প্রসঙ্গ, কোয়ান্টাম ডট: ২০২৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার

সঞ্জীব বাগচী

 



এমেরিটাস অধ্যাপক, রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টিনারি কলেজ

 

 

 

 

এ-বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনজন: এমআইটি (MIT)-র অধ্যাপক মোঙ্গি বাওয়েন্ডি (Moungi Bowendi), কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুই ব্রুস (Louis Brus) এবং নিউ ইয়র্কের ন্যানোক্রিস্টাল টেকনোলজি-র পূর্বতন প্রধান বিজ্ঞানী অ্যালেক্সি একিমভ। কোয়ান্টাম ডট বিষয়ে এঁদের গবেষণা এক নবযুগের সূচনা করেছে— এটাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এঁদের কাজ বর্ণনা করার আগে জেনে নেওয়া যাক এই কোয়ান্টাম ডট বলতে আমরা কী বুঝি এবং তার বিশেষত্বই বা কী।

 

সাধারণভাবে বললে কোয়ান্টাম ডট হল খুব ছোট আকারবিশিষ্ট এক নিয়তাকার গঠন। এদের আকার ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার (nm; 1nm = 10-9m)। নিয়তাকার গঠনের কারণে এদের ন্যানো-কেলাস (nano-crystal) বলা হয়। একটি কোয়ান্টাম ডটের মধ্যে কমবেশি এক হাজার অণু/পরমাণু থাকে। সচরাচর আমরা যে-সব ছোট পদার্থ নিয়ে চর্চা করি, যাকে আমরা বলব স্তূপ বা বাল্ক (bulk), তার মধ্যে অণু/পরমাণুর সংখ্যার চেয়ে কোয়ান্টাম ডটে উপস্থিত অণু/পরমাণুর সংখ্যা অনেক অনেক কম। কোয়ান্টাম ডট আকারে কতটা ছোট সেটা একটা তুলনা দিলেই বোঝা যাবে। একটা ফুটবল পৃথিবীর তুলনায় যতটা ছোট, একটা ফুটবলের তুলনায় কোয়ান্টাম ডট ততটাই ছোট। উদাহরণস্বরূপ, একটি লোহার পিনের মাথায় মোটের ওপর 3×1013 সংখ্যক পরমাণু থাকে। দেখা গেছে, বাল্ক পরিমাণ পদার্থের ভৌত (বৈদ্যুতিক ও আলোক-সংক্রান্ত) ও রাসায়নিক গুণ ওই পদার্থটির ন্যানো-গঠনের ধর্মের চেয়ে আলাদা। উপরন্তু ন্যানো-জগতে বস্তুর ধর্ম বস্তুর আকারের উপর নির্ভর করে।

 

এবার একটু বিশদে ন্যানোজগতের বস্তুর বৈশিষ্ট্য এবং প্রকারভেদ আলোচনা করা যাক। এই ত্রিমাত্রিক বিশ্বে আমরা কোনও বস্তুর বর্ণনার জন্য দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা এই তিনটি মাত্রার কথা বলে থাকি। জ্যামিতিকভাবে যথাক্রমে x, y ও z অক্ষরেখা বরাবর দূরত্ব দ্বারা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা (বেধ) প্রকাশ করা হয়। বাল্ক পরিমাণ বস্তুতে এই তিনটি রাশির যে-কোনও মান সম্ভব। এরকম বস্তুতে অবস্থিত একটি কণা (যেমন ইলেকট্রন) তিনমাত্রায় যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারে। অর্থাৎ কণাটির গতি তিনটি মাত্রাতেই অবাধ বা মুক্ত। বলা যেতে পারে কণাটির মুক্তি-মাত্রা (degree of freedom) হল তিন। তিনটি অক্ষ-বরাবরই কণাটির গতির কোনও বিধিনিষেধ নেই। আরও বলা যেতে পারে, কণাটির আবদ্ধতার মাত্রা (degree of confinement) হল শূন্য। কিন্তু ভাবা যাক, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ-বরাবর যথেচ্ছ বিচরণে সক্ষম হলেও কণাটি একটি নির্দিষ্ট ছোট মানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে বলা হবে মুক্তিমাত্রা দুই, এবং আবদ্ধতা-মাত্রা এক। কণাটির গতিবিধি একের বেশি মাত্রায় আবদ্ধ হতে পারে। এই আবদ্ধতার কারণে কণাটির গতিপ্রকৃতি সনাতন পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে চলে না। তখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগে বস্তুর ধর্মসমূহ নির্ণীত হয়। সে-জন্য এইরকম আবদ্ধতাকে কোয়ান্টাম-আবদ্ধতা (Quantum confinement) বলা হয়।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা গেল যে, কণাটি যখন ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ থাকে তখনই বিশেষ গুণাবলির প্রকাশ পায়। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে ক্ষুদ্র বা বৃহতের ধারণা আপেক্ষিক। যেমন, একটি মার্বেল গুলি একটি ক্রিকেট বলের চেয়ে ছোট, আবার একই মার্বেল গুলি একটি সরষেদানার চেয়ে বড়। সেইজন্য ‘ক্ষুদ্র পরিসর’টি কোন দৈর্ঘ্যের তুলনায় ছোট সেটা অবশ্যই বলতে হবে। সেই দৈর্ঘ্য কীরকম হয় সেটা জানা প্রয়োজন। কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার ধারণা অনুযায়ী একটি কণার যুগপৎ কণা (particle) ও তরঙ্গ (wave) ধর্ম বিদ্যমান। বস্তুত তরঙ্গ-ধর্ম ডি ব্রগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য (de Broglie wavelength) দ্বারা সূচিত হয় (Box 1)।

Box 1

কোনও কণার ডি ব্রগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য (λ)-এর তুলনায় যে দৈর্ঘ্য-বরাবর কণাটির গতি আবদ্ধ (a) তা যদি বেশি হয় তবে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার প্রয়োগ অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি a-র মান λ-র মানের প্রায় সমান বা ছোট হয়, তখন কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অনেক সময় ডি ব্রগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তে বোরের ব্যাসার্ধ (Bohr radius, aB) সাপেক্ষেও তুলনা করা হয়। aB এবং λ রাশিদ্বয় সম্পর্কিত (Box 1)।

আবদ্ধতার নিরিখে বিচার করলে মোট তিন রকম ন্যানো-গঠনের কথা ভাবা যেতে পারে (Box 2)।

মুক্তিমাত্রা আবদ্ধতা-মাত্রা নাম
কোয়ান্টাম কূপ (দ্বিমাত্রিক)
কোয়ান্টাম তার (একমাত্রিক)
কোয়ান্টাম ডট (শূন্যমাত্রিক)

Box 2

 

কোয়ান্টাম কূপ: পদার্থটি দ্বিমাত্রিক। তৃতীয় মাত্রার মান একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, একখণ্ড গ্রাফাইট থেকে সেলোটেপ প্রয়োগে গ্রাফাইট থেকে একটা পাতলা স্তর উঠে আসে— যাকে বলা হয় গ্রাফিন (graphene)। এটি একটি কোয়ান্টাম কূপের উদাহরণ। উল্লেখ করা যেতে পারে গ্রাফিনের প্রস্তুতি এবং ধর্মের উপর গবেষণার জন্য আন্দ্রে গেইম (Andre Geim) এবং কনস্টান্টিন নেভোসেলভ (Konstantin Nevoselov) ২০১০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান।

কোয়ান্টাম তার: একমাত্রিক পদার্থ। অন্য দুটি মাত্রায় বিস্তার ছোট (ন্যানো) সীমার মধ্যে আবদ্ধ। উদাহরণ: কার্বন ন্যানো তার।

কোয়ান্টাম ডট: শূন্যমাত্রিক। আবদ্ধতার মাত্রা এক্ষেত্রে তিন। ১৯৮৫ সালে রিচার্ড স্মলি, রবার্ট কার্ল এবং থারল্ড ক্রোটো গ্রাফাইটের ওপর লেজার রশ্মির ক্রিয়ায় ৬০টি কার্বন পরমাণু-বিশিষ্ট একটি ন্যানো গঠন আবিষ্কার করেন (C60) যার নাম দেওয়া হয় ‘ফুলারিন’ (Fullerene)। এই আবিষ্কারের জন্য এই তিনজন বিজ্ঞানী ১৯৯৬ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। এছাড়া বিভিন্ন যৌগিক পদার্থ (CdS, CdSe, ZnO ইত্যাদি) কোয়ান্টাম ডট তৈরি করে। এর মধ্যে CdSe-র কোয়ান্টাম ডটের আকার 2-6 nm। এই ডটে ইলেকট্রনের বোর ব্যাসার্ধ হিসেব করে দেখা গেছে 5-6 nm। অর্থাৎ এক্ষেত্রে কোয়ান্টাম-আবদ্ধতা কার্যকরী। কোয়ান্টাম ডটের একটি ধর্ম হল অর্ধ-পরিবাহিতা।

পদার্থের মধ্যে অবস্থিত ইলেকট্রনের গতিবিধি পদার্থটির তড়িৎ-পরিবাহিতা, আলোক শোষণ-বিকিরণ ও রাসায়নিক ধর্মাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। যার ফলে এইরূপ ন্যানো-গঠনে ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলি বেশ চিত্তাকর্ষক এবং পদার্থটির আকারের উপর নির্ভরশীল। ১৯৩৯ সালে বিজ্ঞানী ফ্রলিস (Frolich) তাত্ত্বিক গণনায় আকার-নির্ভর ধর্মের উল্লেখ করেন। পরে বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৫৯ সালে একটি বক্তৃতায় (There is plenty of room at the bottom) ক্ষুদ্রায়নের বিপুল সম্ভাবনার কথা আলোচনা করেন। যদিও কোয়ান্টাম ডটের ওপর পরীক্ষামূলক গবেষণা অনেক পরে শুরু হয়।

 

মধ্যযুগীয় গির্জায় যে রঙিন কাচ ব্যবহার করা হত সেই কাচের মধ্যে ধাতব ন্যানো-গঠনের (কোয়ান্টাম ডটের) অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে রোমান সম্রাটদের ব্যবহারের জন্য এক ধরনের কাচের কাপ তৈরি হত যার নাম ‘লাইকারগাস কাপ’। এই কাপের বিশেষত্ব হল দৃষ্টিকোণের সঙ্গে সঙ্গে কাপের রং পরিবর্তিত হয়। এই ধরনের কাচের প্রস্তুতিতে সোনা বা রূপা ব্যবহৃত হত। পরবর্তীকালে ওই ধরনের রঙিন কাচের মধ্যে সোনা/রূপার ন্যানো-গঠনের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। সে-দিক থেকে দেখলে প্রাচীন এই সমস্ত কারিগরই পৃথিবীর আদিম ন্যানো-কারিগর।

সোনার ন্যানো-গঠন নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন মাইকেল ফ্যারাডে। প্রস্তুত-প্রণালীর ওপর নির্ভর করে ধাতব সোনার কোলয়েড দ্রবণে বিভিন্ন রঙের (লাল থেকে নীল) উপস্থিতি ফ্যারাডেকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি বিভিন্ন বিজারকের সাহায্যে দ্রবণে অবস্থিত ক্লোরোঅরিক অ্যাসিড (HAuCl4) বিজারিত করে ধাতব সোনা তৈরির চেষ্টা করেন। যদিও তিনি দ্রবণের রঙের সঙ্গে কোলয়ডাকৃতির সোনার আকারের কোনও সম্পর্ক সম্বন্ধে ধারণা করতে পারেননি, তবুই তাঁর প্রদর্শিত পথেই পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিকরা দ্রাবক, বিজারক ও তাপমাত্রার তারতম্য ঘটিয়েই কোয়ান্টাম ডট প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। এই ধরনের পদ্ধতিতে দ্রবণে অবস্থিত আয়ন (Au3+) থেকে Au পরমাণু তৈরি হয় এবং পরে অনেকগুলি পরমাণু একত্রিত হয়ে ন্যানো-কেলাস গঠন করে। সেইজন্য এই ধরনের প্রস্তুত-প্রণালীকে ‘ছোট-থেকে-বড়’ (Bottom Up) পদ্ধতি বলে। পক্ষান্তরে বড় আকারের কঠিন পদার্থ থেকে আলোক তরঙ্গের সাহায্যে ক্ষুদ্র কণা তৈরি করা যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘বড়-থেকে-ছোট’ (Top Down) পদ্ধতিতে ব্যবহৃত তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কম আকার বিশিষ্ট কণা প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। সেইজন্য ক্ষুদ্রতর কণা তৈরি করতে হলে ক্ষুদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্য-সম্পন্ন রশ্মি (যেমন UV রশ্মি, ইলেকট্রন তরঙ্গ) ব্যবহার করতে হবে।

 

কোয়ান্টাম ডটের ব্যবহারিক প্রয়োগ

আকার-নির্ভর তড়িৎ এবং আলোক-সংক্রান্ত ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এইসব পদার্থকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়:

১. কোষ-চিহ্নিতকরণ: জীবনবিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে কোনও কোষ চিহ্নিত করার জন্য অনেক সময় কয়েকটি জৈব যৌগ ব্যবহার করা হয়। যৌগগুলি কোষের সঙ্গে রাসায়নিকভাবে আটকে থাকে, পরে ওই জৈব বস্তুর বিশেষ প্রতিপ্রভা বা ফ্লুরেসেন্স ধর্ম কাজে লাগিয়ে কোষটি চিহ্নিত করা যায়। কোয়ান্টাম ডটের ওপর নীল আলো আপতিত হলে ওই আলো শোষিত হয় এবং কম কম্পাঙ্কের (বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের) আলোর প্রতিপ্রভা পাওয়া যায়। পরীক্ষাধীন কোষের সঙ্গে কোয়ান্টাম ডট আটকে দিয়ে প্রতিপ্রভা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও কোষটিকে শনাক্ত/চিহ্নিত করা যেতে পারে। জৈব যৌগ অনেক সময় আলোর প্রভাবে আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে (photo-bleaching) এবং জৈবটির প্রতিপ্রভা কমে যায়। ফলে পদার্থটির কার্যকারিতা হ্রাস পায়। কোয়ান্টাম ডট যেহেতু অজৈব যৌগ, এদের ক্ষেত্রে photo-bleaching সাধারণভাবে খুব কম হয়।

২. বিভিন্ন রঙের আলোর উৎপাদন: আলোকের ঝরনাধারায় চারদিক উদ্ভাসিত করতে বর্তমানে আলোক নিঃসরণকারী ডায়োড (light emitting diode, LED) বহুল ব্যবহারের কথা আমরা সবাই জানি। বেশিমাত্রায় তীব্রতা, কম শক্তি খরচ এবং প্রায় শূন্য তাপ উৎপাদন LED ব্যবহারকে জনপ্রিয় করেছে। কোয়ান্টাম ডট এই LED-র প্রবল প্রতিপক্ষ। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পদার্থ বিভিন্ন আকারে বিভিন্ন রঙের আলো নিঃসরণ করে। বিভিন্ন রঙের মিশ্রণে সাদা আলো উৎপাদনও সম্ভব। এছাড়া কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করে লেজার (LASER) রশ্মির উৎপাদনও সম্ভব।

 

কোয়ান্টাম ডটের প্রস্তুতিতে প্রাথমিক যুগান্তকারী গবেষণা

আগে বলা হয়েছে, কোয়ান্টাম-আবদ্ধতার কারণে কোয়ান্টাম ডটের আকার-নির্ভর ধর্মের বিষয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা অনেক আগে শুরু হলেও পরীক্ষাগারে কোয়ান্টাম ডট প্রস্তুতি সহজসাধ্য ছিল না। এছাড়াও এত ছোট আকারের কণা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রেরও (microscope) অভাব ছিল। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ (Electron Microscope) উদ্ভাবিত হওয়ায় ন্যানো-আকারের গবেষণায় জোয়ার এল। বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের প্রথমদিকে বিজ্ঞানীরা কোনও কঠিন পদার্থের ওপর বিভিন্ন আকারের ন্যানো-আস্তরণ তৈরি করতে সক্ষম হন। পরীক্ষায় দেখা গেল, আস্তরণের বেধের ওপর পদার্থটির তড়িৎ এবং আলোক-সংক্রান্ত ধর্ম নির্ভর করে, তাত্ত্বিক গবেষণায় যার হদিশ আগেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এইরকম পরীক্ষায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কারিগরি দক্ষতা— যেমন, চরম বায়ুশূন্যতা (high vacuum) বা অতিরিক্ত তাপমাত্রা— প্রয়োজন। তাই উৎপাদন সম্ভব হলেও ব্যবহারিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কোনও উপযোগিতার কথা ভাবা সম্ভব ছিল না।

বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ায় বিজ্ঞানী একিমভ (Yekimov) রঙিন কাচ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। রঙিন কাচ তৈরি করার সময় মিশ্রণে ধাতব সোনা, রূপা বা ক্যাডমিয়ামের ব্যবহারের বিষয়ে আগেই জানা ছিল। একিমভ যে-ব্যাপারে বিস্মিত হলেন সেটা হল সেই একই ধাতু (যেমন Au) কাচে বিভিন্ন রং এনে দিতে সক্ষম। তিনি নিজে কপার-ক্লোরাইড মিশিয়ে কাচ তৈরি করলেন। প্রস্তুতির সময়ে গলিত কাচকে বিভিন্ন তাপমাত্রায় (৫০০-৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বিভিন্ন সময় ধরে (১-৯৬ ঘন্টা) উত্তপ্ত করা হল। ঠান্ডা করার পরে উৎপন্ন কাচের মধ্যে এক্স রশ্মি চালনা করে তিনি প্রমাণ করলেন যে কাচে কপার ক্লোরাইডের অতিক্ষুদ্র কেলাস বর্তমান। দেখা গেল, উৎপন্ন কাচের রং কপার ক্লোরাইডের কেলাসের আকারের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রথম পরীক্ষাগারে ন্যানো-আকৃতির কেলাস তৈরি করা সম্ভব হল। কোয়ান্টাম ডটের গবেষণায় এটা এক যুগান্তকারী ঘটনা। প্রায় একই সময়ে ব্রুস (Brus) দ্রবণে ভাসমান ন্যানোকেলাস গঠনে সক্ষম হন। তিনি সূর্যরশ্মি থেকে শক্তি আহরণ করে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত করার চেষ্টা করছিলেন। সূর্য থেকে শক্তি আহরণ করার উপকরণ হিসেবে তিনি ক্যাডমিয়াম সালফাইড (CdS) ব্যবহার করেন। সূর্যরশ্মির শক্তি CdS-এর পৃষ্ঠতলে শোষিত হয়। অধিক শক্তি সংগ্রহের জন্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র CdS কেলাস ব্যবহার করতে হয়। ব্রুস লক্ষ করলেন বিকারক মিশ্রণ কিছুক্ষণ রেখে দেওয়ার পর দ্রবণের রঙের পরিবর্তন ঘটছে। রঙের পরিবর্তন যে CdS-এর আকার পরিবর্তনের ফলে ঘটছে সেটা তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন। অর্থাৎ ব্রুসের পরীক্ষাও পরীক্ষাগারে দ্রবণে কোয়ান্টাম ডট উৎপন্ন করার প্রথম সফল প্রয়াস। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই উৎপন্ন কোয়ান্টাম ডটগুলির আকার সমান নয়। অর্থাৎ আকার একটি নির্দিষ্ট পরিসরে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু উৎপন্ন কোয়ান্টাম ডটের আকারের বিভিন্নতা ওদের বাণিজ্যিক ব্যবহারের পরিপন্থী।

কোয়ান্টাম ডটের গবেষণায় সমাকৃতির ন্যানো-কেলাস গঠনের কৃতিত্ব হল মোঙ্গি বাওয়েন্ডির। তিনি ১৯৮৮ সালে ব্রুসের গবেষণাগারে পিএইচডি-উত্তর গবেষক হিসেবে যোগ দেন এবং ব্রুস-বর্ণিত পদ্ধতিকেই পরিমার্জিত করতে চেষ্টা করেন। পরে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিট্যুট অফ টেকনোলজি (MIT)-তে যোগ দেন।

১৯৯৩ সালে বাওয়েন্ডি বিভিন্ন দ্রাবক ও বিকারক ব্যবহার করে এবং তাপমাত্রার তারতম্য ঘটিয়ে উৎপন্ন কোয়ান্টাম ডটগুলির আকার নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হন।

 

কোয়ান্টাম ডট উৎপাদনে সমস্যাবলি এবং বর্তমান গবেষণা

বস্তুত কোয়ান্টাম ডটের বাণিজ্যিক ব্যবহার তাদের আকার-নির্ভর ধর্মের ওপর নির্ভরশীল। বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে হলে একটি নির্দিষ্ট আকারবিশিষ্ট কোয়ান্টাম ডট প্রস্তুত করা প্রয়োজন। কিন্তু এটা সহজসাধ্য নয়। বস্তুর পৃষ্ঠটান ধর্মের জন্য ছোট ছোট কঠিন কণা জোড়া লেগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বড় হতে চায়। এটা যে-কোনও পদার্থের সহজাত ধর্ম। তাই আকার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিক্রিয়ার কোনও পর্যায়ে উৎপন্ন কেলাসগুলির মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি করা প্রয়োজন যার ফলে পৃষ্ঠটানজনিত বল কম কার্যকরী হয়। রাসায়নিকভাবে কোনও উপযুক্ত যৌগ (Ligand) ব্যবহার করে এই কাজ করা সম্ভব। উল্লেখ করা যেতে পারে কোয়ান্টাম ডট হল নিয়তাকার কঠিন পদার্থ। বাস্তবে এরা ক্ষুদ্র (ন্যানো) কেলাস। এই কেলাসের সবচেয়ে বাইরের তলে যে অ্যাটম বা আয়ন থাকে তারা অন্য অ্যাটম/আয়নের সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে যার ফলে কণাটি আকারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বাইরে থেকে কোনও যৌগ ব্যবহার করে পৃষ্ঠতলের আয়ন/অ্যাটমের যোজ্যতা প্রশমিত করা হয়। যোজ্যতা প্রশমনের জন্য বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক যৌগ ব্যবহারের প্রচলন আছে। বর্তমানে বিভিন্ন ছোট আয়ন যোগ করেও এ কাজ করা হয়। তবে দেখা গিয়েছে কোয়ান্টাম ডটের গুণাবলি এইসব যোজ্যতা প্রশমনকারী নিয়ন্ত্রকের ওপর নির্ভর করে।

পরিশেষে উল্লেখ করা যায়, এই আকার-নির্ভরতা শুধু ভৌত ধর্মাবলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। যেহেতু রাসায়নিক ধর্মসমূহ বস্তুর ভিতর অবস্থিত ইলেকট্রনের ওপর নির্ভর করে এবং কোয়ান্টাম ডটে ইলেকট্রনগুলি কোয়ান্টাম আবদ্ধতায় থাকে, সেইজন্য কোয়ান্টাম ডটের রাসায়নিক ধর্ম বড় আকারের বস্তুর ধর্মের থেকে আলাদা হওয়া বিচিত্র নয়। প্রায়শই দেখা যায় যে একটি ধাতু (যেমন Ag) কোয়ান্টাম ডট অবস্থায় বেশি কার্যকরী অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

বিজ্ঞানীরা তাই নতুন নতুন নিয়ন্ত্রিত কোয়ান্টাম ডট তৈরি করে চলেছেন এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে এদের ভৌত এবং রাসায়নিক গুণাবলি পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...