আসামের বাঙালির সমস্যার সমাধান কলকাতায় নেই

জয়দীপ বিশ্বাস

 

বছর শেষের মাঝরাতে অসমে প্রকাশ হল নাগরিকপঞ্জির আংশিক খসড়া। মোট ৩ কোটি ২৯ লাখ আবেদনের মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ নামই স্থান পেয়েছে প্রথম খসড়ায়। এর অর্থ হচ্ছে, আপাতত বাদ গেছে, ১ কোটি ৪০ লাখের মতো মানুষের নাম। ঊর্ধ্বতন আদালতের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে বছর তিনেক ধরে পুরো প্রক্রিয়াটি চলছে। বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ও রোহিংটন জলি নরিম্যানের খণ্ডপীঠের নির্দেশ মেনেই তড়িঘড়ি ৩১শে ডিসেম্বর মধ্যরাতেই এই প্রাথমিক নথিটি টাঙানো হয়েছে।

বিপুল সংখ্যায় নাম বাদ পড়ায় একদিকে যেমন চলছে রাজনৈতিক চাপানউতোর, অন্যদিকে আশঙ্কা ক্রমশই আতঙ্কের চেহারা নিচ্ছে বাঙালিদের মধ্যে। এর পেছনে একদিকে যেমন রয়েছে সংখ্যাতাত্ত্বিক কারণ, অন্যদিকে আছে পুরো এন আর সি পদ্ধতির নিজস্ব ত্রুটির দিক।

জেলাওয়াড়ি তথ্য বলছে অসমিয়া-প্রধান উজান আসামে যেখানে নাম অন্তর্ভুক্তির হার গড়ে পঁচাত্তর শতাংশ, সেখানে বরাক উপত্যকার বাঙালি-অধ্যুষিত তিন জেলার হার সাকুল্যে পঁয়ত্রিশ। গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, তেরোটি জেলায় দু’শোর বেশি এন আর সি সেবাকেন্দ্রে নব্বই শতাংশ লোকের নামই ওঠেনি। বলাই বাহুল্য, ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘু এলাকাগুলোতেই নাম তুলতে সরকারি আধিকারিকরা কার্পণ্য দেখিয়েছেন। পুরো বিষয়টিকে নিছক কাকতালীয় বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তা সম্ভবপর হচ্ছে না একটিই কারণে। এন আর সি কর্তৃপক্ষই বলছেন, উজান আসামে মূলত ভূমিপুত্ররাই বাস করেন, তাই ওখানে দ্রুততার সঙ্গে নথিপরীক্ষা করে অধিকসংখ্যক নাম তোলা গেছে। কিন্তু সংখ্যালঘু-প্রধান ও সীমান্ত জেলাগুলোতে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে বলেই অত লোক বাদ পড়ে গেছেন।

ইঙ্গিত খুবই স্পষ্ট। এবং এর ফলেই পুরো এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়াটি কার্যত এক বাঙালি-বিতাড়নের আদল পেয়েছে। এই সুযোগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আসাম থেকে এক কোটিরও বেশি বাঙালিকে তাড়ানোর প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে হুঙ্কার দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশমতো দলীয় সাংসদেরা অধিবেশন চলাকালীন সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। মমতার এক এই মন্তব্যের জেরে এই রাজ্যে বাঙালিদের আসামের অসমিয়া জাতীয়তাবাদের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে।

বরাক উপত্যকায় বেশ কিছু বিশিষ্টজনের নাম এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এতে এই ‘বিশিষ্ট’রা খুবই অপমানিত বোধ করছেন। এবং সাধারণ মানুষরা ভাবছেন এত বড় বড় কেষ্টবিষ্টুরা যদি বাদ যান, আমরা তো কোন ছাড়! উল্টোদিকে বিশিষ্টরা ভাবছেন, আমরাই যদি বাদ পড়ে যাই আমজনতার দশা যে কী হবে! ডামাডোলের মধ্যে সবাই ভুলে গেছেন, বিশিষ্টদের জন্য নাগরিকত্বের প্রশ্নে কোনও বিশেষ কোটা থাকে না। তাছাড়া, নাম না উঠলে নতুন কোনও অপমান হয় না। সীতার সতীত্বের পরীক্ষার মতো আসামের বাঙালিকে যে বারবার নাগরিকত্বের পরীক্ষায় বসতে হয় তাই চূড়ান্ত অপমানের।

সরকারিভাবে এন আর সি প্রস্তুত হচ্ছে বাঙালি তাড়ানোর জন্য নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে আসামে বসবাসরত বৈধ নাগরিকদের নাম-ধাম সম্বলিত এক শুদ্ধ খাতা তৈরি করা। যাঁরা ১৯৭১ এর ২৪শে মার্চের পর এই রাজ্যে বা দেশে প্রবেশ করেছেন তাঁদের ঠাঁই হবে না এই নাগরিকপঞ্জীতে। কাজেই জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি এবং সরকার যে বলছেন, এন আর সি হচ্ছে আসামকে বিদেশি-মুক্ত করার জন্য, তা তথ্যগতভাবে অবশ্যই সঠিক। এবং পুরো বিতর্ককে বাঙালি বনাম অসমিয়া গোছের সাম্প্রদায়িক চেহারা দিলে আখেরে আসামের বাঙালির লাভ কিছুই হবে না।

পশ্চিমবঙ্গের কোনও মুখ্যমন্ত্রীই আসাম রাজ্যের বাঙালির জন্য কিছুই করেননি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও তেমন কিছু করবেন বা করে উঠতে পারবেন এমনটা ভাবার কোনও সঙ্গত কারণ নেই।

সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে আসামের বাঙালির লড়াইটি তাঁর অস্তিত্ব ও আত্মপরিচিতির লড়াই। এই লড়াই বাইরে থেকে এসে কেউ লড়ে দিতে পারে না। তাঁকে আসামেই থাকতে হবে পূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে এবং বাঙালি হয়ে। বাংলাভাষী অসমিয়া, অসমিয়াভাষী বাঙালি বা হিন্দু বাঙালি, মুসলমান বাঙালি হয়ে নয়, শুধুই বাঙালি হয়ে যদি আসামে থাকা যায় সেটাই হবে মর্যাদার নাগরিকত্ব। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী খসড়া এবং চূড়ান্ত তালিকা পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে এ-ছাড়া গত্যন্তর নেই।

কিন্তু এনআরসি আইনের একটি নিজস্ব ত্রুটি পুরো প্রক্রিয়াটিকে বৈষম্যময় করে তুলেছে। মূলত অসমিয়া এবং জনজাতিদের কথা মাথায় রেখে অরিজিনাল ইনহ্যাবিট্যান্ট বা ভূমিপুত্রদের বেলা নথিপত্রের ছাড় দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একজন কার্বি বা বড়ো বা অসমিয়ার নাম অন্তর্ভুক্তির বেলা কার্যত কোনও প্রমাণেরই প্রয়োজন নেই। একজন বাঙালিকে কিন্তু যাবতীয় নথিপত্র দেখিয়ে তবেই নাগরিকের শংসাপত্র জোগাড় করতে হবে। একই পরীক্ষায় মূল্যায়ন পদ্ধতির এই অগণতান্ত্রিক বৈষম্যের জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে এন আর সি-কে বাঙালি-বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে।

দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত প্রশ্নটি তো কেউ এই মুহূর্তে ওঠাতেই চাইছেন না। এনআরসি- ব্রাত্যদের নিয়ে সরকারের প্রকৃত পরিকল্পনা কী আমরা কেউই জানি না। স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়ে এসে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র নিশ্চয়ই রাষ্ট্রহীন নাগরিকদের জন্ম দেবে না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...