ভাষিক আধিপত্যবাদ ও ভাষিক সংরক্ষণবাদের দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে

ভাষিক আধিপত্যবাদ

রেজাউল করিম ফকির

 

পূর্বকথা

দক্ষিণ এশিয়া হল জটিল ভাষিক বুনোটে গঠিত উপমহাদেশ। এই ভাষিক বুনোটটি অন্ততপক্ষে ইন্দোআর্য, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোট-তিব্বতিয় — এই চারটি ভাষা পরিবারভুক্ত নানা ভাষা ও উপভাষার সমন্বয়ে গঠিত। এই ভাষিক জটিল বুনোটটির সৃষ্টি হয়েছে কালক্রমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াধীনে যাকে বৈশিষ্টায়িত করা যেতে পারে ভাষিক আধিপত্যবাদ ও ভাষিক সংরক্ষণবাদের দ্বান্দ্বিকতা হিসাবে। অন্যকথায় দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজিত ভাষিক বুনোটটি সৃষ্টি হয়েছে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তার দু’টো দিক রয়েছে — ভাষিক আধিপত্যবাদ ও ভাষিক সংরক্ষণবাদ। উক্ত ধারণাগত প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় ভাষিক আধিপত্যবাদ ও ভাষিক সংরক্ষণবাদের দ্বান্দ্বিকতা এবং এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কে এই নিবন্ধে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে।

রাজনৈতিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ অথবা ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের অনুসরণে ভাষানীতি বা অন্য কোনও ভাষাগত কর্মকৌশল প্রয়োগ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনসাধারণের ভাষা ও ভাষাগত আচরণকে নিয়ন্ত্রণে প্রয়াসী হয়। যার জন্য রাজনৈতিক শক্তি অনেক সময় জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে তার গৃহীত নীতির অনুসরণে পছন্দীয় ভাষাকে ভিন্ন ভাষাভাষীর শাসিত জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়। ফলে শাসক শ্রেণির প্রভাবশালী ভাষা শাসিত জনসাধারণের অনুবর্তী ভাষাকে বিপদাপন্ন করে তোলে। এভাবে রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক গৃহীত একচোখা নীতির ফলে সাধারণের ভাষা ও ভাষাগত আচরণে যে পরিবর্তন সূচিত হয় তার একটি রাজনৈতিক দিক লক্ষ করা যায়। এই রাজনৈতিক দিক ভাষিক আধিপত্যবাদ ও ভাষিক সংরক্ষণবাদ — এই দুইয়ের দ্বান্দ্বিকতায় পরিস্ফূট হয়।

ভাষিক আধিপত্যবাদ

রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক কোনও ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ কায়েমের নীতি থেকে ভাষিক আধিপত্যবাদ উৎসারিত হয়। রাজনৈতিক শক্তি অথবা অভিজাত শ্রেণি কর্তৃক তার পছন্দ অনুযায়ী কোনও ভাষাকে ভিন্ন ভাষাভাষী জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার এই তৎপরতা হল ভাষিক আধিপত্যবাদ। ভাষিক আভিজাত্যবাদ ও ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের বহিঃপ্রকাশ হল ভাষিক আধিপত্যবাদ। অর্থাৎ ভাষিক আধিপত্যবাদ ভাষিক আভিজাত্যবাদ ও ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ থেকে উৎসরিত হয়। ভাষিক আভিজাত্যবাদ হল কোনও দেশ বা অঞ্চলে অভিজাত শ্রেণি কর্তৃক তাদের নিজেদের ভাষাকে সমাজের অন্যান্য ভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মনে করা এবং তদনুসারে তাদের নিজেদের ভাষাকে অপরাপর ভাষার তুলনায় গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা করার তৎপরতা। কোনও সমাজে ভাষিক আভিজাত্যবাদ কায়েম হলে তা সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কোনও রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক সেই অভিজাত ভাষাকে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে প্রয়োগ করলে তাকে ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।

ভাষিক আধিপত্যবাদ হল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যবাদের উপজাত একটি আদর্শ বিশেষ। এর অনুসরণে কোনও রাজ্য, সাম্রাজ্য বা রষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তি তার ক্ষমতা বা আভিজাত্যের প্রতীক কোনও ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পায়। বিশ্বজগতের নানা দেশ ও অঞ্চল যুগযুগ ধরে ভাষিক আধিপত্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত বা আক্রান্ত হয়েছে। ভাষিক আধিপত্যবাদ উৎসরিত হয় ভাষিক আভিজাত্যবাদ থেকে আর ভাষিক আভিজাত্যবাদ কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে, তার প্রভাব রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োগে নানাদিকে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। প্রাচীনকালে চীনা, সংস্কৃত, পালি, ল্যাটিন, ফার্সি ও আরবি ইত্যাদি ধ্রুপদী বা চিরায়ত ভাষা বিদ্বৎসমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড দ্বারা পর্যায়ক্রমে ঋদ্ধ হয়ে মান ভাষায় উন্নীত হয়ে উঠলে, সে ভাষার প্রতিভূ রাজনৈতিক শক্তিগুলো সে ভাষাকে প্রথমে রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রে ও পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হয়। এভাবেই ভাষিক আধিপত্যবাদের সূচনা হয়। এবং মধ্যযুগে একই ধারায় ল্যাটিন ভাষাজাত ইংরেজি, ফরাসি ও স্পেনীয় ইত্যাদি ভাষাগুলো নিজস্ব বলয়ে ঋদ্ধ হয়ে উঠলে, এগুলোর প্রতিভূ রাজনৈতিক শক্তিসমূহ সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে তাদের নিজ নিজ ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক আধিপত্যবাদের সূচনা করে। যার ফলাফল হিসাবে আমরা দেখতে পাই এ্যাংলোফোন ভাষিক বলয়, ফ্রাঙ্কোফোন ভাষিক বলয় ও লাতিন আমেরিকা ভাষিক বলয়। আধুনিক যুগে আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে রাশিয়া, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় যথাক্রমে রুশ, চীনা ও মালয়-ইন্দোনেশীয় ভাষানির্ভর ভাষিক আধিপত্যবাদ চলছে।

ভাষিক আধিপত্যবাদ নীতি অনুসরণে যখন কোনও অভিজাত শ্রেণি কোনও ভাষাকে গঠনে, মর্যাদায় ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পায়, তখন এটিকে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ভাষার উপর চাপিয়ে দিতে প্রয়াসী হয়। ভাষিক আধিপত্যবাদ অভিজাত শ্রেণির প্রত্যক্ষ কর্মতৎপরতায় ঘটে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভাষিক আধিপত্যবাদ কায়েম করে থাকে। ভাষিক আধিপত্যবাদ যখন কোনও রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা প্রণীত কর্মকৌশলের মাধ্যমে চাপানো হয়, তখন তাকে ভাষানীতি বলে। এ উপমহাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক ভাষিক আধিপত্যবাদ কায়েমের জ্বলন্ত সাক্ষ্য হল নেপালের শাহ রাজশক্তি কর্তৃক নেওয়ারি (নেপাল ভাষা) ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। নেওয়ারি ভাষা হল একটি ভোট╶তিব্বতিয় ভাষা, আর শাহ রাজবংশের ভাষা হলো নেপালি ভাষা যা একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বভাগ পর্যন্ত নেওয়ারি ভাষা ছিলো নেপালের দাপ্তরিক ভাষা। কিন্তু ১৮৬৮ সাল থেকে নেপালের শাহ রাজশক্তি এ ভাষায় প্রকাশ্যে লিখন ও পঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ ভাষায় সাহিত্য ও বৌদ্ধধর্মীয় পুস্তক রচনার কারণে অনেকে দমন, পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়। নেওয়ারি ভাষাভাষীদের মধ্যে ভাষা অধিকার আন্দোলনে যুক্ত অনেকের যাবজ্জীবন জেল হয়। আবার অনেকে তাঁদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে নির্বাসনে যায়। সেখানে থেকে তারা তাঁদের মাতৃভাষায় লেখাজোখা চালিয়ে যায় ও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে মতামত তৈরিতে কাজ করতে থাকে। কিন্তু ততদিনে এই সমাজের অনেকেই তাদের ভাষা পরিত্যাগ করে নেপালি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়ে যায়। এক জরিপে দেখা যায় যে, কাঠমান্ডু উপত্যকায় যেখানে ১৯৫২ সালে নেওয়ারি ভাষাভাষী জনসংখ্যা ছিলো শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ, ১৯৭২ সালে তা কমে হয়েছে শতকরা প্রায় ৪৪ ভাগ। শাহ রাজবংশের পতনের পর ২০০৬ সালের নতুন সংবিধানে নেওয়ারি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলে, কিন্তু এ ভাষা তার পূর্ব মহিমায় পুনরুজ্জীবন পাবে এমন ধারণা করা বাতুলতা। অনুরূপভাবে, এ উপমহাদেশের সব দেশ ও অঞ্চল অতীতে ভাষিক আধিপত্যবাদকে মোকাবেলা করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে উর্দুভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক আধিপত্যবাদ এবং এখন প্রত্যক্ষ করছে ইংরেজি ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক আধিপত্যবাদ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ প্রত্যক্ষ করছে হিন্দি ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক আভিজাত্যবাদ। একই সাথে ভারতের হিন্দি ভাষাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে ইংরেজি ভাষিক সম্রাজ্যবাদ। দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে দেশ বা অঞ্চলভেদে যে ভাষিক আধিপত্যবাদ চলছে তাদের ধরন ও মাত্রা ভিন্ন। কিন্তু একটি বিষয়ে মিল আছে যে, ইন্দোআর্য থেকে ব্যুৎপন্ন ভাষা সমূ্হই কেবল ভাষিক আধিপত্যকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে। সারা দক্ষিণ এশিয়া যে ভাষা থেকে উৎসরিত ভাষিক আধিপত্য মোকাবেলা করছে তা হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসাবে ইংরেজি ভাষা।

ভাষিক সংরক্ষণবাদ

ভাষিক আধিপত্যবাদের প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ হল ভাষিক সংরক্ষণবাদ। কোনও রাজনৈতিক শক্তির ভাষিক আধিপত্যবাদী নীতির কারণে যে ভাষাসমূহ প্রভাবিত বা আক্রান্ত হয়, সেই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী সমূহ তার প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের ভাষাগত ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে যে তৎপরতা দেখায়, তাই ভাষিক সংরক্ষণবাদ। কাজেই ভাষিক আধিপত্যবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে অভিজাতদের ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার আস্ফালন হিসাবে, আর ভাষিক সংরক্ষণবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষাগত ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের মাধ্যমে। সেজন্য ভাষিক সংরক্ষণবাদ হল প্রভাবশালী ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকার নীতি ও কৌশল বিশেষ। ভাষিক সংরক্ষণবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় প্রান্তিক ভাষাভাষী সমাজে নানা ধরনের নীতি, কৌশল ও তৎপরতার মাধ্যমে। ভাষিক সংরক্ষণবাদের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হল ভাষা অধিকার আন্দোলন। ভাষিক সংরক্ষণবাদ ভাষিক আধিপত্যবাদকে মোকাবেলার একটি কৌশল বিশেষ। ভাষিক সংরক্ষণবাদের মাধ্যমে বহু প্রান্তিক নৃগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠী টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। আবার বহু জনগোষ্ঠী তাঁদের ভাষাকে আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে না পেরে আধিপত্যবাদীদের সমাজের সাথে লীন হয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় শতশত বছর যাবত অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোট-তিব্বতিয় ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত ভাষাসমূহ ইন্দো-আর্য ভাষার আধিপত্যের কবলে নিপতিত রয়েছে। এই সমস্ত ভাষার মধ্যে অনেক ভাষা ইন্দোআর্য ভাষার সাথে লীন হয়ে গেছে। আবার বহু ভাষা সংরক্ষণবাদী নীতির কারণে এখনও টিকে আছে। বাঙলাদেশে (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) অনেক অস্ট্রিক ভাষারূপ ইন্দোআর্য ভাষারূপের সাথে লীন হয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে এ সব ভাষার ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ভাষান্তরিত হয়ে ইন্দোআর্য ভাষাভাষী হয়ে পড়েছে। আবার অনেক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, যেমন — গারো, রাভা ও ত্রিপুরা ইত্যাদি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী শতশত বছর ধরে ইন্দোআর্য ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক আধিপত্যবাদকে মোকাবেলা করে নিজেদের ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্বাধীনতা থেকে লাভের পর ভারত ও পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ যথাক্রমে হিন্দি ও উর্দু ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের কবলে নিপতিত হয়। হিন্দি ও উর্দু ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ভাষিক সংরক্ষণবাদের আশ্রয় নেয়। ভাষিক সংরক্ষণবাদের নীতি গ্রহণের ফলে বহু ভাষা এখনও টিকে আছে। আবার ভারত ও পাকিস্তানের বহু ভাষা হিন্দি ও উর্দু ভাষার প্রভাবে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলাদেশের (অর্থ্যাৎ পূর্ববঙ্গ) উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভাষিক সংরক্ষণবাদের নীতি অনুসরণ করায় বাংলা ভাষা উর্দু ভাষাকেন্দ্রিক ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু বর্তমান অবশিষ্ট পাকিস্তানে বহু আঞ্চলিক ভাষা যেমন সারাইকি ও পাঞ্জাবী ইত্যাদি বিলুপ্তির পথে রয়েছে। ভারতেও তেমনি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষারূপসমূহ, যেমন-অয়ূধী, ভোজপুরী, গাড়োয়াল ও মাগহী ইত্যাদি ভাষারূপ হিন্দি ভাষা থেকে উৎসরিত ভাষিক আধিপত্যবাদের কবলে পড়ে অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে।

উপসংহার

উপরের পর্যালোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে ভাষিক আধিপত্যবাদের প্রতিক্রিয়ায় ভাষিক সংরক্ষণবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রাজনৈতিক শক্তি ভাষিক আধিপত্যবাদী নীতি গ্রহণ করলে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, কোনও অভিজাত ভাষাকে অনুগত জনগোষ্ঠীর ভাষার চেয়ে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস পায়। এই নীতির অংশ হিসাবে রাজনৈতিক শক্তিসমূহ কোনও বিশেষ কায়েমী স্বার্থবাদী অভিজাত গোষ্ঠীর ভাষাচর্চাকে অনুমোদন দিয়ে থাকে। এভাবে ভাষিক আধিপত্যবাদ কায়েমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিকল্পনার প্রভাবে বিজিত বা অনুগত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ভাষিক সংরক্ষণবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। ফলে ভাষিক আধিপত্যবাদ ও ভাষিক সংরক্ষণবাদের মধ্যকার দ্বান্দ্বিকতা সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে নানাভাবে পরিস্ফুট হয়। এবং দ্বান্দ্বিকতার এই বহিঃপ্রকাশ একটি দেশ বা সমাজে কয়েক বছর থেকে কয়েক শতাব্দী ধরে চলতে পারে। ইন্দোআর্য ভাষা এবং অস্ট্রিক, ভোট-তিব্বতিয় ও দ্রাবিড় ইত্যাদি অনার্য ভাষার মধ্যে এই দ্বান্দ্বিকতা দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজিত বর্তমান ভাষিক বুনোটটি সৃষ্টি করেছে এবং বিরাজিত এই ভাষিক বুনোটটিকে রূপান্তরে সহায়ক ভাষিক আধিপত্যবাদ-ভাষিক সংরক্ষণবাদের দ্বান্দ্বিকতা স্বতঃক্রিয়াশীল অবস্থায় রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে হয়তো আরও শতশত বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজিত ভাষিক বুনোট বদলাতে থাকবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4646 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...