জলের সঙ্গে যুদ্ধ: ডুবছে বানি সান্তা

চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য

 
বাংলাদেশের মংলা বন্দর থেকে কিছু দূরেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের সারি দেওয়া একটি দ্বীপ দেখা যায়। দূর থেকে দেখে মনে হয় শান্ত নিরিবিলি সুন্দর একটা জায়গা। কিন্তু দ্বীপটির একটি বিশেষ পরিচয় আছে। যে পরিচয়ের কারণে কিছু জাহাজ ও নৌকো দ্বীপটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গতি কমিয়ে দেয়, এবং যাত্রীদের অনেকেই আগ্রহের থেকে বেশি কিছু, একটা উগ্র কৌতূহল নিয়ে দ্বীপটির দিকে তাকায়।
দ্বীপটির নাম বানি সান্তা। বহু বছর ধরে এই দ্বীপটি দেহব্যবসার একটি কেন্দ্র, এবং অনেক মহিলার বাসস্থান। মংলা বন্দর, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের একটি বড় ব্যবসার কেন্দ্র— যেটি একসময়ে আরও বড় ছিল— এবং বানি সান্তা এতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মংলায় আসা নাবিকেরা, যাঁরা একসময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসতেন, প্রায়শই বানি সান্তায় আসতেন। মংলার রমরমা কমায় বানি সান্তার অবস্থার অবনতি হয়েছে।

কিন্তু এখন বানি সান্তার সামনে অন্য এক বিপদ রোজ দরজায় আঘাত দিচ্ছে। প্রায় আক্ষরিকভাবেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বানি সান্তার চারিধারে জল বাড়ছে। এখানকার বাসিন্দারা, মহিলারা, যাঁরা কেউ কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হয়তো বাংলাদেশের অন্য জায়গা থেকে বাধ্য হয়েছেন বানি সান্তাতে আশ্রয় নিতে, দ্বিতীয়বার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘরছাড়া হতে চলেছেন।

আর এমনিতেই, দেহব্যবসাতে আসা মানেই ঘরছাড়া হওয়া।

বানি সান্তার আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক: এখানে দেহব্যবসা আইনি। বাংলাদেশ সরকার থেকে এখানকার মহিলাদের, যাঁরা নিজেদের যৌনকর্মী বলে পরিচয় দেন, তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হয়। প্রত্যেক বছর নতুন লাইসেন্স নিতে হয়।

বাংলাদেশের কোনও কোনও জায়গায় দেহব্যবসা আইনি। বানি সান্তার মহিলারা খুব কম টাকার বিনিময়ে ব্যবসা করেন।

১৯৫০ সালে যখন বন্দরটি তৈরি হয়েছিল, বা তারও আগে, ব্রিটিস আমল থেকেই বানি সান্তা এইরকমই একটি উপনিবেশ। যে মহিলাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কোথাও যাওয়ার থাকত না তাঁরা এখানে ভেসে আসতেন।

প্রথম থেকেই এই মহিলাদের সরকার লাইসেন্স দিয়েছে। সেই লাইসেন্সের বয়ান এখনও এক আছে।

মহিলাদের স্বীকার করতে হবে যে তাঁরা “পতিতাবৃত্তি” পালন করেন এবং কেউ তাঁদের এই বৃত্তিতে বাধ্য করেনি।

“পতিতা” শব্দটি যেমন আজ কানে লাগে, তেমনি অন্যায় তাঁদের দিয়ে স্বীকার করানো যে তাঁরা স্বেচ্ছায় এখানে এসেছেন।

এক বছর আগে আমি যখন বানি সান্তায় গিয়েছিলাম, রাজিয়া, যিনি বানি সান্তার মহিলাদের সংগঠন নারী জাগরণী সঙ্ঘের পরিচালিকা, বলেছিলেন যে তিনি নিজের কথা বলতে চান না। কিন্তু বেশিরভাগ মহিলাই হয় বিক্রি হয়ে না হয় মিথ্যা প্রতিশ্রুতির শিকার হয়ে এখানে এসেছেন।

ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে জলের সঙ্গে যুদ্ধ। মংলা বন্দর, হিরণ পয়েন্ট এবং খুলনা, এই তিনটি জায়গার পরিমাপ অনুযায়ী, এই অঞ্চলে সমুদ্রের উচ্চতা ৬ মিমি থেকে ৮ মিমি প্রতি বছর বাড়ছে। বানি সান্তার সামনে দিয়ে পশুর নদী বয়ে চলেছে, সমুদ্র ৭৫ কিমি দূরে।

বানি সান্তা দ্বীপটি খুলনা জেলায়, যদিও মংলা বন্দর বাগেরহাটে।

পঞ্চাশের দশকে প্রায় ১২০০ মহিলা এখানে থাকতেন। এখন আছেন ১০০ জনের মতন। আমাদের সংগঠনে ৮৬ জনের নাম আছে। রাজিয়া বলেন। রাজিয়া বলেন যে ১৮ অনূর্ধ্ব কেউ নেই। যদিও স্থানীয় অনেকেই বলেন যে, আছে।

এই ক’ দশকে বানি সান্তার সামনের দিকের ১০০ মিটার মতন জায়গা জলের তলায় চলে গেছে। মাটি আর বাঁশের বাড়িগুলি খালি পিছু হটছে। পেছনের দিকের জমিতে চিংড়ি চাষের জায়গা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে পরিবেশগত নানা কারণে চিংড়ি চাষ আর ভালো হচ্ছে না অনেক জায়গায়। বানি সান্তাতেও নয়।

জল এগোচ্ছে। আর অন্যদিকে পেছোনোর জায়গা নেই।

বানি সান্তার একজন অল্পবয়সী মহিলা জানিয়েছিলেন যে ৩০টা মতন কুঁড়েঘরে তাঁরা থাকেন। এখানকার বাসিন্দারা সবাই মিলে মাঝে মাঝে বাঁধ তৈরি করেন। “কিন্তু কতদিন নদীকে ঠেকিয়ে রাখব?”

মংলা বন্দর এবং বানি সান্তার পতনের পেছনেও জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। নব্বইয়ের দশকে দুটি কারণে মংলা বন্দর পড়তে শুরু করে। শ্রমিক অসন্তোষ এবং নদীতে পলি পড়া। তারপরই শুরু হয় ভয়ঙ্কর কিছু সাইক্লোন এবং ঝড়ের সময়।

সাইক্লোন সিড্‌র ২০০৭ সালে আসে। সেটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সাইক্লোন। সিড্‌র-এর সময় বানি সান্তায় প্রচুর মানুষ মারা যান। বাকিরা চলে যান। “শুধু যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তারাই থেকে যায়,” একজন ৬০ বছরের মহিলা জানান। তিনি ৫০ বছর এখানে আছেন।

তারপর থেকে মংলা বন্দরের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, বানি সান্তার নয়। এখানে থাকলেই নদীর আক্রমণ।

“আমাদের অনেক সমস্যা। বাড়ির মালিক (বানি সান্তার পুরনো বাসিন্দারা নতুনদের বাড়ি ভাড়া দেন), ক্লায়েন্ট, পুলিশ, যৌনরোগ— সব। কিন্তু নদীর মতন বড় কোনও সমস্যা নেই,” একজন মহিলা বাসিন্দা বললেন। “রাত্রিবেলায় সবসময় নজর রাখতে হয়।” বিশেষ করে বর্ষার সময়।

তিনি আরও জানান যে এখন বানি সান্তায় শুধু নাবিকেরা নয়, বাংলাদেশের অন্য জায়গা থেকে পুরুষদের দল আসে। “পিকনিক”-এর একটা অঙ্গ হিসেবে বানি সান্তায় আনন্দ করতে।

বাচ্চাদের পড়াশোনা? কখনও স্কুল খোলা হয়, কখনও বন্ধ হয়। ডাক্তার দেখাতে নৌকা করে অন্য কোথাও যেতে হয়।

লাইসেন্স থাকায় কোনও আলাদা সুবিধা বা অসুবিধা হয়? “না, আমরা কী লিখি তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।”

বানি সান্তা ভৌগোলিক অর্থে একটি দ্বীপ। কিন্তু তা না হলেও বাসিন্দাদের কাজের কারণে, সামাজিক, আর্থিক এবং মানসিকভাবেও বানি সান্তা একটি দ্বীপের মতই তত। এই দ্বীপটিও সঙ্কুচিত হতে হতে নিশ্চিহ্নের দিকে চলেছে।

এর মধ্যেই একজন নৌকাযাত্রী পুরুষ একটি কবিতা আওড়ান। তার মর্মার্থ: জাহাজডুবি হলে বানি সান্তাতেই হওয়া উচিত।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...