বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত শ্রদ্ধাস্পদেষু

বিনয় চক্রবর্তী

 

ছয়ের দশকে বব ডিলানের একটি গান বিখ্যাত হয়ে বারে বারে বেজে উঠেছিল — ‘কতটা পথ পেরোলে পরে বলো, মানুষ বললে তাকে মানায়।’ ডিলান উত্তর দিয়েছেন পরের লাইনে, The answer my friend is blowin’ in the wind, the answer is blowin’ in the wind. বাতাসে কান পেতে কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। হয়তো ডিলানের উত্তর অধরা। ক্লাসিক্যাল গান-বাজনার একজন নিবিড় ভক্ত হয়ে আমার মগজে এরকম একটি কৌতূহল ঘুরপাক খেয়ে ফিরেছে যতদিন না আপনার লেখা বই ‘বামনের চন্দ্রস্পর্শাভিলাষ’ ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। আমার প্রশ্নটা এই রকম ‘কতটা সিদ্ধি পার করে একজন শিল্পী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুলতান হতে পারেন।’ আপনি কিন্তু সরাসরি উত্তর দিয়েছেন অন্য এক রূপকে — ‘আমার সঙ্গে ওস্তাদ বা পণ্ডিত বংশের ছেলেদের তুলনা করে দেখুন, তাঁরা প্রত্যহ কতটা সময় পান গান-বাজনা অধ্যয়ন অনুশীলন ও শ্রবণের জন্য, আর আমার বরাতে বা কতটুকু সময় জুটেছে!’ আমরা জানি আপনি অনেক আলোচনায় এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘ বছর চাকরি করে রেওয়াজ অনেক সময়ই সেরিব্র্যালি সারতে হয়েছে। চিন্তায় মননে সঙ্গীতচর্চা। সময়কে নিজের অধীনে নিয়ে আনার এক প্রচেষ্টা। এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে এর চেয়ে বাস্তব ছবি আমাদের আজ পর্যন্ত কেউ দেখাননি। একুশ শতকে আধুনিক জীবনযাপনের মধ্যে এমন মানানসই চিন্তা আমরা আর কোথায় পেয়েছি। শাস্ত্রীয় গান-বাজনায় গুরুগৃহ বা আকাদেমি এখন যতই আধুনিক ব্যবস্থায় উপযোগী হোক না কেন সময় এখন সবার কাছে বড় বালাই। জীবিকা, সাধনা, অর্থোপার্জন নানা প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। চাকের সব খোপেই মধু জমাতে হবে নইলে আগামীকালের জন্য শিল্পী এবং শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা কে করবে কে জোগাবে ভাত-কাপড়। শেষ পর্যন্ত কি গভর্নমেন্টের কাছে হাত পাততে হবে। আপনার আত্মজীবনীতে আপনি লিখেছেন, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবকে তাঁর এক ছাত্র লাইফ ইন্সিওরেন্স পলিসি করতে পীড়াপীড়ি করছিল কিন্তু খাঁ সাহেব রাজি হচ্ছেন না। অবশেষে যখন বলা হল লাইফ ইন্সিওরেন্সে মোটা লাভ হবে মৃত্যুর পর। খাঁ সাহেব নাকি বলেছিলেন ‘পয়সা ভি লিবে অউর জান ভি লিবে।’ পরিপূরক করে বললে বলতে হয় একজন শিল্পী সাধনাও করবে আবার হাতও পাতবে তাঁর বেঁচে থাকার জন্য। এও কি শিল্পীর স্বাভাবিক জীবনসংগ্রাম? আপনি লিখেছেন এককালে ধনী সুধীজনেরা যে বিনয় ও আন্তরিকতায় শিল্পীদের সমাদর করতেন মহাকাল তা গ্রাস করেছে। এ কথা ভাবলে আপনার চোখ জলে ভরে ওঠে।

দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে দেশে বিদেশে অজস্র অনুষ্ঠানে আপনার বাজানো রাগ-রাগিনীর পরিবেশন ও পদ্ধতি নিয়ে বহু সার্থক চর্চা হয়েছে। আপনি অনেক সম্মানে বিভূষিত হয়েছেন। রেকর্ডিং-এ প্রায় অনেকটাই ধরা রয়েছে এই সব অমূল্য সম্পদ। এর উত্তরাধিকারী সারা বিশ্বের শ্রোতৃবৃন্দ। এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু আপনার বাজনায় কীভাবে তন্ত্রকারি বাজ এবং গায়কির অভূতপূর্ব মিশেল ঘটে গেছে তা ব্যাখ্যা করে আমাদের এখন কে বুঝিয়ে দেবে। আমাদের ইথার-কল্প তলে অনেক প্রশ্নের জবাব যে মেলে না তার উপায় কি। গান-বাজনার জন্য একটু বেশি অবসর যে আপনি চেয়েছিলেন অথচ সাহেবি কোম্পানীর কঠিন দায়িত্ব আপনার সঙ্গীতচর্চার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে খেদ কি আপনাকে তপ্ত করেছে। সাধারণ শ্রোতার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রকৃত জ্ঞান ও রসবোধ তৈরি করতে আপনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। রেডিওতে টেলিভিশনে এ নিয়ে কত অনুষ্ঠান করেছেন। শ্রোতা হিসেবে আমরা কি সত্যি যোগ্য হতে পেরেছি। কনফারেন্সে গান-বাজনা শুনতে গিয়ে তবলা ও বাজনার লড়াইতে আমরা এখনও কেন মত্ত হয়ে যাই। আপনি আকাশবাণী কলকাতায় ‘মল্লার কি প্রকার’ নামে একটি প্রযোজনায় রূপ দিয়েছিলেন। কত রকম মল্লার হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে সৃষ্টি হয়েছিল আপনি শ্রোতাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বর্ষার কবিতার সঙ্গে মল্লারের প্রকার যখন ফুটে ফুটে উঠছিল, কতজন মনে রেখেছে সেই অনুষ্ঠান। তার রেকর্ডিং কি রক্ষিত রয়েছে। আর কোনও বর্ষায় সে প্রযোজনা কি বেজেছিল। রবীন্দ্রনাথের কম্পোজিশন নিয়ে আপনার অনুরাগ সুবিদিত। কলকাতা দূরদর্শন থেকে প্রচারিতও হয়েছে কয়েকটি অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের কম্পোজিশন নিয়ে অডিও সিডি রেকর্ডিং এখনও পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের সুর করা গান থেকে আপনি যে শাস্ত্রীয় রাগ-বন্দিশ সৃষ্টি করলেন তার প্রসার কি রুদ্ধ হয়ে গেল। নতুন প্রজন্মের গায়ক বাদকের দল কি বুঝতে পারল না।

আপনার সরোদের ভগবান ওস্তাদ আলি আকবর খাঁকে আপনি আকাশবাণী দিল্লী থেকে প্রচারিত বিস্তৃত একটি ইন্টারভিউ করেছিলেন। সরোদ বাজনার খুটিনাটি নানা বিষয় নিয়ে খাঁ সাহেব আলোচনা করছিলেন। আমরা সবিস্তারে বুঝতে চাইছিলাম যে আলি আকবার খাঁ কোন প্রক্রিয়ায় সরোদ যন্ত্রের আওয়াজ এবং টোনালিটি কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছেন। আপনি জিজ্ঞাসা করছিলেন হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে সরোদে আপনিই কি এর পথিকৃৎ। খাঁ সাহেব বলছেন আমি কিছু নতুন করিনি। সবই বাবা আলাউদ্দিনের শিক্ষা এবং সরস্বতীর আশীর্বাদ। শ্রোতা হিসেবে এ সব কথা আমাদের বোধের বাইরে চলে গেছে। আপনার কাছেই এর ব্যাখ্যা আমরা শুনতে চেয়েছিলাম।

এর পরে আবার খাঁ সাহেবের কাছে আপনার প্রশ্ন কীভাবে চিকারী ও ঝংকার রাগের আমেজ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। বাজাতে বাজাতে খাঁ সাহেব লয়কে যেমন খুশি বাড়ান কমান, তানের দৈর্ঘ্যের হিসেব পাওয়া যায় না অথচ কোনও এক মুহূর্তে সম-এ এসে যান। আপনি জানতে চাইছেন কীভাবে এটা সম্ভব হয়। খাঁ সাহেব বলছেন কী জানি ক্যামনে হয়। আমার কোনও হিসাব আগে থেকে থাকে না। কবিতাটা ঠিক মিলে গেল কিনা বুঝতে পারি। অপার বিস্ময়ে শ্রোতার মাথায় বাজ পড়ে। কে বোঝাবে আমাদের।

আপনি শৈশবে যখন আপনার গুরুজি পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্রকে দেখেছিলেন এবং বাজনা শুনে সরোদের প্রেমে পড়লেন আপনার বাবা লেখা-পড়া চুলোয় যাবে বলে গান-বাজনায় আপনাকে দিতে রাজি ছিলেন না। গুরুদেব বাবাকে উত্তর দিয়েছিলেন ‘কেন আপনার আশীর্বাদে আমি তো লেখা-পড়া কিছুটা করেছি… এম.এ. এবং বি.এল। আপনার গুরুদেব বিশ্ব সাহিত্যের গুণগ্রাহী বিদগ্ধ পাঠক। তিনি নানা আলাপচারিতায় বলতেন যে গান-বাজনার সঙ্গে সাহিত্য অধ্যয়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ব-সাহিত্যের। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ কৃতী ছাত্র হয়ে গান-বাজনায় মেধা প্রয়োগে কি আপনার সুবিধে হয়নি।

প্রণামান্তে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...