেই সদাব্যস্ত, কর্মোদ্যোগী সভাপতি মিঃ ইম্পে বার্বিকেনের চরিত্রের সঙ্গে সুপরিচিত। আসুন আমরা বরং তাঁরই সঙ্গে ফ্লোরিডার ট্যাম্পায় সেই যে পাহাড়, স্টোনস হিল, তারই উপরে গিয়ে দাঁড়াই। যেখান থেকে তাঁরই তৈরি সেই ‘কলম্বিয়ান স্পেস গান’টিকে ব্যবহার করে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিবেগে কোনও একটি বস্তুকে চাঁদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেওয়া হবে। এখন সেই বস্তুটির ভবিষ্যৎ কী হতে পারে সেই বিষয়ে চিত্র ১-এ কিঞ্চিৎ ধারণা দেওয়া হয়েছে। যেমনই কামানটিকে ছোড়া হবে, অমনিই সেই বস্তুটি খানিক দূরে উড়ে গিয়ে আবার পৃথিবীপৃষ্ঠেই এসে পড়বে। আরও একটু জোরে যদি ছোড়া হয়, তাহলে বস্তুটি হয়তো আরও একটু দূরে গিয়ে, পৃথিবীর মোটামুটি অর্ধেক অংশ পেরিয়ে কোথাও গিয়ে পড়বে। এবারে এইভাবে বাড়তে বাড়তে যদি নির্দিষ্ট একটি গতিবেগকে ছাড়িয়ে গিয়ে বস্তুটিকে ছোড়া হয়, তাহলে এটি গোটা পৃথিবীকেই পাক খেয়ে এসে, সেই একই পথে আবারও ঘুরে চলতে চেষ্টা করবে। এই পাক খেয়ে আসার পথটিকেই আমরা কক্ষ বলে অভিহিত করব। প্রধান যে বিষয়টি এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, এই পরীক্ষায় সাফল্য পেতে গেলে স্টোনস হিলের উচ্চতা অস্বাভাবিক রকমের বেশি হওয়া প্রয়োজন, যাতে কামান থেকে ছোড়া বস্তুটি নিচে পড়তে শুরু করার আগেই পর্যাপ্ত উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে এবং আবহমণ্ডলের উপস্থিতির কারণে যে ঘর্ষণ বল বস্তুটির গতিবেগকে ক্রমশ কমিয়ে আনে— সেই ঘর্ষণ বলের মাধ্যমে গতিবেগ কমিয়ে আনার ঘটনাটি বস্তুর উপরে উপযুক্ত প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়। এভাবেই ছুড়ে দেওয়া বস্তুটি ক্রমশ একটি কৃত্রিম উপগ্রহে পরিণত হতে পারে।

আরও একটি বিষয় এখানে মনে রাখা প্রয়োজন। উপগ্রহটি কিন্তু এক্ষেত্রে পৃথিবী অভিকর্ষ বলের যে প্রভাব, তাকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে চলে যায় না। বরং বস্তুটির বহির্মুখী যে প্রচণ্ড গতিবেগ, সেটিই পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের সঙ্গে একটি ভারসাম্য স্থাপন করে যা কিনা উপগ্রহটিকে ক্রমাগতই পৃথিবীর দিকে টেনে আনতে চায়, এবং উপগ্রহটি পৃথিবীর দিকে পড়তে পড়তে নিজকক্ষে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় থাকে। এবারে, একটি রকেট যদি এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যা সেই বস্তু বা উপগ্রহটিকে আরও বেশি উচ্চতায় তুলে দিতে সক্ষম, ধরে নেওয়া যাক ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি উচ্চতায়, যেখানে আবহমণ্ডলের অস্তিত্ব ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে এসেছে, এবং সেই রকেট যদি উপগ্রহটির গতিবেগকে এমনই এক অবস্থায় পৌঁছে দিতে পারে— যা কিনা পৃথিবীর অভিকর্ষ-জনিত বলকে তুচ্ছ করে বেরিয়ে যেতে সক্ষম, তাহলেই আমরা শুরুতে বলে আসা সেই বিরাট উঁচু পাহাড় আর কামানের প্রয়োজনীয়তা ঝেড়ে ফেলতে পারব।

চিত্র ১

উপগ্রহটিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া রকেট, সেটিকে একটি বৃত্তাকার অথবা উপবৃত্তাকার কক্ষে স্থাপন করতে পারে। কোনও মহাজাগতিক বস্তুর চারপাশে ঘূর্ণায়মান একটি উপগ্রহ যে বিন্দুতে মহাজাগতিক বস্তুটির সবচেয়ে কাছে আসে, মহাকাশবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় অনুভূ (perigee); আবার যে বিন্দুতে উপগ্রহটি মহাজাগতিক বস্তুটির থেকে সবচেয়ে দূরে চলে যায়, মহাকাশবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় অপভূ (apogee)। অনেক ক্ষেত্রে perigee শব্দটিকে periapsis শব্দ দিয়েও ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে, বিশেষত যখন অনুভূ-বিন্দুটি যে মহাজাগতিক বস্তুটিকে ঘিরে উপগ্রহটি পাক খাচ্ছে, তারই উপরে অবস্থিত হয়। অনুভূ-বিন্দুতে উপগ্রহের গতিবেগ সবচেয়ে বেশি ও অপভূ বিন্দুতে সবচেয়ে কম হয়। তদুপরি, উপগ্রহটিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া রকেট যদি অপভূ-বিন্দুতে উপগ্রহটিকে উৎক্ষেপণ করে, সর্বোচ্চ গতিবেগ অর্জনের বিষয়টি মাথায় রেখে, সেই ক্ষেত্রে অনুভূ-বিন্দুটির অবস্থান ক্রমশ বাড়তে শুরু করে ও উপবৃত্তের পরিবর্তে বৃত্তাকার একটি কক্ষের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনাকে apogee kick বলে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, উপগ্রহটিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া রকেট যদি অনুভূ-বিন্দুতে উপগ্রহটিকে উৎক্ষেপণ করে, সর্বোচ্চ গতিবেগ অর্জনের বিষয়টি মাথায় রেখে, সেই ক্ষেত্রে অপভূ-বিন্দুটির অবস্থান ক্রমশ বাড়তে শুরু করে ও বৃত্তের পরিবর্তে উপবৃত্তাকার একটি কক্ষের সৃষ্টি হয়। রকেটের গতিপথের উলটো-মুখে উপগ্রহকে উৎক্ষেপণ করলে, উপগ্রহের গতিবেগ হ্রাস পায় ও কক্ষে অপভূ এবং অনুভূ দুই বিন্দুরই অবস্থান কমে আসে। উপগ্রহটিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া রকেট এভাবে একাধিকবারে নিজের জ্বালানির সাহায্যে উৎক্ষেপণের অবস্থা সৃষ্টি করে ও উপগ্রহের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। শেষতম কক্ষে পৌঁছলে আর রকেটের মাধ্যমে এমন উৎক্ষেপণের প্রয়োজন থাকে না। রকেটে চেপে আন্তঃগ্রহ যাতায়াতের ক্ষেত্রে এমনই প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়। যদিও, চাঁদ অথবা মঙ্গলের মতো কোনও অভিযানের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই গতিপথ পরিবর্তনকে সুনিশ্চিত করতে উপগ্রহের সঙ্গে ‘থ্রাস্টার’ লাগানো থাকে যা তার গতিপথকে অবস্থা-বিশেষে পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। প্রধানত কোনও গ্রহ বা উপগ্রহে নামার প্রয়োজন থাকলে এই ‘থ্রাস্টার’ প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়।

উপরের বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে এবারে চাঁদের কক্ষপথের বিষয়ে আসা যাক। পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদ মোটামুটি উপবৃত্তাকার একটি কক্ষপথে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। এই উপবৃত্তের বিকেন্দ্রতার মান হল প্রায় ০.০৫৪৯, যা কিনা প্রায় বৃত্তাকারই বলা যেতে পারে। এই কক্ষ অনুযায়ী পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্বের পরিমাণ হল ৩,৮৪,৭৪৮ কিলোমিটার। এই কক্ষের অনুভূ-বিন্দু পৃথিবী থেকে ৩,৬৪,৩৯৭ কিলোমিটার এবং অপভূ-বিন্দু ৪০৬,৭৩১ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে।[1] চাঁদের কক্ষতল পৃথিবীর কক্ষতলের তুলনায় সামান্য একটি কোণে হেলে থাকে, জটিলতা এড়াতে এই আলোচনায় আমরা সেই হেলে থাকার বিষয়টিকে ধারণার মধ্যে আনছি না। চিত্র ২-তে পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদের কক্ষের একটি ছবি তুলে ধরা হল। সূর্যের তুলনায় চাঁদে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি লোভনীয় পথ বা বিকল্প কাজ করে, চিত্র ৩-এ সেই অবস্থাকেই তুলে ধরা হয়েছে। সেই চিত্রটিকে দেখলে মনে হবে চাঁদে যাওয়া যেন একটি রকেট জোগাড় করে পাশের বাড়িতে চলে যাওয়ার মতোই সহজ। মাত্র ৯ বার পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতেই চাঁদে পৌঁছে যাওয়া চলে। এভাবেই হার্জের অমর সৃষ্টি ‘চন্দ্রলোকে অভিযান’-এর কুশীলবেরা, যথাক্রমে প্রফেসর ক্যালকুলাস, টিনটিন ও ক্যাপ্টেন হ্যাডক চাঁদে গিয়েছিলেন। যদি এমন একটি রকেট কখনও তৈরি করা যায়, যাতে বিপুল পরিমাণে জ্বালানির বন্দোবস্ত থাকবে, তাহলেই এই গতিপথ অনুসারে, টিনটিন-ক্যালকুলাসের মতো চাঁদে ঘুরে আসা সম্ভব। যদিও এই প্রস্তাব অনেক দূর ভবিষ্যতের জন্য, কিন্তু একেবারেই এটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, বা অবাস্তব নয়। নাসা ইতিমধ্যেই পরমাণু-শক্তি চালিত রকেট তৈরির ক্ষেত্রে গবেষণা শুরু করেছে।[2]

এখনও পর্যন্ত, চন্দ্রাভিযানের বিষয়টি গতানুগতিক রকেট ও পৃথিবীর অভিকর্ষ বলেরই উপর নির্ভরশীল। কাজেই, প্রাথমিক কক্ষটিকে দিয়ে শুরু করে, রকেটের মাধ্যমে একাধিক উৎক্ষেপণের অবস্থা সৃষ্টি করে, ক্রমশ উপগ্রহটিকে বৃহত্তর অপভূ-বিন্দুবিশিষ্ট একাধিক উচ্চতর কক্ষে স্থাপন করা হয়। শেষ অবধি উপগ্রহটি গিয়ে পৌঁছয় একটি উপবৃত্তাকার ট্রান্সফার অরবিট বা স্থানান্তর কক্ষে (চন্দ্রযান-১ দ্রষ্টব্য), অথবা একটি বৃত্তাকার পার্কিং অরবিট বা বিশ্রামকক্ষে (অ্যাপোলো ১১ অভিযান দ্রষ্টব্য), যে অবস্থান থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর জন্য রকেটের মাধ্যমে অন্তিম উৎক্ষেপণটি করা হয়ে থাকে। চিত্র ২-তে পৃথিবীকে ঘিরে থাকা উপবৃত্তাকার প্রাথমিক কক্ষ ও আরও দূরের বৃত্তাকার বিশ্রামকক্ষের একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই শেষ উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হয় সেটি হল, স্থানান্তর অথবা বিশ্রামকক্ষের উপর এমন একটি উৎক্ষেপণ-বিন্দুকে বেছে নেওয়া যা কিনা অন্তিম উৎক্ষেপণ-পরবর্তী যে কক্ষ তার অপভূ-বিন্দুটিকে প্রায় চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর যে গড় দূরত্ব, তারই কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ফেলবে। এরফলে উপগ্রহটি ক্রমশ পৃথিবী ও চাঁদের অভিকর্ষ বলের ভারসাম্যকে ব্যবহার করতে করতে চাঁদের কাছে গিয়ে পড়বে, ও শেষ অবধি চাঁদের অভিকর্ষ বলের আকর্ষণে তার দিকে আকৃষ্ট হবে। চিত্র ৩-এ এই অবস্থার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই অবস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়, আমরা প্রতি মুহূর্তে চাঁদের নির্দিষ্ট ও নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম, অর্থাৎ কিনা আমরা প্রতি মুহূর্তে চাঁদের গতিবেগ ও সেই কথা মাথায় রেখে উপগ্রহের গতিপথকেও নির্ণয় করতে পারি। এ জিনিস সম্ভব না হলে, উপগ্রহ-বহনকারী রকেটে থাকা বিবিধ যন্ত্রের সাহায্যে আমাদের মাঝের সময়ে রকেটের গতিপথকে সংশোধন করতে হত— চন্দ্রযান-১-এর মতো।

চিত্র ২ ও ৩

এবারে চিত্র ৪-এর দিকে লক্ষ করা যাক। একবার চাঁদের অভিকর্ষ বলের আওতায় চলে আসতে পারলে, উপগ্রহটি প্রাথমিক চন্দ্র-কক্ষে প্রবেশ করে। ক্রমশ সেই কক্ষের পরিসীমা কমতে থাকে, ও উপগ্রহটি আরও নিম্নতর চন্দ্র-কক্ষে প্রবেশ করতে থাকে। এই নিম্নতর কক্ষ বৃত্তাকার আকৃতির হয়, যার ব্যাসার্ধ চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে কমবেশি ১০০ কিলোমিটার। অভিযাত্রী-বিহীন উপগ্রহের ক্ষেত্রে এই সময় রকেটের মাধ্যমে আবারও একটি উৎক্ষেপণের অবস্থা সৃষ্টি করা হয়, যা কিনা ক্রমশ অপভূ-বিন্দুকে কমিয়ে আনে ও উপগ্রহকে অবতরণ-কক্ষে নামিয়ে আনতে সাহায্য করে। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের পরিকল্পনা থাকলে, এই অবতরণ কক্ষের periapsis বিন্দুটি বা চন্দ্রপৃষ্ঠে অবস্থান করা অনুভূ-বিন্দুটিই সম্ভাব্য অবতরণ-স্থল বলে পরিগণিত হয়। যদি অভিযানের উদ্দেশ্য থাকে কেবলই চাঁদের চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া (যেমন, চন্দ্রযান-১), তাহলে উপগ্রহটি রকেট সমেত নিম্নতর চন্দ্র-কক্ষেই অবস্থান করে ও চাঁদের চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে ছবি তোলা ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে।

চিত্র ৪

বেশিরভাগ চন্দ্রাভিযান প্রকল্পের ক্ষেত্রে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের প্রয়োজনে চাঁদের মেরু অঞ্চলদুটিকেই বেছে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে অবতরণ-কক্ষে প্রবেশের সময়, যে মেরুতে অবতরণ ঘটবে, তার বিপরীত মেরুর উপরে উপগ্রহটি যখন অবস্থান করে, সেই সময়েই উৎক্ষেপণের অবস্থার সৃষ্টি করা হয় এবং অভিযাত্রী-বিহীন উপগ্রহটি চাঁদের অভিকর্ষ বলের আকর্ষণের উপর ভিত্তি করে, ক্রমশ ভাসতে ভাসতে চন্দ্রপৃষ্ঠে এসে নামে। যদিও, কেবলমাত্র অভিকর্ষ বলেরই উপর ভিত্তি করে যদি উপগ্রহটিকে অবতরণের সুযোগ দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে উপগ্রহটির আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই, চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১০ কিলোমিটার উপরে উপগ্রহটির সঙ্গে যুক্ত রকেট বা ‘থ্রাস্টার’গুলিকে চালু করা হয় ও নিয়ন্ত্রণাধীন অবতরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। অবতরণের ক্ষেত্রে এই সময়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সঙ্কটের সময়। যদি অভিযাত্রী-বিহীন রকেট হয় তাহলে অবতরণের সময় অতি সন্তর্পণে গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করে উল্কাগহ্বর অথবা পর্বতশৃঙ্গগুলিকে কাটিয়ে অবতরণের ব্যবস্থা করা হয়। যদিও চন্দ্রলোকে অভিযানের সময় প্রফেসর ক্যালকুলাস হিপারকাস উল্কাগহ্বরের কেন্দ্রেই তাঁদের রকেটটিকে নামিয়ে এনেছিলেন, বাস্তব পরিস্থিতিতে এমন কোনও উল্কাগহ্বরের চেয়ে সমতল জমিতে রকেটের অবতরণ ঘটানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। অবতরণের সময় উপগ্রহটিকে সম্পূর্ণ খাড়া অবস্থায় নিয়ে আসা প্রয়োজন, এবং সম্পূর্ণ সমতল একটি অবতরণ-ক্ষেত্র নির্ণয় করা প্রয়োজন, যেখানে কোনও পাথর বা সমতুল অন্য কোনও প্রতিবন্ধকতা উঁচিয়ে নেই। অবতরণের সময় উপগ্রহের গতিবেগ ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে, এবং ঠিক অবতরণের মুহূর্তে তা শূন্যে গিয়ে পৌঁছয়। এক বা একাধিক থ্রাস্টারের সাহায্যে এই গতিবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু কোনও নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন অথবা মাইকেল কলিন্সের সাহায্য ব্যতীত— এবং যেখানে পৃথিবীর অবস্থান কয়েক লক্ষ মাইল দূরে, যেখান থেকে সরাসরি রকেট অথবা উপগ্রহে বার্তা পাঠিয়ে গতিপথ নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব— সেই অবস্থায় উপগ্রহ কীভাবে সঠিক পদ্ধতি মেনে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করবে? এই কাজে ব্যবহার করা হয় একাধিক সেনসর অথবা কৃত্রিম নির্ণায়ক-যন্ত্রকে, যেগুলি সেই সময়ে উপগ্রহের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। কেমনভাবে তা করা হয়? এবার আসব সেই গল্পে।

 

আর্মস্ট্রংকে ছাড়াই যেভাবে অবতরণ

মাইকেল কলিন্স লক্ষ রাখছিলেন, ৫০ বছর বা তারও কিছু বেশি সময় আগে, ঈগল ল্যান্ডার-যানে চড়ে, নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করতে চলেছেন। তার পরবর্তীতে চন্দ্রপৃষ্ঠে একাধিক, অভিযাত্রী-সহ অথবা অভিযাত্রী-বিহীন রকেট অবতরণ করেছে। মহাকাশ গবেষণায় অগ্রগণ্য একাধিক দেশের তরফে, তাদের মধ্যে আমাদের দেশও রয়েছে, চন্দ্রপৃষ্ঠে অভিযাত্রী-বিহীন ল্যান্ডার বা উপগ্রহের নিখুঁত অবতরণের বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে নাসার মতো সাফল্য অর্জন করতে আর কোনও দেশই পারেনি। তাহলে নিল আর্মস্ট্রংয়ের সহায়তা ছাড়া, কোনও ঈগল ল্যান্ডারকে অভিযাত্রী-বিহীন অবস্থায় চন্দ্রপৃষ্ঠে নামিয়ে আনার বিষয়টিকে কোনদিক থেকে দেখলে এত বেশি পরিমাণে জটিল বলে মনে হয়?

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটু আগে দেওয়া চিত্র ৪-টিকে আরেকবার দেখে নিই। সাধারণভাবে অ্যাপোলো ১১ অথবা ভারতের চন্দ্রযান ২ প্রকল্পের ক্ষেত্রে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকারী যে ল্যান্ডার তা অবতরণের আগে মূল উপগ্রহ বা অরবাইটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অরবাইটার উপগ্রহটি চিত্রে দেখানো বৃত্তাকার পথে চাঁদের চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে। ল্যান্ডার অংশটি ক্রমশ অবতরণ-কক্ষে প্রবেশ করে চন্দ্রমার বুকে নেমে আসার জন্য। আমাদের যাত্রা শুরু হবে এই নিয়ন্ত্রিত অবতরণের সময়ে। অবস্থাটি অনেকাংশে এইরকম— আমাদের ল্যান্ডারের নাম ঈগল নয়, এবং তাতে কোনও নিল আর্মস্ট্রং অবতরণের অবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বসে নেই। আমাদের ল্যান্ডারের নাম, ধরা যাক বিক্রম, সে সম্পূর্ণভাবে কিছু যন্ত্র বা প্রযুক্তির সাহায্যে নিচের সম্ভাব্য অবতরণ-ক্ষেত্রটিকে পর্যবেক্ষণ করবে, এবং তারই ভিত্তিতে সঠিক অবতরণ-স্থল বা বিন্দুটিকে নির্ণয় করবে।

চিত্র ৫

এবারে চিত্র ৫-এর কথায় আসা যাক। এই চিত্রে একটি কাল্পনিক স্থানাঙ্ক-ব্যবস্থার বর্ণনা রয়েছে, যা কিনা চাঁদের কেন্দ্রবিন্দুর সাপেক্ষে ল্যান্ডারের নির্দিষ্ট অবস্থানকে গাণিতিক স্থানাঙ্কের মাধ্যমে চিহ্নিত করে। চিত্র ৫-এ প্রদর্শিত স্থানাঙ্ক-ব্যবস্থাটি কার্টেসিয় স্থানাঙ্ক-ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত, যা কিনা অন্যান্য স্থানাঙ্ক-ব্যবস্থাগুলির সাপেক্ষে সহজতম। যদিও, আলোচিত পরিস্থিতিতে গোলকাকৃতি অথবা spherical স্থানাঙ্ক-ব্যবস্থাটিই সবচেয়ে উপযোগী বলে প্রতিভাত হত। সহজ করে বলতে গেলে, আপনি যদি কেন্দ্রবিন্দু O-তে অবস্থান করেন এবং আপনার সঙ্গে থাকা যানটি আপনাকে OX–অক্ষরেখা বরাবর x কিলোমিটার দূরত্বে নিয়ে যেতে পারে, এবং তার পরবর্তীতে OY-অক্ষরেখা বরাবর y কিলোমিটার দূরত্বে নিয়ে যেতে পারে, এবং সবশেষে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে উল্লম্ব অবস্থায় OZ-অক্ষরেখা বরাবর z কিলোমিটার উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, তাহলে সেই অবস্থায় আপনার স্থানাঙ্ক দাঁড়াবে (x,y,z)। যদি কেউ ছোট্ট পাঠক থাকো, যাদের এখনও বীজগণিতের ধারণা জন্মায়নি, তারা x, y ও z-এর পরিবর্তে বেশ বড় বড় কয়েকটি সংখ্যাকে মনে মনে কল্পনা করে নিতে পারো। চিত্র ৫-এ কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে ল্যান্ডারটিকে (Xs,Ys,Zs) অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। যেখানে, ল্যান্ডারটির সম্ভাব্য অবতরণস্থলের স্থানাঙ্ক (Xp,Yp,Zp)। ক্রমশ যতই ল্যান্ডার যান নিয়ন্ত্রিত অবতরণের অবস্থার দিকে এগোবে, প্রথমে সেটিকে খাড়া অবস্থায় একেবারে অবতরণস্থল বা অবতরণ বিন্দুটির একেবারে উপরে পৌঁছতে হবে। তারপর সেটিকে ক্রমশ উল্লম্ব গতিবেগ কমিয়ে একেবারে খাড়া অবস্থায় চন্দ্রপৃষ্ঠে নেমে আসতে হবে। ঠিক অবতরণের মুহূর্তে তার উল্লম্ব গতিবেগ শূন্যে এসে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, অবতরণের সময়ে মূলত দুটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ১) (Xs,Ys,Zs) বিন্দু থেকে (Xp,Yp,Zp) বিন্দু অবধি ল্যান্ডারের গতিপথ, যা কিনা গতিপথ নিয়ন্ত্রণ অথবা kinematic control বা navigation-এর মাধ্যমে পরিচালিত হবে, এবং [২] ল্যান্ডারের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ, যা কিনা গতিবিদ্যার নিয়ন্ত্রণ বা control of dynamics-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। বোঝাই যাচ্ছে, দুটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

কীভাবে এই স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নির্ধারিত হয়, তা বুঝতে গেলে আমাদের এমন একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা control system-এর ‘অমর-আকবর-অ্যান্টনি’ মডেলের অংশ, নির্ণায়ক (sensor), নিয়ন্ত্রক (controller) ও কার্যকারক (actuator) যন্ত্র তিনটির বিষয়ে জানতে হবে। যেমন কিনা কেউ যদি কোনও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের উষ্ণতা নির্দিষ্ট করে দেয়, তাহলে সেই যন্ত্রের অংশ হিসেবে একটি উষ্ণতা-নির্ণায়ক বা temperature sensor যন্ত্র ঘরের উষ্ণতাকে পরিমাপ করতে থাকে। নিয়ন্ত্রক বা controller যন্ত্র নির্ণায়ক যন্ত্রের মাধ্যমে নির্ণীত উষ্ণতাকে নির্ধারিত উষ্ণতার মানের সঙ্গে তুলনা করে। নির্ণীত উষ্ণতা কোনও সময়ে নির্ধারিত উষ্ণতার চেয়ে কম হলে নিয়ন্ত্রক বা controller যন্ত্র, কার্যকারক (actuator) যন্ত্রের মাধ্যমে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ভিতরকার কমপ্রেসর (compressor) যন্ত্রকে বন্ধ করে দেয়। এই প্রতিক্রিয়াতে বাড়তে বাড়তে উষ্ণতা আবারও নির্ধারিত উষ্ণতাকে ছাপিয়ে যেতে চাইলে, controller যন্ত্র আবারও, কার্যকারক (actuator) যন্ত্রের মাধ্যমে কমপ্রেসর (compressor) যন্ত্রকে চালু করে। উষ্ণতা আবারও কমতে শুরু করে। এই তিন যন্ত্র ও যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কথা এখানে বলা হল, একত্রে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ-চক্র বা control loop নামে অভিহিত করা হয়।

গতিপথ ও গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়দুটিকে বোঝাতে, আমি ছোট্ট একটি খেলার সাহায্যে নেব। একটি ফাঁকা বর্গাকার ঘরকে ধরে নেওয়া যাক। ঘরটির যে কোনও দেওয়ালের শুরুর বিন্দুকে কেন্দ্রবিন্দু বা (0,0) নির্ণায়ক বিন্দু হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই স্থানের x ও y স্থানাঙ্কের পরিমাণ উভয়েই 0। এবারে শুরুর দেওয়াল বরাবর ১০ ধাপ ও তারপর শুরুর দেওয়ালটির সঙ্গে সমকোণে (বা সেই দেওয়ালের সঙ্গে লেগে থাকা অন্য আড়াআড়ি দেওয়ালটির সঙ্গে সমান্তরালভাবে), ৬ ধাপ হেঁটে যাওয়া হল। এই স্থানে একটি ঢেরা (×) চিহ্ন এঁকে দেওয়া হল। এই জায়গার স্থানাঙ্কের পরিমাপ তাহলে দাঁড়াল (১০,৬)। এবারে আবারও সেই কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসা যাক। খেলোয়াড়কে এইবারে বলা হবে চোখ বাঁধা অবস্থায় আবারও সেই একই জায়গাতে গিয়ে দাঁড়াতে। ঠিক আগের মতো করে এগোলে যে কেউই আবার নির্দিষ্ট জায়গাতে চোখ বাঁধা অবস্থাতেও ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু সে বড় বোকা বোকা ব্যাপার। সবসময়েই আমরা অভীষ্ট বিন্দুর সঙ্গে কেন্দ্রবিন্দুর সংযোগকারী একটি সরলরেখা বরাবর যদি এগোতে পারতাম, তাহলে অনেক তাড়াতাড়িই অভীষ্ট বিন্দুতে পৌঁছনো যেত। এই সরলরেখাটি কোনও দিকের দেওয়ালের সঙ্গেই আর সমান্তরাল থাকত না, বরং দুটি দেওয়ালের সঙ্গেই সে একটি করে কোণ উৎপন্ন করত। এখন চোখ খোলা অবস্থায় এই রেখাবরাবর এগোনো যতখানি সহজ, চোখ বাঁধা অবস্থায় এই কাজটি করতে গেলে কোনও একজন সহায়ক ব্যক্তির প্রয়োজন যে সমস্ত সময়ে বলে দিতে থাকবে খেলোয়াড় কোনও মুহূর্তে নির্দিষ্ট রেখার যাত্রাপথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে কিনা, এবং তার নির্দেশ অনুসারেই খেলোয়াড় তার যাত্রাপথটিকে আবারও রেখার সঙ্গে মিলিয়ে সংশোধন করে নেবে। তদুপরি, অভীষ্ট বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছলেও, সহায়ক ব্যক্তির তরফে খেলোয়াড়কে জানিয়ে দিতে হবে যে, সে তার লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছেছে। এই সহায়ক ব্যক্তিই হলেন গতিপথ-নিয়ন্ত্রক বা navigator, এবং যেভাবে খেলোয়াড় গতিপথ-নিয়ন্ত্রকের নির্দেশ অনুসারে নিজের যাত্রাপথকে সুস্থিত ও নির্দিষ্ট রাখে, তাই হল গতিবেগ ও গতিপথ নিয়ন্ত্রণ বা control of dynamics-এর উদাহরণ। ল্যান্ডারের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে, এই খেলায় প্রতি মুহূর্তে খেলোয়াড়ের দেহের যে আকৃতি ও অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটছে তাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ-চক্র বা control loop-এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। পা এবং দেহের অন্যান্য পেশিসমূহের গতিবিধিকে আমরা কার্যকারক (actuator) যন্ত্রের কাজের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। সর্বোপরি, খেলোয়াড়ের যে মস্তিষ্ক তাকে খেলার সময়ে ক্রমাগত পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে চলেছে, তাকে আমরা নিয়ন্ত্রক বা controller যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এখন, কোনওভাবে যদি খেলোয়াড়ের তরফে প্রতি পদক্ষেপের পূর্বে নিজের নির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক পরিমাপের সুযোগ থাকত, ও নির্ধারিত স্থানাঙ্ক-ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতিটি অক্ষের সাপেক্ষে নিজের কৌণিক অবস্থানকে পরিমাপের সুবিধা থাকত, তাহলে ঠিক সেই পদক্ষেপের পরবর্তীতে সে কোন বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়াবে বা পৌঁছাবে, সেই বিন্দুর স্থানাঙ্ক নির্ধারণেও তার কোনও অসুবিধা হত না। এছাড়াও, অভীষ্ট বিন্দুর স্থানাঙ্কটিও যদি খেলোয়াড়ের কাছে জানা থাকত, তাহলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছে, সেখানে দাঁড়িয়ে পড়তেও খেলোয়াড়ের তরফে কোনও অসুবিধা হত না। এবারে যদি বলা হয়, এই পরিমাপগুলি আদতে খেলোয়াড়ের গতিবিধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, কিন্তু প্রতি ২ সেকেন্ড বিরতির পরেপরেই, নির্দিষ্ট ব্যবধানে এই পরিমাপগুলি করা হচ্ছে ও এবং খেলোয়াড়কে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রে সেই ২ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে সে কতগুলি পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছে, সেই বিষয়টিকে নির্দিষ্ট করে জানাও তখন জরুরি হয়ে পড়ে। এবারে প্রযুক্তির ভাষায় বললে, ল্যান্ডারের অবতরণের সময়, নির্ণায়ক যন্ত্র বা sensor-গুলির তরফে ল্যান্ডারের প্রাথমিক অবস্থানের স্থানাঙ্ক, প্রতি মুহূর্তে তার গতিবেগ, ও রেফারেন্স প্লেন বা নির্দিষ্ট যে তলের সাপেক্ষে সমস্ত গাণিতিক পরিমাপ সম্পন্ন করা হচ্ছে— তারই সাপেক্ষে ল্যান্ডারের কৌণিক অবস্থান (চিত্র ৪ দ্রষ্টব্য), এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার কৌণিক অবস্থানের যে পরিবর্তন (অবতরণের সময় যদি ল্যান্ডার যানটি একটি যান্ত্রিক ‘স্ক্রু’-এর মতো ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসে), এই সমস্ত বিষয়কেই, দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি প্রতিনিধি হিসেবে গতিপথ-নিয়ন্ত্রক বা navigator-এর সাহায্য ছাড়া অবতরণের প্রয়োজনে, পরিমাপ করা হয়ে থাকে। মূলত এই চারটি পরিমাপের বিষয়কেই ল্যান্ডার অবতরণের সময় তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে প্রধান নির্ণায়ক রাশি বা motion attributes হিসেবে গণ্য করা হয়। এগুলিকে সঠিকভাবে পরিমাপের প্রয়োজনেই ল্যান্ডার-যানটিতে একাধিক নির্ণায়ক যন্ত্র বা sensor ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেগুলির মধ্যে প্রথম ও প্রধান যন্ত্রটি হল জাড্য-পরিমাপ যন্ত্র বা Inertial Measurement Unit অথবা সংক্ষেপে বললে IMU। যে IMU যন্ত্রটি ল্যান্ডার-যানের ভিতরে থাকে এবং যারও ভিতরে থাকা প্রধান নির্ণায়ক যন্ত্র বা sensor-টি হল একটি বা accelerometer ত্বরণ-নির্ণায়ক যন্ত্র।

এখন কীভাবে অবতরণের সময়ে ল্যান্ডার তার গতিবিধি পালটায়, সেই বিষয়টি নিঃসন্দেহে পাঠককুলকে ভাবাচ্ছে। আমি এখন আমারই তৈরি একটি খেলনা ল্যান্ডার মডেলের সাহায্যে বিষয়টিকে সহজ করে বোঝাতে চেষ্টা করব (চিত্র ৬ এবং ৭)।

চিত্র ৬ ও ৭

ল্যান্ডার বা যে কোনও কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে যে ‘থ্রাস্টার’গুলি লাগানো থাকে তাদের কাজই হল উত্তপ্ত কিছু গ্যাসকে নির্দিষ্ট দিকে উৎক্ষিপ্ত করে ল্যান্ডার বা উপগ্রহের গতিপথ পরিবর্তন করা। উপরের ছবিতে আমি থ্রাস্টারগুলির সম্ভাব্য অবস্থানের বিষয়ে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। থ্রাস্টারগুলি কোথায় অবস্থান করবে, সেই বিষয়টিও ল্যান্ডারের জ্যামিতিক গড়ন-সহ এমন অনেকগুলি আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এই থ্রাস্টারগুলির মাধ্যমে প্রতিটি সময়ে গ্যাসের উৎক্ষেপণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অভিমুখে যে বলের সৃষ্টি করা হয়, সেই সৃষ্ট বলগুলিকে কার্যত ল্যান্ডারের অদৃশ্য কয়েকটি পায়ের সঙ্গে তুলনা করা চলে, যা চাঁদের অভিকর্ষ বলের বিপরীতে ল্যান্ডারের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। যদি ল্যান্ডারটি কোনও সময়ে সটান খাড়াভাবে অবস্থান করে, ও থ্রাস্টারগুলির মাধ্যমে সৃষ্ট বল চাঁদের অভিকর্ষ বলের সঙ্গে একেবারে সমান হয়, তাহলে তা একই জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে ভেসে থাকতে পারে। থ্রাস্টারগুলির মাধ্যমে সৃষ্ট বল, চাঁদের অভিকর্ষ বলের চেয়ে বেশি হলে ল্যান্ডার খাড়াভাবে আরও উপরের দিকে উঠবে, ও বিপরীতে থ্রাস্টারগুলির মাধ্যমে সৃষ্ট বল চাঁদের অভিকর্ষ বলের চেয়ে কম হলে তা আস্তে আস্তে চন্দ্রপৃষ্ঠের উপরে নেমে আসবে। চিত্র ৭-এ সবুজ তিরচিহ্ন দিয়ে দেখানো জায়গাগুলিতে কীভাবে এই থ্রাস্টারগুলি আদতে ল্যান্ডারের অদৃশ্য পা হিসেবে কাজ করে, তা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যদি কোনও একটি পা আকারে ছোট হয়, অর্থাৎ কিনা কোনও একটি থ্রাস্টার থেকে উৎপন্ন বলের পরিমাণ অন্য থ্রাস্টারগুলি থেকে উৎপন্ন বলের চেয়ে কম হয়, তাহলে তাহলে ল্যান্ডারটি একদিকে হেলে পড়বে ও থ্রাস্টারগুলির মিলিত বলের পরিমাপ অনুযায়ী উপরে বা নিচে ওঠানামা করবে। কাজেই এই থ্রাস্টারগুলিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে প্রধান নির্ণায়ক রাশি বা motion attributes-গুলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কোনও কোনও ল্যান্ডারের মাথার উপরেও তার কৌণিক অবস্থান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে একটি থ্রাস্টার লাগানো থাকে। রোবোটিক ল্যান্ডার কীভাবে কাজ করে তা পাদটীকায় দেওয়া ভিডিওটিতে চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে।

গতিপথ নির্ধারণের বিষয়টিতে ফিরে আসি। IMU যন্ত্রের সাহায্যে যেমন হাতড়ে হাতড়ে ক্রমশ নিজের পথ খুঁজে নেওয়া চলে, তবু যন্ত্র বলেই তার তরফেও ছোটখাটো ভুলত্রুটির জায়গা থেকে যায়। শত হলেও সে যন্ত্র, আরব্য রজনীর আলিবাবা গল্পের বাবা মুস্তাফার মতো তার কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই। এমন ছোট ছোট ভুল যদি পরের পর হয়ে চলে, তবে সেগুলির একত্রিত প্রভাবে ল্যান্ডারের অবতরণ-স্থল একেবারেই বদলে যেতে পারে, অথবা ল্যান্ডার আকস্মিকভাবে সম্পূর্ণ ভুল দিকে হেলে পড়তে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হল অ্যাপোলো অভিযানের সময়, নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের ঈগল ল্যান্ডারটিতে আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ল্যান্ডারের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও, আর্মস্ট্রংয়ের সেই ক্ষমতা ছিল স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিগুলির ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তমতো ল্যান্ডারকে পরিচালনা করার। বিশেষত অবতরণের অন্তিম সময়ে চন্দ্রপৃষ্ঠের ভূমিরূপকে বিশেষ জানালার সাহায্যে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে আর্মস্ট্রং নিজেই ঈগল ল্যান্ডারের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। আর্মস্ট্রংয়ের মতো কেউ উপস্থিত না থাকলে, এমন অবতরণের সময়ে যে বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয় তার নাম Terrain Relative Navigation (সংক্ষেপে TRN) অথবা ভূমিরূপের সাপেক্ষে গতিবিধি নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি। এই নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরও দুইটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। একটি হল Sun Tracker অথবা Star Tracker (যা সংশ্লিষ্ট তারকাবস্তুকে সময় অনুসারে পর্যবেক্ষণ বা অনুসরণ করে), এবং Pulsed Laser Altimeter (PLI), যা লেজারের সাহায্যে কোনও নির্দিষ্ট তল থেকে উচ্চতা নির্ণয় করতে সহায়তা করে।

TRN প্রযুক্তি অনুযায়ী, চিত্র ৬-এ প্রদর্শিত একটি ভূমিরূপ পর্যবেক্ষণকারী ক্যামেরার সাহায্যে নিচের ভূমিরূপের ছবি তোলা হতে থাকে। শূন্যে ল্যান্ডারের অবস্থান ও সেটি কেমন কৌণিক অবস্থানে থাকবে, তা এই সময়ে সময়ে তুলে চলা ছবিগুলি থেকে পাওয়া তথ্যকে বিশ্লেষণ করেই নির্ধারিত হতে থাকে। চন্দ্রপৃষ্ঠের বেশ কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা থেকে অবতরণের স্থান নির্ণয় অনেকাংশে সহজ হয়ে আসে। উপরের ভিডিওটি দেখলে এই বৈশিষ্ট্যগুলির বিষয়ে আরও জানা যাবে। সহজ করে এটুকুই বলা যায়, এই প্রযুক্তি আসলে ক্যামেরার মাধ্যমে তুলে আনা ছবিগুলির মধ্যে কতগুলি বিন্দু বা pixel-কে চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে ছবির নির্দিষ্ট একেকটি এলাকাকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করতে পারে। যা সেই সময়ে ল্যান্ডারের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে প্রধান নির্ণায়ক রাশি বা motion attributes-গুলি পরিমাপ করতে সাহায্য করে। এই বিষয়টিকে ভাল করে বুঝতে গেলে আমরা নিচের চিত্র ৮-টি দেখব, যেখানে নাসার মহাকাশযান ‘রেঞ্জার’ থেকে তোলা দুটি উল্কাগহ্বর ‘সাবরিনা’ ও ‘রিটার’-এর সাদাকালো ছবি দেখানো হয়েছে। চিত্র ৯-এ সেই একই ছবিকে আরেকটু বড় করে বা আরেকটু কাছ থেকে দেখানো হয়েছে। ধরা যাক ল্যান্ডার-যান অবতরণের সময়, যে মুহূর্তে চিত্র ৮-কে দেখবে, তার ঠিক ১ সেকেন্ড পরে যদি সে আবার ছবি তোলে, তাহলে সে একই ভূমিরূপকে চিত্র ৯-এর অবস্থায় দেখবে। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে ল্যান্ডার নির্দিষ্ট এক গতিবেগে খাড়াখাড়িভাবে নেমে আসছে। কিন্তু যদি সে খাড়াখাড়িভাবে নেমে আসার বদলে একটু সরে যায়, অথবা কোনও দিকে হেলে পড়ে, তাহলে কিন্তু চিত্র ৯-এর বদলে সে সম্পূর্ণ অন্য এক ভূমিরূপের চিত্র প্রত্যক্ষ করবে, এবং ছবিতে যে বিন্দু বা pixel-গুলি উল্কাগহ্বরের ধারের অংশগুলিকে চিহ্নিত করছিল সেগুলি পূর্বে তোলা ছবিতে যে অবস্থানে ছিল, নতুন তোলা ছবিতে তার থেকে সরে যাবে। কাজেই প্রাথমিক অবস্থানে ভূমিরূপের একটি ছবি বা মানচিত্র নিয়ে ল্যান্ডার অবতরণের কাজ শুরু করে। সে সেই সময়ে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে motion attributes-গুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সে এও নির্ণয় করতে পারে যে, motion attributes-গুলি একইরকম থাকলে, কিছু সময় পর ভূমিরূপের মানচিত্রটি কেমন হয়ে দাঁড়াবে। সেই সময়ে, ক্যামেরাতে তোলা ছবি, ও নিজের গণনার মাধ্যমে বের করা ভূমিরূপের যে আদর্শ ছবি, দুটিকে মিলিয়ে ল্যান্ডারের অবস্থান সরে গিয়েছে কিনা সেই বিষয়টি খুঁজে বের করা চলে। এর পরবর্তীতে অবস্থান পরিবর্তনের সেই ত্রুটির পরিমাপকে ব্যবহার করেই ল্যান্ডারে থাকা অত্যাধুনিক কম্পিউটার ও Inertial Measurement Unit বা IMU যন্ত্রের সাহায্যে আবারও ল্যান্ডারের গতিপথকে সংশোধন করে নেওয়া হয়। চিত্র ৮ ও ৯-এ প্রদর্শিত দুইটি আলোকচিত্র বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় আদতে বেশ কিছু ফ্রেম-এর সমাহার। ল্যান্ডারে থাকা কম্পিউটারে এমন বেশ কিছু ফ্রেমের বিষয়ে তথ্য ভরে দেওয়া থাকে, সম্মিলিতভাবে যা Initial Hazard Map বা প্রাথমিক সম্ভাব্য বিপর্যয়সমূহের মানচিত্র তৈরি করে। এই ফ্রেমগুলিকে ব্যবহার করেই ল্যান্ডারের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা হয় ও উল্কাগহ্বর বা পাহাড়ের মতো বড় বড় বিপদকে কাটিয়ে সে সন্তর্পণে চন্দ্রপৃষ্ঠে নেমে আসে। অন্তিম অবতরণের সময় পরপর আসতে থাকা এই ফ্রেমগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করার জন্য ও সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করার জন্য সময় পাওয়া যায় খুবই কম, হয়তো বা ১ সেকেন্ডের চেয়েও অল্প। কাজেই ল্যান্ডারে থাকা বিশেষ কম্পিউটারটিকে এই গতিতে গণনা করার জন্য সক্ষম থাকতে হয়। তাই সেই কম্পিউটার তৈরির বিষয়টিও গবেষকদের কাছে অন্যতম চ্যালেঞ্জের কাজ।

চিত্র ৮ ও ৯

Terrain Relative Navigation (সংক্ষেপে TRN) অথবা ভূমিরূপের সাপেক্ষে গতিবিধি নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি ছাড়াও, কোনও কোনও ল্যান্ডার অবতরণের সময় Star Tracker অথবা উজ্জ্বল তারকাবস্তুর অবস্থান অনুসারী গতিবিধি নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সময়ে, ল্যান্ডারে থাকা ক্যামেরা মহাজাগতিক কোনও উজ্জ্বল তারকাবস্তু, যেমন সূর্য অথবা অন্য কোনও নক্ষত্রের দিকে এমনভাবে তাক করা থাকে, যাতে ছবিতে উজ্জ্বল বস্তুটিকে চিহ্নিতকারী যে বিন্দু বা পিক্সেলগুলি থাকবে, সেগুলি সর্বদাই ক্যামেরার যে ছবির ফ্রেম, তার কেন্দ্রাংশে অবস্থান করবে। এই অবস্থা জারি রাখতে গিয়ে ক্যামেরাটিকে যেভাবে সরাতে বা তার কৌণিক অবস্থানকে যেভাবে ক্রমাগত বদলাতে হয়, সেটাই ল্যান্ডারের গতিবিধি নির্ণায়ক রাশিগুলিকে পরিমাপ করে।

এইবারে আমার মনে হয়, স্বনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ল্যান্ডার অবতরণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত যে প্রাথমিক বিষয়গুলি রয়েছে, সেগুলি আমি মোটামুটি বুঝিয়ে উঠতে পেরেছি। এভাবে অবতরণের মূল তত্ত্বটিই হল, বিবিধ সম্ভাব্য বিপর্যয়কে কাটিয়ে ল্যান্ডারের গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং ক্রমশ তার উল্লম্ব গতিবেগকে কমিয়ে এনে, উল্লম্ব অক্ষের সঙ্গে তার হেলে পড়ার বিষয়টিকে একেবারে কাটিয়ে উঠে, খাড়াখাড়িভাবে ল্যান্ডার-যানটিকে সাফল্যের সঙ্গে চন্দ্রপৃষ্ঠে নামিয়ে আনা। এই সময়ে ল্যান্ডারের গতিবেগ অনেক সময়ই ব্রেক কষার মতো করে কমিয়ে আনতে হয়, গতিবিধি নির্ণায়ক রাশিগুলিকে নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্তিম অবতরণের সময় এই সময়কালটিকে তাই fine braking phase বলে অভিহিত করা হয়। একথা সকলেই বুঝবে, ল্যান্ডার যতই চন্দ্রপৃষ্ঠের কাছে নেমে আসবে ততই পৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতাকে আরওই নির্ভুলভাবে পরিমাপের প্রয়োজন পড়বে। এই সময় Terrain Relative Navigation (সংক্ষেপে TRN) প্রযুক্তিও সবসময় যথেষ্ট হয় না। তখন আমাদের Pulsed Laser Altimeter বা PLI প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়।

চিত্র ১০-এ PLI প্রযুক্তির ব্যবহার বোঝানো হয়েছে। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে ল্যান্ডারটি দুটি উল্কাগহ্বরের মাঝামাঝি অংশে চলে এসেছে, যার মধ্যে একটির ধারের অংশের বেশ বিপজ্জনকভাবে কাছাকাছি। এই অবস্থায় লেজারের সাহায্যে ছোট ছোট স্পন্দন বা pulse signal-কে চন্দ্রপৃষ্ঠের দিকে তাক করে ছোড়া হতে থাকে। যদি নিচের ভূমিরূপ সমতল হয়, তবে সেই স্পন্দন বা পালস সিগনালগুলি সরাসরি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসবে, অর্থাৎ প্রতিফলনের পরিমাণ হবে বেশি। যদি তা না হয়, অর্থাৎ যদি নিচের ভূমিরূপ চিত্র ১০-এর মতো একপাশে ঢালু হয়ে বা খাড়া হয়ে নেমে গিয়ে থাকে, তাহলে প্রতিফলিত সিগনালের শক্তি হবে কম, অর্থাৎ প্রতিফলনের পরিমাণও কম হয়ে দাঁড়াবে। সেই থেকেই ল্যান্ডার বুঝে ফেলবে নিচের অংশে সমতল জমি রয়েছে, নাকি ঢালু বিপজ্জনক খাদ অবস্থান করছে। এখন, ল্যান্ডার থেকে নিচের জমি অবধি লেজারের আলো পৌঁছিয়ে তা ফিরে আসতে সময় লাগে খুবই কম। তবু সেই অতিবাহিত সময়ের পরিমাপ থেকেই নিচের জমির সাপেক্ষে ল্যান্ডারের উচ্চতা নির্ণয় সম্ভব হয়। ল্যান্ডারে থাকা যন্ত্র এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময় অবধি সময়ের ব্যবধান নিখুঁতভাবে পরিমাপ করতে পারে।

চিত্র ১০ ও ১১

এখন কেবল PLI প্রযুক্তি ব্যবহারের পরবর্তীতেই কেউ যদি ভেবে নেয় চাঁদে অবতরণ তাহলে সুসম্পন্ন হয়েছে, তবে সে একেবারেই মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। এখনও সবচেয়ে জটিল প্রতিবন্ধকতাটি বাকি রয়ে গিয়েছে। চিত্র ১১-তে সেই বিষয়টিকেই দেখানো হয়েছে। এই ছবি অনুযায়ী ল্যান্ডারটি সোজাসুজি একটি বোল্ডারের উপর নেমে আসছে যাকে ধরা কোনও প্রযুক্তির সাহায্যেই অসম্ভব। যদি আর্মস্ট্রং স্বয়ং ল্যান্ডারযানের ভিতরে যানটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকেন, অথবা যানটি বোল্ডারের চারপাশে ঘুরে বিভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে তার ছবি তুলে বিশ্লেষণ করে তবে হয়তো এটিকে ধরা যেতে পারে। এর সমাধান কী জানেন? এর সমাধান হল ল্যান্ডারকে শেষ মুহূর্তের অবতরণের সময় দীপাবলির চরকির মতোই, চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০ মিটার উচ্চতায় থেকে, একটি বৃত্তাকার পথ ঘুরে আসতে হবে। এই সময় চাঁদের অভিকর্ষ বলের বিপরীতে ভারসাম্য বজায় রেখে তাকে ভেসে থাকতে হবে, এবং শেষ এই চরকিপাকের সময়েই আরও সমস্ত ছবি তুলে, সেগুলিকে বিশ্লেষণ করে নিখুঁতভাবে এমন সমস্ত ছোট ছোট বিপদসঙ্কুল অঞ্চলকে কাটিয়ে, বিপদবিহীন একটি অবতরণ-বিন্দুকে বেছে নিতে হবে ও গতিবেগ কমিয়ে সেখানে ধীরে ধীরে নেমে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে এই অতিশয় সূক্ষ গতিবেগ ও গতিপথ নিয়ন্ত্রণের সময়েও, চারপাশে কিন্তু কোনও বায়ুমণ্ডলের প্রভাব থাকছে না। এখন, এই সবকিছুকে বিবেচনা করে যখন আমরা সেই সাফল্যেরই মঞ্চে গিয়ে দাঁড়িয়েছি— সবশেষে কেবল দুইটি শব্দে আমার এই বক্তব্য শেষ করতে চাইব। মুক্তকণ্ঠে কেবল বলব, ‘জয় হিন্দ!’


[1] Williams, Matt. The Orbit of the Moon. Universe Today. Nov 5, 2016.
[2] Nuclear Thermal Propulsion: Game Changing Technology for Deep Space Exploration. NASA. May 25, 2018.; Slough, John. Nuclear Propulsion Through Direcy Conversion of Fusion Energy. NASA. Feb 17, 2014. Last Updated Apr 3, 2019.


*নিবন্ধটি প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় SPHS স্কুল ম্যাগাজিনে। বাংলা অনুবাদ আমাদের।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...