একটি নান্দনিক পরিকল্পনা

রোমেল রহমান

 

সেই সময়ের গল্প মনে পড়ে, যখন সারাদেশে ‘সূর্যের থেকে বালি গরম’ টাইপ ব্যাপার বিরাজমান; অর্থাৎ নেতাদের থেকেও বেশি হম্বিতম্বি করতো অধস্তন নেতারা, অর্থাৎ রাষ্ট্র মানে সেই সময় দিকে দিকে নেতা, পাতিনেতা আর ক্ষমতার কোটাল চৌকিদারদের উন্মাদনা, চারদিকে চাঁদাবাজি আর কালোটাকার হাতবদল আর দুর্নীতি; ফলে আমাদের মনে পড়ে যায় এক দেশে এইরকম এক সময় যখন চলছিলো তখন সেই দেশে একটা ঘটনা ঘটে, ঘটনাটা এরকম যে :
একদিন দেশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নেতা আমলার বাসায় একজন করে তরুণ/তরুণী আসে দেখা করতে, এই তরুণ/তরুণীরা ছিল অসম্ভব সুন্দর, গড় মানুষের চেহারার সঙ্গে তাদেরকে মেলান যেতো না, যেহেতু ‘পোশাকের মর্যাদা’ বলে একটা ব্যাপার চালু আছে তাই এদের প্রত্যেকের পরনে ছিল আকর্ষণীয় গাম্ভীর্যময় পোশাক যা থেকে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীর মানুষ বলে আলাদা করা যেতো, কারণ সেই সময়ে নেতা মন্ত্রীদের দর্শন সাধারণ মানুষেরা পেতো না কেনোনা নেতাদের নিতম্ব এতোটাই ভারি হয়ে গিয়েছিলো যে তারা সেটা কোথায় রাখবে সেটা ঠিক করতে করতেই তারা ভুলে গেলো যে তারা আসলে কোথা হতে উঠে এসেছিলো, ফলে ধান্দাবাজ নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত মন্ত্রিদের দর্শনপ্রার্থী হয়ে যখন সেই যুবক/যুবতীরা গেলো তাদের বেশিরভাগকেই প্রবেশ দুয়ারে আটকানো হল না চেহারার গুনে কিংবা পোশাকের গুনে, ফলে তারা যখন মন্ত্রিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তখন লোকের ভিড়ে তাদের পোশাকের গুনেই হোক কিংবা চেহারার গুনেই হোক তারা আলাদাভাবে নজরে আসলো আর অন্যদের ফেলে মন্ত্রী যখন তাদের আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলো তখন তারা বলল; ‘আপনার হাতের কাজ শেষ করুণ, তারপর বলি, ফাঁকা হলে খবরটা দিতে হবে’, ফলে এই কথা শোনার পর সকল মন্ত্রী/আমলাই আন্দাজ করতে লাগলো এরা নিশ্চয়ই বিশেষ কেউ, নিশ্চয়ই কেন্দ্র থেকে পাঠানো হয়েছে কিংবা গুরুতর কোন প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট, ফলে সকল মন্ত্রী/আমলা তাদের দরবার ফাঁকা করে দিয়ে বলল, ‘বলুন এবার’; প্রত্যেক মন্ত্রী/আমলার কাছেই শুধু একটা মাত্র বাক্য তারা পৌছাল আর সেটা হচ্ছে, ‘আপনার সময় শেষ!!’; শুধুমাত্র একজন মন্ত্রী প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন’, ফলে সেই মন্ত্রীর সামনে দণ্ডায়মান তরুণীটি একটা দারুণ চমৎকার হাসি ঠোঁটে এঁকে বলল, ‘যাক্‌ অন্তত আপনি প্রশ্ন করেছেন, আপনারা তো প্রশ্নই করা ভুলে গেছেন’, ফলে এই উত্তর শুনে মন্ত্রী ভুলে গেলো যে সে একটা প্রশ্ন করেছিলো ফলে তার উত্তর না দিয়ে তরুণীটি চলে গেলো, এরকম ভাবে সারা দেশে একদিনেই সাতজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং তিনজন জাঁহাবাজ আমলার সামনে একই ঘটনা, একই প্রশ্ন ভোজবাজীর মতন দশজন তরুণ তরুণী মাত্র এক ঘটনার মধ্যে রেখে হাওয়া হয়ে গেলো, ফলে প্রেশারে পড়ে যাওয়া মন্ত্রী/আমলারা এই ঘটনা কাউকে শেয়ার করলো না শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত পরামর্শদাতার কানে কানে বলল, ‘কাউকে কিচ্ছু বোলো না; একজন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট এসে বলেছে আমার নাকি সময় শেষ!’ ফলে সেই পরামর্শদাতা ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ থেমে বলল, ‘দাড়াও ভেবে নি, বিষয়টা ভাবনাচিন্তার!’ আর ভাবনার সেই ফাঁকে সেই পরামর্শদাতা তার পরামর্শদাতার কাছে কানে কানে বলল, ‘কাউকে বলবেন না, উনাকে জানানো হয়েছে উনার নাকি সময় শেষ!’ ফলে তিনি বললেন, ‘বল কি ডেঞ্জারাস ব্যাপার তো, দাড়াও একটু ভেবে নি’, ফলে ভাবনার বিরতির নিয়ে তিনি তার পরামর্শদাতার কাছে কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘটনাটা তো খারাপ, সোর্স নিজে এসে বলে গেছে সময় হাতে বেশি নেই খতম!’, ফলে তিনিও বলেন, ‘সর্বনাশ দাড়াও একটু ভেবে নি’, এরকমভাবে ভাবতে ভাবতে ঘটনার গুমর ফাঁস হয়ে গেলো মোড়ে মোড়ে, ফলে আমরা সকলেই সব জানি কিন্তু কেউ কিচ্ছু জানি না এমন মুখ করে ঘুরে বেড়াই আর তখন ব্যাপারটা এরকম এক গল্পের আকার নেয় যে, স্বয়ং মৃত্যুদূত এসে নাকি হুমকি দিয়ে গেছে মন্ত্রঈ/আমলাদের, কেউ কেউ বলল, ‘উঁহু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এজেন্ট এসে আগাম খবর দিয়ে গেছে’, কেউ কেউ বলল, ‘পারমাণবিক শক্তিতে সবচে বলিয়ান রাষ্ট্রের লোক এসে নাড়া দিয়ে গেছে’, আবার কেউ বলল, ‘কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা নেবার জন্য পাঠানো হয়েছিলো’, কিন্তু সকলের মাথায় ঢুকে যায় যে, এই মন্ত্রী/আমলাদেরদের সময় শেষ, এরা হয় খুন হবে নইলে বাদ পড়বে ক্ষমতার আসন থেকে, আর তাই নেতারা এই প্রথম নিজেদের পকেট থেকে চাঁদা দিয়ে মিলাদ কিংবা যজ্ঞ করতে লাগলো, যেন বালামুছিবদ দূর হয়ে যায়, ফলে এই সময়ে সারা দেশে সাতদিন কোন চাঁদাবাজি, ক্ষমতার দম্ভের কারণে গেঞ্জাম কিংবা কালোটাকার লেনদেন হল না, কিন্তু মানুষ যেহেতু জ্ঞান হবার পর থেকে জানে সে একদিন মরে যাবে আর এটা জেনেই সে সজ্ঞানে অমর হবার জন্য লুটপাট শুরু করে, সেই সূত্র অনুযায়ী সাতদিন বেকার থাকার পর জমেওঠা ধুলোর আড়ালে আবার নেতা মন্ত্রী আমলাদের লোভী জিহ্বা লকলক করে ওঠে ফলে ক্রমে ধীর থেকে মাঝারি এবং তারপর ভারি আকারেই পুনরায় শুরু হয় চাঁদাবাজি দখলবাজি আর লুটপাট, ফলে আবার আগের অবস্থা ফিরে আসে এক সপ্তাহের মধ্যে, এবং এর মধ্যে একদিন বাজার গুলোতে দৈনন্দিন পণ্য কেনাকাটা বেড়ে যায় আর তারপর যেদিন সাপ্তাহিক ছুটি সেদিনের পরের দিন থেকে দেখা যায় সারাদেশের অফিস আদালত ব্যাংক বীমা বাস ট্রেনে কোন মানুষ নেই, কোন কর্মচারী নেই, সবাই বাসায় বসে আছে খাচ্ছেদাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে, শুধুমাত্র রাস্তায় আর অফিস গেটে এসে দাঁড়ানো দেখা গেলো মন্ত্রী নেতা আমলা আর ষড়যন্ত্রকারীদের, তারা অফিসেও ঢুকতে পারছিল না কেনোনা গেটকিপার অফিসে আসে নি, ফলে পুরো সিস্টেম জমে গেলো, স্থানীয় নেতারা প্রত্যেকে তাদের পাড়া মহল্লার অলিগলিতে গিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে জানতে চাইলো কই তারা কিন্তু কেউ দরজা খুলল না, ফলে তারা সবাই ভয় পেয়ে গেলো, এবং তাদের মনে পড়ে গেলো গত সপ্তাহে মন্ত্রী/আমলাদের কাছে আসা সুদর্শন যুবক/যুবতীদের দিয়ে যাওয়া হুমকির কথা, তবে কি এটা তারই নমুনা, কোন মুসিবত নামতে যাচ্ছে এই জমিনে, ফলে একরকম অনাথের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো সেইসব নষ্ট লোভী মানুষেরা, আর তারা জানলো এইরকম অবস্থায় তাদের দলপ্রধান তাদেরকে ফেলে বিদেশে উড়ে গেছেন মানসিক চিকিৎসার জন্য, ফলে তারা ক্রমশ গুটিয়ে আসতে লাগলো, কেনোনা তারা ক্ষমতা দেখানোর কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিল না, ফলে তারা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো, আর কেউ কেউ টাকা থাকা স্বত্বেও খাবারের সংকটে পড়ে গেলো, এরকম একসপ্তাহ কেটে যাবার পর এক সকালে আবার সারাদেশে মানুষের কোলাহল শোনা গেলো, মানুষেরা সেদিন আবার পথে নামলো, ফলে নেতা মন্ত্রী আমলা আর ষড়যন্ত্রকারীরা নেমে এলো মেজাজ নিয়ে যে; তাদের ডাক উপেক্ষা করে এইসব সাধারণ সস্তা মানুষেরা দরজা দিয়ে ঘরে বসে ছিল কোন সাহসে, ফলে সেইদিন শুরু হল এক অদ্ভুত ঘটনা জনগণ যখন তাদের মুখোমুখি হল তারা তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো কিংবা তাড়া করলো, ফলে তারা প্রথম প্রথম বুঝতে পারলো না যে তাদের মতো ক্ষমতাবানদের সঙ্গে এটা কোন ধরণের বেয়াদবি, ফলে দুই তিনটে ধাক্কা বা চড় খাবার পর তারা টের পেলো কাহিনী অন্য লাইনে চলে গেছে, ফলে মন্ত্রী নেতা পাতিনেতা আমলা ষড়যন্ত্রকারীরা পালাতে লাগলো আর জনগন তাদেরকে ধাওয়া করে নিয়ে যেতে লাগলো, ফলে বুদ্ধিমান ষড়যন্ত্রকারীরা জনগণের হাত পা ধরতে লাগলো আর তখন জনগন তাদেরকে লাথি মারতে শুরু করলো যেন ফুটবল খেলা শুরু হয়ে গেলো তাদেরকে নিয়ে, আর ঠিক যেমন একঘণ্টার মধ্যে দশজন জুবক যুবতী একটা বাক্য দশজন নষ্ট হিংস্র মানুষের কানে পৌঁছে দিয়েছিলো ঠিক তেমন একঘণ্টার মধ্যে সারা দেশের নষ্ট আর লোভী মানুষদের তারা সাফ করে ফেললো,

১৮ এপ্রিল ২০১৭
romelabc@gmail.com

Be the first to comment

আপনার মতামত...