![nilkontho](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2023/11/nilkontho.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
নীলকণ্ঠ
দৃশ্য-১
স্থান: বৈকুণ্ঠে ভগবান বিষ্ণুর শয়নকক্ষ।
সময়: সবে সূর্যোদয় হচ্ছে।
(শয্যায় গভীর ঘুমে নিমগ্ন ভগবান বিষ্ণু নাক ডাকছেন। মা লক্ষ্মী ঘর ঝাড় দেওয়া শেষ করে, দুয়ারে সবে আলপনা দেওয়া শুরু করেছেন, এমন সময়ে কোনও এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে ‘না-আ-আ’ বলে চিৎকার করেই ধড়ফড় করে উঠে বসলেন বিষ্ণুদেব)
লক্ষ্মী: কী হল গো? স্বপ্নে কি আবার মধু-কৈটব এসেছিল?
বিষ্ণু: না তার থেকেও ভয়ানক। যাক্ গে। সকালের সোমরস কি তৈরি হয়ে গেছে?
লক্ষ্মী: হ্যাঁ, আনছি।
(ছোট ছোট পা ফেলে প্রস্থান ও এক কমণ্ডলু সোমরস সহ প্রবেশ ও পরিবেশন)
লক্ষ্মী: আগে একটু জল খেয়ে নেবে?
বিষ্ণু: না দরকার নেই। (বলেই এক চুমুকে সোমরস পান শেষ করে, মোবাইলের মতো দেখতে কাষ্ঠনির্মিত একটা যন্ত্রে মুখ লাগিয়ে নারদকে দ্রুত আসতে বললেন।)
দৃশ্য-২
(বিষ্ণুদেবের বৈঠকখানা। বিষ্ণুদেব আধশোয়া)
প্রহরী: নারদবাবু এয়েচেন। ভিতরে আসতি বলব?
বিষ্ণু: হ্যাঁ, আসতে বলো।
(নারদের প্রবেশ)
বিষ্ণু: এসো নারদ, বোসো। ভোরের দিকে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙেছে। দেখলাম ব্রহ্মা আর আমার লক্ষ-কোটি অব্দের সাধনায় সৃষ্ট মর্ত্যলোক ধোঁয়ায় ঢেকে মুহূর্তে ব্রহ্মাণ্ডে মিলিয়ে গেল!
নারদ: যাক তাহলে, আপদ গেল। আপনাকে আর এই বৃদ্ধ বয়সে মর্ত্যলোকের ফালতু ঝামেলা পোহাতে হবে না।
বিষ্ণু: কী বলছ নারদ! মর্ত্যলোক ধ্বংস মানে তো আমরাও ধ্বংস! কে পুজো দেবে, কে আর স্মরণ করবে আমাদের?
নারদ: না, মানে আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার সব সৃষ্টি ধ্বংস না হলে তো আমরাও মুক্তি পাব না। আর মর্ত্যে যা হয় তা ভালর জন্যই হয়, এটাই তো আমরা চিরকাল বুঝিয়ে এসেছি। এখন অন্য কথা বলা কি ঠিক হবে?
বিষ্ণু: শোনো নারদ এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রচুর ছায়াপথে্ আমি লক্ষ-কোটি প্রাণীর সৃষ্টি করেছি কিন্তু একমাত্র এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের দু-পায়ের জীবগুলো ছাড়া কেউ আমাদের স্রষ্টার সম্মান দেয়নি, পিতৃত্ব স্বীকার করেনি। ভেট দিয়ে আমাদের খুশি করার চেষ্টা পর্যন্ত করে না, এটা কি তোমার অজানা?
নারদ: সেটা অবশ্য ঠিকই। কিন্তু আমি বলছিলাম, আমাদের সবারই যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাই মনে হয় বাইরের ঝামেলায় মাথা না ঘামানোই ভালো হবে। আর মর্ত্যের মানুষের ভেট দিয়ে তো আর আমাদের পেট চলে না। কাজেই…
বিষ্ণু: চুপ করো, আমাকে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দাও। (কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন। তারপর স্বগতোক্তির ঢঙে) এতদিন মর্ত্যের কথা ভুলে থাকা আমার উচিত হয়নি। (আবার নারদকে) আচ্ছা নারদ, শেষ যেবার আমি কৃষ্ণ-বলরামকে মর্ত্যে পাঠিয়েছিলাম তা ঠিক কত যুগ আগে তা কি তোমার মনে আছে?
নারদ: আজ্ঞে, ডিমেনসিয়া হওয়ার পর থেকে অত পুরনো কথা আর মনে রাখতে পারি না। তবে, তারপর মর্ত্য বোধহয় তিন সহস্রাধিক বার সূর্যদেবকে প্রদক্ষিণ সেরে ফেলেছে।
বিষ্ণু: বলো কী! এতদিন হয়ে গেছে!
নারদ: আমার তো সেরকমই মনে হচ্ছে।
বিষ্ণু: আমিই তো কৃষ্ণকে বলেছিলাম যে মর্ত্যবাসীকে কথা দিয়ে আসতে যে, তাদের রক্ষা করতে ও দূষ্কৃতিদের বিনাশ করতে আমি বারবার মর্ত্যে অবতীর্ণ হব। মহাভারতের যুদ্ধের ঠিক আগে, ভাষণ দেওয়ার সময় ও সেকথা বড়মুখ করে বলেও এসেছিল। আর তোমরা কেউ একবার সেকথা আমাকে মনে করানোর প্রয়োজন বোধ করলে না?
নারদ: বলছিলাম না প্রভু, ডিমেনসিয়া হওয়ার পর থেকে…
বিষ্ণু: ওই তোমার এক অজুহাত হয়েছে। অশ্বিনীকুমারদের দেওয়া ওষুধ ঠিকমতো খাচ্ছ? (আবার স্বগতোক্তি) সব অপদার্থের দল। এখনই আমাকে মর্ত্যের খবর জানবার ব্যবস্থা করতে হবে। (নারদকে উদ্দেশ্য করে) শোনো, কল্কি সেজে মর্ত্যে যাওয়ার আগে, তুমি, কৃষ্ণরা ফিরে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত, মর্ত্যে ঠিক কী কী ঘটেছে তা বিশদভাবে জেনে আমাকে জানাও। আর তোমার এই মর্ত্যভ্রমণের যাবতীয় খরচ লক্ষ্মীকে বলে দিচ্ছি, তুমি চাইলেই উনি দিয়ে দেবেন।
নারদ: যথা আজ্ঞা, ভগবান। আমি আগামীকালই রওনা দেব। মাকে বলবেন একটু বেশি করেই দিতে, শুনেছি আজকাল মর্ত্যে সব জিনিসেরই প্রচুর দাম! বেশ, এখন চলি তাহলে। (প্রস্থানে উদ্যত)
বিষ্ণু: দাঁড়াও। যাওয়ার আগে একবার মহাদেববাবু বা অগ্নিদেব কোনও কারণবশত মর্ত্যবাসীদের উপর কুপিত হয়েছেন কিনা, সেটা জানা দরকার। তুমি আজ রাতেই এই খবর নিয়ে আমাকে জানাও।
নারদ: বেশ। আমি আজ রাতেই আবার আসব। আমি আসার আগে আবার ঘুমিয়ে পড়বেন না তো?
বিষ্ণু: আরে না না, বলছি না আমার ঘুম ছুটে গেছে।
নারদ: ঠিক আছে, রাতে আবার আসছি। (প্রস্থান)
দৃশ্য-৩
(বিষ্ণুদেবের বৈঠকখানায় বিষ্ণুদেব অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। স্বর্গের এক অদ্ভুত ধরনের ঘড়িতে রাত ১০টা বাজে। লক্ষ্মীর প্রবেশ)
লক্ষ্মী: আপনাকে আজ সকাল থেকেই বড় বিচলিত দেখাচ্ছে। শরীরটা বোধহয় ভাল নেই। আজ বরং একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। আমি পা টিপে দিচ্ছি।
বিষ্ণু: আরে না না, এখনই নারদ আসবে। ওর থেকে সব খবর না জানা অবধি আমার ঘুম আসবে না। তুমি বরং ঘুমাতে যাও। আমি মশারি টাঙিয়ে এসেছি, ডেঙ্গির যা উপদ্রব।
(লক্ষ্মী বেরিয়ে যান)
প্রহরী (দরজার বাইরে থেকে চেঁচিয়ে): নারদবাবু আবার এয়েচেন।
বিষ্ণু (একটু জোরেই): ভেতরে আসতে বলো।
নারদ (ঢুকতে ঢুকতে): জয় ভগবান বিষ্ণুর জয়।
বিষ্ণু: ওসব রাখো। আসল কথা বলো। কী দেখলে?
নারদ: জানেনই তো সন্ধ্যার পর দেবাদিদেবের ঠেকে যাওয়া মানেই একটা হাড় হিম করা ব্যাপার। গিয়ে দেখি নন্দী-ভৃঙ্গি প্রায় দু-গণ্ডা স্যাঙাৎ নিয়ে ওনাকে ঘিরে বসে অগ্নিদেবকে আহ্বান করে মন্ত্র পড়ছে। কয়েক মুহূর্ত বাদেই অগ্নিদেবও ওখানে হাজির হলেন।
বিষ্ণু: বাহ্, তাহলে তো এক জায়গাতেই সবাইকে পেয়ে গেলে।
নারদ: হ্যাঁ। কিন্তু মহাদেবকাকা, অগ্নিদেব কারও মধ্যেই কোনওরকম ক্রোধের লেশমাত্র না দেখে, দিলাম কাকাকে একটু খুঁচিয়ে। বললাম, কতদিন আপনার তাণ্ডবনাচ দেখিনি, শেষ যেবার প্রলয়-ড্যান্স করেছিলেন তখন আমি খুব ছোট ছিলাম, এ-জীবনে আর একটিবার যদি আপনার নাচ দেখতে পেতাম!
বিষ্ণু: উনি তখন কী বললেন?
নারদ: কল্কেতে একটা জোর টান দিয়ে উনি খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগলেন।
বিষ্ণু: কেন?
নারদ: তারপর আমাকে বললেন, আমাকে কি তোর মতো গর্দভ ভেবেছিস? বুড়ো বয়সে নাচতে গিয়ে কোমর ভাঙব নাকি? আমি তখন ওনাকে বললাম, কিন্তু প্রলয় ঘটানোর দায়িত্ব তো আপনারই প্রভু।
বিষ্ণু: তা শুনে উনি কী বললেন?
নারদ: উনি বললেন, শোন্ বিষ্ণুবাবুর মতো একঘেয়ে খেলা আমি খেলি না। মাঝেমাঝে মর্ত্যে যাব, আর দু-একটা শত্রু মেরেই বড় বড় ভাষণ দিয়ে ফিরে আসব, সেই পাত্র আমাকে পাসনি। দু-পেয়ে জন্তুগুলোকে এমন বিদ্যা শিখিয়ে দিয়েছি, যে একটা সুইচ টিপবে আর অনাচার, অত্যাচারে ভরা বিষ্ণুবাবুর বড় সাধের মর্ত্যলোকে প্রলয় শুরু হয়ে যাবে। আমার নাচ-ফাচের কোনও দরকারই পড়বে না। এই বলেই তিনি আবার হ্যা-হ্যা করে হাসতে শুরু করলেন।
বিষ্ণু: এসব তো ভয়ানক কথা! আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে, কাল সকালে সূর্যদেবকে প্রণাম সেরেই তুমি রওনা দাও। তোমার প্রধান কাজ হল কৃষ্ণ-বলরাম ফিরে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত মর্ত্যে ঠিক কী কী ঘটেছে তা বিশদভাবে আমাকে জানানো। আজ আসো তাহলে, শুভরাত্রি।
নারদ: মা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? তাহলে ডাকার দরকার নেই। কাল সকালেই আর একবার আসব’খনে।
বিষ্ণু: কত লাগবে বলো আমি এনে দিচ্ছি।
নারদ: আজ্ঞে নিরামিষ খাব… স্বর্ণমুদ্রায় দিলে এক অর্বুদ আর রৌপ্যে দশ নির্বুদেই চালিয়ে নেব।
বিষ্ণু: এত অর্থ লাগে আজকাল মর্ত্যভ্রমণে?
নারদ: আপনি তো এরপরই যাবেন, তখনই দেখে আসবেন। ওখানে এখন রাস্তায় চলতে গেলে শুনেছি এক ক্রোশ পরপর পথকর দিতে হয়, আর সব জিনিসেরই প্রচুর দাম। এমনকি একটু জল পর্যন্ত কোথাও প্রায় নাকি আজকাল বিনা পয়সায় পাওয়া যায় না।
(বিষ্ণুর অপর কক্ষে প্রবেশ ও ফিরে নারদকে থলি প্রদান)
বিষ্ণু: যা চেয়েছ, তা-ই দিলাম। একটু বুঝে খরচ কোরো। আর কোথাও বাকি রেখে এসো না।
নারদ: যথা আজ্ঞা, ভগবান। (প্রস্থানে উদ্যত)
বিষ্ণু: দাঁড়াও। একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম তাই আবার পিছু ডাকতে হল। এবারে তুমি মর্ত্যের যে গোলার্ধে আর্যাবর্ত, তার ঠিক বিপরীত গোলার্ধে প্রথমে যাবে। আমি বারবার বলা সত্ত্বেও রাম-পরশুরাম-কৃষ্ণ-বলরাম কেউ একবারের জন্যও ওদিকে যায়নি। মর্ত্যে যেতে বললেই আর্যাবর্তে গিয়ে খানিক হম্বিতম্বি করে ফেরত এসেছে। ওদিককার নরগণের সম্বন্ধে একবিন্দুও আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না। মর্ত্য মানে কি শুধু আর্যাবর্ত? যত্তসব অপদার্থ!… আচ্ছা, আজ যাও তাহলে, শুভরাত্রি ও শুভযাত্রা।
দৃশ্য-৪
(বৈঠকখানায় বিষ্ণুদেব তাকিয়ায় হেলান দিয়ে অর্ধনিমীলিত চক্ষে অর্ধশায়িত। দেবী সরস্বতী ওঁর পায়ের কাছে বসে ওঁকে গান শোনাচ্ছেন)
সরস্বতী: ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।
বিষ্ণু: এই গান তো সর্বদাই শুনছি, তুমি বরং একটা অন্য গান শোনাও।
সরস্বতী: বেশ শোনাচ্ছি। সম্প্রতি মর্ত্যলোক থেকে এক বিখ্যাত গায়িকা আমাদের এখানে এসেছেন, ওনার থেকে একটা গান শিখেছি, সেটাই তোমায় শোনাচ্ছি।
বিষ্ণু: বেশ, শোনাও।
সরস্বতী: আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে/আমার নয়নদুটি শুধুই তোমারে চাহে, ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে…
বিষ্ণু: বাহ্, কী চমৎকার কথা, তেমনি চমৎকার সুর।
প্রহরী (দরজার বাইরে থেকে চেঁচিয়ে): ভগবান, নারদবাবু মর্ত্য ঘুরে ফেরত এয়েছেন। ঢেঁকিশুদ্ধু ভিতরে আসতি চাইছেন। বলতেছেন ওতে নাকি অনেক দরকারি কাগজপত্তর আছে, ঢুকতি দেব?
বিষ্ণু: হ্যাঁ হ্যাঁ দাও।
সরস্বতী: আমি তাহলে আসি এখন।
বিষ্ণু: না না যাওয়ার দরকার নেই। নারদের বিবরণ শোনার পর, ও আর তুমি আমাকে কয়েকটি দ্বৈতসঙ্গীত শোনাবে।
(নারদের ঢেঁকিশুদ্ধু প্রবেশ)
নারদ: জয় ভগবান বিষ্ণুর জয়।
বিষ্ণু: আরে এসো এসো নারদ। বোসো। এ কী চেহারা হয়েছে তোমার! মর্ত্যে কি খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে?
নারদ (ঢেঁকিতে হাত রেখে): যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না।
বিষ্ণু: এ আবার কী নাটক?
নারদ: আজকাল মর্ত্যে সত্য-মিথ্যা যে যাই বলুক তার আগে এই কথাগুলো বলে নিতে হয়।
বিষ্ণু: এই মেরেছে, তুমি কি এখানে মর্ত্যের নিয়মকানুন চালু করবে নাকি? মানে তোমার বক্তব্য কি মিথ্যাও হতে পারে?
নারদ: কী যে বলেন! সাক্ষাৎ ভগবানের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলব? নরগণের মতো অত সাহস আমার নেই। তবে যে-সব তথ্য শুনলে আপনি দুঃখ পাবেন, যেমন ধরুন দীন-দরিদ্রদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার হাল, এগুলো নিয়ে হয়তো, আমাকে আপনার লাঞ্ছন এড়াতে কিছু অর্ধসত্য বলতে হবে।
বিষ্ণু: এই কদিনেই তুমি কেমন যেন অনেকটা বদলে গেছ! আমার কেমন যেন একটা ভয় ভয় করছে। কী শুনব কে জানে! যাক্ গে, তুমি পড়ো কী লিখেছ।
নারদ: দেখুন সব জায়গায় স্বচক্ষে সব দেখেছি আর সব দরকারি কাগজ আর বইপত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছি। কিন্তু সময়-অভাবে আর চোখে কনজাংটিভাইটিস মানে ওই জয়-বাংলা হওয়ার কারণে লিখে উঠতে পারিনি। আপনি যদি অনুগ্রহ করে গণেশকে ডেকে পাঠান, তাহলে আমি মুখে বলে যাই, আর ও ঝটপট লিখতে থাকুক। আরও তাড়াতাড়ি হয় যদি সরস্বতী দিদিমণি ওনার লেখনী-যন্ত্রমের সাহায্যে ফটাফট টাইপ করে দিতে পারেন।
বিষ্ণু: বেশ, সরস্বতী তুমি বরং তোমার লেখনী-যন্ত্রমটাই নিয়ে এসো।
সরস্বতী: আমি এখনই আনছি।
(প্রস্থান ও কয়েক মুহূর্ত পরেই ল্যাপটপের মতো দেখতে একটি কাষ্ঠনির্মিত যন্ত্রসমেত প্রবেশ)
বিষ্ণু: নাও, এবার বলতে শুরু করো।
নারদ: যদিও সেদিন পঞ্জিকায় দক্ষিণে যাত্রা নাস্তি ছিল, তবু আপনার নাম নিয়ে মর্ত্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যেতে যেতে দেখতে পেলাম অদ্ভুতদর্শন এক-একটা যান মর্ত্যের দিক থেকে ধেয়ে আসছে। এর মধ্যে কোনওটা চন্দ্রের দিকে, তো কোনওটা সূর্যদেবের দিকে বা মঙ্গলের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল। মর্ত্যের যত কাছে এগোতে লাগলাম তত বেশি বেশি করে এরকম বিচিত্র দেখতে, অগণিত চালকবিহীন যান দেখলাম মর্ত্যের চারপাশে সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে। একটার সঙ্গে তো আর একটু হলেই আমার ঢেঁকিটার ধাক্কা লাগছিল, আপনার কৃপায় বড় বাঁচা বেঁচেছি।
বিষ্ণু: বলো কী! এগুলো কি নরগণের সৃষ্ট?
নারদ: আর কে করবে বলুন। গরু-ছাগল-শুয়োরদের মাথায় কি আপনি এসব করার মতো বুদ্ধি দিয়েছেন?
বিষ্ণু: হুম্, রাম এসে বলেছিল বটে সে-সময়ে লঙ্কারাজ রাবণ, তার পুষ্পক নামের রথে চড়ে আকাশপথে গমন করতে পারত। কিন্তু তা বলে নরগণ আকাশ ছাড়িয়ে একেবারে মহাকাশে!
নারদ: আকাশপথ তো ওদের কাছে এখন জলভাত। প্রতিদিন লক্ষাধিক নর-নারী গরুড়ের মতো দেখতে আকাশযানের পেটে ঢুকে এক মুলুক থেকে আরেক মুলুকে কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছে।
বিষ্ণু: বেশ চিন্তার বিষয়! ওরা আমার এখানে এসে হাজির হবে না তো?
নারদ: সে গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না। এখনি ওদের না আটকালে আগামী দিনে সেটা ঘটতেই পারে।
বিষ্ণু: বেশ, তারপর কী হল বলো।
নারদ: মহাকাশ থেকে মর্ত্যের আকাশসীমায় প্রবেশের পর আমি আপনার কথামতো আর্যাবর্তের অনেকটা উত্তরদিক দিয়ে পশ্চিম গোলার্ধের দিকে এগোতে থাকলাম, এই সময়ে এক জায়গায় আকাশজুড়ে বড় ধরনের ব্রহ্মাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী কিছু ফাটতে দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত ওই জায়গাটা পার করে যেই পশ্চিম গোলার্ধের আকাশসীমায় ঢুকেছি, ব্যস্ শুরু হয়ে গেল বিপত্তি।
সরস্বতী: আপনার আবার কীসের বিপত্তি?
নারদ: বিপত্তি বলে বিপত্তি! আকাশেই চারদিক থেকে ওদের আকাশযান দিয়ে ওরা আমাকে ঘিরে ফেলে মাটিতে নামতে বাধ্য করল।
বিষ্ণু: বলো কী! এত বড় স্পর্ধা ওই সামান্য নরগণের! তারপর?
নারদ: আমাকে দু-হাত তুলে দাঁড় করিয়ে রেখে, কীসব যন্ত্রপাতি দিয়ে ওরা আমার সারা শরীর পরীক্ষা করতে লাগল। ওদের ভাষা আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, আর ওরাও আমার বৈদিক-সংস্কৃত কোনও ভাষাই বুঝছিল না।
বিষ্ণু: সরস্বতী, তুমি কি জানো পশ্চিম গোলার্ধের নরগণ কী ভাষায় কথা বলে?
সরস্বতী: পশ্চিম গোলার্ধের বেশিরভাগ জায়গায় আমার যাওয়া হয়নি। শুধুমাত্র ইদানিং যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডায় প্রবাসী বাঙালিরা ডাকায়, মা-দুর্গার সঙ্গে গেছি, তারা বেশিরভাগ সময় ইংরেজি ভাষায় এখন কথা বলেন। আগে ওখানকার আদি বাসিন্দারা শুনেছি ইংরেজি ভাষা জানতেন না। কিন্তু সেই সময় তো কখনও ওই গোলার্ধে যাইনি, তাই সঠিক বলতে পারব না।
বিষ্ণু: ঠিক আছে, তারপর বলো নারদ। এরপর ওরা কি তোমায় হেনস্থা করেছে?
নারদ: হেনস্থা কি আর একটু আধটু! বলতে আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে।
বিষ্ণু: আহা-আহা কেঁদো না। অকপটে সব খুলে বলো। আমার সবটা জানা দরকার।
নারদ: আমার ঢেঁকিটাকে নানা ধরনের যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে ওর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ওরা বলতে লাগল, ইউএফও, ইউএফও। আর আমাকে দেখিয়ে একে অন্যকে বলতে লাগল এলিয়েন! এলিয়েন!
বিষ্ণু: এত স্পর্ধা ওদের! তারপর?
নারদ: তারপর ওরা আমার ভাষা বোঝার জন্য এক বুড়োর কাছে ধরে নিয়ে গেল। সে নাকি বর্তমান দুনিয়ার অনেক ভাষা জানে। তার নামটা ভারী অদ্ভুত, চকমকি না চমস্কি এরকম একটা কিছু।
সরস্বতী: ও, আপনাকে তাহলে বোধহয় নোয়াম চমস্কির কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
বিষ্ণু: তাকে সব বুঝিয়ে বললে যে আমি তোমায় পাঠিয়েছি? আর সে কি তোমার ভাষা বুঝতে পারল?
নারদ: সে বুড়ো ভাষা ঠিকই বুঝেছে, কিন্তু আমার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। উল্টে যে প্রহরীগুলো আমায় ধরে নিয়ে গেছিল, তাদের বলল, পসিবলি ইন্ডিয়ান হিন্দু মঙ্ক অ্যান্ড স্কিৎজোফ্রেনিক পেশেন্ট। ব্যস, এটা শুনেই ওই প্রহরীগুলো ওনার কাছে আমাকে ফেলেই চম্পট দিল।
বিষ্ণু: সরস্বতী, তুমি কি ওই কথাগুলোর মানে জানো?
সরস্বতী: আজ্ঞে। ওই ভদ্রলোক নারদবাবুকে একজন মানসিক রোগগ্রস্ত হিন্দু সাধু ভেবেছেন।
বিষ্ণু: হিন্দু মানে?
নারদ: (জনান্তিকে) এই মেরেছে! ওনাকে এবার হিন্দুর মানে বোঝাতে আমার জান কয়লা হয়ে যাবে। (বিষুর দিকে ফিরে) শুনুন, এই ধরুন যারা বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদিকে বিশ্বাস করে ও এইসব পুঁথিতে বর্ণিত দেবদেবীকে পূজ্য মনে করে, তারাই এখন নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেয়।
বিষ্ণু: হ্যাঁ, চার্বাকের শিষ্যরা ছাড়া আর্যাবর্তে আর সকলেই তো এগুলো মানত। কিন্তু ওই হিন্দু না কী একটা বললে, সেটার মানে কী?
নারদ: আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের আর্যাবর্তের পশ্চিমে অবস্থিত পারস্যের, এখন অবশ্য জায়গাগুলোর নাম বদলে ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান হয়েছে, আমাদের জ্ঞাতিশত্রুরা অসুর-কে অহুর বা আহুর, সোম-কে হোম বলত।
সরস্বতী: মজার বিষয় হল আর্যাবর্তের পশ্চিমের লোকের যেমন সিন্ধুকে হিন্দু বলত তেমনি এর পূর্ব অংশ, যেটার নাম এখন বাংলাদেশ হয়েছে, সেখানকার বহু মানুষও সাপকে হাপ, শালাকে হালা বলেন।
নারদ: পরবর্তীকালে অন্যান্য পশ্চিমি মানুষেরা, সিন্ধুনদীর ধারে গড়ে ওঠা আমাদের আর্যাবর্তের সভ্যতাকে হিন্দাস্ আর লোকেদের হিন্দু বলে সম্মোধন করত। সে-কারণেই এখানকার মানুষেরা নিজেদের অন্যধর্মের থেকে আলাদা করে বোঝাতে ওই হিন্দু শব্দটা ব্যবহার করে।
বিষ্ণু: যাচ্চলে, অন্যরা এদের ধর্মের নাম ঠিক করে দিয়েছে? আর এরা সেই নাম মেনেও নিয়েছে!! যাক গে, তারপর কী হল বলো।
নারদ: ওই সাহেব, যেকোনও কারণেই হোক ওনার কাছেই একটা জায়গায় আমার কিছুদিন থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আর ওখানে বেশ কিছুদিন থেকে, অনেক তথ্য জানলাম।
বিষ্ণু: কীরকম? কী তথ্য জানলে?
নারদ: এই যেমন ধরুন, মর্ত্যলোকে, এখন ছয়টি পৃথক ভূখণ্ডে, মনুষ্যজাতি বসবাস করে। এগুলিকে এরা মহাদেশ বলে। কিন্তু ছয়টি মহাদেশের মধ্যে একমাত্র এশিয়া থেকেই বর্তমানকালের সমস্ত ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। আরও মজার ব্যাপার হল শুধুমাত্র আপনার অবতারেরা নয়, গড-এর, বা আল্লাহ-র, বা অন্য কোনও ধর্মের কোনও অবতার বা ঈশ্বরের দূত, যেমন ধরুন রাম-পরশুরাম-কৃষ্ণ-বলরাম-আব্রাহাম-মোজেস-যিশু-মহম্মদ জন্মে কোনওদিন এশিয়ার কিছু অংশ ছাড়া অন্য কোত্থাও যাননি। এমনকি পুরো এশিয়াটাও এরা কেউ ঘুরে দেখেননি, একটার বেশি ভাষাও কেউ শেখেননি, ফলে সমগ্র মর্ত্যলোক ও মানবসমাজ বিষয়ে এদের জ্ঞান, ওই অন্ধের হস্তীদর্শনের চেয়ে বেশি কিছু হয়নি।
বিষ্ণু: আহা, যাবে কী করে? তখন কি আর আজকালকার মতো আকাশপথে, জলপথে, স্থলপথে যাতায়াতের সুবিধা ছিল? আচ্ছা গড, তারপর আল্লাহ, যিশু, আরও কত নাম বললে, এনারা কারা?
নারদ: গড, তারপর আল্লাহ। এই শব্দগুলোর মানেও ঈশ্বর বা স্রষ্টা। বাকিরা তাদের দূত।
বিষ্ণু: বেশ, কিন্তু সেই স্রষ্টার নাম কী?
নারদ: ওই যে বললাম গড বা আল্লাহ।
বিষ্ণু: আহাম্মকদের মতো কথা বোলো না। তাদের কিছু একটা নাম তো থাকবে! এই যেমন ঋগ্বেদের মিত্রদেবকে পারস্যের লোকেরা বলত মিথ্র, গ্রিক ও রোমানরা বলত মিথ্রস্। অনেক সময় ভাষার বিভিন্নতার কারণে উচ্চারণ বদলে যায় কিন্তু নাম তো কিছু একটা থাকবে।
নারদ: আপনাকে এই কেসটা ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমরা যেমন এই ধরুন সরস্বতী দিদিমণির বর্ণনা করে বলেছি, ’কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে’, তেমন করে কোথাও গড বা আল্লাহের রূপের কোনও বর্ণনা করা হয়নি। বর্তমানকালের মর্ত্যলোকের মনুষ্যজাতির ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসটা পুরোটা না শুনলে আপনি বিষয়টা ঠিক বুঝবেন না।
বিষ্ণু: বেশ, তুমি সেটা বিশদে বলো, আমি শুনছি।
নারদ: ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও স্রষ্টা নিয়ে মর্ত্যের এক-একটা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে চিন্তার কিছু মিল ও অমিল বহু সহস্র বছরের। এছাড়া খাদ্য ও নিষিদ্ধ খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদের রকম, চুল-দাড়ির ছাঁট, ঈশ্বরকে ডাকার ভাষা ও ভঙ্গি ইত্যাদি নিয়েও স্থানভেদে বিভিন্নতা ছিল।
বিষ্ণু: হ্যাঁ, সে বিভিন্নতা তো আর্যাবর্তের ক্ষেত্রেও ছিল।
নারদ: বর্তমান ধর্মগুলো সেই বিভিন্নতাকে অস্বীকার করে ভয়ঙ্কর এক গোঁড়ামি ও নিজেদের সংস্কৃতি অন্যদের ওপর জোরজবরদস্তি করে চাপাতে গিয়ে মারামারি-খুনোখুনির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ধর্মের নাম করে ব্যাপক আকারে নরহত্যা-গণহত্যা-শিশুহত্যা-ধর্ষণ এই মোটামুটি ধরুন পনেরোশো বছর ধরে মর্ত্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছে।
বিষ্ণু: ধর্ম নিয়ে হত্যাকাণ্ড!! সেটাও আবার জনপ্রিয়! মানুষের ধর্ম তো চিরকাল একটাই, সেটা হল মানবধর্ম।
নারদ: তাহলে তো ল্যাটা চুকেই যেত। নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিটা অন্তত ধর্মের নাম করে করতে পারত না।
বিষ্ণু: সেটাই তো কথা। আচ্ছা স্রষ্টা ও সৃষ্টি নিয়ে বিভেদ তৈরি হয়েছে কেন?
নারদ: কেন আমাদের শুধুমাত্র আর্যাবর্তেই তো এই সৃষ্টি নিয়ে কোনও একটা কাহিনি সর্বজনগ্রাহ্য নয়। নানা মুনির নানা মত, তাই সাধারণ নর-নারীর মতও এই নিয়ে প্রথম থেকেই আলাদা আলাদা।
বিষ্ণু: এই ভিন্ন ভিন্ন মতগুলো আমাকে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে পারো?
নারদ: পারব না কেন? এই মনে করুন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের নাসদীয় সূক্তে সৃষ্টি নিয়ে অনেক কিছু বলার পর একদম শেষে এসে আমরা বলেছিলাম— এই নানা সৃষ্টি যে কোথা থেকে হল, কেউ সৃষ্টি করেছেন না করেননি, তা একমাত্র তিনিই জানেন, যিনি এর প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন। অথবা তিনিও হয়তো জানেন না। এই কথাগুলোতে যুক্তি ছিল, আবার ওই বেদেই পু্রুষ সূক্তে, হিরণ্যগর্ভ নামক মহাজাগতিক অণ্ড বা সোনার ডিম থেকে ব্রহ্মা বেরিয়ে, ওই ডিমটিকে তিনভাগে ভেঙে, ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ ঘটালেন বলে বর্ণনা করা হল। কিন্তু এর আগেই আবার নাকি পঞ্চভূতের উৎপত্তি হয়ে গেছিল!!
বিষ্ণু: হুম্, বিভ্রান্ত হওয়ার মতোই বিষয়।
নারদ: এ তো কিছুই না, আগে সবটা ভাল করে শুনুন।… এরপর শিবপুরাণে মূল স্রষ্টা হিসেবে শিবকে বলা হল। আবার মহানির্বাণ তন্ত্রের তৃতীয় অধ্যায়ে মহাদেব মাদুর্গাকে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি নিয়ে যা বললেন তাতে তিনি একবারও ওই মহাজাগতিক ডিমের কোনও উল্লেখই করলেন না। উল্টে প্রকৃতি-পুরুষ এইসব কী ছাইমাথা বললেন।
বিষ্ণু: ওনাকে নিয়ে তো এটাই সমস্যা। উনি যে কী অবস্থায়, কখন, কাকে, কী বলে বসেন!!!
নারদ: শুধুমাত্র ওনাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিষ্ণুপুরাণ আর ভাগবত পুরাণে সৃষ্টির সব কৃতিত্ব আপনাকে দিয়ে, ব্রহ্মা ও শিবকে খাটো করার চেষ্টা হল, সেই বেলা? ওখানে আবার নতুন গল্প বলা হল, আপনি নাকি ক্ষীরসাগরে শায়িত থাকাকালীন আপনার নাভি থেকে বেরোনো একটি পদ্মফুলের উপর বসে ব্রহ্মা আপনার কথামতো ‘সৃষ্টির’ সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন!!!… তাহলে কি ক্ষীরসাগর, পদ্মফুল এগুলো সৃষ্টির আগে থেকেই ছিল??
বিষ্ণু: হতভাগাগুলো ঈশ্বরের নাম করে যা ইচ্ছা লিখেছে। বারবার বলেছিলাম, ছাপতে দেওয়ার আগে খসড়াটা একবার আমাকে দেখিয়ে নিতে। কেউ শুনেছে সে কথা!
নারদ: আপনাকেও তো আমি বারবার সতর্ক করেছিলাম, ভক্ত শুনলেই অত গদগদ হবেন না, কখনও শুনেছেন সে কথা? যত সব ধান্দাবাজ আপনাকে ভাঙিয়ে, পাহাড়প্রমাণ সম্পত্তি বানিয়ে ফায়দা লুটল, আর আপনি ঘুমিয়ে রইলেন!!
বিষ্ণু: শোনো, যা কেলো হওয়ার তা হয়েছে, এখন এসব নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি বরং যে কথাটা শুরু করেছিলে সেটা বলো।
নারদ: কী বলছিলাম, সেটাই তো এখন মনে করতে পারছি না। ওই রোগটা আমার স্মৃতিশক্তিকে বড় দুর্বল করে দিয়েছে।
বিষ্ণু: ওই তো, সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে মনুষ্যজাতির বিভেদ ও বিবাদের কথা।
নারদ: হ্যাঁ, এইবারে মনে পড়েছে। মহাভারতের যুদ্ধের পর আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের অত্যাচারে নিচুজাতের মানে সাধারণ প্রজাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আর ঠিক ওই সময়ে গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর তীর্থঙ্কর ওই অত্যাচারিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্মের নতূন ব্যাখ্যা দেন যা আর্যাবর্তে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অশোক নামের এক রাজার চেষ্টায় গৌতম বুদ্ধের বাণী সমগ্র আর্যাবর্ত এবং ক্রমে তিব্বত, চৈনিকপ্রদেশ, জাপান, সিংহল, কম্বোজ আর জম্বুদ্বীপেও ছড়িয়ে পড়ে। বুদ্ধের অনুগামীরা বৌদ্ধ ও মহাবীরের অনুগামীরা জৈন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
বিষ্ণু: কিন্তু কৃষ্ণ যে বলেছিল ও ধর্ম স্থাপনা করে এসেছে!! তবে কি মহাভারতের যুদ্ধে এত প্রাণহানির পরও ওখানে ধর্মরাজ্য স্থাপনা হয়নি?
নারদ: কচু হয়েছিল। তাহলে তার পরপরই বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মের উৎপত্তি হয়? যেখানে এক নারীর লাঞ্ছনার কারণে অত বড় যুদ্ধ হয়, সেখানে আজও নারীদের বিশেষত নিচুজাতির নারীদেরকে বিবস্ত্র করে ঘোরানো, ধর্ষণ, কন্যাভ্রূণ হত্যা, পারিবারিক সম্মান বাঁচাতে হত্যা, এসবই কুরুক্ষেত্রের আশেপাশের অঞ্চলেই বেশি হয়।
বিষ্ণু: সে কি! কিন্তু কৃষ্ণ-বলরাম তো অন্যরকম বলেছিল। আচ্ছা গৌতম বা মহাবীর কি সৃষ্টি ও স্রষ্টা নিয়ে বেদের থেকে নতুন কোনও কথা বলেছিল?
নারদ: ওরা বেদ ও চতুর্বর্ণ প্রথা মানতেন না আর বুদ্ধ ঈশ্বর নিয়ে সারাজীবনে একটা শব্দও বলেননি। আর জৈনরা মনে করেন এই জগতের কোনও সৃষ্টিকর্তা নেই।
বিষ্ণু: মানুষ হিসেবে জন্মে ওরা নতুন ধর্মকথা প্রচার করার দুঃসাহস দেখাল!! তাহলে ওই গৌতমকে আমার অবতার হিসেবে মেনে নিতে কোন আহম্মক সুপারিশ করেছিল? মাঝখান থেকে একটা কাউকেও খতম না করে ও আমার অবতার হয়ে গেল?
নারদ: সেইসময়ে ওঁর যে জনপ্রিয়তা ছিল এটা না করে উপায় ছিল না। আপনি যাদের আহাম্মক বলছেন তারা আসলে গৌতমকে অবতার বানিয়ে ওনার বেদ ও বর্ণপ্রথার বিরোধিতার বিষয়টা মানুষের মন থেকে মুছে দিয়েছিল। ঠিক এভাবেই প্রাচীনকালে সাংখ্যবাদী দার্শনিক কপিলমুনির নামে মন্দির তৈরি করে, ওনাকেই প্রায় ভগবান বানিয়ে, ওনার ভয়ঙ্কর বক্তব্য— ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ নেই— এটা সাধারণ মানুষের কাছে ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আর্যাবর্তে এছাড়াও আরও একটি ধর্মের জন্ম হয়েছে। সেটা হল গুরু নানক প্রচারিত শিখ ধর্ম।
বিষ্ণু: তাহলে এক আর্যাবর্তেই তো দেখছি ধর্মের ছড়াছড়ি, বাকি জগতের ধর্মসংখ্যা তবে কত হবে ভেবে তো আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি।
নারদ: দেখুন, আগে এবং এখনও অজস্র ধর্মের অস্তিত্ব থাকলেও, বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, সেভাবে বড় ধর্মগুলোর বিপুলসংখ্যক অনুগামীদের চাপে আঞ্চলিক ধর্মগুলো প্রায় হারিয়েই গেছে। মর্ত্যে ধর্মই এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। যেকোনও লাভজনক ব্যবসায় যেমন বহু কোম্পানি ঝাঁপায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে দু-একটি বড় কোম্পানি, ধর্মের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
বিষ্ণু: তুমি আর্যাবর্তের পশ্চিমদিকে উদ্ভব হওয়া ধর্মগুলো সম্বন্ধে কী যেন বলছিলে?
নারদ: হ্যাঁ, আমাদের জ্ঞাতিশত্রু জরাথ্রুস্ট সর্বপ্রথম দেবগণকে অপূজনীয় এবং ঋগ্বেদে উল্লেখিত অসুর মহৎ, ওদের ভাষায় আহুর মাজদা-কেই একমাত্র জগতের স্রষ্টা হিসেবে আবেস্তায় বর্ণনা করেন। আমরাও পরবর্তীকালে এই কারণে অসুরদেরকে অশুভশক্তি হিসেবে বর্ণনা করতে থাকি। বহুকাল ওই জরাথ্রস্টের ধর্ম পারস্যের প্রধান ধর্ম থাকলেও প্রায় দেড়হাজার বছর আগে ইসলামপন্থী আরব উপজাতির পারস্য বিজয়ের পর অধিকাংশ মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম স্বীকার করে নেয়, ও কিছু মানুষ অনৈস্লামিক দেশগুলোতে পালিয়ে যায়। ভারতের পার্সি সম্প্রদায় এরকমভাবে পালিয়ে আসা একটি জরাথ্রুষ্টীয় গোষ্ঠী।
বিষ্ণু: তুমি তো অনেক তথ্য সংগ্রহ করে এনেছ দেখছি। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এইসব তথ্য জানায়নি।
নারদ: আমার কাজে আর যাই হোক ফাঁকি পাবেন না। আপনি যেমন অর্থ দিতে কার্পণ্য করেননি, আমিও পুরো মর্ত্যলোক এই কদিনে চষে ফেলেছি।
সরস্বতী: আজকাল তো মর্ত্যে গিয়ে ইন্টারনেট ঘাঁটলেই বহু তথ্য পাওয়া যায়।
বিষ্ণু: সেটা আবার কি?
সরস্বতী: আমাদের এখানে টাওয়ার পাওয়া যায় না, নাহলে আপনাকে দেখাতে পারতাম।
বিষ্ণু: কিন্তু তুমি যাই বলো সরস্বতী, তোমরা কেউ কিন্তু এসব আমাকে জানাওনি। আর মহর্ষি নারদকে প্রায় সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি ক্লান্তিহীনভাবে দরকারি-অদরকারি সমস্ত খবর সংগ্রহ করে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে দেখেছি।
সরস্বতী: হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক। (নারদকে উদ্দেশ করে) আপনি বরং ওই পশ্চিমি আব্রাহামিক ধর্মগুলো সম্বন্ধে ভগবানকে অবহিত করুন।
বিষ্ণু: হ্যাঁ, আমরা বারবার প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি।
নারদ: পশ্চিম এশিয়ায় বর্তমানের প্যালেস্তাইন-ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে আশেপাশের অঞ্চলে সম্ভবত তিন সহস্রাধিক বছর আগে আব্রাহাম মতান্তরে ইব্রাহিম বলে কোনও দেবদূত আবির্ভূত হয়ে নিরাকার, একেশ্বরবাদ প্রচার করেন। আর তারপর থেকে ওই অঞ্চলে এবং তার আশেপাশে কয়েকশো বছর পরপর নিয়ম করে একের পর এক দেবদূত আবির্ভূত হতেই থাকেন। এর ফলে এইসব ঈশ্বরের দূতদের কাকে খাঁটি বলে মানা হবে ও কার কার বক্তব্যকে মান্যতা দেওয়া উচিত তা নিয়ে কিছুদিন পরপর জুদাই, ক্রিশ্চান ও ইসলাম নামে তিন-তিনটে ধর্মের উদ্ভব ও খুনোখুনি শুরু হয়, আর এই রক্তারক্তি হিংসাকে সবাই ধর্মযুদ্ধ বলে প্রচার করতে থাকে। যা ক্রমে এশিয়ার বাইরে বাকি মহাদেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে, যা আমি ফেরত আসার দিনও দেখে এসেছি।
বিষ্ণু: তাহলে গ্রিকরা অলিম্পাস পর্বতের বারো দেবতাকে, মানে আমাদের বন্ধুস্থানীয় জিউস সহ অন্যান্যদের, আর রোমানরা জুপিটার-অ্যাপোলোদের পূজা করা বন্ধ করে দিয়েছে?
নারদ: হ্যাঁ, ভগবান। ওনারা ওই চত্বরে আর পূজা পান না। রোম সম্রাট কনস্তান্তিনোপলই এশিয়ার ক্রিশ্চান ধর্ম ইউরোপে প্রচারে প্রধান ভূমিকা নেন। আর তারপর ইউরোপীয়রা আমেরিকা মহাদেশ দখল করে ওখানকার আদি বাসিন্দাদের ভাষা, ধর্ম ধ্বংস করে ইংরেজি ভাষা আর ক্রিশ্চান ধর্মের আধিপত্য কায়েম করে।
বিষ্ণু: আচ্ছা বলো তো, মর্ত্যবাসীরা তাহলে এখন ধর্ম বলতে ঠিক কী বোঝে?
নারদ: নিজের সৎ বা অসৎ মনস্কামনা পূর্ণ করতে মন্দির-মসজিদ-গির্জায় যাওয়া। তাই মর্ত্যে এখন মন্দির-মসজিদ-গির্জা তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে।
বিষ্ণু: ওসব জায়গায় কী হয়?
নারদ: ভগবান, আল্লাহ ও গডের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা হয়।
বিষ্ণু: সেটা তো যেকোনও জায়গা থেকেই করা যায়। মন্দির বানানোর কথা তো বেদ-উপনিষদ কোথাও আমরা বলিনি। এমনকি রাম নিজে রাজা হওয়ার পর, ওর রাজ্যেও তো কখনও কোনও মন্দির বানিয়েছিল বলে শুনিনি। কৃষ্ণ কি গীতার ভাষণে কোথাও ওসব করতে বলেছিল?
নারদ: আপনি এখনও সেই প্রাচীনকালেই পড়ে আছেন। বলছি অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ ও সম্পদের একটা ভাগ এইসব জায়গায় ঈশ্বরকে তাদের মতোই তোলাবাজ বা ঘুষখোর জ্ঞানে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে বিপদগ্রস্ত মানুষেরা বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশাতেও দানধ্যান করে থাকে।
বিষ্ণু: মর্ত্যের যেকোনও দেশের টাকাই তো আমাদের এখানে অচল, তাহলে ওই অর্থ যায় কোথায়?
নারদ: আজ্ঞে আপনার স্বঘোষিত এজেন্টদের ভোগে। আরও একটা কথা শুনুন, আর্যাবর্তে এখন আপনার বিষ্ণু পুরাণ সিরিয়ালের চেয়ে জয় হনুমানের টিআরপি বেশি।
বিষ্ণু: এর মানে?
নারদ: মানে সোজা কথায়, আপনার চেয়ে হনুমানের জনপ্রিয়তা বেশি।
বিষ্ণু: হায়, হায়! এই বয়সে এও আমাকে শুনতে হল!!
নারদ: সেইজন্য আমি তো আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম মর্ত্যবাসীদের সম্বন্ধে অত মাথা ঘামানোর আর দরকার নেই। ওরা নিজেরাই নিজেদের মর্ত্যলোককে ধ্বংস করবে। আপনাকে বলেছিলাম, মর্ত্যে যাওয়ার সময় দেখেছি উত্তরের দুই দেশের যুদ্ধ চলছে, মহাদেবকাকা ইশারা করলেই নাকি দুটো টেকোর যে-কোনও একটা সুইচ টিপবে, আর প্রলয় শুরু হয়ে যাবে।
বিষ্ণু: তুমিও দেখছি আজকাল সারাক্ষণ মহাদেববাবুর মতোই নেতিবাচক কথাবার্তা বলছ আর প্রলয়ের জন্য বড্ড বেশি হাঁকপাক করছ। এত ব্যগ্র হয়ে পোড়ো না, আমাকে একটু ভাববার সময় দাও।
নারদ: সে আপনি যত খুশি ভাবুন। কিন্তু দয়া করে আমাকে আর কখনও ওখানে যেতে বলবেন না। বৃদ্ধ বয়সে কিছু বাড়তি অর্থ রোজগারের আশায় গিয়ে যা হেনস্থা হয়েছি এবার!!
বিষ্ণু: একই ব্রহ্মাণ্ডের এতজন পৃথক পৃথক স্রষ্টা যে হতে পারে না এই সামান্য বোধটুকুও কি এই অতিবুদ্ধিমান মনুষ্যকুলের নেই?
নারদ: সত্যি কথা বলতে কী, প্রকৃত বুদ্ধিমান মনুষ্যদের এ বোধ আছে। কিন্তু তারা সংখ্যায় কম। মর্ত্যের এই মূহূর্তের প্রধান সমস্যা হল, অতি ধূর্ত অসৎ মানুষেরা প্রচুর সংখ্যক নির্বোধকে তাদের অধীনে সংগঠিত করে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, অর্থ সমস্ত কিছুর অধিপতি হয়ে বসে আছে। তারাই ওই নির্বোধদের আত্মঘাতী ধ্বংসের দিকে চালনা করছে।
বিষ্ণু: কিন্তু আমার পক্ষে এই ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা হিসেবে অন্য কাউকে মানা অসম্ভব। (একটু থেমে) আচ্ছা, মনুষ্যগণ বর্তমানকালে মতান্তর বা পছন্দের অমিল হলে কীভাবে তার সমাধান করেন?
নারদ: গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থাই এখন মর্ত্যে সুপারহিট। সৎ বা অসৎভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করে, এই ব্যবস্থায়, সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মান্যতা পায়। ওখানে একজনের মতপ্রকাশকে তার ভোট বলা হয়।
বিষ্ণু: তাহলে সত্যি সত্যি স্রষ্টা আসলে কে, এই নিয়ে সমগ্র মর্ত্যে ভোটাভুটি হলে কী ফল হতে পারে?
নারদ: সেরকম কোনও নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে, গড পাবেন শতকরা ৩১ জনের ভোট, আল্লাহ পাবেন শতকরা ২৫ জনের ভোট, আর আপনাদের পক্ষে থাকবে শতকরা ১৬ জন মানুষের ভোট।
বিষ্ণু: তাহলে তো কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এবং এই বিষয়টা অমীমাংসীতই থেকে যাবে।
নারদ: আজ্ঞে না। মর্ত্যের নিয়মে এক্ষেত্রে গডকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
বিষ্ণু: কেন উনি তো মাত্র শতকরা ৩১ জনের ভোট পেয়েছেন!! শতকরা ৬৯ জন, মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, ওনাকে মানে না।
নারদ: না তা হবে না। এটাই মর্ত্যের নিয়ম, এখানে প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পায় না, কিন্তু অন্যদের প্রতি মানুষের সমর্থন আরও কম হলে শতকরা মাত্র পাঁচজনের ভোট পেয়েও কেউ বিজয়ী বলে ঘোষিত হন। মর্ত্যে এখন তো এ হামেশাই ঘটছে।
বিষ্ণু: এ তো ভারী বিচিত্র ব্যবস্থা!! আচ্ছা তুমি যা বললে তাতে তো একশো ভাগের মধ্যে একত্রিশ+পঁচিশ+ষোলো, মানে শতকরা ৭২ ভাগ মাত্র ভোট হল, আর বাকি ২৮ শতাংশ মানুষের কী মত?
নারদ: বাকি ২৮ শতাংশের মধ্যে ৬ শতাংশ বৌদ্ধ ও জৈন ও ৬ শতাংশ ছোট ছোট আঞ্চলিক ধর্মের অনুগামীরা, মানে মোট ১২ শতাংশ, এইসব বিষয়কে ফালতু বিবেচনা করে সম্ভবত ভোটদানে বিরত থাকবেন। আর ১৬ শতাংশ মানুষ বলবেন এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও সৃষ্টিকর্তা কোনওদিন ছিল না, আর এখনও নেই।
বিষ্ণু: এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড তবে কি কোনও স্রষ্টা ছাড়াই তৈরি হয়ে গ্যাছে? এরা কি তবে সব চার্বাকচ্যালা?
নারদ: বর্তমানকালের কিছু মুনি-ঋষি, থুড়ি এরা আজকাল এঁদেরকে বিজ্ঞানী বলে ডাকেন, মর্ত্যের লোকেদের বুঝিয়েছেন যে কী একটা বিগ-ব্যাং না কোলাব্যাঙের থেকে এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে।
বিষ্ণু: কী?? ব্যাং এই ব্রহ্মাণ্ড বানিয়েছে? চার্বাকবাদী মূর্খরা আমাকে হেয় করতে এর চেয়ে আর বেশি কী বলবে? আর প্রাণীজগৎ? সেটাও কি ওই কোলাব্যাংটাই বানিয়েছে?
নারদ: না, কী একটা বিবর্তনবাদের তত্ত্ব, ডারউইন নামের কে একজন, মনুষ্যসমাজকে বুঝিয়েছে যে এককোষী প্রাণী থেকে নাকি ধীরে সব প্রাণী মানে মানুষ অবধি তৈরি হয়েছে!!
বিষ্ণু: এদের কথা কি মনুষ্যগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে?
নারদ: আরে না না। বললাম না মর্ত্যে এদের সংখ্যা এখনও মাত্র ২০ থেকে ২২ শতাংশ। বাকিরা তো কোনও না কোনও স্রষ্টাকে মানেন।
বিষ্ণু: কিন্তু আগামীদিনে বেশিরভাগ মানুষ যদি এদের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে, তবে আমারও তো জিউস-জুপিটারদের মতো অবস্থা হবে!
নারদ: সেটা হলে তো আপনার চেয়েও বড় বিপদে পড়বেন মর্ত্যের সব ধর্মের ব্যবসায়ীরা। কাজেই তারা সবাই মিলে এখন প্রাণপাত করে খাটছেন মর্ত্যের মানুষদের যেভাবেই হোক আদি মধ্যযুগে, মানে এইসব আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের আগের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
বিষ্ণু: সেটা কি আজ আর সম্ভব? মানে মানবসভ্যতাকে এতটা পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া?
নারদ: প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধানরা, অধিকাংশ শিক্ষামন্ত্রীরা, ধর্মগুরুরা, রাষ্ট্রের অধীনে থাকা বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা, এমনকি অনেক ডাক্তাররাও দিনরাত এক করে খাটছেন মানুষকে পিছনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যসূচি থেকে ডারউইনসহ নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানীদের কথা বাদ দিয়ে আদি মধ্যযুগের ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
বিষ্ণু: তাতে কি কাজের কাজ কিছু হচ্ছে?
নারদ: কাজ হবে না? একবার আপনি সম্ভব হলে নিজে গিয়ে আর্যাবর্তে, মানে যেটা এখন ভারত নামের দেশের অন্তর্গত, দেখে আসুন। চন্দ্রদেবের বাড়িতে, মহাকাশে যান পাঠানো বিজ্ঞানীরা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে ঘন্টা বাজাচ্ছেন। ডাক্তারেরা আধুনিক সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে রোগীকে পরীক্ষা করিয়ে কমিশন পাওয়ার পর বলছেন, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। এরপরেও কাজ না হয়ে পারে? আর্যাবর্তের পশ্চিমের ইসলামপন্থী দেশগুলো তো খুব তাড়াতাড়ি প্রায় দুশো বছর পেছোতে সক্ষম হয়েছে।
বিষ্ণু: তাহলে এখনও আশা আছে বলছ?
নারদ: অবশ্যই। আপনার, আল্লার, গডের উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। ধর্মব্যবসা আপনাদের ছাড়া চালানো অসম্ভব। কেউ কোনও কিছু আবিষ্কার করলেই ধর্মগুরুরা বলেন এসব হাজার হাজার বছর আগে থেকেই আমরা জানি। ব্যস্ বিজ্ঞানের বেলুন চুপসে যায়।
(হঠাৎ বাইরে গোলমালের শব্দ। মহাদেবের নেতৃত্বে বরুণ, অগ্নি, পবন সহ আরও কয়েকজন দেবতা প্রবেশ করেন)
মহাদেব (বিষ্ণুকে লক্ষ করে): যদি ওই দুপায়ে চলা জন্তুগুলোকে সামলাতে না পারেন, তবে দায়িত্ব ছেড়ে দিন।
বিষ্ণু: আরে আগে বসুন সবাই। এত উত্তেজিত কেন আপনারা? কী হয়েছে সেটা আগে বলবেন তো।
মহাদেব: কোনও খবরই যখন রাখেন না তখন ওনাদের থেকেই শুনুন।
বিষ্ণু: বেশ। বরুণবাবু আপনি প্রথমে বলুন।
বরুণ: আমরা দেবকুলের সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অশুভ অসুর, দানব, রাক্ষসদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আজ অবধি টিকে থেকেছি। কিন্তু আপনার প্রশ্রয়ে মানবদানবদের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। এর প্রতিকার করুন ভগবান। এদের অত্যাচারে আমার শরীরের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বিষ্ণু: কিন্তু আমি তো ওদের ধারালো নখ-দাঁত এসব কিছুই দিইনি। ওরা আপনাদের ওপর কী করে অত্যাচার করবে!? পবনদেব আপনি কিছু বলবেন?
পবনদেব: হ্যাঁ। ওসব ছাড়াই যা শুরু করেছে, থাকলে না জানি কী করত! ওদের অত্যাচারে মর্ত্য থেকে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বাকি সমস্ত জীবকুল হয় সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে বিলুপ্ত। শুধু গাছপালা-জীবজন্তু নয় এরা কম উন্নত মানুষদেরও বিলুপ্তির কারণ হয়ে উঠেছে।
মহাদেব: বানানোর সময়ই বলেছিলাম অতটা করে ঘিলু দেওয়ার দরকার নেই। এখনই ঠ্যালা সামলান নয়তো সময়ের আগেই প্রলয় ঘটিয়ে দেব।
বিষ্ণু: দয়া করে সবাই একটু ধৈর্য ধরুন। আমাকে একটু ভাববার সময় দিন। (একটু থেমে) আমি একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার ফল যে এত মারাত্মক হবে ভাবতে পারিনি। এখন আমাকে অবিলম্বে মর্ত্যলোক ও বিশেষত মনুষ্যজাতি সম্বন্ধে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মহাদেব: যাই সিদ্ধান্ত করবেন একটু তাড়াতাড়ি আর আমাদের সবাইকে জানিয়ে করবেন।
বিষ্ণু: অবশ্যই।