মালদহের গনি খান কলেজের সঙ্কট : একটি আবেদন

সাইন জাইদি

 

‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্যটার কথা মনে আছে? যেখানে রাজার পেয়াদা এসে বইপত্র শিক্ষাসামগ্রী ঘর থেকে বের করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলছে, আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে, বাধা দিতে আসা শিক্ষক ও ছাত্রদের সরিয়ে দিচ্ছে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে, হতবুদ্ধি ছেলের দল সভয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের চোখের সামনে কীভাবে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ!

এই মুহূর্তে আমাদের, অর্থাৎ মালদহের গনি খান চৌধুরী ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-র ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা অনেকটা সেইসব হতবুদ্ধি শিক্ষার্থীদের মতোই। না, আমাদের বইপত্র কেড়ে নেয়নি কেউ, গত জুনে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধের সময় পুলিশের লাঠির বাড়ি ঘাড়ধাক্কা খেয়েছি বটে, কিন্তু আমরা এই সাড়ে আটশো ছাত্রছাত্রী ধনেপ্রাণে মারা গেলাম সেদিন, ছয় বছর ধরে এখানে পড়াশুনো করার পর যেদিন আমরা জানতে পারলাম যে আমাদের রেজাল্ট বা সার্টিফিকেট কিছুই দেওয়া হবে না, কারণ আমাদের কলেজেরই কোনও অ্যাফিলিয়েশন নেই।

সেই দিনটির কথায় পরে আসব। তার আগে, শুরু থেকে শুরু করা যাক।

২০১০ সালে পথ চলা শুরু করে GKCIET, উদ্বোধন হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধীর হাত ধরে। মালদহবাসীর এক স্বপ্নের পথ চলা শুরু হয়েছিল সেদিন। মড্যুলার প্যাটার্ন-এ চালু হয় কলেজ। অর্থাৎ মাধ্যমিক পাশের পর প্রথম দু বছরের ভোকেশনাল কোর্স, তারপর দু বছরের ডিপ্লোমা এবং তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং (বি টেক) পড়ার সুযোগ, এই ছিল রুটম্যাপ। ভর্তি নেওয়া হবে সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে। ২০১৪ সাল, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি এসে উদ্বোধন করলেন বি টেক কোর্সের। এ যেন স্বপ্নপূরণের দিকে এক ধাপ পেরোনো। ২০১৬ এল, প্রথম বি টেকের ব্যাচ বেরোল, পড়াশোনা শেষ হল, কিন্তু হঠাৎ জানা গেল বি টেকের কোনও সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব নয়। আজব ব্যাপার! আপনারা অবাক হচ্ছেন? সত্যিই, ছয় বছর পড়াশুনো করার পর হঠাৎ জানা গেল গনি খান কলেজের বি টেক ডিগ্রি প্রদানের ছাড়পত্রই নেই। স্বপ্নেরা ভেঙে খানখান! সে আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। বিশ্বাস হয়নি, আমরা ভুয়ো কলেজের ছাত্র, জীবনের সুবর্ণ সময় ব্যয় করে আমরা যা শিখলাম, কাজের বাজারে তার কানাকড়িও দাম নেই। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত কয়েকশো ছেলেমেয়ের সামনে অপেক্ষা করে রয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যত!

অতএব লড়াই ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না। আমরা লড়াইয়ে নামলাম। এ লড়াই আমাদের লড়তেই হত নিজেদের জীবনের স্বার্থে, নিজেদের বাবা-মায়ের মুখ চেয়ে। অতঃপর দীর্ঘ ২৬ দিনের অনশন, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ, রেল অবরোধের পর রাজ্য সরকারের টনক নড়ল। ডিপ্লোমা পর্যন্ত অ্যাফিলিয়েশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। আর বি টেক ডিগ্রিটি এন আই টি দুর্গাপুর দেবে, একথা চিঠি দিয়ে জানাল কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি, এন আই টি দুর্গাপুর, দীর্ঘ টালবাহানার পর কোনও শংসাপত্র দিতে বা ভর্তির সুযোগ দিতে অস্বীকার করল। আমাদের থেমে যাওয়া লড়াই শুরু হল আবার। চলল এখান থেকে সেখান– সর্বত্র দরবার, পিটিশন, ডেপুটেশন। কোনও ফল মিলল না।

২০১৮-র শুরুতে বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রজীবনের একটা বছর বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মড্যুলার প্যাটার্নের নতুন নিয়ম অনুযায়ী গনি খান কলেজেই ভর্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হল আবার। এবার কলেজ কর্তৃপক্ষ লিখিত আশ্বাস দিলেন, ২০১৮-র মার্চ নাগাদ MAKAUT অনুমোদন পাবে কলেজ। মিটবে সমস্যা। এভাবে বারেবারে আন্দোলনের পরে পাওনা এক-একেকটা আশ্বাস, আর এক-একটা দিন অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। বারবার প্রতারিত হই আমরা।

ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট নিয়েই কেউ কেউ চাকরির জন্য চেষ্টা চালাল, পেটের দায়! আর ক’দিন এভাবে শূন্যহাতে ফেরা যায়! কিন্তু সরকারি সংস্থায় চাকরির জন্য গেলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। স্পষ্ট জানানো হয় দুবছরের ডিপ্লোমা বৈধ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত ২ বছরের ডিপ্লোমার আগে দু বছরের ITI অথবা 12th ভোকেশনাল পাস করবে। আমাদের যেহেতু ডিপ্লোমার আগে কলেজ কর্তৃপক্ষ ২ বছরের সার্টিফিকেট কোর্স করিয়েছে আমরা সেই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা চুপ করে থাকেন। এবং এটা ITI এবং ভোকেশনাল কোনওটাই নয় সেটাও জানিয়ে দেন। এতদিন তাহলে কী নিদারুণ প্রতারণা চলেছে আমাদের সঙ্গে! ভাবতে পারছেন?

এবার আর চুপ থাকা নয়, তীব্র লড়াইয়ে নামি আমরা। না, এবার আর হেরে যাওয়া নয়। এবার শেষ দেখে ছাড়ার পালা। এই জুলাই মাসেই আন্দোলন চলে, চলে দীর্ঘ ১৬ দিনের অনশন, তবুও প্রতারিত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ছেলেখেলা চলতে থাকে। জোটে আশ্বাস, জোটে হুমকি, হয় পুলিস কেস, মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয় ছাত্রদের। আর এই মাসেই রেজিস্ট্রার আমাদের সাফ জানিয়ে দেন MAKAUT আমাদের পুরোনো ছাত্রছাত্রীদের কোনও দায়িত্ব নিতে পারবে না। তাছাড়া ওনারা এও জানান যে আমাদের প্যাটার্নের সার্টিফিকেটে MAKAUT-এ ভর্তি হওয়াও অসম্ভব। এক কথায় এটা একটা অবৈধ সার্টিফিকেট এবং ইতিমধ্যেই আমাদের কিছু ছাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেও ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশনের সময় বাদ পড়েছে। আমরা এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে আন্দোলন চালিয়ে যাই, আর আন্দোলন করার অপরাধে আমাদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে যেতে থাকেন আমাদের মাননীয় কর্তৃপক্ষ।

আমরা অসহায়, আমরা প্রতারিত, আমরা নির্যাতিত। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সংবাদমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় না আমাদের মুখ। আমাদের প্রতিবাদ-লড়াই সেভাবে জায়গা পায় না খবরের কাগজের এক কোণেও। এর মধ্যেই অনশনের চাপে কলকাতার মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। আমাদের ভরসা বাড়ে। সোশাল মিডিয়ার দৌলতে কলকাতা ও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই সমর্থনের হাত বাড়াতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে পারছি আমরা একা নই, আমাদের পাশে বেশ কিছু মানুষ আছেন, আমাদের প্রতি প্রায় এক দশকব্যাপী অবিচারের প্রতিবাদে গলা তুলছেন। কিন্তু এখনও অনেকটা পথ পেরোনো বাকি। আমরা সব মানুষেরও সাহায্য চাই। সংবাদমাধ্যমের সাহায্য চাই। গত আট বছর ধরে পড়াশুনো করা, এখানে ‘সময় নষ্ট’ করা প্রায় সাড়ে আটশো জন ছাত্রছাত্রী ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ এর সঙ্গে জড়িত। আমাদের পাশে দাঁড়ান।

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...