তোমার সমাধি, গুলি বোমায় ঢাকা

রেবা ভৌমিক

 

প্রায় ৩৫ বছর হয়ে গেল সাংবাদিকতা করছি। এই রাজ্যে বহু ভোট দেখেছি। বাম জমানার ভোটে রিগিং, ছাপ্পা, বুথদখল, ভোটের আগে ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেওয়ার মতো অসংখ্য অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরে গিয়েছে এই প্রায় সাড়ে তিন দশকে। কিন্তু তৃণমূলের জমানায় যে পঞ্চায়েত ভোট দেখলাম এবার, তা সিপিএম জমানাকে তো বটেই — বিহার, উত্তরপ্রদেশের ভোটকেও লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।

পাঠক বলুন তো — এর আগে কখনও শুনেছেন, গণনাকেন্দ্রে ছাপ্পা ভোট হয়? অতীতে কখনও শুনিনি, চোখেও দেখিনি। ভারতের কোনও রাজ্যেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনীর সৌজন্যে ১৭ই মে ভোট গণনার দিন সেই দৃশ্যও আমাদের দেখতে হল। নদীয়া জেলার একটি গণনাকেন্দ্রের এই ছাপ্পা ভোট মারার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বৃহস্পতিবার ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তারজালে ঘেরা গণনাকেন্দ্রের মধ্যেই শাসকদলের এক বীরপুঙ্গব সমানে ব্যালট পেপারে ছাপ্পা দিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে তাকে আঙুল উঁচিয়ে কয়েকজনকে শাসাতেও দেখা গেল। সম্ভবত তারা বিরোধী দলের এজেন্ট হবেন। ওই বীরপুঙ্গব এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের শাসানিতে তারা আর বাধা দিতে এগিয়ে আসেননি। বাধা দিতে দেখা যায়নি কোনও ভোটকর্মী কিংবা পুলিশকর্মীকে।

গণনা-প্রহসনের আর একটি নমুনা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসন্তী ব্লকের রামচন্দ্রখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৩১ পার্ট। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৫০টি। কিন্তু গণনা হয়েছে ৭৮২টি ব্যালট। তাতে শাসকদলের প্রার্থী ৩৯২টি ভোট পেয়ে জিতেছেন।

এরকম যে কত বুথে হয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। আসলে গোটা পঞ্চায়েত ভোটটাই হয়েছে এক বিরাট প্রহসন। ভোটের আগে মনোনয়ন পর্বে যা যা ঘটেছে তা সুধী পাঠক সকলেই জানেন। টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে তৃণমূলের ভৈরব বাহিনীর তাণ্ডবলীলা কারও অজানা থাকার কথা নয়। ১৪ই মে ভোটের দিনটিও ছিল পশ্চিমবাংলার ইতিহাসে এক কালো দিন। আর গণনার দিন গণনাকেন্দ্রের ছাপ্পা ভোট আরও ভয়ঙ্কর নজির। উদ্দেশ্য একটাই — যে কোনও মূল্যে আমাদের জয় চাই!

কিন্তু কারণ কী? দলনেত্রী আগেই হুঙ্কার দিয়ে রেখেছেন, আমাদের ১০০ শতাংশ আসন চাই পঞ্চায়েতে। যুক্তিও অদ্ভুত। কোনও পঞ্চায়েত বিরোধীদের হাতে আসলে নাকি রাজ্যে ‘উন্নয়ন’ ব্যাহত হবে! নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর একই যুক্তি পুরসভাগুলির ক্ষেত্রেও। পুরসভার ভোটে পেশিশক্তির আস্ফালন আমরা দেখেছি এর আগে। যে সব পুরসভা এবং পঞ্চায়েত বিরোধীদের দখলে ছিল, সেগুলিকে হয় টাকার লোভ দেখিয়ে নতুবা ভয় দেখিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আসলে তিনি চান বিরোধীশূন্য রাজ্য — যেমন প্রধানমন্ত্রী মোদী চান কংগ্রেসমুক্ত দেশ, দু’জনেই আবার নাকি গণতন্ত্রের পূজারী!

প্রত্যাশামতোই পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে শাসকদলের বিপুল জয় হয়েছে। এমনিতে ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা ৩৪ শতাংশ আসনে জয়ী হয়েছে। বাম আমলেও পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের নজির ছিল। তবে তা কখনও ১৩ শতাংশের উপরে ওঠেনি। এবারই অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে শাসক বিনা যুদ্ধে ৩৪ শতাংশ আসন পেয়ে গিয়েছে। বাকি ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে যা ভোট হল, তার নমুনা সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। এই প্রথম প্রায় ১ কোটি ৬৫ লক্ষ মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগই পেলেন না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়ানো শাসকদলের ‘উন্নয়নের’ সৌজন্যে।

দাবি করা হচ্ছে, তিন স্তর মিলে তৃণমূল ৯০ শতাংশ জিতে গিয়েছে প্রহসনের ভোটে। এখন দেখার, বাদবাকি যেসব আসনে বিরোধী অথবা নির্দলরা জয়ী হয়েছেন তাঁদের কী হাল হয়। কতদিন তাঁরা বিরোধী থাকতে পারেন। কারণ নেত্রী আগেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন বিরোধী নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে, যাঁরা জিতলেন, তাঁদের ধরে রাখতে পারবেন তো?

ইঙ্গিতটা খুব পরিষ্কার। ছলে বলে কৌশলে, প্রলোভন অথবা ভয় দেখিয়ে তাঁদের ভাঙিয়ে নিয়ে আসা। ওই যে, তাঁর ১০০ শতাংশ চাই-ই চাই!

আসলে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনও বিরোধী পরিসর রাখতে চান না। ২০১১ সালে মসনদে বসার পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটাই মহান ব্রত, বিরোধী আবার কী। তাই দেখুন, সর্বত্রই তৃণমূল বিরোধীশূন্য করতে বদ্ধপরিকর। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে কোনও বিরোধী ছাত্র সংসদ নেই। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার তৃণমূল ছাত্র ইউনিয়নেরই একাধিক গোষ্ঠী, সেখানে মারামারি রক্তপাত নিত্যদিনের সঙ্গী। এর উপরে আবার দলের নেতারাও যত্রতত্র শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকে পড়েন।

এবার ভোটের আগে মনোনয়ন পর্ব থেকেই দেখা গেল, শাসকদলের লুম্পেনবাহিনী কী মহাসমারোহে গণতন্ত্রের বহ্নিউৎসবে মেতে উঠল। দিদির বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ার নির্দেশ পেয়ে তাঁর সোনার টুকরো ভাইয়েরা বিডিও অফিস, এসডিও অফিস দখল করে ফেলল, যাতে বিরোধীরা মনোনয়ন না দিতে পারে। আর সেই ভাইদের যোগ্য সঙ্গত দিল অপদার্থ, ক্লীব রাজ্য নির্বাচন কমিশন। যেখানে শাসকদলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিরোধী মনোনয়ন পড়ল, সেখানেই হুলুস্থূল। মারদাঙ্গা, লাশ — আদালত পর্যন্ত গড়াল বিষয়টি। শাসকদলের যুক্তি, মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই তাদের লোক। এতে কোনও ভ্রান্তি নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গোষ্ঠী সংঘর্ষের বলি হয়েছেন তাঁরা। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর অবশেষে কোলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, ১৪ই মে শেষদিনে ভোট করতে কোনও বাধা নেই। ভোটের দিন সকাল থেকেই জেলায় জেলায় শাসক দলের ভৈরব বাহিনীর তাণ্ডব চলল। মারদাঙ্গা, বুথ দখল, রিগিং, ছাপ্পা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ব্যালটে আগুন চলল অবাধে। যেখানে যেখানে মানুষ পারলেন রুখে দাঁড়ালেন, প্রতিরোধ গড়লেন বিরোধীরা। দিনের শেষে মৃতের সংখ্যা প্রায় কুড়ি। সারাদিনে এত তাণ্ডব, অথচ একবারের জন্যও দেখা মিলল না সরকারের বংশবদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনার এ কে সিং-এর। তিনি কোন দিদির আঁচলের তলায় মুখ লুকোলেন, কে জানে। বিকেলে কালীঘাটের উঠোন থেকে বেরিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি সাফাই দিলেন, ভোট ভালোই হয়েছে! গত পঞ্চায়েত ভোটের থেকে মৃত্যু হয়েছে কম। ১২ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে, তার মধ্যে ছয়টি ভোট সম্পর্কিত। বাকি ছয় মৃত্যুর সঙ্গে ভোটের কোনও সম্পর্কই নেই! মুখ্যমন্ত্রী, যিনি কথায় কথায় টুইট করেন, ভোটের দিন নিশ্চুপ। তাঁর স্থূল চেহারার এক ভাই, যিনি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে ওস্তাদ, তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনকে বাহবা দিলেন। দাবি করলেন, সর্বত্র দলের কর্মীরা নাকি অসাধারণ সংযম দেখিয়েছে। দলের মহাসচিবের আরও দাবি, মৃতদের মধ্যে তাদের দলের লোকই বেশি।

এ যে ভয়ঙ্কর দাবি! যে নিজের দলের লোকেদেরই নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে রাজ্যবাসীকে নিরাপত্তা দেবে কেমন করে? এর থেকেই বোঝা যায়, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। বস্তুত, ১৪ই মে তারিখেই রাজ্যে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে ফেলল তৃণমূল।

আর বৃহস্পতিবার তথাকথিত ফলপ্রকাশের পর সেই সমাধির উপরে বসে মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূলের ‘বিশাল জয়’কে মানুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন। আর কী বললেন? বললেন, “বাংলায় গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকলে পঞ্চায়েতে এতগুলি আসনে এত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা যেত না। কয়েকটা জায়গায় যদি বিক্ষিপ্ত ঘটনাও ঘটে, আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছি।”

এত তাণ্ডব, এত মৃত্যু, এত লুটপাট, ভাঙচুর, আগুন! আর নবান্নের অধিকারিণীর দাবী, এসবই নাকি বিক্ষিপ্ত ঘটনা। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে বোধহয় আরও একবার বলতেন, “বাহবা সময়, তোর সার্কাসের খেল।” সত্যিই, এ ভোট তো সার্কাস ছাড়া আর কিছু নয়!

মনে পড়ছে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ১৯৮৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের কথা। বাম জমানায় কোনও পঞ্চায়েত ভোটেই বাম শরিকদের মধ্যে সার্বিক বোঝাপড়া হত না। যেখানে যে শরিক শক্তিশালী ছিল, সেখানে তারাই দাপট দেখাত। সেই সময় কুচবিহার জেলায় দাপট ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের। প্রয়াত কমল গুহ ছিলেন কুচবিহারের অবিসংবাদী নেতা। বড় শরিক সিপিএম ছোট শরিকদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত। সেবারে কুচবিহার গিয়েছিলাম পঞ্চায়েত ভোট কভার করতে। ভোটে সিপিএমের সঙ্গে বনিবনা হয়নি ফব-র। ব্যাপক রিগিং, সন্ত্রাস চালিয়েছিল সিপিএম। ভোটের দিন বিকেলে জেলা পার্টি অফিসে সাংবাদিক বৈঠক করে কমলবাবু অভিযোগ করলেন, সিপিএম এই ভোটকে প্রহসনে পরিণত করল। কমলবাবু তখন বাম সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীও বটে। পরের দিন কোলকাতার সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় লিড স্টোরি ছিল কমলবাবুর সেই বক্তব্য।

এবারের পঞ্চায়েত ভোটকে প্রহসন বললেও কম বলা হয়। এই ভোটে কে জিতল কে হারল সেটা বড় কথা নয়। পরীক্ষাই হল না, তার আবার পাশ ফেল! আর এমন একটা দল এই তৃণমূল, যে দলে আত্মমর্যাদাপূর্ণ, মেরুদণ্ডী লোকের বড় অভাব। গত এক দেড়মাস ধরে ভোটের নামে তাণ্ডব চলল রাজ্য জুড়ে, একটি নেতারও মুখে কোনও রা নেই? থাকবেই বা কী করে, যদি চাকরি চলে যায়! খোদ পঞ্চায়েতমন্ত্রীও নীরব কেন?

পরিশেষে বলি, তৃণমূল জয়ের যে দাবিই করুক না কেন, রাজ্যবাসীর বড় অংশ এটাকে জয় বলে মনে করে না। তারা চায়, ভোটের নামে এই তামাশা বন্ধ হোক। আর মুখ্যমন্ত্রী, দোহাই আপনার, কথায় কথায় গণতন্ত্রের বুলি আর আওড়াবেন না। আপনার প্রত্যক্ষ মদতে রাজ্যে আজ গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হল। সে সমাধি গুলি, বোমা, আর পোড়া লাশের গন্ধে ঢাকা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. এমনি ভালো লেখা। তবে রাগের পরিমাণ একটু কমিয়ে যদি আরেকটু বিশ্লেষণাত্মক হওয়া যেত, মনে হয় আরও ভালো হত। ব্যক্তিগত মতামত অবশ্য।

Leave a Reply to ক.ব. Cancel reply