“একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?” রাজনীতিকরা উত্তর দিন

জয়ন্ত বসু

 

সারা দেশ যেন হঠাৎ করে ফ্ল্যাশব্যাকে সুকুমার রায়ের অবাক জলপানে ফেরত গেছে, আর জিজ্ঞাসা করছে, “মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?” প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ‘বিধানসভা কা বাত’– সব জায়গাতেই যেন ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? দেশ জুড়ে হইচই। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু বা দিল্লি জলের জন্য মাথা খুঁড়ে মরছে; নীতি আয়োগ হিসেবনিকেশ করে জানাচ্ছেদেশের বড়-বড় বেশ কিছু শহর সম্পূর্ণ জলহীন অবস্থায় পৌঁছতে আর খুব বেশি দেরি নেইl খবরের কাগজের হেডলাইনে মোদী, মমতাকে সরিয়ে দেশ জুড়ে জলকষ্টের ধারাবিবরণী; ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারে বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে জল নিয়ে; প্রায় প্রতি মুহূর্তে কোনও না কোনও নতুন পোস্ট– কেমন করে জল সংরক্ষণ করা উচিত! যেন, মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব।

এইসব শুনছি, দেখছি; আর নিঃশব্দে হাসছি। যেন আজকের এই জলসঙ্কট হঠাৎ করে রকেটে চেপে, ধরাধামে (আব্বুলিশ, ভারতবর্ষে) অবতীর্ণ হয়েছে! মনে পড়ে যাচ্ছে, অন্তত বছরপাঁচেক আগে দেখা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবুল কালাম আজাদের নিজের তৈরি একটি ডকুমেন্টারি। ‘দ্য লাইফলাইন’ নামের ওই ফিল্মে দেখানো হয়েছিল এমন এক সময়ের কথা, যখন সব দিকে জলের জন্য হাহাকার, বন্দুকধারী প্রহরীরা রাজনীতিকদের ছেড়ে জলাশয়গুলিকে রক্ষা করছে যাতে কেউ বরাদ্দ রেশনের বেশি জল নিতে না-পারে। দেখানো হয়েছিল,কীভাবে জলের অভাবে মারা যাচ্ছে শিশু-সহ সাধারণ মানুষ; মানুষের স্বভাব-চরিত্র-চেহারা পালটে যাচ্ছে অনবরত। আজকের দেশের ছবি যেন তার ট্রেলার মাত্র, অনবরত মনে পড়িয়ে দিচ্ছে‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’।

আসলে এমনটাই তো হওয়ার ছিল। ‘জলই জীবন’ স্লোগানটিকে তো আমরা বিশ্ব পরিবেশদিবস বা জলদিবসের প্রাসঙ্গিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলমারিতে তালাচাবি দিয়ে বন্ধ রেখেছিলাম। বাকি দেশের কথা ছেড়ে দিয়ে আমাদের রাজ্য আর আমাদের শহরের কথাতেই আসা যাক। বিশ্বখ্যাত জলাভূমি বিশেষজ্ঞ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ বারে বারে একটা কথা বলতেন যে, কলকাতা হল একটি ‘ইকোলজিকালি সাবসিডাইসড’ শহর, অর্থাৎ প্রকৃতির অপার দাক্ষিণ্য কলকাতার ওপর না-চাইতেই বর্ষিত হয়েছে; বিশেষ করে জলসম্পদের ক্ষেত্রে। এই শহরের পশ্চিমে হুগলি নদী, যেখান থেকে মূলত আমাদের পানীয় জলের প্রয়োজন মেটে; পুবে বিশাল পূর্ব কলকাতার জলাভূমি, যেখানে শহরের ময়লা জল শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোধনই হয়না, এই জল ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে মাছ চাষ হয়, শাকসবজি উত্পাদন হয় যা সম্ভবত কলকাতার ‘কস্ট অফ লিভিং’কে অন্যান্য মেট্রো শহরের তুলনায় কম রেখেছে। পূর্ব-পশ্চিমে এমন প্রাকৃতিক দাক্ষিণ্য ছাড়াও মাটির তলাতেও শহরে ঐতিহাসিকভাবে জল প্রচুর ছিল, কেননা এই গোটা অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে গাঙ্গেয় বদ্বীপ হিসেবে, এবং পলি থাকার কারণে মাটির তলায় বিপুল পরিমাণ জল প্রবেশ করতে পেরেছে ও মাটির তলার জলসম্পদকে বাড়িয়ে রেখেছে। ইতিহাসে চোখ রাখুনl এই কলকাতাকে একসময় ‘সিটি অফ পন্ডস’ বলা হত, এত অজস্র ছোট-বড় পুকুর ও জলাশয় ছিল এই শহরে; কটন সাহেবের বইতে এমন প্রচুর জলাশয়ের কথা বলা আছে। কটন সাহেব ছেড়ে দিন, এমনকী সাম্প্রতিক ‘ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থিমাটিক অ্যাসোসিয়েশন’ (ন্যাটমো)-র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কয়েক দশক আগেও এই শহরে ৮৭০০-র বেশি জলাশয় ছিল। পরিবেশবিদ মোহিত রায়ের গবেষণা অনুযায়ী, গত দু’তিন দশকের মধ্যে এর প্রায় ৪০ শতাংশ বেমালুম ভরাট হয়ে গিয়েছে। পূর্ব কলকাতার আন্তর্জাতিক জলাভূমি, যাকে দেশের গর্ব বলা চলে, তার ১২৫ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ঘরবাড়ি উঠেছে সরকারি নিয়মকানুন আর আদালতের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে; যেমন আইনকে নিজের মতো করে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে বহুতল উঠেছে শহরের একের পর এক জলাশয় ভরাট করে মনে পড়ে যাচ্ছে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় জানিয়েছিলেন, কীভাবে তাঁর চোখের সামনে জোড়াসাঁকোতে একটি পুকুর ভরাট হয়ে গিয়েছিল! ছোটখাটো জলা ভরাট নিয়ে বেসরকারি অভিযোগ তো ছেড়েই দিন, রাজ্যের একাধিক সরকারি সংস্থার দেওয়া তথ্য ও অভিযোগ অনুযায়ী দক্ষিণ কলকাতার আনোয়ার শাহ রোডে বিশাল সাউথ সিটি আবাসনের একাংশ গড়ে উঠেছে লাগোয়া বিক্রমগড় ঝিল ভরাট করে– রাজ্য সরকার নিজেরই সংস্থার অভিযোগকে গুরুত্ব দেয়নি। একে জলা ভরাট আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোটা শহরকে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া; এই যুগলবন্দিতে ক্রমেই যে মাটির তলায় জল যাওয়ার রাস্তা কমেছে এবং জলের ভাণ্ডার ক্রমে ফুরিয়ে এসেছে, তা বুঝতে বিজ্ঞানী হতে হয় না।

শহরের পাশাপাশি রাজ্যের ছবিটাও কমবেশি একইরকম। রাজারহাটের বিস্তীর্ণ জলাভূমি বন্ধ করে নতুন কলকাতা তৈরি হল, সারা রাজ্য জুড়ে মূলত মানুষের নানান অপব্যবহারের ফলে বর্ষা বাদ দিয়ে অন্যসময় রাজ্যের অধিকাংশ নদী চাষের জমিতে পরিণত হল, আদি গঙ্গা বা সরস্বতী নদীর মতো ঐতিহাসিক নদীগুলি স্রেফ নর্দমায় পর্যবসিত হল; উত্তর চব্বিশ পরগনায় কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের দু’পাশের বিশাল বিলকান্দা জলাভূমি চোখের সামনে স্রেফ ‘নেই’ হয়ে গেল– সমস্ত উদাহরণ একত্র করলে আর একটা ‘অবাক জলপান’ লেখা হয়ে যাবে।

আর, প্রশ্নটা ঠিক এখানেই। গোটা দেশ জুড়ে এত বছর ধরে রাজনীতিক নেতানেত্রী ও তাঁদের বশংবদ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় বড় শিল্পপতি থেকে পাড়ার প্রোমোটাররা জলা বুজিয়ে বহুতল বানিয়েছে; আর আজ জলসঙ্কট গলা চেপে ধরলে শুধু জনগণের সচেতনতাকে পাখির চোখ করলে চলবে? আজকের এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ দায় দেশের রাজনীতিক ও প্রশাসকদের; দায়ভারও তাঁদেরই নিতে হবে। অধুনা পৃথিবী জুড়ে ‘পলিটিকাল রেন্ট সিকিং’ নামে অর্থনীতির একটি তত্ত্ব খুব আলোচিত হচ্ছে, যার অর্থ হল রাজনীতিকরা নিজেদের ক্ষমতাকে কেমনভাবে ব্যবহার করতে দিচ্ছেন অসাধু নিয়মভঙ্গকারীদের ভাড়ার (পড়ুন আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধার) বিনিময়ে। এর ফলে তাঁদের, ও নিয়ম যাঁরা ভাঙছেন তাঁদের আর্থিক লাভ হচ্ছে; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ ও সার্বিকভাবে দেশের প্রশাসনিক ও আর্থিক অবস্থা। জলা ভরাট করে, জলসম্পদ নষ্ট করে তথাকথিত উন্নয়ন এর বড় উদাহরণ। জনসচেতনতা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তা তখনই আসবে যখন সাধারণ মানুষরা দেখবেন তাঁদের ভোট দিয়ে জেতানো অসাধারণ মানুষদের নিয়ে তৈরি সরকার জলসম্পদ বাঁচাতে কতটা সৎ ও আগ্রহী। আপনি পর্দার পিছনে বন্দোবস্ত করে জলা ভরাটে সহায়তা করবেনআর বক্তৃতা দেবেন জনমানসে সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে– দুটো সমান্তরাল বন্দোবস্ত পাশাপাশি চলতে পারে না, চলা উচিতও নয়।

সাম্প্রতিক জলসঙ্কটের যদি কোনও ভাল দিক থাকে, তবে তা হল তথাকথিত আধুনিক উন্নয়নের মডেল নিয়ে জোর গলায় প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেওয়া। এ প্রশ্ন বহুদিন ধরেই পরিবেশবিদরা করছিলেন, কিন্তু অর্থনীতির টাকার ঝনৎকারের তলায় তাঁরা চাপা পড়ে যাচ্ছিলেন। “আরে, পরিবেশ-পরিবেশ করে কি খাবার জুটবে? চাই অর্থনীতির জোয়ার, আর তা আসবে রিয়্যাল এস্টেটের হাত ধরেই”,এমনটাই বোঝাচ্ছিলেন আধুনিক উন্নয়নের ধ্বজাধারীরা, জলা আর অন্যান্য পরিবেশ নিয়ে চিন্তাগুলিকে স্রেফ নস্যাৎ করে। কিন্তু জলসঙ্কট বুঝিয়ে দিল, সেই দিন আগতপ্রায় যখন খাবার কোনওক্রমে জুটলেও জল জুটবেনা!

আর, শুধুমাত্র জলের ক্ষেত্রেই নয়, তথাকথিত উন্নয়নের এই দ্বিচারিতা, একচোখোমি ও দীর্ঘকালীন মাপকাঠিতে অসারতা স্পষ্ট পরিবেশ উন্নয়নের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। কেন গুরুগ্রাম সবচেয়ে পরিকল্পিত শহর হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর সবচেয়ে দুষিত শহর, কেন সল্টলেক বা রাজারহাট পরিকল্পিত শহর হলেও ময়লা ফেলার জায়গা নেই, কেন দেশের অধিকাংশ ‘উন্নত’ শহরের বাতাসে বিষ, কেন একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে হাজার কথা বললেও কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক অরণ্যধ্বংসে সিলমোহর লাগাচ্ছেন– প্রশ্ন অনেক, উত্তরও জানা; যদিও সে উত্তর সর্বসমক্ষে দেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায়না।

আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে সোশ্যাল মিডিয়ায় জল নিয়ে বিপ্লবের ধরনধারন দেখে। অধিকাংশই প্রশ্ন তুলছেন ব্যক্তিমানুষের দায়িত্ব নিয়ে। হক কথা। কিন্তু তা বলতে গিয়ে বকলমে রাজনীতিকদের ও প্রশাসনিক কর্তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা স্বরণ করাতে ভুলে যাচ্ছেন তাঁরা। সরকারি চেয়ারে বসা কর্তাব্যক্তিরাও সুযোগ বুঝে ‘মন কি বাত’-এ আমাদের ঘাটেই দায়িত্ব ন্যস্ত করে দায় সারছেন। দয়া করে কেউ একটা বলুন, রাজার গায়ে কাপড় নেই! নয়তো রাজা আজ বা কাল, আমার আপনার গায়ের বাকি কাপড় খুলে নেবে– জল, স্থল, বাতাস নির্বিশেষে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...