দেবব্রত শ্যামরায়
এক
দু’হাজার সাতচল্লিশ সাল। স্বাধীনতার ঠিক একশো বছর পরের ভারতবর্ষ। না, ভুল হল। নামটা আর ভারত নেই, বদলে গেছে, এখন ভূখণ্ডটির পরিচয়- আর্যাবর্ত। এখানে যে কোনও দুজন মানুষের বার্তালাপ শুরু ও শেষ করার একমাত্র স্বীকৃত সম্বোধন- ‘জয় আর্যাবর্ত’। দীপা মেহতার এই ছবিটি শুরু হচ্ছে এক চূড়ান্ত ‘ডিসটোপিক’ পৃথিবীতে, যেখানে ধনী মানুষেরা উঁচু প্রাচীরে ঘেরা বিলাসবহুল আধুনিক বাংলোয় থাকে, ব্যক্তিগত সুইমিং পুলে সপরিবার ভেসে ভেসে আয়েস করে, অথচ তাদের শহরের সীমার বাইরে পানীয় জলের জন্য রোজ দাঙ্গা হয়। প্রতিটি মানুষের সামাজিক অবস্থান এখানে তার জাত ও ধর্ম দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। নিচু জাতের লোকেরা শহরের বাইরে অস্বাস্হ্যকর বস্তি এলাকায় থাকে ও কীটের জীবন কাটায়। সন্ত্রস্ত মুসলিম পরিবার ত্রিমাত্রিক টিভির পর্দায় দেখে তাজমহল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার এই আর্যাবর্তে যারা অধর্মচারিণী, তাদের বনিতা আবাসে আনা হয়, যা প্রকৃতপক্ষে একটি কয়েদখানা। এখানে ভিন্ন ধর্মে সম্পর্ক করার জন্য বা অন্যান্য জাতধর্মবিরোধী আচরণের জন্য হিন্দু মেয়েদের শুদ্ধিকরণ হয়। আর্যাবর্তের আদর্শ ও সংস্কারের কাছে যতদিন না তারা আনুগত্য স্বীকার করে নিচ্ছে ও তার পরীক্ষায় সফল হচ্ছে, এই আবাস থেকে তাদের মুক্তি নেই। সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনার সময় আবাসিকদের যন্ত্রচালিতের মতো মন্ত্র আউড়ে যেতে হয়- আমার জন্মই আমার ভবিতব্য, আমার জন্মই আমার ভবিতব্য…
বোঝা যায়, ছবিটিতে দুহাজার সাতচল্লিশ সালের উল্লেখ বিশেষ অর্থবহ। ভারতের স্বাধীনতার ঠিক একশো বছর পূর্তিতে এ এক টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রের বর্ণনা, যা স্বাধীনতার সমস্ত অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। অথচ ছবির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে আমরা যদি আজকের বাস্তবতার দিকে তাকাই, আর্যাবর্ত-কে কোনও কষ্টকল্পনা বলে মনে হয় না, বরং এই ২০১৯-এ বসেই সর্বনাশের আগাম ও অমোঘ চিহ্নগুলোকে প্রায় হুবহু চিনে নিতে পারি। কাগজের প্রথম পাতায় পাশাপাশি শুয়ে থাকে গণপ্রহারে মৃত ২৪ বছরের নবীন শ্রমিক তাবরেজ আনসারি ও দেশজুড়ে আসন্ন তীব্র জলবায়ু সঙ্কটের খবর৷ আমরা দেখি, কীভাবে দূরের রেলস্টেশন থেকে সামান্য দু বালতি জল সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন ভিড় ট্রেনে চেপে ১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় ঔরঙ্গাবাদের দরিদ্র বালক সিদ্ধার্থ৷ আমরা দেখি কিন্তু খেয়াল করি না, আমাদের দেশের প্রতিটি অর্থনৈতিক অসাম্য ও সামাজিক অন্যায়ের মতোই পরিবেশ সংক্রান্ত সঙ্কটকেও যে নেপথ্য ফ্যাক্টরটি সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে আরও নিষ্ঠুর, আরও ভয়াবহ করে তোলে, তা হল জাতপাতের সমীকরণ। জাতিভেদ হিন্দু অধ্যুষিত ভারতের এমন এক সচেতন রাজনৈতিক নির্মাণ যা যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক বিপুলসংখ্যক ভারতবাসীকে সামাজিক সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে৷ তাই সাধারণভাবে, এদেশে দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতা ‘নিম্নবর্ণ’ শব্দটির সমার্থক। আমাদের জন্মই আমাদের ভবিতব্য। জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়ন, জলসঙ্কট- এই পরিবেশ-সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সবক’টিই সর্বজনীন, আমাদের সকলের ওপরেই পড়বে প্রকৃতির মার, তা সত্ত্বেও এই সমস্ত ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাত-ধর্ম-অর্থনীতির সিঁড়ির একদম নিচের পাদানিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন। কীভাবে? দেখা যাক।
দুই
সরাসরি আসি জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক সাংবাদিকতার প্রসঙ্গে। আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমে যারা এই বিশেষ ও অপেক্ষাকৃত নতুন ক্ষেত্রটি নিয়ে এই মুহূর্তে কাজ করছেন, তারা প্রধানত অ্যাকাডেমিক, শহরে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত যুবা সম্প্রদায়। গ্রামীণ, প্রান্তিক ও নিম্নবর্ণের প্রতিনিধিত্ব সেখানে থাকার কথা নয়, নেইও। ১৯৯৬ সালে বিখ্যাত কুপার-উনিয়াল অনুসন্ধান দেখিয়েছিল দেশের সংবাদমাধ্যমে দলিত ভারতবর্ষের স্বর বিশ্বাসযোগ্যভাবে উঠে আসে না৷ প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোয় নথিবদ্ধ সারা দেশ থেকে প্রায় ৭০০ জন প্রথম শ্রেণির সাংবাদিকের পরিচয় ঘেঁটে তপশিলি জাতি বা উপজাতির একজন প্রতিনিধির নামও খুঁজে পাননি বি এন উনিয়াল৷ দু’দশক পেরিয়ে আসার পরেও এই পরিস্থিতির হেরফের সামান্যই। আমাদের নিউজরুমগুলোতে দলিত বা আদিবাসী সাংবাদিক কম অথবা নেই। ফলত, আমাদের দেশের জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক সাংবাদিকতায় একটা বড়সড় ‘অন্ধ বিন্দু’ তৈরি হয়েছে৷ শহরের ঘেরাটোপের বাইরে জলবায়ু পরিবর্তন প্রান্তিক ও দরিদ্রতম মানুষকে ঠিক কীভাবে ও কতখানি তীব্রতায় আঘাত করছে, বা তা থেকে উত্তরণের কোনও পথ আছে কিনা, এবিষয়ে কোনও ফার্স্ট-হ্যান্ড অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় না৷ আমরা শহর কলকাতার বায়ুদূষণের ভয়াবহতা নিয়ে ভাবিত হই, ধুলো-কুয়াশার জালে আবদ্ধ দিল্লিতে দিনেদুপুরে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন- এই ছবি দেখে ভয়ে আঁতকে উঠি। অথচ ভারতবর্ষের প্রায় তিরিশ কোটি মানুষ রোজ মাত্র কয়েক বর্গফুটের জানালাহীন ও ধোঁয়াভর্তি খুপরিতে বসে রান্না করেন, তাদের যাপন আমাদের নজরে আসে না। নাগরিক সাংবাদিকরা যখন সংবাদ পরিবেশন করছেন, তারা সেই সংবাদই আমাদের সামনে তুলে ধরছেন, যা তাদের নিজেদেরকে প্রভাবিত বা আহত করছে সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণি-কারাগারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতের পরিবেশ-সাংবাদিকতা।
ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ৭০ কোটি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে, যে দেশগুলোর মধ্যে ভারতের স্থান অন্যতম৷ স্বাভাবিকভাবেই, এই দরিদ্র মানুষদের পুরোভাগে থাকবেন আমাদের দেশের কৃষিজীবিরা, যারা গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় সত্তর শতাংশ ও পরিকাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরাসরি আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল৷ এখানে একটা প্রাসঙ্গিক তুলনা দেওয়া যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল, সেখান আমাদের দেশে সংখ্যাটা প্রায় ৫৫%। ভারতের কৃষকদের মধ্যে আবার প্রায় ৮২ শতাংশ প্রান্তিক চাষি ও ভূমিহীন, যারা নিম্নবর্ণ, আদিবাসী এবং মুসলিম। জলবায়ু পরিবর্তন যে চাষিদের ক্ষেত্রে ফলন-সংক্রান্ত আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনবে শুধু তাই-ই নয়, জল সমস্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ম্যালেরিয়া ডায়রিয়া জাতীয় রোগের প্রকোপ বাড়াবে, যাকে মোকাবিলা করার মতো স্বাস্থ্যপরিকাঠামো গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট নয়। ফলে আমরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছি, জলবায়ু সঙ্কটের খাঁড়ার প্রথম কোপটা কার কার ওপর পড়বে৷
দেশজুড়ে জলসঙ্কট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সংবাদমাধ্যমে আরও বেশি করে অন্তঃরাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্র জলচুক্তি সংক্রান্ত সমস্যার খবর দেখতে পাব। দেশজুড়ে একাধিক ওয়াটার ডিসপিউট ট্রাইবুনাল থাকা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে দেশের সতেরোটা রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আভ্যন্তরীন জলবণ্টন নিয়ে সমস্যাদীর্ণ৷ তবে যে খবরগুলো আমাদের কাছে এত সহজে পৌঁছবে না, তা হল মারাঠাওয়াড়া অঞ্চলের সাত হাজার গ্রামে এখন একবিন্দু জল নেই, হ্যাঁ, এখন অর্থাৎ এই মুহূর্তের কথাই বলছি, ঠিক যখন এই লেখাটি তৈরি হচ্ছে৷ দশ বছরের সিদ্ধার্থ ধাগে, বছর বারোর আয়েশা ও তার ছোট বোন সাক্ষীর কথা গত সপ্তাহের খবরে উঠে এসেছে। এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সকালের ট্রেনে চেপে দূরের স্টেশন ঔরঙ্গাবাদে নেমে দিনের শেষে কয়েক পাত্র জল নিয়ে ঘরে ফেরে। কিন্তু সিদ্ধার্থ-আয়েশা নিউজরুমের হাজারো স্টোরির একটি বিচ্ছিন্ন খবর মাত্র নয়, আমাদের প্রতিদিন হাজার হাজার মহিলা কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাড়ির কাজের জন্য জল ভরতে যান। জলস্তর যত কমবে, জল আনার জন্য তত বেশি দূরত্ব হাঁটতে হবে ওদের, এবং তত বেশি সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হবে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের অন্য কাজের সময় কমবে, একশো দিনের কাজে অংশগ্রহণ কমবে, উপার্জনও কম হবে। এইভাবে জলস্তরের সংকোচন সরাসরি প্রভাব ফেলছে একটি প্রান্তিক পরিবারের অর্থনীতিতে। দরিদ্র ক্রমে দরিদ্রতর হচ্ছে।
তিন
ভারত বেশ কয়েক দশক ধরেই তথাকথিত পরিবেশ সচেতন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি, অন্তত ঘোষিতভাবে। বহুবছর ধরেই আমাদের দেশে পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প হিসেবে অচিরাচরিত শক্তির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ও দূষণহীন সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে এই মুহূর্তে সরকারের সুস্পষ্ট নীতি ও কর্মসূচি রয়েছে। জলসঙ্কটের সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে সকলের সামনে আসার পরপরই প্রসার ভারতীতে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে সে প্রসঙ্গে উঠে এসেছে, দেশের সরকার যে এই সঙ্কট মোকাবিলায় তৎপর তা শোনা গেছে তাঁর ভাষণে। অবশ্য এই তৎপরতা সত্যিই কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। কারণ, আমরা দেখে এসেছি, ভারত রাষ্ট্রের প্রথম আনুগত্য সবসময় তার কর্পোরেট ইয়ারদোস্তদের কাছে। বর্তমান ও প্রাক্তন কেন্দ্র সরকারগুলির আমলে কর্পোরেট-বান্ধব উন্নয়নের রথের ঘোড়া পরিবেশ ধ্বংস করতে করতে এগিয়েছে, উদাহরণ ভুরি ভুরি। শুধুমাত্র গত তিরিশ বছরে ১৪০০০ বর্গ কিলোমিটার বনভূমির নথিবদ্ধ চরিত্র পালটে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে রাষ্ট্র। পাহাড়-জঙ্গল থেকে তার আদি বাসিন্দাদের উৎখাত করে মাটির ভেতর থেকে সোনা খুঁড়ে বের করবে বলে ওৎ পেতে বসে আছে বহুজাতিক মাইনিং জায়ান্ট-রা। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ আদালত নজিরবিহীনভাবে প্রায় ১৮ লক্ষের বেশি আদিবাসী ও অরণ্যবাসী মানুষকে অরণ্য থেকে উচ্ছেদ করতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিল। অর্থাৎ আরেকবার নির্দ্বিধায় আঘাত করা হল দেশের বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ অর্থাৎ নিম্নবর্ণকে। এমনকি অতি সম্প্রতি দেশজোড়া জলসঙ্কট নিয়ে হাহাকারের মধ্যেই এক মর্মান্তিক খবর বেরোল, মুম্বাই-আমেদাবাদ রুটে দ্রুতগামী বুলেট ট্রেন চালানোর জন্য পরিকাঠামো নির্মাণে প্রাণ ৫৪,০০০ ম্যানগ্রোভের অরণ্যকে বলি দিতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই মাত্রার এক দানবীয় কর্মসূচি ‘পরিবেশ বাঁচাতে আন্তরিক ও সংবেদনশীল’ সরকারের ছাড়পত্র পায় কীভাবে?
অপ্রিয় প্রশ্নগুলি ছাড়াও বেশ কিছু আশঙ্কা রয়েছে৷ আমাদের দেশ যতই বিকল্প শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করুক না কেন, ভারতের যে তিরিশ কোটি মানুষ এখনও জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল, তাদের পরিবেশবান্ধব জ্বালানির আওতায় নিয়ে আসা সহজ নয় মোটেই। প্রথমত, অচিরাচরিত শক্তিকে ব্যবহার করা এই মুহূর্তে ব্যয়সাপেক্ষে, যা এই পরিবারগুলির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। ফলে পরিবেশের ওপর চাপ কমিয়ে বিকল্প শক্তির প্রয়োগ বহুল ও ব্যাপক করতে গেলে, আগে এই তিরিশ কোটি মানুষকে (এবং যে সংখ্যাটা বাড়ছে) দারিদ্র্যরেখার ওপরে টেনে তুলতে হবে। সেই টেনে তোলার কাজটা খাতায় কলমে সম্ভব হলেও, প্রক্রিয়াটি বাস্তবিক কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। সেই সুদিনের জন্য বসে অপেক্ষা করার পরিবর্তে আমরা নিজেরা কি কিছু করতে পারি না?
অবশ্যই পারি। আশার কথা, সেই ধরনের কাজকর্মের খবর মিলছে। সংগঠিত বড় পুঁজিকেন্দ্রিক পরিকাঠামো নির্মাণের বাইরেও বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় স্তরে নানা পরিবেশ-বান্ধব কৌম প্রচেষ্টা গড়ে উঠছে, মূলস্রোতের মিডিয়ার কাছে যার কোনও খবর নেই। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে লায়া উপজাতি উন্নয়ন সংস্থার (Laya Tribal Development Organization)। এরা আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন, নারীদের সাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি বিকল্প শক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে। কোথাও কোথাও বিকল্প কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষে ব্যবহৃত জলের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা চলছে, জমির ফলন বাড়ছে। অন্ধ্রপ্রদেশে প্রায় ৬৫০০ আদিবাসী পরিবারে ধোঁয়াহীন স্টোভ পৌঁছে দেওয়া গেছে। প্রায় ২০০০ গ্রামীণ পরিবারে যেখানে এখনও অবধি কোনও বিদ্যুৎসংযোগ নেই, সৌরলণ্ঠনে আলোকিত হচ্ছে। এইসব গ্রামে আজকাল সন্ধের পরেও বাচ্চা ছেলেমেয়েরা লণ্ঠনের আলোয় পড়তে বসে, সেই একই আলোয় তাদের মা-কাকিমারা রান্না করেন, কাঠের ধোঁয়ায় আর চোখ জ্বালা করছে না তাদের। বালি দিয়ে তৈরি ওয়াটার ফিলটার দরিদ্র পরিবারগুলিতে পরিশ্রুত জলের অভাব ঘুচিয়েছে। এইসব প্রান্তিক নিম্নবর্গের মানুষ, যাদের রাষ্ট্র তপশিলি জাতি ও উপজাতি হিসেবে দাগিয়ে রেখে কর্তব্য সেরেছে ঠিকই, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও সুযোগসুবিধা পৌঁছে দিতে পারেনি, লায়ার মতো ছোট ছোট কৌম উদ্যোগ তাদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও বাড়িয়ে তুলতে পারছে, পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট থেকেও উদ্ধারের একটা ক্ষীণ আশা দেখা যাচ্ছে।
মূলস্রোতের সংবাদসংস্থার নিউজরুমগুলি এই প্রান্তিক ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নয়। অথচ এই সময়ে তাদের অন্যতম দায়িত্ব এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন কৌম প্রচেষ্টাগুলির কথা আরও বেশি বেশি করে সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। পরিবেশের পক্ষে ও জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় সহযোদ্ধাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে হবে। নিম্নবর্গের মানুষের পাশে দাঁড়ানো, জাতিভেদের দেওয়াল ভাঙার চেষ্টা এবং কর্পোরেট লোভের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধাচারণ, এসব প্রকৃতপক্ষে একটিই অবিচ্ছিন্ন লড়াই। এই লড়াই-এর সম্ভাবনাগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভারতবর্ষের খেত-খামারে, জঙ্গলে, মরুভূমিতে। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই লড়াইগুলিকে সংঘবদ্ধভাবে আত্মস্থ করার মধ্যেই। আমাদের জন্ম আমাদের ভবিতব্য নয়। আমাদের ভবিতব্য একমাত্র আমাদের কাজ। ২০৪৭ সালের সংবেদনহীন ডিসটোপিক আর্যাবর্ত যেন কোনওভাবেই আমার দেশ না হয়।