বিহার জাতগণনা রিপোর্ট: সংসদীয় রাজনীতির নতুন ঘূর্ণিঝড়

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 


দেশজোড়া জাতসমীক্ষা একদিকে যেমন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঠিক সংখ্যাটা নির্ধারণ করবে তেমনি সরকার বিজ্ঞাপিত পৃথিবীর তৃতীয় বড় অর্থনীতিতে এই মানুষদের অংশীদারিত্ব, দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে তাদের অবস্থান, রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের ভূমিকা নিরূপিত হবে। সরকারের জনকল্যাণ প্রকল্পের বিন্যাস, লক্ষ্যমাত্রার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব এই তথ্য পাওয়া গেলে। তাই জাতগণনার ন্যায্যতা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না

 

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার সে রাজ্যের জাতগণনা রিপোর্ট প্রকাশ করার পর থেকেই ভারতের সংসদীয়  রাজনীতিতে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই বিহারের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আটকে থাকবে না। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতগণনার বিষয়টি একটি জ্বলন্ত ইস্যু হয়ে ওঠার যাবতীয় সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ইতিমধ্যে এই রিপোর্টের প্রভাব ফলিত রাজনীতিতে দৃশ্যমান। স্বাধীন ভারতে এটাই প্রথম জাতগণনা যাতে দেখা যায় ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের ১৩ কোটি মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ অনগ্রসর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এবং এদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। স্বাভাবিকভাবেই এই রিপোর্টের ফলাফলকে সামনে রেখে বিহার রাজ্য মন্ত্রিসভা সংরক্ষণের মাত্রা ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং অতি অনগ্রসর শ্রেণির (ইবিসি) জন্য আর্থিক সহায়তা প্রকল্প ঘোষণা করেছে। জাতীয় কংগ্রেস আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ম্যানিফেস্টোতে জাতগণনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একদা দলিত রাজনীতির অন্যতম তারকা কাঁসিরামের বিখ্যাত স্লোগান “জিসকি জিতনি সংখ্যা ভারি, উতনি উসকি হিস্যাদারি” নতুন রূপে শোনা যাচ্ছে রাহুল গান্ধির গলায়: “জিতনি আবাদি উতনা হক”। প্রকাশ্যে জাতগণনার বিরোধিতা না করতে পারলেও বিজেপি নানানভাবে এই জাতগণনার দাবিটিকে লঘু করতে চাইছে। রিপোর্ট প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্তব্য করেছেন যে বিরোধীরা জাতের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করে ‘মহাপাপ’ করছেন। অন্যদিকে দেশ জুড়ে জাতগণনা করার দাবি জোরালো হচ্ছে।

ঔপনিবেশিক ভারতে জাতভিত্তিক গণনার কাজ শুরু হয় ১৯১১ সালে। বিআর আম্বেদকর তাঁর ‘untouchables or the children of India’s ghetto’ প্রবন্ধে এই জাতগণনার তাৎপর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এই জাতগণনার তথ্য পরবর্তীতে ১৯২১ ও ১৯৩১ সালের আদমসুমারিতে উল্লেখিত হয় এবং গোলটেবিল বৈঠকে তুমুল বিতর্ক হয়। মার্ক গ্যালেনটারের মতে ‘দলিত শ্রেণির’ এই সংখ্যা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নিপীড়িতদের অংশগ্রহণের প্রশ্ন ও রাজনৈতিক কাঠামোতে তাদের অংশিদারী নিয়ে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু ৪৭-পরবর্তী ভারতে জাতগণনার দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১ সালের আদমসুমারিতে আর্থ-সামাজিক সমীক্ষায় তথ্য সংগৃহীত হলেও সেই জাতভিত্তিক সমীক্ষার তথ্য কখনও প্রকাশিত হয়নি। এমনকি উত্তরপ্রদেশে ‘সামাজিক ন্যায় সমিতির’ নামে জাতভিত্তিক সমীক্ষা করা হলেও সেই সমীক্ষার ফল আটকে রাখা হয়েছে। মনে করা হয় উত্তরপ্রদেশে দলিত নেতা ওমপ্রকাশ রাজভরের দল এই কারণেই এনডিএ জোট পরিত্যাগ করেছে। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র বিহারেই প্রথম জাতগণনা সফল হল।

বিহার বিধানসভা সর্বসম্মতক্রমে জাতগণনার সিদ্ধান্ত নেয় প্রথমে ১৮ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) এবং পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি (২০২১)। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট বিহারের সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে দেশব্যাপী জাতগণনার দাবি পেশ করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে নীতিগতভাবে তারা এই সিদ্ধান্ত নেবে না। এই অবস্থায় ২০২২ সালের জুন মাসে বিহার সরকার নিজেই এই জাতগণনার নোটিফিকেশন জারি করে ও এই কাজের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই জাতগণনা বন্ধ করার দাবিতে পাটনা হাইকোর্টে ৫টি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয় কিন্তু আদালতের হস্তক্ষেপে সমীক্ষার অনুমতি মেলে। দুই পর্বে সমীক্ষার কাজে নিযুক্ত করা হয় ২.৬৪ লক্ষ কর্মীকে যারা ২ কোটি ৯০ লাখ বাড়িতে সমীক্ষা করে। এই সমীক্ষায় ২১৪টি জাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ১৭ পয়েন্ট প্রশ্নমালার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক তথ্যগুলো সমাবেশিত করা হয়েছে।

২০২৩ সালের ২ অক্টোবর প্রকাশিত বিহারের জাত-সমীক্ষার ফলাফলগুলি গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি সম্পূর্ণ সমীক্ষা নয়। বিহার বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে জাতগুলির আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সম্পূর্ণ চিত্রটি প্রকাশিত হবে। এখনও পর্যন্ত যা তথ্য পাওয়া গেছে:

  • বিহারের ১৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে অতি অনগ্রসর শ্রেণি (ইবিসি) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) মোট পরিমাণ ৬৩ শতাংশ।
  • এখন ওবিসি, ইবিসি, তফসিলি জাতি (এসসি) এবং তফসিলি জনজাতি (এসটি)-কে একসঙ্গে যুক্ত করলে সংখ্যাটা হয় প্রায় ৮৫ শতাংশ।
  • অসংরক্ষিত (তথাকথিত উচ্চবর্ণ) পরিমাণ ১৫.৫ শতাংশ।
  • বিহারে অতি অনগ্রসর শ্রেণির (ইবিসি) সংখ্যা ৪,৭০,৮০,৫১৪ (৩৬.০১ শতাংশ)।
  • ওবিসি ৩,৫৪,৬৩,৯৩৬ (২৭.১২ শতাংশ)।
  • এসসি ২,৫৬,৮৯,৮২০ (১৯.৬৫ শতাংশ)।
  • এসটি ২১,৯৯,৩৬১ (১.৬৮ শতাংশ)।
  • তফসিলি জনজাতি (এসটি)-র সংখ্যা কম হওয়ার কারণ অবিভক্ত বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠিত হওয়ার পর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বেশিটাই এখন সে-রাজ্যের।
  • বিহারে সবচেয়ে বেশি লোক রয়েছে যাদব জনগোষ্ঠীর (১৪.২৭ শতাংশ)।
  • বিহারের মোট জনসংখ্যা বর্তমানে ১৩,০৭,২৫,৩১০ (২০১১ সালে জনসংখ্যা ছিল ১০.৪১ কোটি)।
  • ধর্মীয় পরিচিতি অনুসারে বিহারে হিন্দু ৮১.৯৯ শতাংশ, মুসলিম ১৭.৭২ শতাংশ। বৌদ্ধ, ক্রিশ্চান, শিখ, জৈন ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পরিমাণ আণুবীক্ষণিক।

বিহারের এই চিত্র একটি বৃহত্তর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সেটা হল ভারতে এই প্রান্তিক সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যাটা কত। তফসিলি জাতি, জনজাতি, সমস্ত ধরনের অনগ্রসর শ্রেণিকে ধরলে বিহারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সংখ্যাটা প্রায় ৮৫ শতাংশ। বাকি দেশের ছবিটা কেমন সে-সম্পর্কে আমাদের কোনও সঠিক হিসাব নেই। মন্ডল কমিশন শুধু অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি+ইবিসি) সংখ্যাটা ৫২ শতাংশ বলেছিল। ১৯৯৭-২০০৭ সময়পর্বে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার প্রাপ্ত সংখ্যা অনুসারে মনে করা হয় ওবিসির সংখ্যা ৩৬ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশের মধ্যে। আবার ইউনাইটেড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন প্লাসের তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ওবিসি। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশজোড়া জাতসমীক্ষা একদিকে যেমন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঠিক সংখ্যাটা নির্ধারণ করবে তেমনি সরকার বিজ্ঞাপিত পৃথিবীর তৃতীয় বড় অর্থনীতিতে এই মানুষদের অংশীদারিত্ব, দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে তাদের অবস্থান, রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের ভূমিকা নিরূপিত হবে। সরকারের জনকল্যাণ প্রকল্পের বিন্যাস, লক্ষ্যমাত্রার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব এই তথ্য পাওয়া গেলে। তাই জাতগণনার ন্যায্যতা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

এই ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই সমীক্ষা হয়নি কারণ ভারতের শাসক দলগুলোর মধ্যে উচ্চবর্ণ তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের অপরিসীম নিয়ন্ত্রণ। কেন বিহারের এই জাতসমীক্ষা ভারতের রাজনীতিতে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করতে পারবে তা বোঝার জন্য আমাদের কয়েক দশক পিছিয়ে যেতে হবে। ওবিসিদের সংরক্ষণের দাবিটি যখন মন্ডল কমিশনের রিপোর্টে সমর্থিত হয় তখন তার অভিঘাত ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছিল। দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বে উঠে আসে এবং গো-বলয়ে তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। লালুপ্রসাদ যাদব, নীতিশ কুমার, মূলায়ম সিং যাদব, কাঁসিরাম, মায়াবতী, রামবিলাস পাসোয়ান এই নতুন রাজনীতির ফসল হিসাবে উঠে আসেন। এই রাজনীতি সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের রাজনীতির এক বিপরীত চেতনা হিসাবে উপস্থিত হয়। রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা একে ‘মন্ডল বনাম কমন্ডলু’-র রাজনীতি বলে চিহ্নিত করেন।

এই দলিত রাজনীতি প্রায় দুই দশক ধরে গোবলয়ে প্রধান শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই রাজনীতি একদিকে যেমন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের সামাজিক ভিত্তিতে ফাটল ধরায় তেমনি সামাজিক ন্যায়ের কথকতায় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে রাখে। এইজন্য আমরা দেখতে পাই বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির দেশব্যাপী সফল রথযাত্রার পরেও হিন্দুত্ববাদীরা একার শক্তিতে ক্ষমতা পায় না। কিন্তু এই দলিত রাজনীতির মধ্যেকার বিভাজন, দু-তিনটি জাতের প্রাধান্যকারী ভূমিকায় উঠে আসা পরিস্থিতির বদল ঘটায়। সেই সুযোগ নিতে এগিয়ে আসে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। ভারতীয় বর্ণব্যবস্থার অন্তর্বিরোধকে দূরে সরিয়ে রেখে সংঘ ভারতীয় রাজনীতিতে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর এক নতুন ন্যারেটিভ হাজির করে যার পোস্টার বয় অবশ্যই নরেন্দ্র মোদি। একই সঙ্গে তফসিলি জাতি, জনজাতি, ওবিসিরা যাতে এক মহাজোট গঠন করতে না পারে তারজন্য সংঘ ইবিসিদের ক্ষমতায়নের স্লোগান তোলে। এমনকি নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়া আসলে ওবিসিদের ক্ষমতায়নের প্রতীক বলে প্রচার করা হয়। তাই আমরা দেখতে পাই উপর্যুপরি নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের ক্ষেত্রে ওবিসিরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০১৪ সাল থেকে এই জাতগণনার ফলাফল পর্যন্ত গোবলয়ের রাজনীতির সূত্রটা বিজেপি বহুলাংশে নিজের হাতে রাখতে পেরেছিল। এই রাজনীতির কেন্দ্রে আছে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব আর দলিত রাজনীতির মূল লক্ষ্য হল জাতপাত প্রথার ধ্বংসসাধন। তাই বিজেপির পক্ষে স্থিতাবস্থা রক্ষা করে দলিতদের জন্য কিছু প্রসাধনী পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কাছে এই জাতসমীক্ষা নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। বিজেপির সমস্যা হল তারা যদি জাতসমীক্ষা ও তার ফলে উঠে আসা অধিক সংরক্ষণের দাবিকে মান্যতা না দেয় তাহলে তাদের মধ্যেকার দলিত মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা বিদ্রোহী হবে। আবার যদি তারা দলিত তথা সামগ্রিকভাবে প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের দাবি মেনে নেয় তবে তাদের রাজনীতির মূল অক্ষ উচ্চবর্ণের মানুষদের সঙ্গে অনিবার্য বিরোধ উপস্থিত হবে।

বিজেপি-বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের কাছে জাতগণনার দাবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনিতেই ইন্ডিয়া জোটের অনুঘটক দলগুলোর একটা বড় অংশ সামাজিক ন্যায়ের দাবির সমর্থক। এমনকি প্রধান দল কংগ্রেসও কোনওরকম দ্বিধা না দেখিয়েই জাতসমীক্ষার দাবিকে সমর্থন করেছে। বাস্তব ভোটের পাটিগণিতে দক্ষিণ ভারতে আজ কোনও রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায় নেই। তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দক্ষিণ ভারতের পরীক্ষাগারেও সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। এই অবস্থায় বিজেপির প্রধান ভরসার জায়গা উত্তর ভারত। কিন্তু এই জাতগণনার রাজনীতির দাবিতে ওবিসি, ইবিসি, তফসিলি জাতি ও জনজাতিরা একজোট হয় তাহলে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও বিহারে বিরোধীরা অভাবনীয় ফল করতে পারে যাতে বিজেপির নির্বাচনী সাফল্য অনিশ্চিত হয়ে যাবে। এটা আন্দাজ করেই সংঘপ্রধান মোহন ভাগবত দলিতদের ‘মূল স্রোতে’ ফিরিয়ে আনার দাবি তুলছেন। হিন্দুদের গোমাংস খাওয়ার নিদান, সংঘকর্তাদের বাধ্যতামূলকভাবে দলিত বাড়িতে ভোজন ও রাত্রিবাস, আম্বেদকর রচনাবলি পাঠ, এমনকি এতদিন ধরে চলে আসা বর্ণবাদী অত্যাচারের প্রতিকারের দাবি আসলে ড্যামেজ কন্ট্রোলের নীল নকশা মাত্র।

আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনী রাজনীতিতে ইন্ডিয়া জোটের সম্ভাবনা তৈরি হলেও তাদেরও সমস্যা কম নয়। এই সমস্যাটা লুকিয়ে অতি অনগ্রসর শ্রেণি (ইবিসি) হিসাবে। এতদিন পর্যন্ত ওবিসি রাজনীতির অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে তাদের রাজনীতিতে প্রাধান্যকারী অবস্থায় আছে দু-একটি শ্রেণি। বিহারের ক্ষেত্রে যেমন যাদব ও কুর্মিরা। কিন্তু এবারের সমীক্ষা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনে দিয়েছে মাল্লা, নাই, নুনিয়ার মতো অতি পিছড়ে বর্গের মানুষদের, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে যাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ভারতের রাজনীতিতে এই অতি পিছড়ে বর্গের গুরুত্বের কথা প্রথম বলেছিলেন বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরি ঠাকুর। আজ তাই ওবিসির মধ্যে ইবিসিদের জন্য আলাদা সংরক্ষণের (quota within quota) দাবি জোরালো হয়ে উঠে আসছে। ২০১৭ সালে এই বিষয়টা নিয়ে সমীক্ষার জন্য রোহিনী কমিশন গঠিত হয়েছে। ইবিসিদের ক্ষমতায়নের দাবি আবার বৃহত্তর ওবিসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন ক্ষমতাবিন্যাসের দাবি তুলবে। তাই আপাতভাবে সামাজিক ন্যায়ের ধ্বজাধারী দলগুলি লাভবান হলেও ভবিষ্যতে তা নতুন লড়াইয়ের সৃষ্টি করবে।

বিহারের জাতগণনা কোনও নতুন তথ্য দেয়নি। আমাদের এতদিনের ধারণার উপর পরিসংখ্যানের সিলমোহর দিয়েছে মাত্র। আগামীতে প্রকাশিতব্য আর্থ-সামাজিক তথ্যগুলো এই সম্প্রদায়গুলোর প্রকৃত অবস্থাকে উন্মোচন করবে এবং তারা প্রচলিত কাঠামোতে তাদের অধিকার বুঝতে চাইবে। বিহারের জাতগণনা তাই আগামীতে ভারতীয় রাজনীতির আরেকটি জলবিভাজিকা হতে চলেছে— এমন ভাবনা অসঙ্গত নয়।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...