শতাব্দী দাশ
তিন তালাক সংক্রান্ত বিল লোকসভায় পাশ হয়ে গেল সদ্য৷ কিছুদিন আগেই দীপক মিশ্রর বেঞ্চ ৩৭৭ ধারার প্রয়োজনীয় বদল ঘটিয়ে সমকামকে ‘অপরাধ’-এর আওতামুক্ত করেছে। ঔপনিবেশিক ৪৯৭ ধারায় (‘পরকীয়া-সংক্রান্ত আইন’ বলে যা বেশি পরিচিত) স্ত্রীর শরীরের উপর স্বামীর যে একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাও পুনর্বিবেচিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। লিঙ্গ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষজন কি ২০১৮ সালের শেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তবে? এ কি উদযাপনের উপযুক্ত সময় নয়?
পাঠক যখন এই নিবন্ধ পাঠ করছেন, তখন ২০১৯-এর উঠোনে তিনি পা রেখেছেন গুটিগুটি। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন বড় দূরবর্তী নয়। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ‘সেমিফাইনালে’ বর্ষশেষে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে শাসকদল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিলেন সে দেশের লিঙ্গ-রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কর্মীরা। আমাদের দেশে লিঙ্গ-রাজনীতির ততটা সুসংগঠিত ও সর্বব্যাপী হতে এখনও দেরি আছে। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনের আগে লিঙ্গরাজনীতি কর্মী তথা এই রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন মানুষ কীভাবে বর্তমান সরকারের মূল্যায়ন করবেন? কোন দিকে ঝুঁকবেন তাঁরা এবং কিসের আশায়? এসব স্থির করার প্রয়োজনেই আমরা বিগত বছরে চোখ বোলাব।
বেটি বচাও, বেটি পড়াও :
চলতি বছরেই আমাদের হাতে এসেছে চাঞ্চল্যকর একটি রিপোর্ট। Comptroller And Auditor General (C&AG) নামের এক সংস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ নামক সম্ভাবনাময় প্রকল্পের কর্মসূচি ও ফলাফল খতিয়ে দেখে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। লিঙ্গ-রাজনীতি কর্মীরা যে এর চেয়ে খুব ভাল কিছু প্রত্যাশা করেছিলেন তা নয়, কিন্তু চোখের উপর থাকা পরিসংখ্যানগুলি যেন আশার শেষ পর্দাটুকুও সরিয়ে দিল। ‘সিএজি রিপোর্ট’ নামে খ্যাত এই প্রতিবেদনে যার-পর-নাই সমালোচনা করা হয়েছে ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর। ‘কুইন্ট’ সহ অন্যান্য ম্যাগাজিনে তেমনই প্রকাশ। অথচ অমিত-সম্ভাবনাময় এক প্রকল্প হতে পারত এটি।
নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন ২০১৫ সালের ২২শে জানুয়ারি, আন্তর্জাতিক শিশুকন্যা দিবসে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল লিঙ্গবৈষম্যের দিক থেকে প্রথম সারিতে থাকা যে রাজ্যগুলিতে লিঙ্গ-অনুপাত ক্রমশ সঙ্কটজনক অবস্থায় পৌঁছচ্ছে, সেখানে নানা জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে কন্যা-শিশুর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা। গর্ভকালীন লিঙ্গ-নির্ধারণ আটকানো, লিঙ্গ-ভিত্তিক ভ্রূণ নির্বাচন আটকানো, শিশুকন্যাকে সযত্নে ভূমিষ্ঠ হতে দেওয়া, তার শিক্ষায় উৎসাহ-প্রদান। প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়৷ পাখির চোখ ধরা হয় উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, বিহার, দিল্লির মতো রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে। ভারতে ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে পুরুষ : নারী লিঙ্গানুপাত ছিল ১০০০ : ৯২৭। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১০০০ : ৯১৮তে। এই সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ যোজনা আশার আলো দেখিয়েছিল নিঃসন্দেহে। প্রধানমন্ত্রী ২২শে জানুয়ারির শুভদিনে শুধু ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’-এর আভাস দিলেন না, নিজের উচ্চাসন থেকে নেমে এসে দেশবাসীর কাছেও সুপরামর্শ চাইলেন। Mygov.in পোর্টালের মাধ্যমে দেশবাসীও নাকি জানাতে পারবেন, কীভাবে অবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়৷ এর চেয়ে তৎপর অথচ বিনয়াবনত ভঙ্গিমা আর কী বা হতে পারত? আমরা আশায় বুক বাঁধলাম। ‘সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা’-ও চালু হল দেশের সব পোস্ট-অফিসে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, মেয়ের নামে সঞ্চয় করতে পারবেন বাবা-মা। ৯.২% হারে চড়া সুদ মিলবে।
কিন্তু চলতি বছরে, সমাজকর্মী বিহার দার্ভে উদ্যোগ নিয়ে ‘রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে যে সব নথি পেলেন এবং প্রকাশ করলেন ‘সিএজি’ রিপোর্টে, তাতে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় শিশু ও নারী কল্যাণ মন্ত্রক ২০%-এর বেশি বরাদ্দ টাকা উল্লিখিত রাজ্যগুলিতে পাঠাতেই পারেনি। যেটুকু টাকা পাঠানো হয়েছে খেপে খেপে, তা-ও হয়েছে আগের বছরের কাজের খতিয়ান না দেখে। প্রাথমিক বরাদ্দ ১০০ কোটি হলেও, ২০১৬-১৭ সালেই কেন্দ্র থেকে ১৯৯৯৯ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় ১০০টি বাছাই করা জেলার জন্য, যার মধ্যে মাত্র ৫৪৮৯ লক্ষ টাকা বিভিন্ন রাজ্যে বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পাঠানো গেছে। তার মধ্যে আবার মাত্র ১৮৬৫ লক্ষ টাকা খরচ করা গেছে বলে খবর৷ কী খাতে সেটুকুও খরচ হল, তা জানার জন্য কোনও নথি তলব করেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। ফলে উক্ত অর্থের অনেকখানিই ব্যয় হয়েছে বিজ্ঞাপনে আর ঢক্কানিনাদে। সে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও ভাষ্যও অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক। যেমন টুইটারে কিছুকাল আগে বহুল সমালোচিত হয়েছে এক বিজ্ঞাপনী দেওয়াল-লিখন, যা আসলে এই প্রকল্পেরই জয়গান গাইতে চেয়েছিল। ‘জন্মাতেই যদি না দাও মেয়েকে, তবে কার হাতের রুটি খাবে?’— এই ছিল সেই দেওয়াল-লিখনের ভাষা। ‘বেটি’ ও ‘রোটি’-র ‘অবশ্যম্ভাবী’ অন্ত্যমিল সচেতন দেশবাসীকে হতচকিত করেছিল। বোঝা গেছিল, কন্যা-শিশুর বেঁচে থাকা ও শিক্ষার অধিকার নিয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি যাদের হাত ধরে বাস্তবায়িত হবে, তাদের নিজেদেরই সচেতনতা প্রশ্নাতীত নয়।
অলিম্পিক মেডেলিস্ট সাক্ষী মল্লিককে এই প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানিয়ে মহৎ কোনও উদ্দেশ্য যে সাধিত হয়নি, তা বোঝা যায়, যখন দেখা যায় প্রতি জেলায় যে পাঁচ লক্ষ টাকা অনুদান পৌঁছেছিল, হরিয়ানার পানিপথ জেলায় তার মধ্যে তিন লক্ষ টাকা শুধু ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর থিম গেট বানাতে ব্যয় হয়েছে! যে ১৮০০ ল্যাপটপ ব্যাগ ও ২৯০০ মাগ কেনা হল নারী-শিশু কল্যাণ মন্ত্রক-এর তত্ত্বাবধানে এই স্কিমের টাকায়, তা ঠিক কীভাবে ‘বেটি’-দের সাহায্যে লাগল, তাও জানা নেই।
অডিটে দেখা যাচ্ছে, ‘বেটি বচাও..’-এর টাকা সব থেকে কম ব্যবহৃত হয়েছে লাল কালিতে মোটা দাগে চিহ্নিত সেই বিপদসঙ্কুল রাজ্যগুলিতেই– হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তরাখণ্ডে। ‘নিধি আয়োগ’-এর সমীক্ষা দেখাচ্ছে ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর পরে সেক্স রেশিও-র খুব একটা উন্নতি হয়নি এইসব জায়গায়। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’ দেখাচ্ছে, এই রাজ্যগুলিতে শিশুর প্রতি অপরাধ-অত্যাচারও কমেনি। নারীশিক্ষার হার বেড়েছে, তবে খুব সামান্য, গড়ে ১% মতো৷ হাতে রইল ‘সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা’৷ সেখানে সুদের হার পড়েছে, ৯.২% থেকে ৮.৫%-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে এই আর্থিক বছরে। তবে এটি এখনও সরকারি ব্যাঙ্ক বা পোস্ট-অফিসে সর্বাধিক সঞ্চয়ী প্রকল্প।
অর্থাৎ, নারী-উন্নয়নের বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সরকার হয়ত খানিক সদিচ্ছায় মাথা ঘামাতে চেয়েছিলেন, খানিক হয়ত ভোটের তাস হিসেবে খেলতে চেয়েছিলেন এটি নিয়ে। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই পারদর্শিতার পরিচয় দেননি৷ বিজ্ঞাপনী অসারতা আর ‘সেল্ফি উইথ ডটার’ ধরনের কিছু প্রচারমূলক দৃষ্টিসুখকর উদ্যোগের বাইরে সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের চেষ্টায় সত্যি কোথাও ঘাটতি ছিল। তাই ২০১৬ সালে যখন আরও ৬১ জেলাকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হল, আরও ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ হল, তখন আগের খরচের স্বচ্ছ হিসেবও চাওয়া হল না, কীভাবে ভবিষ্যতে এ টাকা খরচ হবে, আগের খেপের অব্যবহৃত টাকারই বা কী হবে, তার কোনও পরিকল্পনাও হল না। সঠিক দিশার অভাবে অনিশ্চয়তার পাথরে পাথরে গোঁত্তা খেতে লাগল বহুল-প্রচারিত একটি জাতীয় প্রকল্প।
হরিয়ানার মতো সঙ্কটাপন্ন লিঙ্গানুপাতের রাজ্যে কোনও অনলাইন পোর্টালের ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত করা যায়নি, যার মাধ্যমে সরাসরি লিঙ্গনির্ধারণ ও গর্ভপাতের ব্যাপারে অভিযোগ জানানো যায় সত্বর, যদিও এমন পোর্টাল তৈরির আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে বহুদিন যাবৎ। ২০১৪-১৬র মধ্যে নাকি হরিয়ানায় মাত্র সাতটি লিঙ্গনির্ধারণের অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সংখ্যাটি হাস্যকর রকমের অবাস্তব। বিদ্যালয় স্তরেও যে টাকা পৌঁছনোর কথা ছিল, পৌঁছেছে তার যৎসামান্যই। ছাত্রী-ড্রপ-আউট শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা এখনও অনেক দূরবর্তী।
লিঙ্গ–সাম্যের তাস :
তাই যখন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযোগ শোনা যায়, জেনেভায় প্রকাশিত জাতিসংঘের ‘ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ’ নামক প্রতিবেদনে সমালোচিত হয় ভারতের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার পাশাপাশি নারী নির্যাতন, লিঙ্গবৈষম্য ও কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, তখন তা প্রত্যাশিত হিসেবেই মেনে নিতে হয়।
অথচ, গত ২০ জুলাই যখন কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম ‘অনাস্থা’ মোশনের মোকাবিলা করল লোকসভায়, তখন নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের তথাকথিত ভূমিকার কথা বারবার তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করল সরকারপক্ষ। জব্বলপুরের বিজেপি সাংসদ রাকেশ শর্মা বললেন, ভারতের ‘মা-বোনেরা’ ‘উজ্জ্বলা যোজনা’ ও ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযানে’ উপকৃত হয়েছেন। ‘উজ্জ্বলা যোজনা’ গরীব সংসারে এলপিজি গ্যাস সরবরাহ করে, মধ্যবিত্তের গ্যাস ভর্তুকি তুলে নেওয়ার বিনিময়ে। তা যে শুধুমাত্র মহিলাদেরই উপকারে লাগে, তা ঘোষণা করে এমপি একরকমভাবে সংসারে মহিলাদের অবৈতনিক রাঁধুনির ভূমিকা নিশ্চিত করলেন৷ ‘স্বচ্ছ ভারত’ ছিল মূলত শৌচাগার নির্মাণ প্রকল্প, যা পূর্ববর্তী সরকারের ‘নির্মল ভারত অভিযানের’-ই সম্প্রসারণ৷ স্বাস্থ্য-সচেতনতার প্রাথমিক চাহিদাটুকুও আমাদের দেশে নারী-কল্যাণের নামে, দাক্ষিণ্য হিসেবে বর্ষিত হচ্ছে একবিংশ শতকে। প্রতি বাড়িতে শৌচাগার যেন লিঙ্গ-নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য একটি সামাজিক দাবি নয়, যেন নারীর লজ্জা নিবারণ ছাড়া শৌচাগারের আর কোনও ভূমিকা নেই৷
মাননীয় সাংসদ অবশ্য আরও বলেন, মধ্যপ্রদেশের রাজ্য সরকার অ-প্রাপ্তবয়স্কদের ধর্ষণের সাজা হিসেবে ফাঁসি ধার্য করেও নজির গড়েছে। কিন্তু কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করে যে ধর্ষণ রোখা যায় না, তার জন্য যে আরও বেশি প্রয়োজন সচেতনতা প্রসার ও লিঙ্গ-সাম্য-শিক্ষা, তা ভুরি ভুরি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা যায়।
জাতীয় কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগহণ, মহিলা–সংরক্ষণ বিল ও কর্মক্ষেত্রে ভারতীয় নারী :
মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বর্তমান সরকার কিন্তু পার্লামেন্টে ৩৩% মহিলা-আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নেয়নি, যদিও বিরোধী হিসেবে তাদের অন্যতম অ্যাজেন্ডা ছিল এই প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করা। ভারত বর্তমানে পার্লামেন্টে-নারী-অংশগ্রহণের নিরিখে ১৮৮টি দেশের মধ্যে আছে ১৪৭তম স্থানে৷ এই অবস্থার উন্নতি ঘটানোর কোনও চেষ্টা বা উদ্যোগ আগের সরকারের মতো এই সরকারেরও নেই। বর্তমানে উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষেই বারো শতাংশ মতো মহিলা আছেন বড়জোর৷ সেই মহিলারা মহিলাদের স্বার্থ দেখার থেকে দলের স্বার্থ নিয়েই বেশি ভাবিত নিঃসন্দেহে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, একবিংশ শতকে অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি প্রগতিশীল দেশে নারীদের যে অংশগ্রহণ থাকা বাঞ্ছনীয়, তা থেকে ভারতবর্ষ অনেক মাইল পিছিয়ে আছে।
আবার বিবিধ কর্মক্ষেত্রর দিকেই যদি চোখ রাখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীর সংখ্যা হতাশাজনকভাবে কম। ২০১৫-১৬ সালে ২৪% কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত ছিলেন, অথচ ২০০৫-০৬ সালে এই হার ছিল ৩৬.৩% মতো। সম কাজে সম বেতনের লক্ষ্য এখনও অধরা।
২০১৭ সালেই দেশ জুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন স্টাডিজ, জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগগুলি নানা অজুহাতে তুলে দেওয়ার তৎপরতা দেখিয়েছিল কেন্দ্রপোষিত ইউজিসি। সে ধারা এ’বছরও অব্যাহত। উপরন্তু, নারী-শিশু কল্যাণ মন্ত্রক-এর বাজেটও সংকোচন করা হয়েছে।
যে আইসিডিএস বা অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে মহিলাদের কর্মসংস্থান হত, শিশু পেত খাদ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা, ১০৯ বিলিয়ন টাকা বাকি পড়ে আছে সেখানেও। যে নির্ভয়া ফান্ড থেকে প্রতি ধর্ষিতার জন্য ক্ষতিপূরণের টাকা আসার কথা, তারও দশা অতি করুণ।
এই ভারতের ‘বেটি’রা– স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা :
নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার প্রশ্নেও তেমন অগ্রগতি হল কই? এই রাষ্ট্র নারীকে তার প্রথাগত ভূমিকার বাইরে অন্য ভূমিকায় মেনে নিতে নারাজ৷ তাই ধর্ষণ ও অসবর্ণ বিবাহ, দুটিই এক সঙ্গে আটকানোর জন্য মধ্যপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক আশ্চর্য নিদান দেন– ‘সাত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দেওয়া হোক’। বালিকা অবস্থাতে বিয়ে দিলেই নাকি যেকোনও বেচাল হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ইউনেস্কো-ইউএন-এর নিরন্তর লড়াই-এর মধ্যে এরকম মন্তব্য আমাদের বিমূঢ় করে। মেয়ের সুরক্ষার দায়িত্ব যে তার পরিবারের নয়, রাষ্ট্রের– এই সামান্য সত্যটুকুও স্বীকৃত না হলে ‘বেটি বচাও…’-এর গোড়ায় গলদ ধরে নিতে হয়।
নারী-সুরক্ষা নিয়েই যখন আলোচনা, তখন কাঠুয়ার ধর্ষণের উল্লেখ করতেই হয়৷ মুসলমান হওয়ার অপরাধে একাধিকবার গণধর্ষিত হয়েছিল আট বছরের বালিকা, মন্দিরের অন্ধকার গর্ভগৃহে। তারপর বাগ্মী দেশাধিনায়কের দীর্ঘ মৌনতাও নিশ্চয় আমাদের স্মরণে আছে। হিন্দু উকিলদের সংগঠন তো বকরাওয়ালদের মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যার কেসও দায়ের করতে দেয়নি প্রাথমিকভাবে জম্মুর আদালতে। নানা কাঠ-খড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আটজনকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে মামলা দায়ের করা গেছে। উত্তরপ্রদেশের উন্নাও-এ শাসক দলের লোকই জড়িত ছিল এক কিশোরীর ধর্ষণে ও তার পিতার নির্যাতনে। ধর্ষিতার পিতাকে শেষে পুলিশ কাস্টডিতে মৃত পাওয়া গেছিল। বড় দেরি হয়েছিল সরকারের টনক নড়তে সে’ক্ষেত্রেও। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের দেশব্যাপী সমালোচনা শুরু হওয়ার আগে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ সতেরো সালের শেষদিকে তৎপরতার সঙ্গে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির মেয়েদের লাঠিপেটা করেছিল সরকারি পুলিশ, ক্যাম্পাসে যৌন হেনস্থার ন্যায্য প্রতিবাদ করায়।
ভারতবর্ষের ‘বেটি’ কি তবে শুধু উচ্চবর্ণীয়, হিন্দু বালিকা বা কিশোরী? মুসলমান বা দলিত মেয়েদের কি ‘বেটি বচাও’-এর আওতায় ধরা হচ্ছে আদৌ? সেই উচ্চবর্ণীয় হিন্দু বালিকা বা কিশোরীই বা কত দূর সুরক্ষিত, কত দিন সুরক্ষিত? যতদিন সে নতমুখ হয়ে পিতৃতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের আজ্ঞা বহন করবে, তত দিন?
সেই বিখ্যাত অনাস্থা মোশনের পরদিনই চন্ডীগড়ের গণধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম, যেখানে একুশ বছরের মেয়েকে চারদিন ধরে পঞ্চাশজন মিলে ধর্ষণ করেছে। এগারো বছরের মেয়ে গণধর্ষিত হয়েছে চেন্নাইতে, প্রায় একই সময়ে। নারী শুধু ধর্ষিতা হচ্ছে না, ধর্ষণের পরে যে ধরনের সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেছিল পুলিশের কাছে, আইনের কাছে, বিশেষত নির্ভয়া কাণ্ডের পর, ভার্মা কমিশনের রিপোর্টের পর– তা পূর্ণ হয়নি৷
টমাস রিউটারস ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ভারত নাকি পৃথিবীর মধ্যে নারীর জন্য সবচেয়ে অসুরক্ষিত দেশ। অবশ্য কখনওই এই বিষয়ে ভারত স্বর্গভূমি ছিল না। তবে ২০১১ সালে অন্তত পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও কঙ্গোর পরে, চতুর্থ স্থানটি ছিল ভারতের।
‘গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী ভারতে রক্তাল্পতায় ভোগা মহিলার সংখ্যা সর্বাধিক, যা অপুষ্টি ও বারংবার সন্তানধারণের ফল বলে আশঙ্কা। ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ বলছে, দলিত মহিলারা স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও কম পান, আরও অল্প বয়সে মারা যান তাঁরা৷ রাষ্ট্রের অভিভাবকোচিত হাত তাদের মাথায় করুণাস্পর্শ ঝরায় না।
প্রধানমন্ত্রীর নিজের বা তাঁর দলের বিভিন্ন বিশিষ্টজনের নানা অসংবেদী, নারীবিদ্বেষী মন্তব্যও হামেশাই কানে আসে, চোখে পড়ে৷ সুনন্দা পুষ্করকে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ‘পঞ্চাশ কোটির গার্লফ্রেন্ড’ বলেছিলেন একটি জন-অধিবেশনে৷ নারীর অবস্থান যে গৃহে, আরও স্পষ্ট করে বললে রান্নাঘরে, তা বাগ্মী প্রধানমন্ত্রীর প্রায় প্রতিটি বক্তৃতার প্রতিপাদ্য৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ‘মহিলা হওয়া সত্ত্বেও’ সন্ত্রাসবাদীদের রেয়াত করেন না, এরকম মন্তব্য প্রায়শই শোনা যায় তাঁর মূল্যবান ভাষণে। তাঁর দলের বিশিষ্ট নেতা দয়াশঙ্কর সিং মায়াবতীকে ‘বেশ্যা’ বলেছেন নিঃসঙ্কোচে। প্রকাশ্যে বাল্যবিবাহ সমর্থন করা, ধর্ষকদের জন্য মিছিলে হাঁটা, স্বেচ্ছায় অসবর্ণ-বিবাহ করলেও খাপ-সুলভ ক্রোধ প্রদর্শন– এসব নজির তো প্রায়শই রেখে থাকেন সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বিশিষ্টজন।
প্রসঙ্গ যখন শবরীমালা :
লিঙ্গ রাজনীতি ও বর্তমান সরকার সংক্রান্ত আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়বে কেরলের আয়াপ্পা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার ঘিরে বিতর্ক৷ দীর্ঘ সাতাশ বছর পরে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সী মহিলাদের জন্য সেই মন্দিরের প্রবেশদ্বার খুলেছিল। অথচ কার্যক্ষেত্রে মহিলারা ঢুকতে পারেননি অনেক চেষ্টাতেও। ২৮শে সেপ্টেম্বর দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের ঐতিহাসিক রায়ের পর একে একে আসতে থাকে মারধোর-খুন-ধর্ষণের হুমকি। এনডিএর সমাবেশে একের পর এক নেতা প্রকাশ্যে বলেন, শবরীমালা মন্দিরে যেসব মহিলা যাবেন তাদের কেটে দু’টুকরো করে ফেলা হোক, তাদের পুরুষেরা ও বাঘেরা ছিঁড়ে খাক, তাদের ঔদ্ধত্যেই কেরলে নাকি বন্যা হয়েছে৷ আয়াপ্পার মন্দিরে ঢোকার আগে নিজেকে ‘শুদ্ধ’ করার জন্য যে একচল্লিশ দিন ব্যাপী ব্রত পালন করতে হয়, তা ঋতুমতী নারীদের পক্ষে করা অসম্ভব, কারণ প্রতি আটাশ ঊনত্রিশ দিন অন্তর তার শরীর ‘অপবিত্র’ হয়– এই ছিল আয়াপ্পার ভক্তদের যুক্তিবিন্যাস। শবরীমালার ভক্তদের অন্ধত্ব ও অযৌক্তিক জেদের সামনে একটি গণতান্ত্রিক দেশে থমকে গেল সুপ্রিম কোর্টের রায়ও।
ধর্ম ও পিতৃতন্ত্রের যৌথ মস্তিষ্ক প্রক্ষালন এতই সুচারু যে শবরীমালার মন্দির কর্তৃপক্ষের সমর্থনে হাজার হাজার মহিলাও গলা ফাটালেন। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছিলেন, শবরীমালায় ঢোকার পথে মহিলা ভক্তদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আশ্বাস ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
একটি হিন্দুত্ববাদী দল হিসেবে হিন্দু নারী-ভক্তদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতিও তো সদয় হতে পারত শাসকদল! তাদেরও সম্ভাব্য ভোটার গণনা করতে পারত। সুপ্রিম কোর্টের রায় মান্য করার প্রাথমিক নীতিটুকুর কথা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু শবরীমালা প্রসঙ্গে বরং শাসক দলের জাতীয় ও স্থানীয় নেতৃত্বের সংঘাত দেখা গেল৷ স্থানীয় নেতৃত্ব সহজে হিন্দু ভক্তদের সমর্থন কুড়োতে আদালত-বিরোধী নানা কর্মকাণ্ডে ইন্ধন জোগাল। শবরীমালাকে এইভাবে ‘দক্ষিণের অযোধ্যা’ হিসেবে গড়ে তুলে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা কিন্তু নজর এড়ায়নি বাকি দেশের মানুষের।
এলজিবিটিকিউ আন্দোলন ও বর্তমান সরকার :
এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষও যে বড় তৃপ্ত এই সরকারকে নিয়ে, তা বলা যায় না। জাস্টিস দীপক মিশ্রর বেঞ্চ ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অমানবিক ৩৭৭ ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে যখন সমকামকে ‘অপরাধ’-এর আওতামুক্ত করল, তখন সরকারপক্ষ ছিল নিশ্চুপ। বিজেপি ও তার আদর্শগত খুঁটি আরএসএস যে সমকামকে ঘৃণ্য, বিদেশি আমদানি মনে করে-তা সর্বজনবিদিত, সুতরাং মৌনতা ছাড়া এক্ষেত্রে গত্যন্তর ছিল না৷ কিন্তু আদতে সমকাম নয়, সমকাম-ভীতি হল একটি ভিক্টোরীয় আমদানি, যা নিজের দেশের সংস্কৃতিকে ভালোভাবে চিনলে তাঁরা সহজেই বুঝতেন। ভোটের রাজনীতির কথাও যদি ধরা হয়, তাহলেও ভেবে অবাক হতে হয় যে কেন ভারতের ২৫ লক্ষ সমকামী জনতাকে ভোটের স্বার্থেও মর্যাদাসম্পন্ন অস্তিত্বের অধিকার দেওয়ার ব্যাপারে উক্ত দলের এত অনীহা? আবার গত ডিসেম্বর মাসেই ‘ট্রান্সজেন্ডার বিল’ নিয়ে নতুন শোরগোল শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত বিলে হিজড়া সম্প্রদায়ের রুজিরুটিতে হাত পড়তে চলেছে, অথচ পুনর্বাসন বা বিকল্প পেশা সংস্থানের কোনও দায়িত্ব নিতে নারাজ সরকার।
বহু–আলোচিত ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ রদ ও হিন্দু পৌরুষের ‘ত্রাতা সিন্ড্রোম‘ :
যে যুগান্তকারী পদক্ষেপের উল্লেখ করে লেখা শুরু করেছিলাম, এবার আসি সেই প্রসঙ্গে৷ ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ বা ‘তালাক-এ-বিদ্দত’ রদ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের একটি ৩৯৫ পাতার রায় এই অমানবিক বৈষম্যমূলক বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পাঁচ বিচারকের বেঞ্চের তিনজন ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’-এর বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন। বাকি দুজন? চিফ জাস্টিস খেহার (জাস্টিস আব্দুল নাজির সমর্থন করেন) ঠিক ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’-এর পক্ষে না, ছিলেন সংবিধানের ২৫ নং ধারার পক্ষে, যেখানে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ করতে বা ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে পারবে যেকোনও ভারতীয়। অন্যদিকে জাস্টিস জোসেফ বললেন, ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ বিষয়টাই আদৌ ধর্মে নেই, ‘কোরাণে’ নেই। তাই তা ‘ধর্মাচরণ’ হবে কেন? অনেক দিন থেকে প্রচলিত বলেই একে ‘ধর্মের অঙ্গ’ ধরে নেওয়া যায় না। আদালত তা রদ করতেই পারে। জাস্টিস নরিম্যান (সমর্থন করেছেন জাস্টিস ললিত) ‘অসাংবিধানিক’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কারণ সেই একই ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারায় জাতি-ধর্ম-ভাষা-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকারের কথা বলা আছে। পুরুষ একা তাহলে হঠাৎ-খেয়ালে মুখের উপর কিংবা চিঠিতে, হোয়াটস্যাপে, ইমেইলে ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে সম্পর্ক শেষ করে কীভাবে?
সত্যি অভিনন্দনযোগ্য রায়। সম্প্রতি লোকসভায় বিল পাশ হওয়ার ঘটনাও প্রশংসনীয়। দেশের আইনমন্ত্রী লোকসভায় বললেন, কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করা নয়, নারীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই সরকারের লক্ষ্য।
‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ নিয়ে মুসলিম নারীদের অসন্তোষ বহুদিনের। ১৯৮৫ সালে শাহবানো-কেসে সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু শাহবানোর পক্ষেই রায় দিয়েছিল। তাঁর প্রাক্তন স্বামী তাঁকে তিন তালাকের পর খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকবেন, সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল। কিন্তু রাজীব গান্ধী সরকার সেই রায় মান্য করার বেলায় পিছিয়ে গেছিল মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে। বিল পাশ হয়নি সে যাত্রায়। এ’ক্ষেত্রে, সুতরাং,বর্তমান সরকারের নির্ভীক ভূমিকা অস্বীকার করে লাভ নেই। সুপ্রিমকোর্ট ও লোকসভা-উভয় জায়গায় শাসকদল ছিল অনমনীয়। নারী-অধিকারের প্রতিটি প্রশ্নে এই অনমনীয় জেদ দেখতে পেলে অবশ্যই শাসকদলের প্রতি নিঃশর্ত আস্থা সমর্পণ করতে পারতেন লিঙ্গ-রাজনীতি-সচেতন মানুষ।
কিন্তু যেহেতু শাসকদলের হিন্দুত্ববাদী নীতি ঘোষিত ও সর্বজনবিদিত, তাই প্রশ্ন উঠছে, বিবাহ-আইনে সংস্কার করলেই যেখানে কার্যসিদ্ধি হতে পারত, সেখানে ফৌজদারি চোখ-রাঙানি কেন? তাৎক্ষণিক তিন তালাক যদি দেওয়াই না যায়, তবে ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাকের জন্য তিন বছরের কারাদণ্ড’– এর কী যুক্তি? কারাবাসী হলে স্বামী কীভাবে খোরপোষ দেবেন, তাও স্পষ্ট নয়। এতদসত্ত্বেও, মুসলিম নারীকুল এই বিল পাশে মোটের উপর উপকৃতই হবেন৷ ‘নিকাহ হালালা’ নামক অমানবিক প্রথাটি নিয়েও শুনানি হবে, এই আশায় দিন গুনছেন অনেক মুসলমান মহিলা।
এরপরেও বলার থাকে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক, তালাক না দিয়ে জোর করে বিয়েতে আটকে রাখা, তালাকের ভয় দেখিয়ে অত্যাচার— এসবই গৃহহিংসা। গৃহহিংসা উভয় সম্প্রদায়েই পূর্ণোদ্যমে ঘটে। পণের জন্য, পড়াশুনো চালানোর অপরাধে, ঠিকমতো গৃহকর্ম না করতে পারার অপরাধে বা দাম্পত্য বিছানায় ‘না’ বলার অপরাধে যাঁরা শরীরে এবং মনে রোজ আঘাত পান পরিবারের মধ্যেই, তাঁরাও অনেকেই হিন্দু। সমস্যা, সুতরাং, গভীরতর ও মূলগত। সমস্যাকে আমরা ‘পিতৃতন্ত্র’ নামে ডাকি। হিন্দু পৌরুষের রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোমের আঁচ পুইয়ে সেই সমস্যার গভীরতা মাপা সম্ভব নয়৷
***
এইসব পাওয়া-না পাওয়ার মধ্য নিয়ে বর্তমানের সরকারের সঙ্গে আরও একটি বছর ঘর করা গেল। মনে রাখতে হবে, উদারীকরণ-উত্তর যুগের একজন দেশনায়ক হিসেবে লিঙ্গ-রাজনীতিকে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেই বারবার জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে চেয়েছেন। সেক্ষেত্রে তাঁর দেশে মহিলা তথা পুরুষ-ভিন্ন-অন্য-লিঙ্গের মানুষের প্রকৃত অবস্থান তাঁর রাজনৈতিক চালের পক্ষেই ক্ষতিকর হয়ে উঠছে না তো? আরও প্রস্তুতি প্রয়োজন ছিল হয়ত, প্রয়োজন ছিল আরও সততা ও সচেতনতার। অন্যথায়, তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ নিয়ে হয়ত মানুষ সাময়িক ভাবে উৎসাহী হবে। সমকাম বা পরকীয়া সংক্রান্ত প্রগতিশীল রায়ে হয়ত তাৎক্ষণিকভাবে ধামাচাপা পড়বে দেশজুড়ে বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তারের তাণ্ডব৷ কিন্তু সুস্থির ও বিচক্ষণ মূল্যায়নের সময় ও অবকাশ যখন আসবে, তখন সচেতন দেশবাসী তথা ভোটদাতা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন, গলদ থেকে গেল বহু জায়গায়!
সুচিন্তিত মূলযায়ন।