শিল্পী

আনসারউদ্দিন

 

 

শিল কোটাবেন শি-ল। শিল কোটাবেন শিল। শিলের উপর রামমন্দির বাবরি মসজিদের ছবি আঁকা হয়। লোকটা হাঁকল, আবার হাঁকল। গলাটা প্রায় কলার মোচার মতো ফুলে উঠছিল। এই উদাস দুপুরে তার রব প্রতিটি বাড়িতে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছিল। লোকটা হাঁকছিল আর হেঁটে যাচ্ছিল। খালি পা। পরনে শতেক রকমের তালিমারা প্যান্ট। বোতামহীন। দড়ি দিয়ে কোমরের সঙ্গে আটকানো। মুখের উপরের পাটির কয়েকটা দাঁত নেই। রোদে জলে সেদ্দ হয়ে শরীর তামাটে। গায়ের জামাটা বোধহয় শ্মশান থেকে কুড়িয়ে নেয়া। পিঠ বরাবর ছিঁড়ে বাতাসে হগলবগল। কনুই থেকে একটা হাতা নেই। কাঁধে ঝোলানো ঘোড়া রঙের ঢোলা ব্যাগ। কপালের মাঝখানে ডাবের মতো মস্ত আব। মোট কথায় চেহারাটা অদ্ভুত। এই অদ্ভুত চেহারার মানুষটাকে একবার দেখলে চিনে নিতে কষ্ট হয় না। মাথার প্রায় তাবৎ চুল কপালের উপর থেকে উড়ে পালিয়েছে হয়তোবা কোনও ঝোড়ো বাতাসে। বাদবাকি চুলগুলো পেছনের পাড় ধরে ঝুলছে। মুখে গুটি বসন্তের অসংখ্য ছোট ছোট গর্ত। এক পলক তাকিয়ে দেখলে মনে হয়, ওর সারা মুখের উপর একসময় রীতিমতো ঝড়-বৃষ্টি বয়ে গেছে।

কয়েকটা কুকুর এ গলি ও গলি থেকে বেরিয়ে এল ঘেউ ঘেউ করে। তাদের ডাকাডাকিতে আরও কিছু। লোকটা একবার থমকে দাঁড়াল। পায়ের তলার তপ্ত ধুলোয় পুড়ে যাচ্ছিল তার পা। হিংস্র কুকুরগুলোর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিটাকে সে যাচাই করতে চাইল। বুঝল, প্রভুভক্ত এই কুকুরগুলোর আর যাই হোক জাতিভেদ ধর্মভেদ নেই। বাঁ কাঁধের ঝোলায় এক হাত রাখতেই নিজেকে কিছুটা মুক্ত করতে পারল। আরও কয়েক পা কুকুরের শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে হাঁক দিল— শিল কোটাবেন— শিল। শিলের উপর—

–দাঁড়াও, ওগো কোটাই মিস্ত্রি। একজন মাঝবয়েসি বনেদি বাড়ির বউ বেরিয়ে এল।
–শিল কোটাবেন মা?
–হ্যাঁ। তা নয়তো কী জন্য ডাকা! শিলই কোটাব আমরা।
–আপনারা ক ঘর?
–আমরা তিন ঘর। তিনটে শিল।
–আর কেউ কোটাবে না?
–বাটনাবাটা কাজ যখন কোটাবে বই কি? পথের ওপাশে মিয়াপাড়া।
–আপনাদের গাঁয়ে হিন্দু মোছলমান দুইয়েরই বাস?
–হ্যাঁ। দু জেতের মানুষ দু পাড়াতে বাস করে। এ পাড়া ও পাড়া মন্দির মসজিদ। এই দুপুরে কুথায় বা যাবে। শিল যদি কোটাও তবে সামনে ওই অশথতলায় বসো। হ্যাঁগো কোটাই মিস্ত্রি, শিলের গায়ে সত্যি সত্যি রামমন্দিরের ছবি আঁকা হয়?

–হ্যাঁ মা। আগে তো শিলের গায়ে লতাপাতা ফুল প্রজাপতির ছবি আঁকতাম। পানপাতা পরীদের ছবি আঁকতাম। এখন ওসব চলে না। দিনে দিনে দিনকাল সব পালটে যাচ্ছে। মানুষের নতুন করে ধর্মে মতি ফিরছে। রামমন্দির বাবরি মসজিদ সব আঁকি। সেই একই হাত একই ছেনি-হাতুড়ির কারসাজি। যার যা পছন্দ। যান, এবার শিল আনেন। আপনার থেকে এ বেলাটার যাত্রা শুরু করি। আচ্ছা মা, একটু জল পাওয়া যাবে? লোকটা করুণ মুখে নিঃশব্দ হাসল। যা রোদের তাপ, পথ নয় তো খোলা হাঁড়ি! এক মুঠো চাল ফেলুন, সঙ্গে সঙ্গে মুড়ি। যা ডাকাতি খরানি।– বলে পথের ধারে বনের উপর পা ঘষল। হয়তো বা একটু আরাম পেল। কপালে গুচ্ছেক ভাঁজ ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। বলতে গেলে তখনই চোখ নামাল। ডান হাতের তর্জনী আঙুলে রগ ও কপালের ঘাম দুয়ে ফেলে অশথ গাছের দিকে এগিয়ে যেতেই একটা কাঠবেড়ালি গুঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে উপরে উঠে গেল। ছায়ায় নিশ্চিন্তে শুয়ে জাবর কাটতে থাকা কাদের গাইগরু হঠাত করে দড়ি ছিঁড়ে ছুটে পালাল। কেমন যেন ধন্দে পড়ে যায় লোকটা। অচেনতো গাঁয়ে গেলেই কুকুর লাগে। গরু ফ্যাসকায়। কাচ্চাবাচ্চা আচমকা ডরিয়ে কেঁদে উঠলেই লোকে ভাবে ছেলেধরা। এমন বেকায়দায় ঘাপটি মেরে প্রাণ বাঁচানো। এই ঝনঝনে বন্ধ্যা দুপুরে তেমন কোনও বালবাচ্চা চোখে পড়েনি। যাক, বাঁচা গেল।

অশথ গাছে ঝিমোনো ছায়ার নীচে বসল লোকটা। বাঁদিকের জামার হাতায় মুখের ঘাম মুছল। ওপাশে পালানো গরুর ছেঁড়া দড়িটা শেকড়ে ঝুলছে। পাতার আঁজলা বেয়ে নেমে আসা ঘন কালো ছায়ার মাঝে ইতিউতি আততায়ী রোদ। আশেপাশে কয়েক তাল গোবর। চোনামাটি। তার উপর ভাঙা ভাঙা খুরের ছাপ।– কই মা, এনেছেন? উপরের পাটির ঝুলে থাকা দাঁত খামচে লোকটা বলে উঠল।

–হ্যাঁ এনেছি। ভরদুপুরে জল চাইলেই কি মানুষকে শুধু জল দেয়া যায়? এই নাও ছোলা আর চালভাজা। বড় বউ ভাজলে আস্ত করে। তুমার আবেস্তা দেখে বললাম, দাও গুঁড়ো করে। মাড়িতে জোর পাবে না।
–তা ভালোই করেছেন। এমন করে কজন ভাবে বলুন? বলে ফোকলা মুখে হাসল লোকটা। কব্জি অব্দি ধুলো রেখেই চাল আর ছোলাভাজা মেখে গোগ্রাসে খেল। খেল না তো গিলল। সেই সঙ্গে কয়েক গিলাস জল। কোটরে বসে যাওয়া ঘোলাটে চোখ দুটো এতক্ষণ পর জেগে উঠল। দুপাশের গাল নাক মুখ জুড়ে এক চাপা প্রসন্নতা। কষে যাওয়া কোমরের বাঁধনটাকে আলগা করে আঃ বলে পরিতৃপ্তির ঢেকুর এমনভাবে তুলল যেন এতক্ষণ ওই দড়িতেই খিদেটাকে বেঁধে রেখেছিল। একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান মেরে বলল— আর দেরি করে লাভ নেই। আমাকে তো পাঁচ জায়গা চরে খুঁটে খেতে হবে। যান বাড়িতে সব খবরা-খবর করুন।

মাঝবয়েসি স্ত্রীলোক থালা গেলাস নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। লোকটা এবার আরও তেজালো গলায় একবার হিন্দু পাড়া একবার মুসলমান পাড়ার দিকে মুখ করে হাঁক দিল— শিল কোটাবেন শিল। শিলের উপর রামমন্দির বাবরি মসজিদের ছবি আঁকা হয়।

এ-পাড়া ও-পাড়ার গলি বেয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল নানান বয়েসি বউ-ঝি। কারও পরনে আলতা-পেড়ে, কারও বা পাছাপেড়ে। প্রত্যেকের কাঁখে মাথায় শিল। শিল নয় যেন টুকরো টুকরো পর্বত নিয়ে ছুটছে সব। কেউ বলে রামমন্দির, কেউ বলে বাবরি মসজিদ।

অত হইচই করলে হবে না। আস্তে আস্তে নামান। পায়ে পড়লে আদা ছেঁচা হয়ে এখনই রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটবে। মন্দির মসজিদ দুদিকে লাইন লাগান।

নির্দেশমতো কাজ হল। অশথ গাছের দুদিকে বেশ কিছু শিলের লাইন। আরও আসছে। মাঝেমধ্যে ধুপ ধাপ। একটা ঘুঘু আচমকা বাসা ছেড়ে উড়ে পালাল। মধ্যিখানে লোকটা চটের থলে পেতে বসে গেল। বুক পকেট থেকে একটা মোটা কাচের চশমা চোখে পরতেই চেহারাটা আমূল বদলে গেল। হাতে এখন ছেনি-হাতুড়ি। ও দুটো কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে উঠল। তারপর বললে, কোনটা আপনার?

–আমার?
–হ্যাঁ আপনার। বলেছি তো আপনারটা থেকে এ বেলার যাত্রা করব।
–আমার তো তিন ছেলে। তিনটে বউ আপন আপন শিল এনেছে! মাঝবয়েসি স্ত্রীলোক কেমন ফাঁপড়ে পড়ে যায়। নিজের বলতে কিছুই নেই। সবই ওদের নিয়ে থুয়ে। কাকে সত্যি কাকে পথ্যি করি বাবা?
–তিনটে শিল যখন তিন ছেলেই আলাদা। তাহলে বড় বউয়ের শিল আগে কোটাই। চাল ছোলা ভেজে বড় বউ তো ভোখ মেটালে।

তিন বউয়ের মধ্যে দুটো বউয়ের হাত শিলের গা থেকে শিথিল হয়ে পড়ল। বড় বউ শিলটাকে সামনে ধরলে। রামমন্দির।

ঠক ঠক শব্দ উঠে আসতে লাগল। সামনে রামমন্দিরের জন্য বিঘত খানেক জায়গা রেখে শুরু হল শিল কোটানো। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত আড়াআড়ি এক সুচারু বুনুনি। ছেনির সঙ্গে হাত, হাতের সঙ্গে হাতুড়ির এক অপূর্ব সমন্বয়। অদ্ভুত শিল্পায়ন। প্রতিটি আঘাতে আঘাতে উঠে আসে টুকরো টুকরো ধাতব সংলাপ। ছড়িয়ে পড়ে এতদিনের ঝাল মশলার ঝাঁঝ। মুখে কাপড় গুঁজে হেঁচে নেয় বড় বউ। দেখে কঠিন শিলার উপর কীভাবে ক্ষণে ক্ষণে তৈরি হচ্ছে সমান মাপের গর্ত। গর্ত তো নয়, যেন গুটিবসন্তের দাগ। অবিকল লোকটার মুখের মতো।

–এভাবে ঝুঁকবেন না মা, একটু তফাতে বসুন।
–ওটা আমার বড় বউ গো কোটাই মিস্ত্রি। প্রতিবাদের সুরে মাঝবয়েসি বলে উঠল।

–আপনার বড় বউ? তাহলে তো আমার বউদি; হ্যা-হ্যা। হাতের হাতুড়ি থামিয়ে নতমুখে হাসল লোকটা। আজকাল সব কিছু স্মরণে থাকে না। তা মেয়েরা তো মায়েরই জাত। এমন আর খারাপ বললাম কী! কাজের সময় শিলের সামনে হ্যাপা মেরে বসে থাকা ভালো নয়, বুঝলেন? টুকরো টাকরা পাথর ছিটকে চোখে ঢুকলে সর্ব্বোনাশ। এই যে চোখে চশমা দেখছেন, ওটা ওজন্যিই পরা। তাছাড়া সব কাজে একটা ধ্যান থাকে। এভাবে চারপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মারলে আর গায়ের উপর গরম গরম নিঃশ্বাস ফেললে কাজে মর্জি টুটে। চশমার কাচ ফুঁড়ে ভাসা ভাসা চোখে বড় বউয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে শিল্পী হাতটা উঠে গেল শিলের উপরে।

মৃদু গুঞ্জন ফিসফাস। জয় ছিরাম। লোকটা দুহাত একসঙ্গে কপালে ঠেকাল। দেখল, শিলের ওপর নোড়ার ঘর্ষণে খয়ে যাওয়া অস্পষ্ট পানপাতা। হাতের ছেনিটা আবার চঞ্চল। এবার শব্দ নয়, যেন কতকগুলো খুচরো শব্দের মাদকতা। চারিদিকে বিস্ফারিত মেয়েলি চোখের চাহনি। হাতুড়ির প্রতিটি আঘাতে গড়ে ওঠে আশ্চর্য ইন্দ্রজাল। অদ্ভুত ভাস্কর্য। একটু একটু করে মুছে যেতে থাকে পানপাতা। রামচবুতরা থেকে জেগে ওঠে রামমন্দির। তার বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ। দালান দরজা। ছোট বড় নানান আকারে চূড়া। সর্বোচ্চ চূড়ায় উড়ছে এক গেরুয়া পতাকা।

সলজ্জ মুখে বড় বউ জিজ্ঞাসা করল, কত নেবে?

–নেবার কথা কী বলব বউদি! আপনারে বিনি পয়সাতেই দিতাম। কিন্তু বউনি বলে কথা। দেবেন আর কী। এই একপালি চাল আর পাঁচসিকে পয়সা।
–আগে তো একপালি চালে শিল কুটেছি, এখন আবার পয়সা কেনে? ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা মুখফোঁড়ে বউ বলে উঠল।
–অন্যায় দাবি তো করিনি। ওটা ওই মন্দিরের মানত আর মসজিদের সেলাম। ভক্তি ভরে দিলে দেবেন। না দিলে আমার কী, পরকালের পাপের দায়ে ঠেকলে আপনারাই ঠেকবেন। তবে হ্যাঁ, এখন কেউ চাল টাকা পয়সা দেবেন না। কেউ শিল নেবেন না। আজকালকার মানুষের মন বড় খুঁতখুঁতে। সবাই ভাবে আমার কাজটা বুঝি ফাঁকি দিলে। একই হাত একই ছেনি-হাতুড়ি দুরকম কেন হবে? দশের সামনে পরপর সাজিয়ে রাখছি মিলিয়ে নিন। কাজ শেষে নিজের নিজেরটা নেবেন। এতে আমারও ঝঞ্ঝাট কমে। একবার পালি মাপা। পয়সা গোনা।

খুলে আসা বাঁ হাতের হাতাটা গুটিয়ে ডান হাতের শিলের গাদায় হাত রাখল লোকটা। এতক্ষণে ঝিম মেরে বসে থাকা মুসলমান পাড়ার মেয়ে-বউরা কলবলিয়ে উঠল। বিবিদের মধ্যে একজন বললে, হ্যাঁগো কোটাই মিস্ত্রি, তুমার আর কোনও যন্ত্রপাতি নেই?

–কেন? এ যন্ত্রপাতির অপরাধ কুথায়? হাতের ছন্দ থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
–ওটা দিয়ে তো ওদের কোটালে। আমাদের হাজিসাহেব কানে শুনলে গোসা করবে। বড় ইমানদার মানুষ যে।
–ও! আপনি হাজিসাহেবের পরিবার বুঝি?
–হ্যাঁ বাবা। শাদিতে ওর সঙ্গেই কলমা পড়িছি।
–আমার একটাই যন্ত্রপাতি মা। আপনাদের দোয়ায় এতেই করে খাচ্ছি।
–তবে দাঁড়াও। বাড়ি থেকে জমজমের পানি আনি। ওতে ধুয়ে পাক সাফ করে কাজ চালাও।
–জমজমের পানি? মক্কার! সে তো বড় পবিত্র মা-জান! চটজলদি নিয়ে আসুন। জমজমের পানির পরশ! আঃ কি ভাগ্য আমার।

বলতে গেলে প্রায় তখনই জমজমের পানি এল। হাজিবিবির মুখে হাসি। বিসমিল্লা বলে বাবরি মসজিদ আঁকছে লোকটা। যে মসজিদে মেয়েমানুষের নামাজ পড়া দূর অস্ত, স্পর্শ করা হাদিছে মানা; সেই মসজিদ সামনে রেখে কুটনো কোটা বাটনা বাটা। হাজিবিবি দেখে প্রতিটি নির্মাণ। দেখে কীভাবে একটা ধ্বংসস্তূপ ফুঁড়ে উঠে আসছে সাড়ে চারশো বছরের অধিককাল এই প্রাচীন ইমারত। নিখুঁত তার রোয়াক, মিনার। সুউচ্চ গম্বুজের উপর স্পষ্ট চাঁদ তারা যেন আল্লার আরশ ছুঁতে চাইছে।

একপাশে গঙ্গাজল অন্যপাশে জমজমের পানি। দুটো বাটিতে হাতুড়ি ছেনি ডুবিয়ে প্রয়োজনমতো শুদ্ধিকরণ চলছে। শিল্পীর চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। যে শিলে এখনও ছ মাস বাটনা বাটার কাজ চলে সে শিলও মন্দির মসজিদের দাবি জানায়। বিয়ের প্রথম দিনে নতুন বউ এইসব শিলের উপর দাঁড়িয়ে চুকুত চুকুত ছিন্নি খেয়ে পরের দিন আলাদা হয়ে উনুন জ্বালায়। দিনের পর দিন ভেঙে পড়ছে বড় বড় গেরস্থালি। কে আর সাত মদ্দের ভাতের হাঁড়িতে ফেন গালে আমানি গালে। গাঁ-গেরামের মেয়েছেলে ঘরের স্বামী আর হেঁসেলের শিল ছাড় আর চেনেই বা কী! কোটাই মিস্ত্রি ধ্যানস্থ হয়। কঠিন শিলাস্তর ভেদ করে একের পর এক ফুটে উঠেছে মন্দির মসজিদ। কোটাই মিস্ত্রি নয়, যেন ঈশ্বরেই এঁকে দিচ্ছেন এসব।

হঠাৎ করেই সেই মাঝবয়েসি জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁগো কোটাই মিস্ত্রি, তুমি হিন্দু না মুছলমান?

–কেন মা? মানুষের আবার জাত কিসের? এই জাত জাত করেই যত অশান্তি, দাঙ্গা, হাঙ্গামা। পশু পাখি জন্তু জানোয়ার এদের মধ্যে দাঙ্গা দেখেছেন? এরা মানুষের থেকেও সরেস।
–বলছি মন্দির মসজিদ দুটোই আঁকছ কিনা?
–ওসব বুঝিনে, আমি মানুষ মা। জাত থাকলে একটাই আঁকতে পারতাম। জাত নেই বলে দুটোই সমানভাবে পারি। এই দ্যাখেন— উপরের পাটিতে কটা দাঁত নেই। হিন্দু-গাঁয়ে গিয়ে এই অবস্থা। ওদের দাবি মজুরি যা খুশি নাও বাবরি মসজিদ আঁকতে পারবে না। আর কান চোয়ালের ওই কোপের দাগটা দেখেছেন? ওটা মুসলমান গাঁয়ে। বলেছিল— কাফেরদের মন্দির আঁকলে কোরবানি দেব৷ ভাগ্যির খাতিরে বেঁচে গেছি। আসল ধর্মটা হল মনের বিশ্বাস। আর মনের মধ্যে মন্দির মসজিদ। যাদের মানুষের ওপর বিশ্বাস নেই তাদের আবার ধর্ম করা কেন?

একটা শিল আসল বাঁড়ুজ্যে বাড়ি থেকে৷ আর একটা আসছে। মৌলভী সাহেবের আট মাসের পোয়াতি বিবির শিলের ভারে শরীর বেসামাল। আচমকা পায়ের কাছে ভূমিকম্প হল। এ কি শিল নামাতে গিয়ে চুড়িতে হাত কাটলেন। ইস! এত রক্ত! এই অবস্থায় নাই বা আসলেন। বলে ক্ষতস্থানটি টিপে ধরল। লজ্জায় মৌলভী বিবির রাঙা মুখ আরও রাঙা হয়ে উঠল। একটা অচেনতা পরপুরুষের নোংরা হাতের স্পর্শ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বুঝল, হাতের ওপর একটা আস্ত পাথর বসে আছে৷ একটু দাঁড়ান। রক্ত জমাট বাঁধুক।

মৌলভী-বিবির সারা শরীর রি-রি করে ওঠে৷ এ কুন দজ্জালের কানায় পড়নু খোদা! কোমরের দড়ির দিকে চোখ পড়তেই গর্ভের শিশুটি চাগাড় মেরে ওঠে। আপন মনে বলে ওঠে, এ যে দেখছি কয়েদভাঙা আসামী মাগো।–

বিবিসাহেবা ছাড়া পেয়ে এখন ভিড়ের মধ্যে। এমনভাবে ভারী শরীরে দু হাত দুপাশে ছড়িয়ে পা গুটিয়ে বসে যেন নিজেই একটা আস্ত হ্যারিকেন। লোকটা আবার শিলের সঙ্গে মোলাকাতে মেতেছে। মুখ-ফোঁড় বউটা এবার বললে, একটা গান গাবে না?

–আগে খুব গেতাম বউদি। এখন গলায় তেমন রব নেই। দশের মজলিশে বললেন যখন শুনুন,

জষ্ঠি মাসেতে গেলাম শউরবাড়িতে
শালা সুমুন্দি এসে বলে বাপজান এয়েছে
শাউড়ি বলে ও প্রাণোনাথ আছ কেমন
শউর বলে সাবাশ বটে মোর ভায়রা ভাই।
আমার আহ্লাদের আর সীমা নাই।

আঁচলে মুখ চেপে মেয়েমহলে উথলে উঠল হাসির তরলতা। তলে তলে লোকটা জানেও তো খুব। হাসির মুখে লাগাম দিয়ে আবার বললে, আর হবে না?

–শুনবেন? আপনাদের গাঁয়ে কাজে এসে আজ মনটা ভালো আছে। শোনেন তো একটা বউয়ের গান বলি,

বউ বাটনা বাটেরে শিলের উপরে বউ
বাটনা বাটে রে-
ঝাল বাটে হলদি বাটে আরও বাটে জিরে
ঠকঠকাঠক খচর খচর
শব্দ ওঠে ধীরে
বউ বাটনা বাটে রে।
দু হাতে তার শাঁখা-চুড়ি/ বাটনা বাটায় নাইকো জুড়ি
সে চুড়ি রিনিক ঠিনিক বাজেরে
বউ বাটনা বাটে রে পাছাখান দুলাইয়া।
পিঠের ওপর চুলের গাছি/করে শুধু নাচানাচি
হয় যে মনে ডানা মেলে, হীরামন পাখির মতো
বউ উড়ে যেতে চায়
বউ বাটনা বাটেরে, কোমর দুলাইয়া বউ
বাটনা বাটেরে—

শিল্পী শিল কোটাতে কোটাতে গান গাইছিল। গান গাইতে গাইতে শিল কোটাচ্ছিল। ছেনি-হাতুড়িটা গঙ্গাজলে ডোবাতে গিয়ে আবার কি ভেবে জমজমের পানিতে ডোবাল। ঠোঁট কচলে সেই মুখ-আলগা বউটা বললে, হ্যাঁগো তুমার বিয়া হয়েচে?

–বিয়ে? তা হইছিল একসময়।
–এখন বউ নেই?
–নাঃ নেই। সবই এই কপাল বুঝলেন। বলে হাতুড়িটা আবে ঠেকাল।
–বাবার বাড়ি পালিয়েছে বুঝি? খুব মারাধরা করতে?

এই প্রশ্নে গলাটা কেমন আড়ষ্ট মেরে যায়। তা বাবার বাড়ি পালানোর কথা বলতে পারেন। গভ্যে দশ মাসের সোন্তান নিয়ে মারা গিছে গো।

শুনেই মৌলভী-বিবির পেটের ভিতর ভূমিকম্প হয়। ভিড়ের মধ্যে মেয়ে-বউদের কেউ কেউ মনপস্তানির সুরে বলে ওঠে— আহা, আহারে!

–বাড়িতে আর কেউ নেই?
–থাকার মধ্যে চার বছরের দুটো যমজ লেংড়া লেংড়ি আছে মা। হাবাগোবা, মুখে বাক্যিও দেয় নাই ওপরঅলা। আমি বাড়ি না থাকলে নিজেদের মধ্যে মারামারি খামচাখামচি করে। সকালবেলা কাজে বেরুলেই দুজনেই কাঁধের ঝোলা ঝাপটে ধরে ঝামেলা পাকায়। জোর করে। ছাড়িয়ে পথে নামতেই আমার পানে শুধু প্যাট প্যাট করে তাকায়। সে থাকলে— একবার ঢোক গিলে বললে— এই যে ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড়, সে থাকলে নিজেই কেচে দিত। সূঁচে সুতো পরিয়ে কেমন সুন্দর সেলাই করে দিত। অশথ গাছের ডালে ঝুল খেয়ে একটা মাকড়শা সুতোর মতো লালা ঝরিয়ে শিরদাঁড়া বরাবর ছেঁড়া জামার উপর নেমে আসছিল সে সময়। শিল্পী বলেই চলে, বাপ মা হারা গরিব ঘরের মেয়ে ছিল সে। দেহে রূপ ছিল যৌবন ছিল। গলাটা আরও ধরে আসে। বাবরি মসজিদের গম্বুজ আঁকতে আঁকতে ভাবতে পারে এমনই পুরুষ্টু স্তন ছিল তার। বুকের গভীরে ওম ছিল। ছিল সহবৎ। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শিল্পী। চোখের সামনে শিলাখণ্ডটি যেন একটু করে গলে যাচ্ছে।

বেলা পড়ে এসেছে। মাটিতে লতিয়ে নামছে গাছেদের সাবালক ছায়া। অশথ গাছের মাথায় এখন পাঁচমেশালি পাখিদের কলরব। দুপুরের শানানো রোদ ক্ষয়ে ক্ষয়ে এখন রেশমি বিকেল। কোটাই মিস্ত্রি সারাদিনের আড়ষ্টতা ভেঙে অবশেষে উঠে দাঁড়ায়। মাথায় চালের থলে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি ভারী। কাঁধে ঝোলা। সব শিল কোটা শেষ। যে যার শিল নিয়ে ফিরে গেছে ঘরে। সারাদিনের ক্লান্ত রোদ এ সময় মূর্চ্ছা যায় পথের ধূলোয়। একটু একটু করে বাড়ির দিকে হাঁটে লোকটা। মৌলভী-বিবি উঠোনে পা দিয়ে শিলের ওপর হঠাৎ নজর পড়তেই ভিরমি খায়। সর্বনাশ! মসজিদের জায়গায় মন্দিরের ছবি! এ শিলের বাটনা বাটা তরকারি পেটে পড়লেই ইমান নষ্ট৷ ওজু নষ্ট। যদি জানতে পারে এ অবস্থাতেও তিনি তালাকের বয়ান হাঁকাবে। যদি জানতে পারে লোকটা তার গায়ের ওপর হাত রেখেছে। ভয়ে সারা শরীরে কাঁপুনি চড়ে। হায় আল্লা! আল্লা গো—

ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়েন মৌলভী। মাথার টুপিটা খুলে পড়ল দোরের গোড়ায়। বলো বিবিজান, বলো কী হয়েছে?

–ওই দেখো শিলের অবস্থা। লোকটা মসজিদ না এঁকে মন্দির এঁকেছে।

মড়িঘরের গলিত শব দেখার ঘৃণা নিয়ে দূর থেকে দেখলেন। তৌবা! তৌবা! লোকটা গেরুয়া পার্টির মস্ত দালাল। কাফের! এখনই হারামজাদা ইবলিশকে কোতল করব৷ বলে খুনের কসম খেয়ে লাফিয়ে বেরুলেন। কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে চিনতে পারেন ওই তো সেই লোকটা। চোখ দুটো জ্বলে ওঠে দ্বিগুণ হিংসায়। কিন্তু পাশে ওই লোকটা রতন বাঁড়ুজ্যে না? কী বলছে মৌলভী সাহেব শোনেন—

–শালা ইয়ার্কি পেয়েছ না? আমার শিলের ওপর মসজিদ! রাম! রাম! বাড়ির মেয়েমানুষ পেয়ে বোকা বানাবে? আগে মন্দির আঁকো নাহলে শ্মশানে শোয়াব।

–না দাদা। আমাকে মাফ করবেন। মরে গেলেও পারব না। মানুষ হিসাবে আমারও তো একটা ধর্ম আছে। যে মসজিদ নিজে হাতে গড়েছি তাকে কেমন করে ভাঙি? কাতর অনুরোধে লোকটার গলা ভারী হয়ে উঠল।

–কী পারবি না? তবে রে শালা— বলেই মাথার ওপর আস্ত শিলটা ছুঁড়ে মারে। একটা অস্পষ্ট গোঙানি করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা৷ মৌলভী সাহেব ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে আচমকা থমকে দাঁড়ালেন। আর তখনই শঙ্খের সুরের সঙ্গে ভেসে এল মগরিবের আজান। চারপাশ জুড়ে নেমে এল শিলাময় অন্ধকার। এমনই শিলাময় অন্ধকার খোদাই করে পাশাপাশি আঁকা যায় অনেক রামমন্দির বাবরিমসজিদ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to Prativa sarker Cancel reply