বাংলা বইয়ের বাজার : পমেটম ও রক্তাল্পতার প্রতিকৃতি

বাংলা বইয়ের বাজার | প্রথম বর্ষ, একাদশতম যাত্রা | মার্চ, ২০১৮

অভীক ভট্টাচার্য

 

সেন্ট্রাল পার্কের বইমেলার মাঠে কান পাতলেই ইতিউতি ফিসফাস শোনা যাচ্ছিল। আর মেলা শেষ না-হতেই হইহই করে উঠে পড়ল প্রশ্নটা। বাঙালির বচ্ছরকার বইপার্বণের উন্মাদনার রেশ ফুরোতেই আলোচনা শুরু হল, এই যে এত উদ্যোগ-আয়োজন, সরকারের এত সহযোগিতা, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের ব্যস্ততার এত বহর, ফি-বছর এসব করে শেষপর্যন্ত কাজের কাজ হচ্ছে কি কিছু? যার জন্য এত ঢাকঢোল, এত প্রচারের ঘনঘটা, তার আসল উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে কতটা?

প্রশ্ন, বলা বাহুল্য, একটা নয়, অনেক। এককথায় সেরে দিতে গেলে জিজ্ঞেস করতে হত, বাংলা বইয়ের বাজারে লক্ষ্মীর আসন পাকা করার কাজ এগোল কদ্দূর; কিন্তু তা বলা যাচ্ছে না। মেলার মাঠের নানা গলিঘুঁজির মতোই এ প্রশ্নের মধ্যেও রয়ে যাচ্ছে অনেক ছোট-ছোট বিভাগ, হাজার উপপ্রশ্ন, অসংখ্য লুকনো পার্ট-মার্কিং। সবক’টা প্রশ্ন ঠিকঠাক বুঝতে না-পারলে, প্রতিটার যথাযথ উত্তর না-পেলে, অতএব, ধরা সম্ভব নয় বইবাজারের হাল-হকিকৎ – মীমাংসা সম্ভব নয় সরস্বতী ও লক্ষ্মীর জটিল এবং বহুস্তর সমীকরণেরও।

কিন্তু অত কাণ্ড করার সামর্থই বা কোথায়, আর চাইছেই বা কে? যাঁরা বইপত্র খোঁজেন এবং সে কারণে নিয়মিত বইবাজারে ঘোরাফেরা করে থাকেন, দশদিনের মেলার মাঠ ও সাম্বৎসরিক কলেজস্ট্রিট ভ্রমণের অভিজ্ঞতার নিরিখে তাঁরা জানেন এ এক অতি রহস্যময় জায়গা। তার নানা গলি, নানান ফ্যাকড়া, বহু হিসেবনিকেশ, বিস্তর ছক্কাপাঞ্জাসেখানে কাটাকাটির ব্যবসা যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’, রয়েছে জেলার মেলায় ‘লাইব্রেরি-পারচেজ’-এর তালিকায় নাম তোলার ভুলভুলাইয়াও। রয়েছে মেলার মাঠে ঠিকঠাক জায়গায় স্টল পাওয়ার অজস্র-সহস্র ব্যাপার-বন্দোবস্ত। সেসব জটিলতার মধ্যে শুরুতেই ঢুকে পড়লে পথ ভুলে বেঘোরে মারা পড়ার প্রভূত আশঙ্কা। তাই বইমেলায় চক্কর কাটতে-কাটতে, বা তার পরে কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় ঘুরতে-ঘুরতে প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে সহজ করে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।

দেখা গেল, প্রশ্নমালার চেহারাটা মোটের ওপর দাঁড়াচ্ছে এরকম… এক – গত কয়েকবছরে বাংলা বইয়ের বাজার আয়তনে কতটা বাড়ল; দুই – বাংলা বইয়ের পাঠক, অর্থাৎ উপভোক্তাদের প্রত্যাশা ও চাহিদা কতটা মেটাতে পারছে বাজারের ‘প্রডাক্ট’, অর্থাৎ উৎপন্ন (সহজ কথায়, বই); এবং তিন – আজকের বাংলা বইয়ের বাজার উপভোক্তাদের কাছে নিজের কোনও চরিত্র বা অভিজ্ঞান (যাকে আজকের বাঙালিরা ‘আইডেন্টিটি’ বললে সহজে বোঝেন), অর্থাৎ কোনও স্থায়ী মূল্য (অর্থনীতির ভাষায় ‘পার্মানেন্ট ভ্যালু’, বিপণনের নিরিখে ‘ব্র্যান্ড রিকল’) তৈরি করতে পারছে কি না। বলা বাহুল্য, প্রতিটি প্রশ্নই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত – এতটাই যে, একটিকে বাদ দিয়ে অন্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব নয়, এমনকী একটির মধ্যে থেকেই উঠে আসতে পারে অন্য প্রশ্নের উত্তর, এবং প্রতিটি প্রশ্নেরই মধ্যে লুকিয়ে থাকে আরও অসংখ্য জিজ্ঞাসার স্তর।

এক-এক করে ভাবা যাক। বইয়ের বাজার কি বাড়ছে? এই প্রশ্নটিকে দু’দিক থেকে দেখা যেতে পারে। এক, বাজারের আয়তন বাড়ছে কি না; এবং দুই, বিক্রিবাটা কতটা বাড়ছে। সহজেই বোঝা যায়, এই দুটি সূচক পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও, স্পষ্টতই আলাদা। যদি বইয়ের নিরিখেই ভাবি, এমন একটা বাজারের কথা সহজেই কল্পনা করা যেতে পারে যেখানে ক্রেতার সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকলেও বিক্রির পরিমাণ বাড়ছে। গতমাসে একশোজন পাঠক যদি প্রত্যেকে গড়ে একশো টাকার বই কিনে থাকেন, এবং এ-মাসে প্রত্যেকে দেড়শো টাকার বই কেনেন, তা হলেই সেটা হওয়া সম্ভব। অন্য সম্ভাবনাটিও সমান সত্য, যেখানে মাথাপিছু বই বিক্রি হয়তো বাড়ল না, কিন্তু দশজন নতুন ক্রেতা বাজারে সামিল হলেন। এই দুটি সম্ভাবনার বিপরীতক্রমদুটিও সমান সম্ভব – যেখানে বাজার বাড়ল না অথচ মাথাপিছু ক্রয় কমল, কিংবা মাথাপিছু ক্রয় সামান্য বাড়ল অথচ বাজার তুলনায় অনেক বেশি ছোট হয়ে এল। তার সঙ্গে রয়েছে পছন্দসই বইয়ের সংখ্যা বাড়া-কমার ওপর বিক্রির সম্ভাবনার হ্রাসবৃদ্ধি, অর্থাৎ আপনি বই কিনতেই এসেছিলেন কিন্তু পছন্দের বইটি পেলেন না বলে খালিহাতে (কিংবা বই কেনার টাকা দিয়ে এগরোল খেয়ে) ফিরে গেলেন। তার সঙ্গে যোগ করুন আপনার সার্বিক ক্রয়ক্ষমতার হ্রাসবৃদ্ধির প্রশ্নটি – আগে একশো টাকার রোজগারে আপনি বই কেনার জন্য যদি পাঁচটাকা বরাদ্দ করতে পেরে থাকেন, আজকেও ততটাই পারছেন কি না; কিংবা হয়তো আপনার আয়বৃদ্ধির কারণে দশটাকাই পারছেন কিন্তু বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখছেন তার দাম ততদিনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে বারোটাকা। অর্থাৎ আপনার রোজগার বাড়লেও ক্রয়ক্ষমতা বস্তুত বাড়ছে না। এখন, এই নানাবিধ সম্ভাবনার মধ্যে কোনও বিশেষ একটি আমাদের বই-বাজারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, নাকি একাধিক, নাকি প্রায় সবগুলোই, সে-কথাও ভাবার প্রয়োজন রয়েছে বই কী

তারও আগে দেখা দরকার এই বাজারটাকে আমরা সংজ্ঞায়িত করছি কীভাবে। কোথায় টানছি তার সীমারেখা।  যখন বাংলা বইবাজারের কথা ভাবছি, তখন কি বাংলায় লেখা অসংখ্য স্কুল ও কলেজপাঠ্য বই, সহায়ক (রেফারেন্স) গ্রন্থ, প্রশ্নবিচিত্রা, নোটবই – সেসবও আলোচনায় আসবে? এই লেখার পরিসরে সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই ‘না’, কিন্তু প্রায় একই নিশ্বাসে এ-কথাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, বইয়ের বাজারের উপভোক্তা ও বাণিজ্যের একটা রীতিমত বড় অংশ কিন্তু এই গোত্রের বইপুথি ও ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণ চান? বিশ্বভারতীর গীতবিতান আর পারুল প্রকাশনীর কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক-এর বিক্রির তুলনামূলক হিসেব যাচাই করুন। সহজেই বুঝতে পারবেন।

এর পরেও কথা থাকে। ধর্মীয় গ্রন্থগুলিকে নিয়ে কী করা হবে? আমাদের এই তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে বরাবরই সেগুলির পাঠক কিছু কম নেই। এর মধ্যে কিছু রচনা রয়েছে যার ধর্মীয় মূল্যের চেয়ে সাহিত্যমূল্য বেশি বই কম নয়, যেমন ধরুন শ্রীম-র রামকৃষ্ণ কথামৃত বা কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত – সেই বইগুলিকে কি আমরা আমাদের আলোচনায় রাখব না? কিংবা ধরুন, আজ যদি দলে-দলে মানুষ অমুক বাবা বা তমুক ব্রহ্মচারীর জীবনী কিনতে শুরু করেন, তার ছাপ তো বাংলা বইয়ের বাজারে পড়বে অবশ্যই। কিন্তু সেগুলিকে কি আমরা ধর্তব্যের মধ্যে রাখব? এমন প্রকাশকের সংখ্যা এ-বঙ্গে কম নয় যাঁরা এই মহাজনদের বাণী-সংবলিত বই ছেপে বেশ টু পাইস করেছেন। কলেজস্ট্রিটের দোকানে-দোকানে এবং মেলার মাঠের পেল্লায় প্যাভিলিয়নে তাঁদের সাড়ম্বর উপস্থিতিও নজর এড়ানোর নয়। সেইসব অমর কথাসাহিত্য কি আসবে আমাদের আলোচনায়? আর সাহিত্যমূল্যই যদি বিচার্য হয়, আমি-আপনিই বা সে বিষয়ে নিদান দেওয়ার কে? কেউ যদি বলেন আমি অমুক বাবার জীবনীকেই আমার পড়া শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগ্রন্থ বলে মানি, আপনি তো তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারবেন না। কিংবা কেউ যদি এসে পালটা প্রশ্ন তোলেন অমুক প্রকাশনের পাঁচশো হাসি দুশো মজা বা তমুক প্রকাশনের সেরা একশো কুইজ কী যুক্তিতে সাহিত্য, তারও উত্তর দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে বই কী। তা হলে উপায়?

এ-লেখার কৃশ কলেবরে একটা সহজ উপায় অবশ্যই আছে। তা হল শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া যে, এখানে বই বলতে আমরা নির্ভেজাল সাহিত্যপুস্তকই বুঝব, তা বাদে আর কিচ্ছুটি নয়। সেখানে সাহিত্য ছাড়া আর কিছু থাকবে না। গল্প-কবিতা-নাটক-উপন্যাস এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ – মোটামুটি এই নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে আলোচনা। তাতে অবশ্য বাজারের কলেবর অনেকটাই ছোট হয়ে আসবে, হয়তো বা সেই আয়তনটা বাংলা বইয়ের ক্রেতার সংখ্যা বা বাংলা বই বিক্রির পরিমাণের অর্ধেকেরও বেশ খানিকটা কম, কিন্তু সহানুভূতিশীল পাঠক একে এক অনিবার্য ‘ডেটা-লস’ হিসেবে দেখবেন এবং মেনে নেবেন, আপাতত এই ভরসা রাখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

বাজারের সীমা নির্ধারণের পর তার মানে আমাদের কাজটা একটু সহজ হয়ে এলভিড় কমে যাওয়ার ফলে এখন যেন পাঠকদের মুখও আর একটু স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। কারা তাঁরা? মূলত সচেতনভাবে বাংলা ভাষাপ্রেমী ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। উপভোক্তা শ্রেণি হিসেবে এটাও অবিশ্যি যথেষ্ট ব্যাপক ও অবয়বহীন – কোনও অর্থনীতির গবেষকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি একবারের বেশি দু’বার না-তাকিয়ে ‘মালটিপ্‌ল সাবসেট্‌স উইথ ইনসাফিশিয়েন্ট ডেটা’ বলে খারিজ করে দেবেন। কিন্তু এই আলোচনার পরিসরে অত বিশদ হওয়ার সুযোগ যেমন নেই, তেমনই সুনির্দিষ্ট কোনও ‘ফোকাস্‌ড ডেটাবেস’-ও হাতের কাছে মজুদ নেই। কেন নেই? খুব সহজ। এবারের মেলাতেই, একই ক্রেতাকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধসংগ্রহ ও বাঁটুল-সমগ্র কিনতে দেখেছি। কোনটি তাঁর নিজের জন্য আর কোনটি সন্তানের, জিজ্ঞেস করতে ভরসা হয়নি। অতএব, সে জটিলতায় না-ঢুকে আমাদের এই আলোচনা কেবল ও কেবলমাত্র সাহিত্যগ্রন্থ নিয়েই। এবং এখানে উপভোক্তা বলতে আমরা তাঁদেরই বুঝছি যাঁরা সাহিত্যানুরাগী ও বাংলা ভাষার সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠায় স্থিত, এবং সর্বোপরি বই কেনার মতো আর্থিক সঙ্গতি যাঁদের রয়েছে। শেষ মাপকাঠিটি ঈষৎ রূঢ় ও বঙ্কিম শোনালেও বস্তুত প্রাসঙ্গিক, কেননা, লাইব্রেরির পাঠক বইয়ের বাজারকে পরোক্ষে যথেষ্ট প্রভাবিত করলেও তাঁদের এই আলোচনায় সরাসরি অন্তর্ভূত করার সু্যোগ নেই।

আলোচনার গণ্ডীকে চারপাশ থেকে যথেচ্ছ ছোট করে আনার পর, এবার তবে ফেরা যেতে পারে প্রথম প্রশ্নটিতে। বইয়ের বাজার কি বাড়ছে? নতুন প্রজন্ম কি বাংলা বই খুঁজছেন? সময় কাটাতে চাইছেন বাংলা বইয়ের সঙ্গে? আশ্রয় খুঁজছেন বাংলা সাহিত্যের মধ্যে? প্রশ্নগুলির সবক’টিই বেশ পুরনো, এবং উত্তরও জানা। কিন্তু যদি এই প্রশ্নগুলোকেই একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে সামনে রাখা যায়? প্রকাশকরা কি এই প্রজন্মকে বাংলা বইয়ে ফেরাতে চাইছেন? উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। নতুন প্রজন্ম বলতে যদি ধরে নেওয়া যায় কিশোর-কিশোরীদের, তা হলে উত্তর আসবে, কেন কিশোরসাহিত্য তো দিব্যি হচ্ছে। আনন্দ-র স্টলে এখনও বেস্টসেলারের তালিকায় শীর্ষেন্দু-সত্যজিৎ-সুনীল। কিন্তু আজকের কৈশোর সত্যিই পড়ছে সেসব? বইমেলার স্টলে ঘুরে সে বিষয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার সুযোগ মেলেনি। বরং শহরের বাবামায়েদের সৌজন্যে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইংরেজি বই পড়ার অভ্যাস যে বেড়েছে, তার প্রমাণ বিলক্ষণ চোখে পড়েছে। মনে রাখতে হবে, আমরা যে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর কথা আজকাল শুনতে খুব অভ্যস্ত, তার সুফল কুড়োতে গেলে কিন্তু প্রকাশকদের এই বিষয়ে নজর দিতেই হবে। অন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যদি কেবল ব্যবসায়িক দিক থেকেই দেখি, পঞ্চাশোত্তীর্ণ প্রৌঢ়কে বই বিক্রি করার চাইতে চুলবুলে চোদ্দকে পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার মধ্যে বাণিজ্যিক দূরদৃষ্টির পরিচয় যে অনেক বেশি আমাদের বাংলা বইয়ের প্রকাশকরা তা এখনও সম্ভবত বুঝতে পারেননি।

অর্থাৎ বাজার যে বাড়ছে, তা অন্তত ক্রেতার সংখ্যাবৃদ্ধি দিয়ে প্রমাণ করার কোনও সুযোগ নেই। বাকি থাকে মাথাপিছু বিক্রি বাড়ছে কি না তার হিসেব নেওয়া। এবং, এখানেও প্রধান বাধা ইনসাফিশিয়েন্ট ডেটা। কোনও ক্রেতা গত দশবছরে নিয়মিতভাবে বই কিনেছেন কি না, এই সময়কালে তাঁর বই কেনার ‘প্যাটার্ন’ কীভাবে পালটেছে, এমন কোনও তথ্যাধার নেই, যা এ-বিষয়ে আলোকপাত করতে পারে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে এটুকু কেবল বলা যেতে পারে, আগেও যাঁরা খুঁজে খুঁজে বই কিনতেন, এখনও তাঁরাই বই কেনেন। কিন্তু এমন প্রায় কাউকে আমি দেখিনি যিনি পঞ্চাশে পৌঁছে হঠাৎ করে বই কিনতে শুরু করেছেন। তা হলে বাজারটা বাড়ছে কোথায়?

তৃতীয় একটা সম্ভাবনা থাকে, সেটা হল, ক্রেতার সংখ্যা বাড়ল না, বিক্রীত বইয়ের সংখ্যাও বাড়ল না, কিন্তু বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে মোট বিক্রির অর্থমূল্য বেড়ে গেল। সেটা যে হচ্ছে না তা নয়। বইয়ের টাইট্‌ল যেহেতু টুথপেস্ট বা কব্জহারের মতো ‘এফএমসিজি’ গোত্রভুক্ত নয় (মানে, আপনি যেহেতু প্রতিমাসে একটা করে এ টি দেবের ডিকশনারি বা গোরস্থানে সাবধান কেনেন না), অতএব বইয়ের ক্ষেত্রে (পঞ্জিকা ছাড়া) রিপিট পারচেজের সম্ভাবনা প্রায় থাকে না। তা হলে উপায় থাকল একটাই, দাম বাড়িয়ে যাও যাতে বিক্রি কমলেও ব্যবসা ধসে না-পড়ে, বই-পিছু প্রিন্ট অর্ডার কমাও যাতে প্রকাশকের ঘরে বই জমে না-যায়, এবং নিত্যনতুন বই অল্প সংখ্যায় ছাপতে থাকো। আপাতত এই ছকেই অনেক প্রকাশনা সংস্থা তাদের ব্যবসা ধরে রেখেছে।

বই অল্প সংখ্যায় ছাপার গল্পটা কিছু বিস্তৃত, সে-প্রসঙ্গে একটু পরে আসা যাবে। দাম বাড়ার কারণটা তুলনায় সহজবোধ্য। গত কয়েক বছরে ছাপার কালি, বিশেষত কাগজের দাম অকল্পনীয় হারে বেড়েছে। এবং প্রতিযোগিতার বাজারে বইয়ের সৌষ্ঠব ও ছাপাই-বাঁধাইয়ের গুণমান বজায় রাখাও প্রায় আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদনের খরচ, যাকে বলে ‘প্রোডাকশন কস্ট’, বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। বিক্রি যেহেতু বাড়ছে না, তাই তার সঙ্গে জুড়েছে বই-পিছু লাভ বাড়িয়ে রাখার একটা চেষ্টাও। অক্ষরবিন্যাস, ‘প্রি-প্রেস’ (‘রেজিস্ট্রেশন’-‘ইমপোজিশন’-‘প্লেট-মেকিং’ বা ‘ট্রেসিং’ তোলা), কালি-কাগজ, ছাপাই-বাঁধাই – সব মিলিয়ে একটি বই ছাপতে যা খরচ হয়, বইয়ের দাম (‘প্রিন্ট প্রাইস’) ধরা হয় তার প্রায় দেড়শোগুণ। হিসেবটা মোটামুটি এরকম – একটি বই ছাপার খরচ যদি হয় সত্তর টাকা, তা হলে তার দাম ধার্য হবে একশো আশি থেকে দুশো টাকার মধ্যে। যাতে পরিবেশক-পাইকারি পুস্তকবিক্রেতা ও খুচরো দোকানদারদের জন্য পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ (এর মধ্যে কলেজস্ট্রিটের ক্রেতার কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ ‘কাটব্যাক’, মানে ‘ডিসকাউন্ট’-ও ধরা রয়েছে) লভ্যাংশ ছেড়ে রেখেও প্রকাশক বই পিছু অন্তত সত্তর টাকা লাভ ঘরে তুলতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে এই বই-পিছু লাভ আড়াইশো-তিনশোগুণও হতে পারে, ‘টাইট্‌ল’ বা লেখকের নামের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বইপাড়ায় এখনও পাতা-পিছু পাঁচটাকা রেটে ‘প্রুফ’ দেখা হয়, সারাদিন ছাপাখানায় কাজ করে রোজগার হয় দুশো টাকা। কিন্তু বই-ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই মানুষদের রোজগার কতটা বাড়ল, তা নিয়ে ভাবলে প্রকাশকের চলবে কেন?     

এখান থেকেই চলে আসা যেতে পারে অল্প ছাপার বিষয়টিতে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে বইপাড়ায় ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ বলে বিচিত্র একটি ব্যাপার শুরু হয়েছে। বাজার যেহেতু ছোট, এবং বিক্রিও যেহেতু নিশ্চিত নয়, তাই হাতে গোনা দু-একটি মেগা-প্রকাশনী ছাড়া প্রায় কেউই আর একসঙ্গে হাজার বই ছেপে গুদামজাত করে রাখার ঝুঁকি নেন না। শুরুতে মাত্র পঞ্চাশ বা একশো কপি বই ছেপে জল মাপতে থাকেন। ঘরে ‘ট্রেসিং’ রাখা থাকে, প্রথম দফায় ছাপা বই ফুরোলে দ্বিতীয় দফায় ছেপে নেওয়া হয়। এটা একটা মজার ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ – প্রকাশকের বেশি টাকা আটকে রইল না, লেখকও খুশি হয়ে ফেসবুকে লিখলেন “এক বছরের মধ্যে আমার অমুক বইটির প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ, দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পথে”বন্ধুরা সেই পোস্টে হইহই করে লাইক দিলেন, জানতে চাইলেন বইটি কোথা থেকে সংগ্রহ করা যায় (এক কবি সেদিন মজা করে বলছিলেন, আজকাল কেউ আর বই কেনেন না, সংগ্রহ করেন – এই অবলোকন যেমন সঠিক, তেমনই এই বিচিত্র সংগ্রহচেতনার পিছনেও একটি মিহি রাজনীতি আছে, কিন্তু তা এ-লেখায় অপ্রাসঙ্গিক)। সবমিলিয়ে যেটা দাঁড়াল, প্রকাশক থেকে লেখক এমনকী পাঠকও খুশি রইলেন, কিন্তু বইয়ের বাজারটা একই জায়গায় আটকে রইল। সেখানে না-বাড়ল বাজারের আয়তন, না-বাড়ল মোট বিক্রির পরিমাণ। আরও বড় কথা, প্রকাশকরা এই সহজ, ঝুঁকিহীন রাস্তাটা পেয়ে গিয়ে আর কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথেই হাঁটলেন না। গোটাটাই একটা পঞ্চাশ কপির টি-টোয়েন্টি ব্যবসায় পরিণত হল।

কিন্তু তার চেয়েও বড় বিপদ একটা ঘটেছে অন্যত্র। পঞ্চাশ-একশো কপি বই ছেপে পয়সা তুলে নেওয়া সহজ, অতএব অনেক নতুন প্রকাশন বাজারে চলে এসেছেনভাল বই করার প্রতি এঁদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই, যেমন নেই পাঠকের কাছে পৌঁছনো বা নতুন পাঠক তৈরির দায়ও। ফলে মুড়ি-মিছরি একদর হয়ে গিয়েছে – বাইরে থেকে বাজারের চেহারায় একটা আলগা লাবণ্য চোখে পড়লেও, প্রকাশকদেরই একাংশের মতে, তার অনেকটাই ‘কসমেটিক’এই নব্য প্রকাশকদের যেহেতু মন দিয়ে বইয়ের ব্যবসাটা করার দায় নেই, প্রস্তুতিও নেই, অতএব এদের মধ্যে অনেকেই চটজলদি কিছু লাভ করে বাজারটাকে ঘেঁটে দিয়ে পরে অবস্থা বেগতিক দেখলে কেটে পড়বেন, মাঝখান থেকে পাঠক আরও সরে যাবেন বই থেকে, আক্ষেপ করছিলেন সপ্তর্ষি প্রকাশনের সৌরভ মুখোপাধ্যায়।

এই প্রিন্ট অন ডিমান্ডের হাত ধরে অবশ্য অনেক তরুণ কবি-লেখক-সাহিত্যিক যথেষ্ট উপকৃত হচ্ছেন। বহু বছর হল বইপাড়ায় পয়সা নিয়ে বই করার একটা রেওয়াজ হয়েছে। ধরুন অ বাবু উদীয়মান লেখক, তিনি একটা পাণ্ডুলিপি নির্মাণ করে কোনও প্রকাশকের দ্বারস্থ হলেন। প্রকাশক পাণ্ডুলিপি দেখে বললেন চারফর্মার একটি বই ছেপে দেবেন, সেখানে তাঁর প্রকাশনার ব্র্যান্ড তিনি লেখককে ব্যবহার করতে দেবেন, পরিবেশনা ও বিক্রির বন্দোবস্তও করে দেবেন, বিনিময়ে বইয়ের প্রোডাকশন কস্ট ও তার ওপর আরও কিছু বাড়তি খরচ লেখককে বহন করতে হবে। এই বাড়তি খরচটাকে প্রকাশক বলবেন ‘লোগো চার্জ’, এবং নিজের বইয়ের শুরুতে বড় প্রকাশকের নাম দেখতে পাওয়ার আনন্দে অ বাবু সেই প্রস্তাবে রাজিও হবেন, কারণ তাঁর কাছে এটি আত্মপ্রকাশ ও খ্যাতিমান হয়ে ওঠার জন্য যৎসামান্য লগ্নি। ডিল হবে, আমি ওই টাকায় আপনার তিনশো কপি বই ছেপে দেব। তার মধ্যে দেড়শো কপি আপনার, বাকি দেড়শো আমি বিক্রি করব। আপনি যদি পারেন দেড়শো কপি বিক্রি করে প্রোডাকশন কস্ট তুলে নিন, আর আমি যা বিক্রি করব, তার লভ্যাংশ আপনি রয়ালটি হিসেবে পাবেন। কথা পাকা হওয়ার পর, আমি, অর্থাৎ প্রকাশক, কিন্তু আদৌ তিনশো কপি ছাপব না। দেড়শো কপি, বা বড়জোর দুশো কপি ছাপব। ছাপা হয়ে গেলে দেড়শো আপনাকে দিয়ে দেব, বাকি পঞ্চাশ দোকানে রেখে জল মাপতে বসব। যদি দেখি মারকাটারি বিক্রি, কুছ পরোয়া নেই, আমার হাতে প্রিন্ট অন ডিমান্ড-এর অমোঘ অস্ত্র রয়েছে। ছ’মাস বাদে আপনাকে ডেকে বলব, দ্বিতীয় সংস্করণ করতে চান? আপনি ডবল-খুশি, আমার ডবল-ব্যবসা। আর যদি বিক্রি না-হয়, তাতেও আমার এক পয়সা লোকসান নেই, কারণ এই গোটা প্রক্রিয়াটায় আমার তো কোনও খরচই হয়নি। এবার অ বাবুকে দেখে খ বাবু, খ বাবুকে দেখে গ বাবু – এইভাবে ব্যবসাটা এগোতে থাকবে। যশোপ্রার্থী তরুণ লেখকের সংখ্যা আশু কমার কোনও লক্ষণ যেহেতু নেই, সুতরাং ধরে নেওয়া যায় এ-ব্যবসার নটেগাছ এক্ষুনি মুড়োবে না।

প্রকাশক যদি প্রকৃতই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন তা হলে তিনি এই পদ্ধতিটাকে সাইড-বিজনেস হিসেবে রাখতেও পারেন, কিন্তু তার পাশাপাশি এমন কিছু বই যত্ন নিয়ে করবেন, যা তাঁকে পরিচিতি দেবে, দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা দেবে, এলিট প্রকাশক হিসেবে ভাবমূর্তির ডিভিডেন্ড দেবে। সেটা ভবিষ্যতের জন্য তাঁর সত্যিকারের লগ্নি। সেখানে তিনি কোনও আপস করবেন না। কিন্তু প্রকাশক যদি হন গোলা, তা হলে তিনি এই ব্যবসাটাতেই বেশি করে জড়িয়ে পড়বেন, এবং দীর্ঘ মেয়াদে ফল যা হওয়ার হবে। এর ফলে কিছু ভাল বই যে বাজারে আসবে না, তা নয়, অনেক তরুণ কবি-গল্পকার এভাবে নিশ্চয়ই উঠে আসবেন, আসছেনও, কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটায় কোনও ‘কোয়ালিটি চেক’-এর সুযোগ না-থাকায়, মাঝখান থেকে বইয়ের বাজার ভরে উঠতে থাকবে কিছু ‘আনপ্রোডাক্টিভ অ্যাসেট’-এ। কোনও তরুণ লেখক ফেসবুকে সাহিত্য করে প্রচুর লাইক পান, অতএব ধরে নিলেন তাঁর এবার একটা বই হওয়ার সময় হয়েছে, একহাতে পাণ্ডুলিপি ও অন্যহাতে টাকা নিয়ে পৌঁছলেন প্রকাশকের দরজায়, এবং একটি বই ছাপিয়ে খুশি হয়ে ঘরে ফিরলেন। প্রথম চোটে বন্ধুবান্ধবেরা হয়তো কিনেও নিলেন কিছু বই। অতএব তিনি পুরোদস্তুর লেখক হয়ে উঠলেন। খোলা চোখে বাংলা বইয়ের বাজার-এর দিকে তাকালে আপাতত এই প্রবণতাটিরই রমরমা চোখে পড়তে বাধ্য।

কিন্তু তা বলে গোটা বইয়ের বাজার-টাই যে আগাপাশতলা এমন একটা বিচিত্র, ফাঁপা রসিকতার ওপর দাঁড়িয়ে, তা মোটেই নয়। বেশ মনে আছে, নয়ের দশকের শেষাশেষি আমরা যখন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরিবাকরিতে ঢুকছি এবং এরপর থেকে প্রাণ ভরে বই কিনতে পারব বলে আত্মপ্রসাদের সপ্তম স্বর্গে, প্রায় সে সময় থেকেই বাংলায় নতুন ধরনের বই করার একটা খুব আন্তরিক চেষ্টা শুরু হয়েছিল। প্রথমে প্রায় অলক্ষ্যে, কিন্তু দু’হাজারের একেবারে গোড়া থেকেই সে চেষ্টাটা রীতিমত চোখে পড়তে শুরু করে। বীজেশের প্রতিভাস অবশ্য আরও খানিক আগেই, কিন্তু দু’হাজারের শুরু থেকে সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের সপ্তর্ষি প্রকাশন, অধীর বিশ্বাসের দোয়েল ও তার কয়েকবছর পর গাংচিল, সন্দীপনের মনচাষা (পরে নাম পালটে মনফকিরা), গৌতম মিত্রর সেরিবান, পার্থ চক্রবর্তীর অবভাস– পরপর অনেকগুলো নাম মনে পড়তে বাধ্য। নতুন ধরনের বিষয়, ঝকঝকে ছাপা ও বাঁধাই, নতুন ধরনের প্রচ্ছদ – এবং এই সবকিছুর পেছনে শিল্প ও রুচির নিষ্ঠ ছাপ নিশ্চিতভাবেই বাংলা বইকে একটা অন্য ধরনের ‘মেক-ওভার’ দিয়েছিল। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বই বিক্রিও বাড়তে শুরু করে। পরে এই তালিকায় আরও অনেক নতুন নাম জুড়েছেসম্প্রতি বেশ কিছু খুব ভালো বই নিয়ে নজরে এসেছে দেবাসিশ সাউয়ের কারিগর, পলাশ বর্মণের কলিকাতা লেটারপ্রেস। অনেকক্ষেত্রে কোনও একটি পত্রিকাকে সামনে রেখে অন্যধারার প্রকাশনায় জায়গা করে নিয়েছে ধানসিঁড়ি, রাবণ, বাতিঘর, কুবোপাখি, বোধশব্দ। কিন্তু বই বিক্রির সেই ট্রেন্ডটা যেন গত দু’তিন বছর ধরে আবার কিছুটা নিম্নগামী, বলছিলেন সপ্তর্ষির সৌরভ। তার কারণ? সৌরভের মতে, বেশ কিছু প্রকাশনা সস্তায় বাজিমাত করতে চাওয়ার কারণেই এমনটা ঘটছে। স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে চটজলদি লাভের আশায় এইসব ব্যবসাদারদের সংখ্যাবৃদ্ধি বাজারটাকে বেশ ঘেঁটে দিয়েছে। তবে এই ঘোলা জলেও যারা কাজ করার তারা কিন্তু ঠিকই করে চলেছে, আশাবাদী তিনি।

আশাবাদী গাংচিলের অধীর বিশ্বাসও। স্পষ্টবক্তা অধীরের বক্তব্য, আমি যদি নতুন কিছু দিতে পারি পাঠক আমায় ঠিকই খুঁজে নেবে। দীর্ঘদিনের লেখালিখির জীবনের অভিজ্ঞতা ও বইপাড়ার সঙ্গে গভীর যোগাযোগের জায়গা থেকেই পাঠকের প্রতি এই বিশ্বাস অর্জন করেছেন অধীর। কিন্তু তাঁর কথায় বারবারই উঠে আসে বইয়ের বাজার-এর পেছনের অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ। বইমেলার মাঠে কে কোথায় স্টল পাবে, সে প্রক্রিয়াই কি পুরোপুরি স্বচ্ছ? প্রশ্ন তোলেন তিনি।

প্রশ্ন থাকে আরও অনেক। এই লেখা তৈরির জন্য বেশ কয়েকটি বড় প্রকাশনীকে ইমেল ও ফোন-মারফত যোগাযোগ করা হলেও লেখার বিষয় বিশদে জেনে মতামত দিতে আগ্রহী হননি অনেকেই, বলছি-বলব বলে এড়িয়ে গিয়েছেন কেউ-কেউ, অনেকে তো উত্তরই দেননি। কেউ বা বাংলাদেশের একুশের বইমেলায় ব্যস্ত থাকার কারণ দেখিয়ে পাশ কাটিয়েছেন। কেন মতামত দেওয়ায় অনীহা? ব্যবসায়িক তথ্য সাধারণ মানুষকে না-জানানোর একটা কারণ বোঝা যায়, যদিও বাৎসরিক অডিট-রিপোর্টে তো সবটাই মুদ্রিত থাকার কথা। তা হলে অসুবিধে কোথায়? কারণ যদি বা অনুমেয়, খোলসা করেননি অনেকেই।

ফল যা দাঁড়িয়েছে, তথ্যের অভাবে ধাক্কা খেতে হয়েছে প্রতিপদে। কারা কেনেন বই বা কোন বয়সের ক্রেতা বেশি চোখে পড়ে – এমন নির্বিষ প্রশ্নেও চোখ কুঁচকেছেন অনেকে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথ্যনিষ্ঠ সমীক্ষার চেয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকেই গুরুত্ব দিতে হইয়েছে। অবশ্য অভিজ্ঞতাও কি এক অর্থে তথ্যই নয়?

শেষ বিচারে, যদি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন পরিচিত মানুষের সঙ্গে আলাপচারী থেকে উঠে আসা অবলোকনকে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য তথ্য বলে মেনে নিই, বাংলা বইবাজার নিয়ে খুব ভেঙে পড়ার কারণ না-দেখলেও খুব আশাবাদী হওয়ারও কোনও কারণ থাকে না। বাঙালির অন্য সব উদ্যোগের মতোই, এখানেও, দিনাবসানে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে হাতে থাকে এক সর্বব্যাপী মধ্যমেধা ও ‘মিডিওক্রিটি’-র রক্তশূন্যতাক্রান্ত প্রতিচ্ছবি। সেখানে পমেটমের প্রসাধনী চটক যদি বা আছে, প্রাণের প্রকাশ্য উৎসব নেই।        

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4859 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. POD একটা প্রযুক্তি। উন্নত প্রযুক্তি। একদল চোর প্রকাশক সেই প্রযুক্তির অপব্যবহার করছেন বলে POD প্রযুক্তিটাকেই এত গাল পাড়ার কোনো দরকার নেই। যাঁরা চোর তাঁরা POD-র আগেও লেখকদের ঠকাতেন পরেও ঠকাবেন। POD থাকায় আমার অন্তত একটি বই যে নতুন প্রাণ পেয়েছে, তা নিজের চোখে দেখেছি, bank-এ তার প্রমাণ আছে। লেখকরা যে ন্যায্য royalty পান না, কত কপি বই ছাপা হলো কতো কপি বিক্রি হলো তা জনার যে কোনো সচ্ছ উপায় নেই, এ সব ছোটখাটো ব্যপারে অভীকের নীরবতা বেশ মজার।

আপনার মতামত...