ডা. প্রিয়াঞ্জলি দত্ত ও স্তনের ক্যানসার : এক অন্য ‘আরোগ্য’র গল্প

প্রিয়াঞ্জলি দত্ত

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

কেন সব কুকুরগুলি খামোখা চেঁচায় রাতে?
কেন দাঁতের পোকা থাকে না ফোকলা দাঁতে?
পৃথিবীর চ্যাপ্টা মাথা, কেন সে কাদের দোষে?
এসো ভাই চিন্তা করি দুজনে ছায়ায় বসে।

সুকুমার রায়

কিছু শুকনো তথ্য।

  1. দেশের মেয়েদের মধ্যে প্রধানতম ক্যানসার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে স্তনের ক্যানসার।
  2. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছেন, অদূর ভবিষ্যতেই, মাত্র বছরকয়েকের মধ্যেই, এদেশে প্রতি পরিবারে অন্তত একজন ক্যানসার আক্রান্ত মানুষ থাকবেন।
  3. জটিল রাশিতত্ত্বের আঁক কষে, আইসিএমআর জানাচ্ছেন, আগামী দিনে, দেশে, প্রতিবছর নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন সাড়ে সতেরো লক্ষ মানুষ, তার মধ্যে দশ শতাংশ স্তনের ক্যানসার। বছরে ক্যানসারে মারা যাবেন, আনুমানিক নয় লক্ষের কাছাকাছি।

এই জুন মাসের মাঝামাঝি প্রকাশিত ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল থেকে কিছু তথ্য:

  1. দেশের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষের বাস গ্রামাঞ্চলে।
  2. স্বাস্থ্যসূচকের প্রায় সবকটি হিসেবেই, গ্রাম শহরের থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে।
  3. বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসক (প্রায় নব্বই শতাংশ) যুক্ত আছেন বেসরকারি পরিষেবায়।
  4. দেশের জনসংখ্যা আর চিকিৎসকের অনুপাতের অঙ্ক কষতে গেলে, প্রতি এগারো হাজার মানুষপিছু রয়েছেন একজন সরকারি এলোপ্যাথি চিকিৎসক। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা চান প্রতি হাজার নাগরিকপিছু একজন চিকিৎসক। (এর সাথে, একটু বাস্তব অভিজ্ঞতা মেলালে, গ্রামীণ স্বাস্থ্যপরিষেবার হাল আরও করুণ, সেখানে নাগরিক-চিকিৎসকের অনুপাত আরও শোচনীয়)।
  5. সরকার স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করেন জিডিপির ১.০২%। বিশ্বের গড় ছয় শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেশ অনুযায়ী যা হওয়া উচিত ন্যূনতম পাঁচ শতাংশ। অনেক বোলচালের পরেও, বিগত পাঁচ-ছয় বছরে, ভদ্রলোকের এক কথা। বরাদ্দ ওই এক শতাংশের চেয়ে বাড়েনি। টাকার অঙ্কে, সরকার বাহাদুর নাগরিকপিছু দিনে তিন টাকা স্বাস্থ্যখাতে খরচা করেন। নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতেও, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আড়াই শতাংশের উপরে পৌঁছোনোর উচ্চাশাটুকু পর্যন্ত নেই।

দু’সেট তথ্য মেলালে, ভবিষ্যতের যে ছবিটা উঠে আসে, সেটা আতঙ্কের। সরকার স্বাস্থ্যের জন্যে বরাদ্দ যা করছেন, তা মরুভূমিতে এক গেলাস জলের তুল্য। বেসরকারি স্বাস্থ্য-উদ্যোগ মূলত মুনাফামুখী, কাজেই শহরকেন্দ্রিক আর উচ্চমধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের পকেটের লক্ষ্যে নিবেদিত। তবে, এগিয়ে আসা ক্যানসার-মহামারীর মোকাবিলা কোন পথে?

নাঃ, এইসব নিয়ে কেউই তেমন ভাবিত নন। না হলে, মিডিয়ার মূলস্রোতে এই নিয়ে তেমন আলোচনা কোথায়? আর, সমস্যার সমাধানে সরকারি-অসরকারি উদ্যোগের কথাই বা কতটুকু?

এরই মধ্যে যখন খবর পাই, সদ্যযৌবনে পা দেওয়া একজন মানুষ, শুধু ভাবনাতেই থেমে না থেকে, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে না থেকে, নিজস্ব সীমিত উদ্যোগে সমাধানের চেষ্টা করছেন, তখন চমৎকৃত হতেই হয়। নিজেদের উদ্যোগহীনতায় লজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি, খুব রাগও হয়, কেন আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এমন উদ্যমের খবর পাবেন না!!

মানুষটির নাম, ডাঃ প্রিয়াঞ্জলি দত্ত। বেড়ে ওঠা শিলং-এ। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই নিজের সংস্থা ‘আরোগ্য’-এর মাধ্যমে একটা বদল আনতে চেয়েছেন। তাঁর সাথে রয়েছেন, ডাঃ ধ্রুব কাক্কর। সদ্য যৌবনেই, বোধ হয়, এমন সহজেই বড় উদ্যোগের কথা ভাবা যায়, এমন আত্মবিশ্বাসে ভর করে বড় সমস্যার সমাধানের পথে একক প্রয়াসে ব্রতী হওয়া যায়!!

স্তনের ক্যানসারের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের নাম ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার। অন্যান্য স্তনের ক্যানসারের তুলনায় এটি অনেকটাই বেশি বিপজ্জনক, আর হয়ও অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্কাদেরই। তাড়াতাড়ি ধরা না পড়লে ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার, চিকিৎসায় তেমন ভাল সাড়া দেয় না। প্রিয়াঞ্জলির আরোগ্য ঠিক এই ক্যানসারের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

শুরু ২০১৭ সালে। ছোটবেলার শহর শিলং থেকেই। আস্তে আস্তে ডালপালা মেলেছে দিল্লি-নয়ডা-হরিয়ানা এমনকি এই বাংলাতেও।

হাইটেক ক্যানসার-প্রতিরোধ আর বহুমূল্য চিকিৎসা, পরিকাঠামোয় গ্রাম আর শহরের যে দুর্লঙ্ঘ ব্যবধান, তার মধ্যে সেতু বাঁধছে আরোগ্য।

সচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্য সংগ্রহ, সেই তথ্যের বিশ্লেষণে উঠে আসা চিত্রটি বিচার করে পরের ধাপে এগোনো, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত প্রান্তেও উন্নত পরামর্শ পৌঁছে দেওয়া– প্রিয়াঞ্জলি-ধ্রুবর আরোগ্য কিন্তু সমস্যার মূলে গিয়েই সমাধানের পথ দেখাচ্ছে।

টিমে আছেন ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী-স্বেচ্ছাসেবী। গ্রামে গ্রামে গিয়ে সচেতনতা বাড়ানো থেকে শুরু করে নিজেই নিজের স্তন-পরীক্ষণ বা ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন শেখানো, সবই রয়েছে কর্মধারার মধ্যে।

তার সাথে সাথে তথ্যসংগ্রহ। কতখানি নাগালের মধ্যে স্বাস্থ্যপরিকাঠামো– সেই অনুসারে গ্রামগুলিকে ভাগ করে নিয়ে স্বাস্থ্যপরিষেবার নৈকট্য বা উপযোগিতার বিশ্লেষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও হচ্ছে এই পথেই। সঙ্গে দেশের একটি স্বাস্থ্যম্যাপ আঁকা বা তদসংক্রান্ত জরিপ।

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছোনোর চ্যালেঞ্জগুলিও খুঁজেছে আরোগ্য। না, সবটাই শুধু স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর অভাব নয়, শিক্ষার অভাব বা কুসংস্কার এও বড় সমস্যা। সত্যি বলতে কি, স্বাস্থ্য বিষয়টিকে শুধু পরিকাঠামো ইত্যাদিতে তো বাঁধা যায় না। সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়ন বা ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ছাড়া সমাজের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি তো অসম্ভব। আরোগ্য-র প্রাথমিক তথ্য, সোচ্চারে না হলেও, স্বাস্থ্যরাজনীতির এই দিকেই পথ দেখাচ্ছে।

প্রিয়াঞ্জলি-দের কাজের গুরুত্ব কিন্তু শুধুমাত্র বর্তমানে থেমে নেই। আরোগ্য-র কর্মধারা সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী পর্যায়েও যদি কেউ উদ্যোগী হন, তাঁর প্রয়োজনীয় তথ্যের রসদ তিনি পেতে পারবেন আরোগ্য থেকেই। কাজেই, পরবর্তী উদ্যম শুরু হতে পারবে পরের ধাপ থেকে। হ্যাঁ, এইখানেই আরোগ্য এক আশ্চর্য দূরদর্শী উদ্যোগ।

সরকারি বা অসরকারি সহায়তা পেতে শুরু করেছে আরোগ্য। কিন্তু, আমি-আপনি এখনও তেমন করে জানতে পেরেছি কি?

প্রচারের অভাব নিয়ে প্রিয়াঞ্জলি বা ধ্রুব ভাবেন না। তাঁদের তারুণ্যের স্পর্ধিত উদ্যোগ ওই তুচ্ছ জনপ্রিয়তার বহু ঊর্ধ্বে।

কিন্তু, আমরাও কি এই মহান উদ্যোগ বিষয়ে উদাসীন থাকব? আর কিছু না পারি, অনুপ্রেরণা তো পেতেই পারি!!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4859 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...