বিষাণ বসু
ফরেন মালের কদরই আলাদা। লেখার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। শুরুতেই কিছু ঝাঁচকচকে দেশের কথা বলে নিলে লেখায় একটা আলাদা ওজন আসে, অন্তত পাঁচটা লোক পড়তে আগ্রহী হন। অতএব, আসুন, একটু মার্কিন মুলুকের গল্প শোনা যাক।
গত শতকের আশির দশক। ম্যাসাচুসেটস-এর ওবাম অঞ্চলের গল্প। স্থানীয় মানুষজন লক্ষ করলেন, এলাকায় বাড়ির বাচ্চারা বড্ডো ভোগে। সর্দি-কাশি-ঠান্ডা লাগা তো আছেই, সঙ্গে বিভিন্ন পেচ্ছাপের অসুখবিসুখ। তার উপরে, বাচ্চাদের মধ্যে রক্তের ক্যানসারে ভোগার সংখ্যাও বাড়াবাড়ি রকমের বেশি।
স্থানীয় স্বাস্থ্যদপ্তর, প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলা হল। কিন্তু, এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, কাজের কাজ কিছু হল না। পাত্তাই দিলেন না কেউ। নিয়তির লিখন বলে চালিয়ে দেওয়া যেত, এবং দেওয়াও হচ্ছিল— কিন্তু, রুখে দাঁড়ালেন একজন মা। তাঁর সন্তানও লিউকিমিয়ার শিকার। তিনি হাল ছাড়লেন না। যোগাযোগ শুরু করলেন লিউকিমিয়ায় ভুগছে, এমন শিশুদের মায়েদের সঙ্গে। শুরু করলেন, তথ্য সংগ্রহ। জন্ম নিল এক আশ্চর্য আন্দোলন।
আন্দাজ করা গেল, যত নষ্টের গোড়া ওই অঞ্চলে সরকারি জল সরবরাহ ব্যবস্থার। কিন্তু, জল থেকে এটাসেটা, পেটখারাপ এসব হয় নিশ্চিত— তাই বলে একেবারে রক্তের ক্যানসার? বাড়াবাড়ির তো একটা সীমা রয়েছে!!
মায়েদের এই নিজেদের মধ্যে খবর চালাচালি, তথ্য সংগ্রহ কিছুদূর এগোলে পাশে এসে দাঁড়ালেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের পাব্লিক হেলথ বিভাগ, কিছু এনজিও। এবং জানা গেল, হ্যাঁ, মায়েরা সঠিক আন্দাজই করেছিলেন। দীর্ঘ এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এলাকার বিভিন্ন কলকারখানা, মূলত চামড়ার কারখানার দূষিত রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য মিশেছে জলে— সেই জল পরিশোধনের পরেও রাসায়নিকমুক্ত হতে পারেনি। অনেক অনেক বছর ধরে সেই দূষিত জল পান করে শরীরে জমেছে রাসায়নিক— বাসা বেঁধেছে রোগব্যাধি— এমনকি ক্যানসারও।
মামলা দায়ের হল। মামলার মাঝপথে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন বিবাদীপক্ষ। কোর্টের বাইরে ক্ষতিপূরণের রফা হল— ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ষাট কোটি টাকায় (আজ থেকে তিরিশ বছরেরও আগের ঘটনা— কাজেই, আর্থিক অঙ্কটা সেই অনুসারে ভেবে নিন)।
***
ফিরে আসা যাক বর্তমানে। দেশের মাটিতে।
তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন অঞ্চলে। নামবদল হয়ে থুতুকুড়ি। তুতিকোরিন বলেই না হয় লিখি এইখানে।
এলাকার মানুষজনের মধ্যে রোগব্যাধির বেশ বাড়াবাড়ি। জ্বর-সর্দি-কাশি-হাঁপানি। না, ক্যানসারের বাড়াবাড়ি এখনও নয়, তবে এমন চলতে থাকলে সে-ও অনিবার্য (দূষিত রাসায়নিক থেকে ক্যানসার হতে অনেক অনেকবছর সময় লাগে, সাধারণত— ক্ষেত্রবিশেষে অসুখে আক্রান্ত হয় পরের প্রজন্ম— দূষণের সরাসরি শিকার যাঁরা, অনেকসময় তাঁরা আর পাঁচটা অসুখে ভুগে মারা যান, ক্যানসার পরিণত হওয়ার সময় পায় না)।
তিরুনাভেল্লি মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ ২০০৬-২০০৭ সালে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে একটি সমীক্ষা করে। রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে।
দেখা গেল, ওই অঞ্চলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যে শ্বাসের অসুখে এবং হাঁপানিতে ভোগার প্রবণতা রাজ্যের বাকি অংশের বাসিন্দাদের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। মেয়েরা ভুগছেন ঋতুস্রাবজনিত সমস্যায়। ক্লান্তি এবং গা-হাত-পায়ে ব্যথার সমস্যাও প্রচুর। জলে আয়রনের পরিমাণ ধার্য মাত্রার তুলনায় প্রায় কুড়ি গুণ।
আরও বিভিন্ন কারখানার সঙ্গে, এলাকার মূল কারখানাটি বেদান্ত গোষ্ঠীভুক্ত স্টারলাইটের। তাম্রশিল্প। সেই কারখানার আশেপাশে থাকছেন যাঁরা, তাঁরা হাঁপানি ছাড়াও ভুগছেন ফ্যারিঞ্জাইটিস বা সাইনাসের সমস্যায়।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, এই সমীক্ষা ২০০৬-২০০৭ সালের। ২০০৭ সালেই স্টারলাইটের কারখানায় উৎপাদন বাড়ানো হয় দ্বিগুণেরও বেশি। দূষণ যদি পাল্লা দিয়ে বেড়ে থাকে, তার প্রভাব এই রিপোর্টে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই।
খুব স্বাভাবিকভাবেই, এমন রিপোর্ট চেপে দেওয়ার চেষ্টা হল। কিন্তু, ঝুলি থেকে শেষমেশ বেড়ালটি বেরিয়েই পড়ল।
প্রত্যাশিতভাবেই, দূষণে আক্রান্তরা জোট বাঁধলেন। আন্দোলনে নামলেন। এবং, প্রত্যাশিতভাবেই, ক্ষমতা তথা রাষ্ট্রশক্তি বিরোধিতা শুরু করলেন।
আন্দোলন জারি থাকে, লাগাতার। ২০১৩ সালে স্টারলাইটের বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ ওঠে— কারখানা থেকে নাকি বিষাক্ত গ্যাস বের হচ্ছে এবং মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। না, অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তামিলনাড়ু সরকার কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ জারি করেন, কিন্তু কোম্পানি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের দ্বারস্থ হয়— রাজ্য সরকারের আদেশটিই খারিজ হয়ে যায়।
কারখানা বন্ধের নির্দেশ জারি অবশ্য এক্ষেত্রে নতুন নয়। ২০১০ সালেও চেন্নাই হাইকোর্ট দূষণের ব্যাপারে যথাবিহিত ছাড়পত্র না থাকার কারণে স্টারলাইটের কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। এবং, বছর তিনেকের মধ্যেই মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্ট, দূষণের ব্যাপারে নির্দেশ অগ্রাহ্য করা, প্রয়োজনীয় অনুমতি না নেওয়া এবং পরিবেশ দূষণের কারণে কোম্পানিকে অভিযুক্ত করেন— দূষণ-আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানির জরিমানা ধার্য হয় একশো কোটি টাকা (প্রসঙ্গত, কোম্পানির বার্ষিক লাভের অঙ্কটি এক হাজার কোটি টাকারও বেশি)। কিন্তু, সেই একই নির্দেশে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত “বৃহত্তর স্বার্থে” কারখানা বন্ধ করার হাইকোর্টের নির্দেশটি খারিজ করেন।
স্টারলাইটের কারখানার আশেপাশে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের বাস। ভয়াবহ দূষণের শিকার তাঁরা। মান্নার উপসাগরীয় বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ কারখানার অতি নিকটে— দূষণের কুপ্রভাব সেখানেও। কিন্তু, এদেশে “বৃহত্তর স্বার্থ” শব্দবন্ধটি কিঞ্চিৎ গোলমেলে।
***
গতবছর, মানে দুহাজার আঠেরো সালের মে মাসের বাইশ তারিখ। কয়েক হাজার মানুষ প্রতিবাদে সামিল হন। সরকার আগেভাগেই ১৪৪ ধারা জারি রেখেছিলেন। সমবেত প্রতিবাদে নির্বিচারে লাঠিচার্জ করেন স্থানীয় পুলিশ। নিরস্ত্র মানুষ ইঁটপাটকেল ছুঁড়ে বিক্ষোভ জানাতে গেলে নেমে আসে বুলেটের বৃষ্টি।
সরকারিভাবে, তেরোজন মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবী, সংখ্যাটা আরও অনেক অনেক বেশি।
এক পরিবেশ-কর্মী ভিডিও প্রকাশ করে জানান, গুলিচালনার পরিকল্পনা তৈরি ছিল আগে থেকেই। এবং, এই পরিকল্পনার সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা জড়িত।
প্রমাণ হয় না কিছুই। শুধু সেই পরিবেশ-কর্মী মাদুরাই থেকে চেন্নাই যাওয়ার পথে, ট্রেন থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। এইটুকুই।
***
দূষণের প্রকোপে স্থানীয় মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। উত্তরে স্টারলাইট কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে জানান, হ্যাঁ, মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ঠিকই। কিন্তু, কারখানা থেকে দূষণের জন্যেই কিনা, সে তো প্রমাণ হয়নি এখনও।
হ্যাঁ, প্রমাণ। প্রমাণ, বৃহত্তর স্বার্থ কথাগুলো বড় জটিল। কর্পোরেট কোম্পানিদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকে একারণেই। কেননা, এদেশের বিচারব্যবস্থায়, (নাকি বিশ্বের সর্বত্রই?) প্রমাণ করে ওঠা দুষ্কর। বছরের পর বছর মামলা চলতে থাকে— আক্রান্তরা মরেহেজে ভূত হয়ে যান— বদলে যায় কোম্পানির সিইও-র মুখ— দুঁদে উকিলেরা কোম্পানির হয়ে সওয়াল করেন, করেই চলেন— শেষমেশ রায় আদৌ বেরোয় কিনা, কে জানে!!
ভূপালে গ্যাস দুর্ঘটনার পরে, কয়েক দশক বাদেও, মানুষ ভুগছেন নানাবিধ অসুখে। জিনজনিত অসুখবিসুখের ঘটনাও সামনে আসছে ক্রমশ। কোম্পানি জানিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদি এইসব কুপ্রভাব যে তাঁদেরই কোম্পানির বিষাক্ত গ্যাসের কারণে, প্রমাণ কই?
ইউনিলিভার কোম্পানির থার্মোমিটার বানানোর কারখানায় শ্রমিকেরা যখন ভোগেন পারদ-দূষণের পরিচিত উপসর্গে— কোম্পানি জিজ্ঞেস করেন, প্রমাণ কোথায়?
নিঃশ্বাসে সিমেন্টের গুঁড়ো নিয়ে সিলিকোসিসে ধুঁকতে থাকা মজুরকেও একই প্রশ্ন শুনতে হয়। সবই তো হল, কিন্তু, প্রমাণ কই!!
ধূমপানের বিষ নিয়ে, ধূমপান যে বিপজ্জনক সেই বিষয়ে হাজার তথ্য পাওয়ার পরেও— তামাক কোম্পানির মুখে ছিল সেই একই কথা— হ্যাঁ, সন্দেহজনক মনে হলেও, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে কি? তামাক ইন্ডাস্ট্রির এক বড় কর্তা মোক্ষম কথাটি বলেছিলেন একান্তে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রির আসল প্রোডাক্ট কী জানেন? সংশয়। ধন্দ। হ্যাঁ, এই যে ধোঁয়াশা, তামাকে ক্ষতি হয় কি হয় না, সেইটাই আমাদের আসল কৃতিত্ব— এবং আমাদের বড়সড় বিনিয়োগ রয়েছে এই ধোঁয়াশা তৈরির পেছনে।
তামাক ইন্ডাস্ট্রির সেই ধোঁয়াশার দিন অতীত। কিন্তু, যুক্তিগুলো নয়।
***
পরিবেশ দূষণ, বা সেই দূষণের কারণে অসুখবিসুখ নিয়ে আলোচনার পথে প্রধান সমস্যা হল, প্রায় সবক্ষেত্রেই, সেই দূষণ বা পরিবেশ ধংসের পেছনে থাকে কোনও প্রভাবশালী মহল— বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেট। এবং সেই কর্পোরেট শক্তি রাষ্ট্রশক্তি ইদানিং মিলেমিশে একাকার।
তাঁদের কোম্পানির ক্রিয়াকলাপে মানুষ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন— এর উত্তরে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মেলে— অবজ্ঞা। তারপর, সংশয়। প্রমাণ করা যাচ্ছে কি? প্রমাণ হলেও, সামান্য দু-দশহাজার, বা দু-চার লাখ মানুষের কথা ভাবতে গিয়ে আহত হবে না তো বৃহত্তর স্বার্থ?
অসুখবিসুখের পেছনে পরিবেশ দূষণের প্রভাব— সেই নিয়ে গবেষণা, ইদানিং, কম। কম, কেননা, আর পাঁচটা বিজ্ঞান গবেষণার মতোই, চিকিৎসা গবেষণাও ব্যয়বহুল এবং সেই অর্থ জোগান দেয় বৃহৎ পুঁজিই— যে পুঁজি আবার কারখানা চালায়। অতএব, কোম্পানির ছড়ানো দূষণে জনসমষ্টি অসুস্থ হচ্ছেন৷ এমন প্রমাণ মেলার সম্ভাবনা কমছে ক্রমশই।
বরং, দূষণজনিত অসুস্থতা নিয়ে গবেষণার চাইতে অসুখের পেছনে জিন-এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা বেশি। মানে, অসুখবিসুখের কারণটি বাইরে নয়, শরীরের মধ্যেই খোঁজা— নিরাপদ, কেননা বহুজাতিক মুনাফায় টান পড়ার ঝুঁকি থাকল না। দূষণের কারণে জিনের বদল এলেও, ঠিক কোন রাসায়নিক বা কার্সিনোজেন আনল সেই বদল, সে খুঁজে দেখার প্রয়াসও অধুনা অনুপস্থিত। আর, দূষণের প্রভাবে এক জায়গায় অনেক মানুষ রোগবালাইয়ে ভুগছেন, এমনটা সামনে এসে পড়লে প্রমাণের পরিবর্তে বিভিন্ন অবান্তর তথ্য দিয়ে সংশয় তৈরি করে পুঁজিকে দায়মুক্ত করে ফেলার চেষ্টা হয়।
তাহলে, শুধুই অন্ধকার? উত্তরণের পথ নেই?
***
ম্যাসাচুসেটস-এর ওবাম অঞ্চলের গল্প দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। না, উদ্দেশ্যটা শুধুই তাক লাগিয়ে দেওয়া ছিল না। বা, ওদের ওই সোনার দেশ বনাম আমাদের এই নৈরাজ্য, এমনটাও তুলে ধরতে চাইনি। মনে রাখবেন, ওবাম-এর মানুষদের লড়াইটাও সহজ ছিল না।
উদ্দেশ্যটা ছিল এটুকুই বলার, যে, এদেশ কিম্বা ওদেশ— পরিবেশ দূষণে আক্রান্ত সাধারণ মানুষ— শরীরে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন ব্যধি। সেই দূষণের কারণ, প্রায় সর্বত্রই, দায়িত্বজ্ঞানহীন শিল্প। কখনও চলছে নদী-বনাঞ্চল-পরিবেশ ধ্বংস করে শিল্পস্থাপন— কখনও বা সেই শিল্পের বর্জ্য বিষিয়ে দিচ্ছে আপনার-আমার নিঃশ্বাস নেওয়ার বাতাস, খাবার বা পানীয় জল। অনিবার্যত অসুস্থ হলেও সুরাহার পথ সহজ নয়।
তিন দশকেরও আগে, প্রথম বিশ্বের দেশে, লিউকিমিয়ায় ভোগা শিশুদের মায়েদের অভিযোগে কান দেননি কেউ। মায়েরা যখন আঙুল তুলেছিলেন পানীয় জলের দিকে— উত্তরে এসেছিল হাসিঠাট্টা— সংশয়— জল থেকে পেটখারাপ নয়, একেবারে ব্লাড ক্যানসার!!! মায়েরা দমে যাননি— সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিলেন, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়েছিলেন। মাঝপথে সঙ্গে পেয়েছিলেন জনস্বাস্থ্য-গবেষক এবং একশ্রেণির চিকিৎসককে। লড়াই সহজ ছিল না।
কঠিন লড়াই কঠিনতর হয়েছে মাঝের এই কয়েক দশকে। রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে বৃহৎ পুঁজির হাত মেলানো ছিল চিরকালই। কিন্তু, কর্পোরেট শক্তিই বকলমে রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার আসন নিয়েছেন ইদানিং। কাজেই, দূষণে আক্রান্তরা সংগঠিত হলে নেমে আসতে পারে রাষ্ট্রের বুলেট।
আর, এই রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের কাজটা সহজ হয়েছে, কেননা, আমাদেরকে করে তোলা গিয়েছে সংশয়ের শিকার। কীভাবে?
***
আগে বলছিলাম, তামাকশিল্পের বড় কর্তা বলেছিলেন, তাঁরা শেষমেশ যা উৎপাদন করেন, তা ওই সংশয়। তাঁদের মাইনে করা বিজ্ঞানীদের টিম রয়েছেন, যাঁরা তামাক আদতেই ক্ষতিকর কিনা, সেই নিয়ে সংশয় তৈরি করেন।
সেসব অনেক বছর আগের কথা। এখন এই হাইটেক দুনিয়ায় সংশয় উৎপাদনের জন্যে শুধু বিজ্ঞানীদের উপর ভরসা করলে চলবে কেন!! বিজ্ঞানীরা আছেন, সঙ্গে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ, মাথার উপরে রয়েছেন সর্বময় মিডিয়া।
কাজেই, কলকারখানা থেকে দূষণ ছড়াচ্ছে— লাগু হোক কড়া নিয়মবিধি— এর উত্তরে প্রাথমিকভাবে যে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়, সেইটা— ইকোলজি বনাম ইকোনমি।
খেয়াল রাখুন ওই বনাম শব্দটির উপরে। পুরো শব্দবন্ধের দ্যোতনা— এই ইকোলজি আর ইকোনমি যেন যুযুধান প্রতিপক্ষ— যেন দুপক্ষের মধ্যে মুখদেখাদেখি বন্ধ। অর্থাৎ, যেন ইকোলজি-পরিবেশের কথা ভাবতে গেলে তা হতেই হবে আর্থিক উন্নয়নের বিনিময়ে আর বিপরীতে, পরিবেশকে শিকেয় না তুললে যেন অর্থনীতির বিকাশ অসম্ভব। অর্থাৎ আপনি যদি ইকোনমি বা আর্থিক বিকাশের পক্ষে হন, কিছুতেই আপনি পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে হতে পারেন না। (ঠিক যেমন, এক দশক আগেই এই রাজ্যে লড়াই হয়েছিল, কৃষি বনাম শিল্প— আপনি যদি কৃষি-কৃষকের অধিকার নিয়ে কথা বলতে চান, তাহলে আপনি অনিবার্যভাবেই শিল্পবিরোধী— আপনি যদি শিল্প চান, তাহলে আপনাকে মাড়িয়ে যেতেই হবে কৃষকের অধিকার।)
হ্যাঁ, খেয়াল করুন, মিডিয়ায়, বিতর্কসভায় এই মূল সুরের হাজারো প্রকাশ শুনতে শুনতে আপনি, আপনার চিন্তাধারা সবই এই বাইনারির অংশ হয়ে গিয়েছে— হয় আপনি আর্থিক উন্নয়নের পক্ষে, নয় আপনি পরিবেশের পক্ষে— দুটো একইসঙ্গে সম্ভব নয়। সুস্থ পরিবেশ যে দীর্ঘমেয়াদে নীরোগ নাগরিকসমাজ এবং ফলত সুঠাম অর্থনীতির অনুকূল— এই সহজ যুক্তির অবতারণা করছেন না কেউ।
আর হ্যাঁ, বৃহত্তর স্বার্থের গল্পটাও থাকছে। কয়েক হাজার আদিবাসী উচ্ছেদ করে কারখানা হলে, বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষিত হবে— চাকরি পাবেন দুশো কি পাঁচশো মানুষ। অনিয়ন্ত্রিত কারখানার দূষণে আক্রান্ত হবেন কয়েক লক্ষ। গাছ কেটে বদলে যাবে এলাকার বাস্তুতন্ত্র— বৃষ্টি সরে গিয়ে চাষবাস হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হবেন আরও কয়েক লক্ষ। সে যাক গে— বৃহত্তর স্বার্থটুকু রক্ষিত হলেই হল!! (প্রসঙ্গত, শিল্প নিঃসন্দেহে অবশ্যপ্রয়োজনীয়— দূষণ নিয়ন্ত্রণে কড়া নিয়মবিধি প্রযুক্ত হলে পরিবেশ বাঁচিয়ে, গাছ বাঁচিয়েই শিল্প সম্ভব— শুধু সদিচ্ছে আর সচেতনতাটুকু জরুরি)।
বড় সুবিধে একটাই। সমাজের বৃহত্তর অংশকেই অপর এবং ইনভিজিবল করে দেওয়া গিয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, কয়েক লক্ষ মানুষ দূষণের চোটে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন— কিন্তু, এই বিপুল সংখ্যক মানুষ বৃহত্তর স্বার্থের অঙ্কে ঠাঁই পাচ্ছেন না। এঁদের বেঁচে থাকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে পরিবেশের প্রশ্ন জড়িত— কিন্তু, যেহেতু আপনি এঁদের নিয়ে ভাবতে চাইছেন না, আপনি পরিবেশ নিয়েও ভাবিত নন। প্লাস, এর সুবাদে, পরিবেশ নিয়ে যাঁরা ভাবেনটাবেন, তাঁদেরকেও আপনি ভাবছেন ওই প্রাচীনপন্থী বা দাও-ফিরে-সে-অরণ্য-লও-নগর-টাইপের হাহুতাশবাদী।
***
শেষমেশ কী দাঁড়াল তাহলে? দেশের বৃহত্তর অংশ এক অসামান্য ম্যাজিকে বৃহত্তর স্বার্থের হিসেবের অন্তর্ভুক্ত নন। কিন্তু, আপনি কি বেঁচে যাচ্ছেন?
আপনি ধূমপান এড়িয়ে চলেন। টিভিতে এবং সিনেমাহলে নিরন্তর চোখে পড়ে ধূমপান-বিরোধী প্রচার। কিন্তু, আপনাকে কেউ জানায়ও না, সিগারেটের বিক্রি কমলেও, দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও, ফুসফুসের ক্যানসারে লাগাম টানা যাচ্ছে না। না, আপনি ভাবতে শেখেননি, যে, বছরভর লেগে থাকা কনস্ট্রাকশনের কাজ, সিমেন্টের ধূলো বা ক্রমবর্ধমান গাড়ির ধোঁয়া বা শিল্পাঞ্চলের বিষাক্ত বাতাসটাও ক্যানসারের কারণ।
আপনি যথাসাধ্য নিয়ম মেনে চলেন। মেপে খান। বেশি করে ফল-সব্জি খান। রং আছে, এমন খাবার এড়িয়ে চলেন। আপনার মতো আরও অনেকেই এমন তথাকথিত স্বাস্থ্যসচেতন হওয়া সত্ত্বেও, অন্ত্রের ক্যানসার, পিত্তথলির ক্যানসার, মূত্রথলির ক্যানসার বেড়ে চলেছে— বেড়েই চলেছে। না, আপনি জানতে চেষ্টা করেননি, খাবারে পানীয় জলে অনর্গল মিশছে রাসায়নিক— সরাসরি শিল্পের সুবাদে, বা তার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে। আপনার বাড়ির হাইটেক ওয়াটার পিউরিফায়ারের সাধ্য নেই সেই রাসায়নিক থেকে আপনাকে রক্ষা করার।
ট্যানারি থেকে শহরে দূষণ ছড়াচ্ছে। সে ট্যানারি সরে গেল শহরের বাইরে। বেশ কথা। কিন্তু, শহরের বাইরে হলেও সেই দূষণের সুরাহা হচ্ছে কি? দূষিত বর্জ্য মিশছে যে ভেড়ির জলে, সেই ভেড়ির মাছ আসছে না তো আপনার আমার খাবার পাতে? রেড মিট ছেড়ে স্বাস্থ্যকর যে শাক-সব্জিতে আপনি ভরিয়েছেন খাবার থালা, মিশে নেই তো দূষিত রাসায়নিক তার মধ্যেও? শহরের প্রান্তে যে আশ্চর্য ইকোসিস্টেম রয়েছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি— যার জুড়ি নেই সারা বিশ্বের আর কোথাও— সেই জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেলে তার কেমন প্রভাব পড়বে আপনার শরীরে? স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, নিয়মিত হেলথ চেক-আপ মেনে স্বাস্থ্যরক্ষা হবে তো?
***
তাহলে?
একটু বুঝুন, পরিবেশ বিষয়টা কোনও তাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় নয়। হ্যাঁ, ব্যাপারটাকে ওরকম ওসব-বড়দের-ব্যাপারস্যাপার-আমাদের-মাথা-ঘামিয়ে-লাভ-নেই করে রাখলে নিস্তার নেই। পরিবেশ ব্যাপারটা একেবারে আপনার বাঁচামরার সঙ্গেই জড়িয়ে, ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। কায়েমি স্বার্থ আপনাকে উল্টোটা ভাবাতে চাইবে— ভাবাতে চাইবেই, উন্নয়ন, আর্থিক উন্নয়নের কথা ভাবতে হলে পরিবেশ ফেস নিয়ে ভাবলে চলবে না— আপনাকে শেখাবে, বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবুন, পরিবেশ নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়, সব উন্নত দেশ এমন করেই এগিয়েছে, এরা পরিবেশের ধুয়ো তুলে দেশকে সুপারপাওয়ার হতে দিচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই ধোয়াঁশার চাদর সরিয়ে আপনাকে সত্যির মুখোমুখি হতে হবে। দেরি হয়ে গিয়েছে— কিন্তু, এখনও শুরু করা যায়। ভেবে দেখুন, পরিবেশ না বাঁচলে আপনি কি বাঁচবেন? সুস্থ থাকবেন? বৃহত্তর স্বার্থ মানে ঠিক কার স্বার্থ? প্রকৃত অর্থেই যা বৃহত্তর স্বার্থ, তা ঠিক কোন পথে রক্ষা করা যেতে পারে?
আর পাঁচটা অধিকারের মতো সুস্থ পরিবেশ— রাসায়নিকমুক্ত খাদ্যপানীয়, দূষণহীন বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া— সেই সুস্থ পরিবেশে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা আপনার অধিকার। শুধু আপনার নয়, এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মানবসন্তানের অধিকার— কারও একটু বেশি বা কারও কিছু কম নয়।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যটা হল, আর পাঁচটা অধিকারের মতোই, এই অধিকারও কেউ আপনার সামনে সাজিয়ে দেবে না। এই অধিকারও আপনাকে রীতিমতো আদায় করে নিতে হবে। সেই অধিকার অর্জনের লড়াই থেকে আপনার নজর সরিয়ে রাখতে, আপনাকে এর যাথার্থ্য বিষয়ে সংশয়ী করে রাখতে জারি আছে বিশাল এক নেটওয়ার্ক। এই সংশয়ের চাদর ছিঁড়ে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার দায় আপনার— একেবারে নিজের স্বার্থেই। বলতে পারেন, না, শুধুই বৃহত্তর স্বার্থে বা কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে নয়— স্রেফ নিজের ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ, নিজের সন্তানের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে চাইলেও পরিবেশ নিয়ে আপনার ভাবা জরুরি।
তাহলে আর কী ভাবছেন? আসুন, শুরু করা যাক। আজ থেকেই। এখুনি।