এ মাসের কবি: বেবী সাউ

এ মাসের কবি: বেবী সাউ । আলোচনা: গৌতম বসু

বেবী সাউয়ের কবিতা

 

অন্ধকার নিয়ন্ত্রণরেখায়…

(উৎসর্গ: কবি বিভাস রায়চৌধুরী)

উন্মাদ সময়ের গান

এ উন্মাদ সময় নয় আমার প্রিয়তম
এ উন্মাদ আকাশ নয় আমার আশ্রয়
গভীর জলে পেতেছি সুখ দুঃখ এলোমেলো
আমাকে চাও কেবল শ্রমে এবং রান্নায়

কোথায় তুমি হে ঈশ্বর, নারীর দেহ নিয়ে
নারীর মুখ সেলাই করা, নারীর পেটে বোমা
নারীর পিঠে চাবুকদাগ, নারীর যোনি ছেঁড়া
নারীর চোখে অন্ধকার পাতাল খোঁড়া আছে

তুমি তো এক ছোট্ট মেয়ে, আকাশভরা চোখে
তুমি তো সেই রবিঠাকুর, প্রেমের কবিতার
তুমি তো ফুল, নন্দিনী, একাকী গান শোন-
কী করে তুমি জানবে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে?

এ উন্মাদ সময়ে তুমি জন্ম নিও না আর
এ উন্মাদ সময়ে কোনও বাগান লিখবে না
এ উন্মাদ সময়ে শিশু জন্ম থেকে বোবা
এ উন্মাদ সময়ে লেখা রয়েছে— চুপ করো!

 

জার্নাল

লজ্জা হয়, প্রেম নয় প্রতিহিংসা আসে
এখন কলমে। সব ক্রোধ নগ্ন হয়
মনে হয় ক্ষমা করি, কবিতায়, প্রেমে
তোমাকে আদর করি পুরনো সাহসে।
এখন কলমে বড় বেশি অন্ধকার।
কারা কড়া নাড়ে? কারা হাতের মুজরোয়
ছুঁড়ে দেয় টাকা? আমি অভিমানবশে
তাদের জীবনে যাই। পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে
তুলে আনি খাজুরাহ, বাৎস্যায়ন, চৌষট্টি কলায়
ডাক দিই রূপকথায়। পেতে রাখি চাঁদ।
তার পর রক্তে কারা ডাক দেয়
আদিম হরিণী? বাঘ?
নির্ভয়ার যোনি থেকে রক্ত ঝরে আমার কুহকে।
তুমি ভাবো আমিও দিয়েছে
আমার সোহাগ।
লজ্জা হয়, প্রেম নয়, প্রতিহিংসা লিখি
এখন কলমে। সব ক্রোধ নগ্ন হয়।

 

পাণ্ডুলিপি

জমানো, সমস্ত ধূসরতা নিয়ে কথা বলি

চোখে ছবি জেগে ওঠে
কামদুনির হারানো মেয়ে উঠে বসে ভাঙা যোনিপথে

দূরে বেজে যায় উদভ্রান্তের জীবনী

আর এ মাহেন্দ্রক্ষণে, অস্থির দেওয়ালে
নিপুণ সার্চলাইট জ্বলে

 

হিংসা

ধীরে ধীরে স্বাভাবিক  বলির পাঁঠাও

মৃত্যু মরে যেতে থাকে
ভয় মরে যেতে থাকে

হৃদপিণ্ডের লোভে জেগে থাকা চোখ
রোয়াকে কুকুর ছানা
মাথায় উড়ন্ত চিল

মনে মনে ডিল তৈরি হয়
মাথা বিক্রি হওয়ার আগেই

প্রতিটি মস্তক পাক খেতে থাকে
চাকু ও ছুরির চোখে, ঝকঝকে আঘাতে আঘাতে

 

লক্ষ্য 

আমাদের এবার একটা দৌড়ের বড্ড প্রয়োজন

মিছিল
ব্যারিকেড ছেড়ে
লেপকম্বল জড়ানো মানুষের মাথা ভেঙে
নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর

 

অ্যালেক্সা, তুমি কি জানো? 

আকাশে ঝড়ের গন্ধ, এখনই কি রক্তবৃষ্টি হবে?

খবরে প্রকাশ, ওরা ধরে নিয়ে গেছে
বড় মাংসপ্রেমী হয়ে গেছে আমাদের সভ্যতায়
ঝুলবারান্দার মতো মনখারাপগুলি

আকাশে ঝড়ের গন্ধ, কোথায় পালিয়ে যাব তবে?

এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস ব’লে গেছেন টমাস
এলিয়ট, যাঁর কাছে সন্ধ্যা মানে শায়িত পেশেন্ট!

আমি তো তোমার কাছে প্রেম বলতে চাই!
বলতে চাই আগুনের পুড়ে যাওয়া শোনো-

বলতে চাই, শোনা যায় সেই কবেকার
গ্রামপতনের শব্দ, রেললাইন, কিশোরী বিজুরী…

শোনা যায় গান। এত দুঃখ জমে থাকে কেন?
এত রক্ত কেন পড়ে? এত কেন মাটি ভিজে যায়?

অ্যালেক্সা, তুমি কি জানো, কীভাবে আবার
ফিরে পাব আমাদের ঘর?

পুনঃপ্রকাশিত হবে অন্ধকার মহাকাশে একবিন্দু
আলোর পৃথিবী?

 

পোস্টার

এই কাঁটাতারে লেগে আছে ছেঁড়া ইস্তেহার

নিরীহ শরীর, নারী
বুলেটের ধুঁয়ো মেখে
পাখির ক্ষতের মত কাকে চেয়ে গেছে!

সে কি দেশ? সে কি রাষ্ট্র?  নাকি শুধু  বাসস্থান,  ভূমি?
হৃদয়ে ভাতের গন্ধ;
আর কিছু নেই তত,  চাইতে শেখেনি কোনদিন
মূক বধিরেরা!

তোমাকে পুরুষ ভেবে
তুলে দেয়  সমর্পণ… আগুন ভ্রমণ

পরিত্যক্ত, খাস জমি ভেবে
তুমি তাকে ছলনা শেখাবে?

 

কৃষক

ঘর নেই, সীমারেখা নেই
অসংখ্য কালের ছায়া তোমাকে ঈশ্বর ভেবে বসে

তুমিও দয়ালু, দয়াপরবশ
আলোক দেখানো ছলে

ভবিতব্য উপড়ে নিয়েছে দৃশ্য, ভাষা

শতাব্দী শতাব্দী তাই অন্ধ চাষ ফলে

 

প্রবাহ

পয়ারে রচিত এই বিদ্রোহের গান
জামায় জামায় তার স্নায়ু, ক্লোরোফিল
জন্মের কুঠার নিয়ে হেঁটে আসা ব্যাধ
উজ্জ্বল উঠোনে আজ কাটা মাছ, ছবি

দিনের মোরামে বাজে কথক ঠাকুর
ফাটা পা, কলিতে স্মৃতি। আগুন নেভানো
কে তাকে বসত দেবে, বস্ত্র পরমায়ু?

ঘনসঙ্ঘবদ্ধ এই শ্যাম্পেন রহস্য
ভিনদেশী রোদ আজ সমাজ চালায়
প্রসেসিং এ পিরিয়ড জানে জর্দাপান

এক্কাদোক্কা খেলা ফেলে সুগারকিউব
নোনা জল মুখে দাও মৃত আন্দামান!

 

মূর্তি

মুক্ত বুক লজ্জা নেই কোনও
বস্ত্র আজ উড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায়
নগ্ন চোখ শিখেই নিক আলো
মাতৃ বুকে গরল উঠে এলে…

বুঝবে দেশ?

ধর্ম যাক, জন্ম যাক মৃত্যু অভিশাপে!

 

কলস

আশ্রয় আসলে থিম…

জীবনের মায়া, মনস্কাম
সবেতে ঘষেটে দাগ লেগে আছে

বহু অতীতের পার থেকে ভেসে আসা মাটির কলস
দু’পাশে জড়ানো তার অভিনয়, মৃদু অনুরাগ

পরাগের রেণু থেকে
ছিঁড়ে যাওয়া ফুল থেকে
মৃত মাছেদের চোখ

নিরুপায় অথচ সন্তানবৎ…

 


নতুনতর কবিতার দিকে

গৌতম বসু

আমাদের কবিতা পড়া, সাধারণত, এক প্রবল বিশৃঙ্খল আচরণ। এ-কবিতা পড়তে গিয়ে ও-কবিতা প’ড়ে ফেলি, রামের কবিতা পড়তে-পড়তে রহিমের কবিতা, এমন কি কখনও-কখনও  জোসেফের টেম্পেরার অথবা কাঠ খোদাইয়ের কোনও কাজও, মনে পড়ে যায় ।  আবার, লম্বা লাঠির ডগা সহযোগেও ঘেঁটু-র কবিতা ছুঁই না । কবি যতবার তাঁর নিজের ভাবনার দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন, ততবার তাঁরই দেওয়া কোনও চিন্তাসূত্র ধ’রেই পালিয়ে বেড়াতে আমরা ভালবাসি । কবিও কিছু কম ছটফটে স্বভাবের ব্যক্তি নন, তিনিও এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত নিয়ন্ত্রণের উপর ভর ক’রে অনিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেন, উল্লাসের ধ্বনিও কখনও-কখনও আর্তনাদের মতো তাঁর কানে বেজে ওঠে । প্রথম চরণ লেখার সময়ে যিনি সম্যক জানেন শেষ চরণটি ঠিক কেমন হবে, তিনি সুপণ্ডিত, নগর-পরিকল্পক, এমন কি উৎকৃষ্ট ফুটবল কোচ হতে পারেন, কিন্তু, নিশ্চিত রূপে বলা যায়, কবি তিনি নন । বিশদ  ক’রে বলা নিষ্প্রয়োজন, কবির এই দশার সঙ্গে ‘অটোম্যাটিক রাইটিং’-এর প্রবক্তাদের কিছুমাত্র সাদৃশ্য নেই, যদিও বাইরের দিকের দু-একটা মিল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে । কবির প্রধান উপকরণ তাঁর মন,সেই মন অটোম্যাটিক রাইটারের কোথায়?আকস্মিকতাকে(‘চান্স’)রচয়িতার স্থানে বলপূর্বক বসিয়ে দিয়ে শ্রীমান অটোম্যাটিক এক অভিনব পরিস্থিতি তৈরি করলেন বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আকস্মিকতাকে লঘুপ্রকৃতির সাহিত্যতত্ত্ব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কখনও-কখনও এক সুগম্ভীর চেহারা প্রদান করবার প্রয়াসও লক্ষ করা যায়, যেমন সম্ভাবনাতত্ত্ব(থিওরি অফ্‌ প্রব্যবিলিটি)। প্রতিটি ঘটনা ঘটবার একটি সম্ভাবনা আছে, যা কোনও–না-কোনও ভগ্নাংশের সমান । আমরা সকলেই জানি যে, এক টাকার মুদ্রা ‘টস’ করলে ‘হেড’ অথবা ‘টেল’ পড়ার সম্ভাবনা /২, কারণ এই ঘটনাটির দু’টির অধিক ফল হওয়া অসম্ভব । এর অর্থ এই নয় যে, এক টাকার মুদ্রাটি দু’বার ‘টস’ করলে একবার ‘হেড’ এবং অন্যবার ‘টেল’ পড়বেই। সম্ভাবনাতত্ত্ব  থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, ‘টস’ করার ঘটনার সংখ্যা যদি বৃদ্ধি করা যায়, ধরা যাক ১০, তারপর ১০০, তারপর ১০০০ ইত্যাদি, তা হলে ঘটনার সংখ্যা যত বাড়বে, ‘হেড’ পড়ার ফলটি তত ০.৫০ ভগ্নাংশের কাছাকাছি আসবে। সম্ভাবনাতত্ত্ব প্রয়োগ ক’রে কেউ-কেউ প্রস্তাব রেখেছেন যে, প্রসঙ্গটি যখন মূলত ‘ঘটনা’ এবং তার সম্ভাব্য ‘ফল’-এর বাইরে যেতে পারছে না, সেহেতু প্রত্যেকটি সাহিত্যকর্ম ঘটবার একটি নিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে, যা একটি ভগ্নাংশের দ্বারা প্রকাশ করা যায় । এই ভাবনাবলয়ে,স্পষ্টতই, কবির ভূমিকা গৌণ, প্রায় অনুপস্থিত। এই মতের প্রবক্তাগণ, যাঁরা উগ্রস্বভাবের ঐতিহাসিকতা-বিরোধীও, একটি জনপ্রিয় এবং কৌতুকময় ‘মাইন্ডগেম’ রচনা করেছেন : একটি বাঁদরকে যদি একটি টাইপরাইটারের উপর লম্ফঝম্প করার অবাধ অনুমতি দেওয়া হয় তা হলে কোনও–না-কোনও দিন, হতে পারে  ইতঃমধ্যে কয়েক হাজার বছর অতিক্রান্ত, আমরা শেক্সপীয়র-এর সমগ্র সাহিত্যকর্ম হাতে পেয়ে যাব! সাহিত্যপ্রেমীরা এ-প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে  দেবেন, কিন্তু তা ব’লে প্রসঙ্গটি মুছে যায় না, কারণ সত্যই, শেক্সপীয়র-এর সমগ্র সাহিত্যকর্মও একটি ‘ফল’ যা কোনও একটি ভগ্নাংশের সঙ্গে যুক্ত করা যায় । আকস্মিকতাবাদীকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবার একটিই যুক্তি আমাদের হস্তগত, যা ‘অটোম্যাটিক রাইটিং’-এর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ  করা হয়েছিল : কবির মন। লম্ফনরত বাঁদরটির মনের অস্তিত্ব নেই,সেইজন্য তাঁর দ্বারা শেক্সপীয়র-এর সমগ্র সাহিত্যকর্ম তো দূরের কথা, তাঁর সনেটের একটি চরণও রচনা করা অসম্ভব । বস্তুত, উল্লিখিত বিতর্ক থেকে নিজেদের মুক্ত ক’রে নিয়ে আমরা বলতে চাই, আকস্মিকতার সঙ্গে কবির কোনও  সম্পর্ক নেই, তিনি সর্বান্তকরণে দৈবের সঙ্গে একটি যোগাযোগ স্থাপন করতে চান, তাঁর বিরহ সম্পূর্ণভাবে দৈবের সঙ্গে বিরহ, তাঁর সমূহ প্রচেষ্টা, দৈবানুগ্রহলাভের এক মর্মান্তিক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে, আদ্যন্ত বিফল, আত্মক্ষয়ী, নিঃসঙ্গ এক প্রয়াস। স্বয়ং মির্জা আসাদুল্লা খান ঘালিব ব’লে গেছেন, দুর্দশাপীড়িত ঘালিব-এর মাথা ঠোকা দেখে, তোমার দেওয়ালের কথা মনে প’ড়ে গেল!

এতগুলি কথা একসঙ্গে ব’লে ফেলার এবং কলহে-কলহে এতটা লিপ্ত হওয়ার তাৎক্ষণিক কোনও কারণ না থাকলেও, একটা উপলক্ষ আছে : ২০১৯ সালের গোড়ায় প্রথম প্রকাশিত নবীন কবি বেবী সাউ-এর নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘একান্ন শরীরে ভাঙো’। শিরোনামে একটি গূঢ় সঙ্কেতের টের পেতেই মনে হল এটি অনুসরণ করলে কবির হদিস পাওয়া যাবে । আরও  অনুমান করলাম, বইয়ের অন্তিম পৃষ্ঠাগুলিতেই কবিতাটি পাওয়া যাবে, সেইজন্য শেষ কবিতা থেকেই পড়তে শুরু করলাম। পাওয়াও গেল লেখাটি একেবারে শেষে, কিন্তু চক্ষুস্থির হল অন্য একটি কবিতায়, বেবী লিখেছেন:

উনুনের ধারে উপুড় হয়ে আছে দীর্ঘ শীতকাল

ফাটা গোড়ালি ভর্তি মৃত কোষ
বিভাজনের লাল আলতা

বিষাদ আনুষঙ্গিক ভেবে
পাল্টে যাচ্ছে চোখ

বন্ধ দরজার কাছে প্রাচীন অশ্বারোহী
বারবার পেছন ঘুরে দেখছে

সমস্ত বিকল সময় একটিবার বলে যেতে চাইছে

অন্তিম ফেরার রাস্তা

[৫১ সংখ্যক কবিতা, পৃষ্ঠা ৬১]

ফাটা দাগের সারি ঘেরা রয়েছে আলতায়, আমার মায়ের পা দু’খানি দপ্‌ ক’রে চোখের সামনে জ্ব’লে উঠল, এবং কবিতার বইটি আমি বন্ধ ক’রে দিলাম। একেই কি কবিতাপাঠকের বিশৃঙ্খলা বলে ? কে জানে! বন্ধ দরজার কাছে প্রাচীন অশ্বারোহী পিছন ঘুরে দেখছে কেন ? কী দেখছে সে? কে জানে! একটি শব্দচিত্র ভীষণ পরিচিত কিন্তু অর্ধবিস্মৃত, অন্যটি অদেখা কিন্তু অচেনা নয় । দু’টি শব্দচিত্র পাশাপাশি বসিয়ে কবি কিছু-একটা প্রকাশ করতে চাইছেন,যা যুগপৎ অস্পষ্ট ও মনোরম।

কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা লেখার বিধি যেটুকু রপ্ত করেছিলাম তা ভুলতে বসেছি ব’লে   অসংলগ্নতার ঝুঁকি নিয়েই বলি, কবিকৃত বাধার সম্মুখীন না-হয়েই যে কবিতার বই   গড়গড়িয়ে প’ড়ে ফেলা যায় তার কাছে মানুষ আর ফিরে আসে না । শব্দদূষণ ও দৃশ্যদূষণের চাপে প’ড়ে সেরকম কিছু কবিতা কবি লিখে ফেলেছেন বটে, কিন্তু, সৌভাগ্যবশত, সেই রকম লেখার সংখ্যা ও ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা এখানে অনুল্লেখ্য, উভয় মিলেও বইটিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারে নি। এই বাক্যটিতে একটা ভুল রয়ে গেল, কারণ, সুকাব্যের, বিশেষ ক’রে  গুণী কাব্যগ্রন্থের কোনও লক্ষ্যবস্তু থাকে না, যা থাকে, তা হয়তো দৈর্ঘ্য–প্রস্থ-উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা-করা বিস্তৃতি, দূরদৃষ্টি ও গভীরতার এক ত্রিমাত্রিক বিন্যাস। কবি যে-কোনও একটি দিকে মনোযোগ দিলে, পাঠ্যবস্তুর সাম্যাবস্থা রক্ষার অদৃশ্য প্রয়োজনবোধ থেকে অন্য দু’টি দিক আপনিই সাড়া দেয়। কৌতুকের বিষয় এই যে, এ-সমস্ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, কবির অজ্ঞাতেই ঘ’টে যায় । অর্থাৎ, কবি যদি তাঁর দেখার  দৃষ্টির ব্যাপ্তি (ভিশন্‌ অর্থে) প্রসারিত করতে পারেন, গভীরতা ও দূরদৃষ্টি  তাঁর লেখায় আপনিই ফুটে উঠতে শুরু করে।

বস্তুত, এই বইটি জুড়ে বেবী এই কাজটিই সম্পন্ন করেছেন; প্রথাগত বিচারে একটি ভাবনা কবিতাপদবাচ্য হল কি হল না, তা নিয়ে অকারণে ভাবিত না হয়ে তিনি নিজের অন্তরের কণ্ঠস্বর নিঃসঙ্কোচে অনুসরণ করেছেন। ফলত, অন্যরকমের এক প্রাকৃতিক ঋতুবৈচিত্র্যে বইটি সমৃদ্ধ হয়েছে ব’লে মনে হয় । একই বইয়ে, দুই প্রান্তের দুই রকম কণ্ঠস্বরের দৃষ্টান্ত আমরা তুলে ধরলাম, একটি কঠোর, অন্যটি কোমল, দু’টিই তাঁর আপন। পাঠক লক্ষ করবেন ভিন্ন ভাব ধারণ করতে গিয়ে ভাষাব্যবহারেও কত বৈচিত্র্য আপনিই প্রকাশ পেয়েছে। বেবী-র কঠোর কণ্ঠস্বরটি এইরকম:

যেসব পথে হেঁটেছে ক’জন মাত্র ─ তাঁদের প্রসঙ্গ টেনে বলা যায় সাম্যের কথা । সমস্ত বিলাপের আশ্রয়স্থল একমাত্র ধর্ম ভেবে, দু’চারটে ধূপকাঠি সংগ্রহে রাখি । ব্যারিকেড ধুয়ে দিই অচেনা রক্তে । ঝিরঝিরে শব্দে এ যাবৎ জমানো স্বীকারোক্তি দহলিজে ফেরে । মুক্তির কোনো পথে নেই ভেবে তুমিও যেমন ভেবে নাও মঙ্গলগ্রহের কথা । ক্যারেট  অনুযায়ী  রক্তপ্রবাল ধারণা । আর নিশানা অব্যর্থ ভেবে বেশধারী মাকান্দার নিজেকে জাদুকর ভেবে বসে ─ এই একবিংশের মাঝখানে ।

[৪১ সংখ্যক কবিতা, পৃষ্ঠা ৪৭]

 

এর বিপরীত প্রান্তে বেবীর একটি কোমল কণ্ঠস্বরও আমরা লক্ষ করি, যা কার্যত জলরঙের মতো স্বচ্ছ:

নিয়ত চলে যাওয়া দেখি

কিছু অনিবার্য নীল এখনও বিস্তারিত সমুদ্রের কথা বলে
নিরীহ সবুজে গড়ে ওঠে প্রবাল শক্ত পাহাড়

সূক্ষ্মতম কুয়াশা দিতে পারিনি বলে
ঠোঁট ভর্তি শ্যাওলার গন্ধ

পাল্টা অপেক্ষমাণ
দোরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে চলে

আর…

বিদায় জরুরী হলে
কিছু ফেরা গুছিয়ে রাখি

পাখির ডানায় শোনা যায় ঝরাশব্দ

[৩৫ সংখ্যক কবিতা, পৃষ্ঠা ৪১ ]

৩৫ সংখ্যক কবিতাটি কোনও দুরূহ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয় নি, এই কারণে ভাবের দিক থেকে তা স্বচ্ছ। কিন্তু, সেই স্বচ্ছতার কারণেই বোধ করি, লেখাটি একরকম অধরাই থেকে যায় । আমরা অনুভব করি ‘সূক্ষ্মতম কুয়াশা’র পরিমণ্ডল পর্যন্ত তিনি আমাদের এগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারপর? কয়েকটি আপাতদৃষ্টিতে অসংলগ্ন শব্দচিত্রের সঙ্কেত টের পাওয়া যায় চারপাশে, যেখানে কবি অনুপস্থিত। ঠিক যখন পরিণতির এক আবহ তৈরি হতে চলেছে, ঠিক তখনই আমরা অনুভব করি, নিজেরই সৃষ্ট দৃশ্যাবলী থেকে কবি নিজেকে প্রত্যাহার ক’রে নিয়েছেন!

এই গদ্যরচনার প্রারম্ভে, আমরা, সাধারণ স্তরে, পাঠকের মনের বিশৃঙ্খলা এবং কবির অগোছালো ভাবের উল্লেখ করেছি। এর বাইরেও কবিতাপাঠের একটা জগৎ আছে, যার সঙ্গে আমরা সকলেই অল্পবিস্তর পরিচিত। সে জগৎ হ্রদের মতো গভীর ও নিশ্চল। আমরা যখন ‘আরোগ্য’ পড়ি, অথবা ‘রূপসী বাঙলা’, অথবা ‘পারাপার’, অথবা ‘দশমী’ পড়ি, তখন কি আমাদের মনোযোগ অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে? কাব্যগ্রন্থের আলোচনা কীভাবে লেখা উচিত,‌ তা যে ভুলতে বসেছি, এ-কথা কবুল করা হয়ে গেছে আগেই। ফলত, একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে এই রচনা শেষ করায় আর কোনও বাধা রইল না । আমার  কাঁচা বয়সের  বন্ধুদের সঙ্গে,  ময়দানের এক কোণে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলন’-এর অধিবেশনগুলি নিয়মিত শুনতে যেতাম। প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পীরা সেখানে গাইতে ও বাজাতে আসতেন। একবার, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব এসে বসলেন, মাইক টেনে বিড়-বিড় ক’রে কি সব বললেন, কিছুই শোনা গেল না । হঠাৎ মাইক থেকে বিকট শব্দ হতে লাগল । আর যায় কোথায় ! সামনে, পিছনে, আশেপাশে, তুমুল হইচই, কর্মকর্তারা মঞ্চে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিলেন, এরই মধ্যে, ওই বিকট শব্দের ফাঁকেই উস্তাদজীর অসহায় কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,‘ফিডব্যাক হচ্ছে’! অবশেষে ইলেকট্রিক  কন্‌ট্র্যাক্‌টারের লোকজন এসে প’ড়ে, খুব দ্রুত বদলে ফেললেন যন্ত্রপাতি, শব্দপ্রক্ষেপণ পরীক্ষা করলেন স্বয়ং উস্তাদজী এবং তবলিয়া উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ, এবং, দূর থেকে বুঝতে পারলাম, তাঁরা উভয়ই এখন সন্তুষ্ট। কর্মকর্তারা মঞ্চ থেকে নেমে এলেও অনুষ্ঠান শুরু করা গেল না, কারণ ততক্ষণে দর্শক-শ্রোতাদের চিৎকার-চ্যাঁচামিচি উচ্চতম পর্দায় পৌঁছে গেছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা শীর্ষস্থানীয় তাঁদের আবার দেখা গেল মঞ্চে, কখনও তাঁরা সামনে এসে দর্শকদের শান্ত হবার জন্য মিনতি করছেন, কখনও উস্তাদজীর  কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছেন। উস্তাদজী কিন্তু অবিচলিত ও প্রসন্ন, হাত তুলে তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, এবং একটিই  বাক্য ব্যয় করলেন, যা মাইকে স্পষ্ট ভেসে এল, ‘বাজনাটা শুরু করি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তারপর, তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস মতো নিজের শরীরটাকে যন্ত্রের চারপাশে জড়িয়ে নিলেন, মাথা একেবারে নিচু, মাথার টাকটি মঞ্চের উপরদিকের আলোয় চক্‌চক্‌ করছে ; সরোদের তারে ঘা পড়ল। যার জন্য এত অশান্তি, এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা, এবার সেই অতল হ্রদের দেখা পেলাম।

 

ঋণস্বীকার:

  • ‘একান্ন শরীরে ভাঙো’ / বেবী সাউ
  • প্রথম প্রকাশ : কলকাতা বইমেলা ২০১৯
  • প্রকাশক : ‘আদম’/ প্রচ্ছদশিল্পী: শোভন পাত্র
  • পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৬৩ / মূল্য : ১২৫ টাকা

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4656 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. জার্নাল তো অসাধারণ। তবে সব ভাল লাগল। অভিনন্দন।

Leave a Reply to biswanath Bhattacharya Cancel reply