জিললুর রহমান
ইশকুলের স্মৃতিচারণা মানেই পুরনো যন্ত্রণাকে খুঁচিয়ে বের করা, আমার জন্যে অন্তত। ইশকুল মানেই আমার কাছে একটা ভয়ঙ্কর সূচনা। সেই একেবারে শৈশবে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিয়ে বাবা আমাকে আবুল কাসেম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রেখে বাড়ি ফিরে যান। তখন আমার ভেতরে হাজারটা কান্নার দমক গুমরে মরছিল। এমন সময় এক শিক্ষক এসে কি জানি এক পড়া ধরতে যখন পারলাম না— কান ধরে হাঁটু ভেঙে বেঞ্চির উপরে দাঁড় করিয়ে দিলেন, কপোল গড়ানো অশ্রুর দিকে সেদিন দৃকপাত করেনি কেউই। তেমনি অভিজ্ঞতা হাই স্কুলেও।
যখন ক্লাস ফোরে উঠার সময় আমার ক্লাসের অনেকেই চট্টগ্রাম সরকারি জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেল, সেবার বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েও ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করি। ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি ও অংক তিন বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা ছিল। আমি প্রশ্ন পেয়ে দেখি সব পারি। মনের মাধুরী মিশিয়ে বাংলা লিখতে লিখতেই সময় প্রায় শেষ। অল্প একটু ইংরেজি লিখলেও অংক খাতা সাদা জমা দিতে হল। ভর্তি পরীক্ষার এই ফেল বাবা মেনে নিতে পারেননি। স্কুলে গিয়ে তিনি উত্তরপত্র দেখে আসেন। এরপরে আমার উপরে যে শাস্তির খড়্গ নেমে আসছিল, আমার জ্যাঠামশাই সেদিন না বাঁচালে হয়তো বাড়ি ছেড়েই পালাতাম শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাডি থেকে পালিয়ে’র মতো। যাই হোক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কিন্তু আমার এই অকৃতকার্যতায় মহাখুশি। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষার ব্যাপার তো আছেই।
ক্লাস সিক্সে উঠে যখন আবার ভর্তি পরীক্ষা এল, বাবার সে কী সতর্কতা—আগের সে ভুল যেন আর না করি। পরীক্ষাও দিলাম তিনটি স্কুলে। টিকে গেলাম সবকটিতেই। ইচ্ছে হল বিখ্যাত কলেজিয়েট স্কুলে পড়ব। অনুচ্চ স্বরে মিনতিও করলাম পিতৃদেবের কাছে। কিন্তু আবেদন না-মঞ্জুর। ঘরের পাশের স্কুল ফেলে এতদূরের স্কুলে যাবার কোনও যুক্তি সেদিন আমার কাছে ছিল না। তাই পিতার হাত ধরে ভর্তি হতে গেলাম তখনকার চট্টগ্রাম সরকারি জুনিয়র হাইস্কুলে। বাবা ভর্তি করে দিয়েই চলে গেলেন। আমাকে চালান করে দেওয়া হল ষষ্ঠ শ্রেণীর ক শাখায়।
ক্লাসে সামান্য ছাগুলে দাঁড়ির বেঁটেমতো সাধারণ চেহারার এক শিক্ষক বসে আছেন। ইস্ত্রিবিহীন ফুলহাতা সাদা শার্ট পরিহিত। সাথে একটি ক্যারেক বেত (এখনও তার শুদ্ধ নাম জানি না)। পড়া ধরছেন আর সপাং সপাং হস্তরেখা বৃদ্ধির প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। একসময় আমার পালা এল। বললাম, আমি নতুন ভর্তি হয়েছি, আজকের পাঠ্য আমার জানা নেই। সাথে সাথে আমাকে তিনি কাছে ডেকে নিলেন। তারপর আমার নাকের ডগায় তাঁর হাত দিয়ে অনেকক্ষণ দলাইমলাই করলেন। অন্যদের সাথে আমিও হাসলাম। পরে সিটে ফিরে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলাম— স্যারের প্রবলেমটা কি? আমাকে এমন করলেন কেন? তখন সে জানাল— আমার নাকের ডগা লাল হয়ে হয়ে গেছে। এটাকে ‘নাকে ডলা’ আদর বলত!! অই জমানায় ওটা বেশ পপুলার ছিল!! স্যারের নাম পরে জানলাম কোব্বাত স্যার। নামেরও সে কী বাহার! এমন অদ্ভুতরকম শাস্তি দিয়েই আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল এই স্কুলে। পরে দেখেছি, কোব্বাত স্যার এলেই ক্লাস ক্যাপ্টেন জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে পাহাড়ে। গোঁড়া শুদ্ধ ইয়া লম্বা লম্বা গাছ নিয়ে আসে। স্যার চেয়ারে বসেই পুরা ক্লাসে বেতাতে পারেন মহা আনন্দে। কোব্বাত স্যারের শাস্তির ধরন ছিল অদ্ভুত। তিনি ডাস্টার, পেন্সিল এসব দিয়ে তার নিজস্ব কায়দায় আমাদের শাস্তি দিতেন। পেন্সিল দুই আঙুলের মাঝে রেখে চাপ দিতেন। তখন কে দেখে প্রাণের আহাজারি।
যতদূর মনে পড়ে, ক্লাস টিচার ছিলেন তমিজউদ্দিন স্যার। উনি তেমন দাগ কাটেননি—না পিঠে, না মনে। মারার অভ্যাস তেমন তাঁর ছিল না। তবে তিনি কথায় কথায় ছড়া কাটতেন—অশেষ কুমার চৌধুরী, ভাত খায় আধ আরি। সে সময়ে সহপাঠী কানাইকে নিয়েও কী যেন ছড়া তৈরি হয়েছিল।
কোব্বাত স্যার বিদায় নিতে নজর দিলাম শ্রেণিকক্ষের দিকে। দেখলাম একটা লম্বা বেড়ার ঘর পাহাড়ের গায়ের ভেতরে লেপ্টে আছে। তার নিচের দিকে নালা পার হলে দেবপাহাড়ের রাস্তা। বেড়ার ঘরটিকে ভাগ করে ৩টি ক্লাসরুম বানানো হয়েছে। প্রথম ঘরটিই আমাদের ক্লাসরুম। উল্টাদিকে তাকিয়ে দেখি জানালা থেকেই পাহাড়। জানালা ডিঙিয়েই পাহাড়ে ওঠা যায়। মনটা কেমন আনচান করে উঠল জানালা দিয়ে সেই পাহাড় উঠে যেতে। এদিকে তারপরের ক্লাসে মনে হল হঠাৎ এক গোরিলা যেন লাফ দিয়ে ঢুকে পড়েছে পাহাড়ের অরণ্য থেকে। পরে বুঝলাম—না, তিনি আমাদের শিক্ষক। আবলুস কাঠের মতো কুচকুচে কালো গায়ের রং। চুল-গোঁফ তো কালোই, কুতকুতে কালো চোখগুলো যেন গভীর অন্ধকারে টলটল করছে। গায়ে একটা পুরো কালো সোয়েটার, পায়ে কালো জুতো। মোজাটাও কালো। তখনও বুঝিনি যে মেজাজটাও তেমনই গাঢ়। ক্লাসে ঢুকেই একপাশ থেকে পড়া ধরলেন। তারপর দেখি, কেউ কোনও রা না করেই কানে ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে পড়ছে। আমিও আর নতুনত্বের অজুহাত দেখালাম না। দশে মিলে করি কাজ ভেবে দাঁড়িয়ে গেলাম কানে ধরে। তারপর শুরু হল ধোলাইপর্ব। সেদিনের সেই ভীতি আমাকে আজও মেরুদণ্ড কাঁপিয়ে দেয়। এরপরদিন থেকে আমি আর কারও পড়া পড়তাম না। কেবল সারারাত জেগে কুঞ্জবিহারী নাথ ওরফে কুঞ্জু স্যারের ট্রান্সলেশন পড়তাম। আর প্রতিদিন স্যার ক্লাসে এলেই ভয়ে সব পড়া ভুলে গিয়ে কান ধরে বেঞ্চে উঠে যেতাম আর সকলের মতো। কুঞ্জু স্যার যাকে মারার ইচ্ছা ছিল তাকে দিয়ে বেত আনিয়ে নিতেন। খুব শীঘ্রই নিজেকে প্রাইমারি জীবনে প্রথম তিনজন ছাত্রের মধ্য থেকে হাইস্কুল জীবনে ক্লাসে শেষ তিনজনের মধ্যে আবিষ্কার করলাম। আর কুঞ্জ স্যারের পছন্দ ছিল প্রথমে পিঠে কনুই দিয়ে মেরে তার সাথে সাথে ১ মণ ওজনের কিল। কারও কারও মতে কুঞ্জবিহারী নাথ মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। হয় টেবিলের নীচে মাথা ঢুকিয়ে পাছায় সপাং সপাং বেতের বারি অথবা পিঠের মেরুদণ্ড হয়ে ঘাড় এবং মাথা পর্যন্ত হাতের কনুই দিয়ে উদ্ভট এক মাইর, নাম ছিল ডিসকো মাইর। কতবার যে খেয়েছি তার হিসেব নেই । আবার ইউনুস স্যার দিতেন পেটে ডলা আদর! একদম সেরকম!!!
হেডমাস্টার মুসলেহউদ্দিন স্যার করিডর দিয়ে হাঁটলে একবার করে যেন কেয়ামত নাজিল হত। কোব্বাত স্যার আর বাঘা সিদ্দিক স্যার ছিলেন ছাত্রদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। তবে হেড স্যারের শাস্তির কাছে উনারা ছিলেন পানিভাত। রীতিমত আয়োজন করে যাকে শাস্তি দিতেন তার প্রসারিত হাতে বেতের বাড়ি চলত গুনে গুনে। ‘অপরাধী’ ছাত্রের কষ্টে আমরা যারা দর্শক তাদের চোখ থেকে পর্যন্ত অবিরল ধারায় জল ঝরে পড়ত। তবে মনে হয়, যখন হাইস্কুল হবার পরে রবিউল স্যার নতুন হেডস্যার হিসেবে যোগ দেন, তখন থেকে মুসলেহউদ্দিন স্যারের তেজ কিছুটা কমে আসে।
তবে আমাদের আনন্দের সময় ছিল টিফিন পিরিয়ড। পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে দুই দলে ভাগ হয়ে গেরিলা দলের মতো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। যদিও আমাকে চলে যেতে হত বাসায় ভাত খাবার জন্যে, তবুও মাঝে মাঝে খেলাতে মত্ত হয়ে থেকে গেছি। বাড়ির কাছে ইশকুল না হলে যে কী ভাল হত! ইরশাদ সাঈদ কি সে যুদ্ধে সেনাপতি হত? তার নামই হয়ে গেল সেনাপতি।
আরিফ স্যার ছিলেন পেন্সিলের মত চিকন। ছবি আঁকার স্যার। তিনিও শাস্তি দিতেন আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল চেপে ধরে। ক্লাস সেভেনে দুই সেকশন একত্র হয়ে গেল। ইয়া লম্বা হলঘরের মত ক্লাসরুম। ছাত্র গিজগিজ করছে। কোনও হাঁটাচলার পথ নেই। ক্লাস টিচার বাঘা সিদ্দিক। তাঁর এক একটা ঘুষির ওজনই হবে ১ মণ প্রায়। স্যার ছাত্রদের মারার জন্যে হাইবেঞ্চের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে পেছনের সিটের দিকে ছুটে যেতেন। তাঁর ঢোলা পাজামার তলায় দোলায়মান মস্কোর ঘণ্টার নিচে ক্যাচ ধরার ভঙ্গি করে কখনও কখনও এগিয়ে যেত আমাদের বন্ধু কামালও। কামাল খেলাধুলায় যেমন তুখোড় ছিল, দুষ্টামিতেও তেমনি সফল। একদিন দুপুরে টিফিন পিরিয়ডের পরে কামালসহ আরও দুয়েকজনের প্ররোচনায় পানির টাঙ্কির পাশ দিয়ে লুকিয়ে বের হয়ে গেলাম ইশকুল থেকে। সোজা দৌড় গুলজার সিনেমা হলের দিকে। যতদূর মনে পড়ে ‘আসামী হাজির’ ছিল সেদিনের সিনেমার নাম। সেই প্রথম পালিয়ে সিনেমা দেখা।
এভাবেই চলছিল—এমন সময়ে একদিন শুনি, আমাদের স্কুল হাই স্কুল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আর ক্লাস নাইনে নতুন স্কুলের সন্ধানে যেতে হবে না। এদিকে ক্লাসঘরে টিনের চালা ফুটো করে বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পড়ে, আর ওদিকে আমরা হাইস্কুল হতে যাচ্ছি। আমরা ডাকতাম, ভাঙাচোরা হাইস্কুল। মাঝে মাঝে বর্ষার সময় ক্লাসে ছাতা খুলে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে মাথা বাঁচাতাম। যতটা না বৃষ্টি পড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ছত্রধর। কোনও মতে হেডস্যারের নজরে এলে সহসা ছুটি মিলে যেত।
স্যারদের তেজ কখনও কমেনি। ক্লাস এইটে কুঞ্জু স্যার নিতেন ইতিহাস। প্রতিদিন বেঞ্চে দাঁড়াতে আর কতো ভাল লাগে! তাই ক’জন মিলে বুদ্ধি বের করলাম। স্যারকে ক্লাসে ঢুকতেই ইতিহাসের কোনও একটা ঘটনার গল্প জানতে চাইতাম। আর স্যার গভীর উৎসাহে সে গল্প করতে করতে ঘণ্টা পার। এভাবে বেশ কিছুদিন গেলে, একদিন স্যার চালাকি ধরে ফেললেন। এবার তিনি ঘোষণা দিলেন, তোরা যদি পড়া ধরার আগে আমাকে গল্প ধরিয়ে দিস, তবে যে প্রশ্ন করবে তাকে আগে পিটাব, তারপর গল্প করব। কয়েকদিন খুব কষ্টে কাটালেও আমরা গল্প ধরিয়ে দিয়েই স্যারের হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিলাম।
ইউনুস স্যার অন্য শিক্ষকদের মতো নন। তিনি কিছুটা প্রতিবাদী ছিলেন। তৎকালীন জিয়া সরকারের ব্যাপারে তাঁর খুব ক্ষোভ ছিল। সে উষ্মা তিনি আমাদের মধ্যেও মাঝেমধ্যে সঞ্চালিত করতেন। আবার আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনও ভিনদেশী নারীর দিকে চেয়ে হা করে থাকতাম তখন হয়ত পিছন থেকে ক্লাসে ঢুকে বলতেন, যত ভাল লাগছে, তত ভাল আসলে নয়—সামনে সেন্টের খুশবু পেলেও পেছনে গিয়ে দেখ গুয়ের গন্ধ—এরা নাকি মলত্যাগ করে শৌচ করে না। এমন সব রসিকতাও চলত।
মোস্তফা স্যার হঠাৎ শাস্তির নতুন পদ্ধতি বের করলেন। তার জন্যে আবার একটা গল্পও শোনালেন। “একদল পাখি একসাথে ওড়ে। একসাথে কোনও ফসলের ক্ষেতে নেমে খুঁটে খায়। একবার পাখিরা একটা ধানক্ষেতে খাচ্ছিল, তাদের নেতা জানাল কেউ যেন পাশের ক্ষেতে ধান খেতে না যায়। সেখানে জাল পাতা আছে। একপাখি কথা না শুনে যেই ধান খেল সেই ক্ষেতের, সাথে সাথে পেতে রাখা জালে পুরা দল ধরা পড়ল।’ স্যার বললেন, এখন থেকে দুজনের বেঞ্চে একজন পড়া না পারলে দুজনেই শাস্তি পাবে। এমন কথাতে আমরা প্রতিবাদ করলেও কর্ণপাত করার লোক তিনি নন। তিনি বললেন, তোরা যে পড়া পারে না তার পাশে বসবি না। এমন ফাঁদে পড়ে, পড়া পারা সত্ত্বেও কত মার খেলাম।
আরেকজন ছিলেন আফসার আলী স্যার। তাঁর কাছে খারাপ ছাত্রের জায়গা কাজেম আলি স্কুল। পিটাতে পিটাতে বলতেন কাজেম আলি চলে যা। তবে এই মারের ভেতরেই তো আফসার আলি স্যার ইংরেজি গ্রামারটা আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের কানাইয়ের বাবার বেকারী রেস্টুরেন্ট থেকে দুপুরের টিফিন আসত শক্ত শক্ত লাঠি বিস্কুট, প্যারা-মিষ্টান্ন ইত্যাদি। শিরা-দেওয়া মিষ্টি পরটাকে আমরা চট্টগ্রামের লোকেরা বাকরখানি বলি।
এই টিফিনটা অতি উপাদেয় ছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন উপস্থিতির সংখ্যা ২/৩ জন বাড়িয়ে দিলে নাস্তা বেশি আসত, আর সে নাস্তা নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি আজ বড় মধুর মনে হয়। মনে পড়ে একবার আমরা টিফিন বিদ্রোহ করেছিলাম। আবার কখনও গণিবেকারী থেকেও টিফিন আসত। তবে প্রায়সময়ই দেওয়া হত ২টি করে লাঠি বিস্কুট। শালার বিস্কুটে কামড় দিলে দাঁত ভেঙে যেত, কিন্তু মরার বিস্কুট ভাঙত না। একদিন সব ছাত্র টিফিন বয়কট করে এসেম্বলির মাঠে জড়ো করে রেখে দিলাম। পরের দিন থেকে লাঠি বিস্কুট বন্ধ হয়েছিল। আমার দেখা প্রথম বিদ্রোহ সফল হল।
আরেকটি মারাত্মক ঘটনার কথা এখন মনে পড়ছে। আমাদের গ্রীষ্মের ছুটির আগের দিন আর রোজার ছুটির আগের দিন ক্লাসরুম সাজিয়ে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা লাগত। এটা কিছুটা ক্লাস টিচাররা চাপিয়ে দিতেন। ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন বয়সের কারণেই হয়তো মন কিছুটা প্রতিবাদী। তার উপরে ইউনুস স্যারের মতো স্পষ্টভাষী শিক্ষকের কাছ থেকে অসন্তোষমূলক বক্তব্য আমাদের কিছু বন্ধুদের মধ্যে উষ্মা সৃষ্টি করে। আমরা ঠিক করেছিলাম ক্লাস এইটের ছাত্ররা কোনও ক্লাসসজ্জা বা খাবারের আয়োজন করব না। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সকালে স্কুলে গিয়ে দেখি সব ক্লাস সুন্দর সজ্জিত আমাদের ক্লাস বাদে। আজ মনে নেই কে কীভাবে ঘটালো, কারা ছিল, হঠাৎ উপস্থিত কজনের জুতা স্যান্ডেল নিয়ে মালা বানিয়ে তারা লটকে দিল। আমার স্যান্ডেলও সেখানে দিতে হয়েছিল। এরমধ্যে একজন বলল, শুধু জুতায় হবে না। দুইটা বিড়িও সাথে লটকে দিলে সুন্দর হয়। আমার পকেটে কিছু খুচরা ছিল তাও ওরা নিল। সব আয়োজন করে মাত্র ২ মিনিট মতো মালাটি ক্লাসের দরজায় লটকানো ছিল। এর মধ্যেই কেউ বললো, স্যাররা আসার আগে নামা। সবাই আবার সুবোধ বালকের মত ক্লাসে বসে গেলাম। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানে মেটেনি। আমাদের মতিনের ছোটভাই ২ ক্লাস নিচের, এসে দেখিয়ে দিল আমাদের। স্যারেরা তদন্ত করে গার্ডিয়ান ডেকে কাউকে টিসি, কাউকে শাস্তিও দেন। আমাকে প্রচণ্ড ধমকের সাথে সতর্ক করা হয় বাবার সামনে। আর সে অপমানের খেসারত বাবা তোলেন ঘরে এসে। আমি আজীবন এই অপকর্মটার জন্যে আফসোস করে গেছি। যে বন্ধুরা টিসি খেল তাদের জন্যেও খুব আফসোস হত। এমন হঠকারিতা তো প্রতিবাদ নয়। এসব থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।
প্রতিবাদ আমরা প্রায় দেখতাম স্কুলের পাশে দু-দুটো কলেজের ছাত্রদের। আজ মনে নেই, তখন মাঝে মাঝে মিছিল এসে আমাদের পথে ডেকে নিত। আমরাও মিছিলের সাথে সাথে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে যেতাম। ক্লাস নাইনে এসে দেখি খেলাধূলা শক্তিমত্তা বা বুদ্ধিচর্চায় অপারগতাহেতু আমার মধ্যে কবিভাব জন্ম নেয়। সে সময় আবু হেনা মেরশেদ জামান, সুবীর চৌধুরী ও আমি কবিতা লিখছি। আবু হেনার গল্প তখন কিশোর বাংলায় ছাপা হয়। আমরা হাতে লেখা সাহিত্যপত্র বের করতে লাগলাম। হাসনাইন সবিহ্ নায়কও কিছু কিছু লিখত।
হাই স্কুল হয়ে গেছে। আমরা হব এসএসসি-র ৩য় ব্যাচ। শুধু বিজ্ঞান আর মানবিক শাখা খোলা হয়েছে। আমি বিজ্ঞান নিলাম। আবু হেনা নিল মানবিক। এত অসাধারণ মেধাবী ছাত্র—কেবল অঙ্কে কোনওরকমে টেনেটুনে ৩৩ পায়। আবার আমি আজীবন সমাজবিজ্ঞানে ৩৪ এর বেশি পাইনি। দুজনের শাখা আলাদা হলেও সাহিত্যের টানে সম্পর্ক থেকে গেছে ক্লাসের সীমানা ডিঙিয়ে বাড়ির আঙিনায়। একদিন বিজ্ঞানলেখক আবদুল্লাহ আলমুতি শরফুদ্দিন এলেন স্কুল দেখতে। তিনি নাকি এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। হেডস্যার বললেন, ক্লাসে অপর্যাপ্ত জায়গার জন্যে এখনও বাণিজ্য শাখা খোলা সম্ভব হয়নি। শুনে প্রখ্যাত লেখক বললেন, মানবিক শাখাও বন্ধ করে দেন। এসব পড়ে কী হবে!! একবার যাদুকর এসে যাদুও দেখিয়ে গেছে। নাইন-টেনে যখন পড়ি, তখন স্কুলের লম্বা ছেলেদের মধ্যে আমি একজন। এসেম্বলির সময় সবার পেছনে দাঁড়াতে হতো। ফলে শারীরিক কসরত কিম্বা জাতীয় সঙ্গীতের প্রাত্যহিকতা থেকে কিছুটা আড়াল নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠতে পারতাম।
এতক্ষণে অনেকের মনেই এমন ধারণা হয়ে গেছে যে, এই ইশকুলে সবাই কেবল ‘মাইরের’ ওপরই ছিল। আসলে তা কিন্তু নয়। কঠোর শাসনে থেকে ভাল পড়ালেখাই করেছি। সহজাত দুষ্টুমিও থেমে থাকেনি। ওয়াহিদ স্যার ছিলেন ছাত্রবান্ধব, বেশ আন্তরিক ও অমায়িক। স্কুলের মর্যাদা ও ছাত্রদের প্রতি মমতা সব শিক্ষকেরই ছিল। তবে ওয়াহিদ স্যার বেশ ব্যতিক্রম। এমন একটি ঘটনার কথা বলতেই হয় যে ঘটনায় উত্তেজনার আতিশয্য নিয়ে আমরা কেউ কিন্তু মার কিংবা বকা খাইনি।
একবার আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্ণামেন্টে আমাদের স্কুলের খেলা। কাদের বিরুদ্ধে মনে নেই, তবে মনে আছে নাসিরাবাদ স্কুলের মাঠে খেলা হয়েছে। আমাদের স্কুলের ক্ষীণাঙ্গী খেলোয়ারদের যখন প্রতিপক্ষ তুলাধূনা করছিল তখন দেখি ছোটখাট গেইম টিচার ওয়াহিদ স্যার ড্রেস পরে ফেলেছেন। আমাদের বললেন, দেখিস্ তোরা আবার স্যার ডাকিস না। আমরাও প্রবল উৎসাহে চিৎকার করতে লাগলাম— ওয়াহিদ ভাই গোল, ওয়াহিদ ভাই মারেন, ওয়াইদ ভাই জোরে। এমন বলতে বলতে উচ্ছ্বাস সীমা ছাড়িয় গেল। আমাদের কন্ঠস্বর কখন যে খেলার হট্টগোলের মধ্যে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া স্ট্রাইকার ওয়াহিদ স্যারকে উৎসাহ জোগাতে উদ্দীপিত শোর তুলল— ওয়াইদ্যা মার্—মার্ ওয়াইদ্যা মার্। সেদিন গোলও হল, সম্বোধনে গোলমালও হল।