এ মাসের কবি : তৃষ্ণা বসাক

তৃষ্ণা নীলাঞ্জন

তৃষ্ণা বসাকের কবিতা

 

প্রলয়কাল

 

আমরা এখানে আছি। দুহাত রেখেছি।
অস্থির জল সরে। পাতাফুল নড়ে।
যাবার যখন যায়। আসবার আসে।
আমাদের তারামধ্য। গান ভালবাসে।
মধ্যে মধ্যে ও পাড়ায়। তোমার সাড়ায়।
মধ্যে মধ্যে ট্রেন থামে। বৃষ্টি এসে যায়।
যাবার কোথাও নেই।  পরিণাম এই।
থাকবার থাকাটুকু তোমার বুকেই।
দেখেছি কমলা আলো। আলোকের নাচ।
তোমার তৃতীয় চক্ষু ঢুকে গেছে কাচ।
কাচ হয়ে রয়ে যায়। রক্তে গুঁড়ো গুঁড়ো।
কতবার বলব আমি পেতে চাই পুরো।
সময় বেশি তো নেই। যতটুকু বাঁচি।
আর একবার, বারবার খুব কাছাকাছি।
চৌচির হবে মাটি, আকাশ দুফাঁক
খুলে ফেল সন্তাপ, অন্যান্য পোশাক।

 

গোপন ট্যাটু

 

কথা বলো, কথা দিয়ে সাজাও শিকারা
আমরা ভেসেছি আজ, ভালোওবেসেছি
গহন জলের মাছ খুবলিয়ে খায়
তোমার গোপন ট্যাটু,হেমন্ত বেলায়

 

তুমি যা পারোনি দিতে, আমি যা পারিনি
ঈশ্বর জানেন তবু সূচ্যগ্র ছাড়িনি
যে যার মালাটি নিয়ে ফুল গেঁথে গেছি
আমরা ভেসেছি আজ, ভালোওবেসেছি।

 

নোঙরের মতো স্থির, তুমি যাও আসো,
আমাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসো
কথা বলো, কথা দিয়ে সাজাও শিকারা
আমরা অনন্ত কাল ডাক খোঁজ সাড়া।

 

আনন্দের মতো এ জীবন

 

এভাবেই শুরু করো, আনন্দের মতো এ জীবন।
ফার্স্ট বাস মিস করো, অন্য রুটে পাবে নিধুবন।
গাছতলা খিচুড়ির, কান দিয়ে হাঁটা কইমাছ,
পরস্পর রুটিগুলি ভাগ করে নেয় নিবু আঁচ…
এখানে তোমার খেলা, মায়া নয়, বান-ফোঁড়া শিব!
চেটে দিই জাদুদণ্ড- আমারো ত্রিলোক মেলা জিভ,
এখানে আমার খেলা, মায়া নয়, জন্মের কোরাস,
অন্ধ এই আইনক্স, হাতে হাত জানে সর্বনাশ!

 

লুপ্তচিহ্ন

 

পাড়ার কুকুরগুলো ইদানীং সঙ্গম রহিত,
কুলপতি ভেবেছেন, ঠিকই ভেবেছেন–
রাস্তার রমণ থেকে অনর্গল সন্তান সন্ততি, ভারতবর্ষের কোন কাজে লাগবে?
ওরা সঙ্গসুখ পেল কিনা, তাতে কার কি-ইবা ছেঁড়া যায়?
কুলপতি ভেবেছেন, ঠিকই ভেবেছেন,
লুপ্তচিহ্ন কুকুরেরা ইদানীং রাতপাহারায়, উষ্ণতা রহিত,
যোনিতল থামের মতন,
সেখানে পলাশ কাঁদে, ঠিকানা মেলে না।

 

ঠান্ডা মাংস

 

তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না।
রাতের অন্ধকারে একে চিরে চলে যাবে, যেন কন্ডোমবিহীন জিপ,
আর এ পড়ে থাকবে পারাপারহীন ফ্লাইওভারের মতো-
তোমার অশ্বারোহীর মতো পুরুষাঙ্গের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না;

 

কমলালেবুর মতো স্তন দুটি, ঠান্ডা, যেন সদ্য ফ্রিজ থেকে বার করা,
রেশমবেড়ালের মতো যোনি, কাঠ, এখনি মাছি বসবে,
রোদ ঠিকরনো নিতম্ব বেয়ে কয়েকটি পিঁপড়ে
নিজেদের মধ্যে ব্যস্তভাবে কথা বলতে বলতে উঠে যাচ্ছে।
তুমি অনেক চড়াই উতরাই ভেঙে এসে ওর বুকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছো,
ওর স্তনের সুপেয় তরল কখন শুকিয়ে গেছে, বুঝতে পারোনি।
তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না।

 

মাথুর ৪

 

তোমায় যখন ফোন করছি, আমি তখন আসলে এক বাটি মুড়িতে ঢেলে নিচ্ছি
সেদ্ধ মুসুর ডাল, আর একটু আলু,
তার সংগে মিশিয়ে নিচ্ছি বাঁধাকপির পকোড়া।
আর পেঁয়াজকুচি আর অবশ্যই তোমার শিশ্নের মত চাবুক সবুজ একটি কাঁচা লংকা।
তোমার সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন আসলে আমি লংকায় কুট কুট করে কামড় দিচ্ছি,
আর উঃ আঃ করছি ঝালে,
আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে,
ফোটাঁ ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে
আমার স্তনবৃন্ত ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে সপ্তম পাতালে,
সেসব তুমি শুনতে পাচ্ছ না সোনা,
শুধু শুনতে পাচ্ছ উঃ আঃ!

 

মাথুর ৫

 

তুমি যখন ফিরবে, এ শহরে, শীত পড়ে যাবে
নরম উলের মতো রোদ হবে, কোল্ড ক্রিম মেখে
তোমার বুকের কাছে বেড়ালেরা সুখ খাবে, তাই যেন হয়।
এ শহর উঞ্ছ, তবু, তোমার অদেয় কিছু নয়…

 

বিপত্তারিণী পূজাপদ্ধতি

 

তুমি এসে দাঁড়িয়েছ গমকল মাঠে
দাড়িভিট তাড়িপীঠ বিপত্তারিণী
আমরা নিমিত্ত কিন্তু তুমিও তো দেবী
তোমাকে যেভাবে লিখি সেভাবে হারিনি!

 

সময় বোমার মতো, নিরপেক্ষ ফাটে,
শেষ দৃশ্যে লাল সূর্য, ধানক্ষেত ধরে
কবি চলে যাচ্ছেন বাঁশি নিয়ে তাঁর,
ফুটো মুখ বুজে গেছে বৃন্দগান করে।

 

সাইবারে পমেটম গাঁয়ের বধূরা
অফুরন্ত অপশন যমুনা পুলিনে
মাখব, মাখিয়ে দেব, তাফাল মাচাব
সব দিন শুরু হয় অচ্ছে ভালে দিনে!

 

শান্তি ও কল্যাণ

 

আমার এখন কোন মুখ নেই,
আমার এখন কোন চিৎকারও নেই,
সব শান্ত হয়ে গেছে,
শান্তি ও কল্যাণ চতুর্দিকে,
কল্যাণ রাষ্ট্রে কোন হিংসা নেই,
সেতুগুলি নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়,
বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যায় দধিকর্মা হাঁড়ি-
হে অগ্নি, উৎসব করো , নগর-বাওয়ালি
হে মাটি উৎসব ধরো, শাহাদাৎ বালি
জেনে যাও, আমার এখন কোন মুখ নেই,
আমার এখন কোন চিৎকারও নেই!

 

কেন কি মাটিই জানে, মাটি সব জানে
যতই বাওয়াল কর এখানে ওখানে-
ডিকি ভরা লাশ আর গোলা ভরা ধান
পায়ের তলায় নাচে শালা ভগবান!

 

প্রতি-ইতিহাস

 

কী কী শিখলাম আমি এই অব্দে, ভেবে দেখা যাক,
কিছুতে যা শিখব না, ইতিহাস; ভূগোলের কাক
বরাবর ঠুকরে যাবে, ঠুকরোবেই, আমি ভয়হীন
এভাবেই কেটে যাবে আরো কিছু মধুক্ষরা দিন…
আমাদের ইতিহাস, সত্যি বলতে, লেখাই হল না
উখিলা, এলাচি,  ইত্যাদি প্রভৃতি ছলনা,
বামহাতে বটবৃক্ষ, বৌদির চায়ের বিপণি
সেইখানে অকস্মাৎ বেজে ওঠে কালের খঞ্জনি
ইতিহাস জানো কিছু? না জেনেই এত কেতকাত?
স্পর্ধিত বিচি একি! কাঁকুড় যেখানে বার হাত!
উত্তর দিই না কিছু, হেঁটে চলি, উদ্ধাররহিত
দুইপাশে আভা, মনু, তারপরও অনেকটাই শীত….

 

তৃষ্ণা-র কবিতার নির্ভার নৌকো

নীলাঞ্জন হাজরা

পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর বাঁক বেয়ে চলে যাওয়া নৌকো দেখার মতো আমি তৃষ্ণা বসাকের কবিতা পড়ি। একজন কবি যিনি অন্তত দু’ দশক কবিতা লিখছেন, কোনও একটি ছবির ওপর তাঁর কবিতা জগতের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া দারুণ বিপজ্জনক। কিন্তু কবিতার সঙ্গে, কবিতার প্রসঙ্গে যে অনৃত ভাষণ চলে না, তাই আমি নিরুপায় — আমি ওইভাবেই পড়ি তৃষ্ণা-র কবিতা।

ভাবটা কী? ‘টা’ বোধহয় নয়। ভাবগুলো। এ দেখা-পড়ার অনেক ভাব বোধকরি। যেমন, সব্বার আগে মনে পড়ে — Mobilis in mobili। গতির মধ্যে গতিময়। তৃষ্ণা-র কবিতার, সব কবিতার, মধ্যে গতি আছে। বয়ে চলে। তরল? তরল কথাটার ব্যবহারে একটা বিভ্রান্তি আছে। ভারী জানে জলের সাংঘাতিক ভার। টলটলে জলেরও। নদীকে কি খুব ভারী মনে হয় তা বলে? বহমান কিভাবে জানি নিজের ভার জাহির না করা শিখে ফেলেছে। তৃষ্ণা-র কবিতাও। তার গতিটা খেয়াল থাকে, ভারটা নয়। ভারটা ভেবে নিতে হয় পরে, রোমন্থনে।

পুনর্নিমিত স্মৃতি, এ চুম্বনটিও
বহু কাতরতা রাখি, এইবার নিয়ো
এখানে রন্ধন নেই, দীর্ঘকাল হল
উনুনটি ভাঙাচোরা, অপ্রতুল জলও
তৃষ্ণা জেগে রয় তবু পুষ্পে কীট যথা
প্রত্নমন্দিরে পূজা পাননি দেবতা
আশ্বিনের রোদ পড়ে ফুল্ল কুসুমিত
স্তন তার কবেকার, মায়া অগণিত
এখানে রেখেছ মুখ, সপ্তাশ্ব তোমার
জ্যোৎস্না চেটে খায় আজো দুর্নিবার
আর ফিরবে না তুমি? মুহূর্ত মালিকা
গলায় জড়াবে বলে উন্মখ বালিকা
ঝাঁপ দিল শূন্যে ফের অনিশ্চয়প্রিয়
পুনর্নিমিত স্মৃতি, এ চুম্বনটিও।

(এ চুম্বনটিও। গোপন ট্যাটু। কৃতি। জানুয়ারি ২০১৮)

এ কবিতা তৃষ্ণা-র অধিকাংশ কবিতার থেকে আলাদা — ছন্দে, শব্দ চয়নে। ‘ফুল্ল কুসুমিত’ বা ‘পুষ্পে কীট যথা’-র মতো শব্দবন্ধ তিনি কদাচ ব্যবহার করেন। প্রয়োজন বোধে যে করতে পারেন সহজে, তার নিদর্শন এ কবিতা। কিন্তু সে জন্য এ কবিতা উদ্ধৃত করছি না। দেখতে চাইছি, তেমন শব্দবন্ধ সত্ত্বেও, জোরে জোরে বা অস্ফুট স্বরে পড়লে কী নির্ভার তার চলন। ছোট ছোট আটপৌরে ছবি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সহজে। বিশ্বের সব কবিতা পুনর্পাঠ দাবি করা, নতুবা তা কবিতা নয়। পাঠক ভেদে পুনর্পাঠের সংখ্যার ভেদ হয়, কিন্তু একটা সময়ে এসে বোধ হয় তা বোধে ছাপ ফেলে গিয়েছে, এইমাত্র আরও একবার না পড়লেও চলবে। হয়তো বা অনেক পরে নবপাঠ নতুন ছাপে নতুন ছবির দ্যোতনা আনবে। কিন্তু আপাতত এই ফেলে যাওয়া ছাপের রোমন্থনে বুঝি — ওহ্! কী ব্যথায় এ কবিতা কানায় কানায় ভরা। কিন্তু তা পাথুরে নয়। ‘আর ফিরবে না তুমি? মুহূর্ত মালিকা / গলায় জড়াবে বলে উন্মখ বালিকা/ ঝাঁপ দিল শূন্যে ফের অনিশ্চয়প্রিয়…’। রোমন্থনে অনুভব করি, কী কাতরতা জাহির করে না তৃষ্ণা-র কবিতার গতি।

এ তো কবিতার চলন। গতি। নদী। কিন্তু তাতে যে আটপৌরে ছবিগুলো ভেসে চলেছে তরতর করে, তা তো ভেসে যাওয়া লাশ নয়, গাঁদা ফুলের ছেঁড়া মালার কুণ্ডলী নয়, পানা নয়। তার মাঝি আছে। মাঝি তাকে নিশ্চয়ই নিয়ে চলেছে একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত (রাজনীতিকরা শব্দটাকে এত কোরাপ্ট করে দিয়েছে, ব্যবহার করতে দ্বিধা হয়) লক্ষ্যে। মুশকিল হল, মাঝিকে হয়তো বা গলার শির ফুলিয়ে পাড় থেকেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করা যায় — কই লইয়া যাস তর নাও? কবিকে তো যায় না। কোন লক্ষ্যে চলেছে ছবি বোঝাই নৌকো? বড়ো জোর ছবি থেকে একটা আন্দাজ মিলতে পারে, জানার কোনও উপায় নেই। আর সত্যি বলতে কী, উপায় থাকলেও, এমনতরো প্রশ্নে আমি, পাঠক, কবির উত্তরে অবিচল আস্থা রাখতে এক্কেবারে রাজি নই। কোনও কবি যখন কোনও সাক্ষাৎকারে, বা লেখায়, নিজের কবিতার নিজেই ব্যখ্যা দেন কবিতাটির পক্ষে তার থেকে বড়ো বিপর্যয় আর হয় না। কবির নৌকো যাক কবির লক্ষ্যে, আমাদের পাঠকদেরগুলো যাবে নিজের নিজের ঘাটে। আর তৃষ্ণা-র কবিতার ছবির আটপৌরেপনা, প্রায় সর্বত্র, সে নৌকোকে করে নির্ভার। কষ্টকল্পিত ব্যাপারটাই তৃষ্ণা-র কবিতায় নেই।

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া নৌকো দেখায় একটা রোম্যান্টিক বাতাস আছে। তৃষ্ণা-র কবিতাকে সে বাতাসই চালায় বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁর চারটি বই আমি হাতে পেয়েছি — বেড়াল না নীলঘণ্টা? (একুশ শতক।২০০২), উল্টে মেলো (একুশ শতক। ২০১৩), অজাতক সমগ্র থেকে (কলিকাতা লেটার প্রেস। ২০১৭) এবং গোপন ট্যাটু (কৃতি। ২০১৮)। আমার মনে হয়েছে নৌকোর সাজসজ্জা, নদীর গতি এ সবের রকম ফের ঘটেছে অবশ্যই এ ষোল বছরে, কিন্তু রোম্যান্টিক বাতাসটা বয়েই চলেছে।

রাগ হল বিকেলের হাওয়া
দুঃখ হল পাখির মুখর
উড়োবীজ আমার বাগানে
বাগানে সবার আসা যাওয়া

এ মাটি বৃষ্টির মোহনা
রোদ আর মাঝেমধ্যে চর
বৃষ্টি হল বন্ধুর আঙুল
কাছে এলে ছুঁয়ে দেখব না?

(বৃষ্টি হল বন্ধুর আঙুল। বেড়াল না নীলঘন্টা? একুশ শতক। ২০০২।)

গোড়ায় উদ্ধৃত ২০১৮-য় প্রকাশিত কবিতা থেকে ২০০২-এ প্রকাশিত এ কবিতায় তফাত আছে বইকি, কিন্তু বুঝি তৃষ্ণা-র কবিতার পাড়ে দাঁড়ালে কপালে রোম্যান্টিক বাতাস তখনও লাগত, আজও লাগে। কিন্তু রোম্যান্টিক মানেই মাখো মাখো পেলব শব্দে বোঝাই নয় তৃষ্ণা-র নির্ভার নৌকোগুলো। তাতে যথেষ্ট বিশ্রী গন্ধের কুৎসিত দেখতে ছবিও তোলা হয়, তবে হ্যাঁ, সবই অবশ্যই একদিন প্রতিদিনের আটপৌরে জীবন থেকে। কিন্তু সে নৌকোর তরতরে চলে যাওয়ার সার্বিক ছবিটায় রোম্যান্টিক মনখারপই থেকে যায়, কুবাস বা কুদর্শনের ধাক্কা নয়।

আমার কোনও আরোগ্যই পূর্ণ নয়
অন্ত্রের মধ্যে রয়ে যায় পূর্ব জন্মের মরচে ধরা ছুরি কাঁচি,
এমনকী একটা মিকিমাউস ছাপ তোয়ালে,
গতজন্মে যাতে আমাকে জড়িয়ে
বাড়ি এনেছিলেন আমার নেকুপুষু মা,
আমি বড়ো হয়ে যাওয়ার পর
তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়তেন,
সুদীর্ঘ তাঁর চুল, মেঘ কালো, তার মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটার মতো
সদ্য স্নানের জলকণা…
চুল ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি বৃদ্ধা হলেন,
তখন অয়েলক্লথে ওই তোয়ালে পেতে তাঁকে শুইয়ে রাখা হত।

আমি এখান থেকে আমার গতজন্মের মায়ের হিসির গন্ধ পাচ্ছি!
আমার পুরোনো হাঁটুর ব্যথা আবার জেগে উঠছে,
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি গতজন্মর ফোস্কাগুলো আবার লজ্জারুণ হয়ে উঠেছে,
সমস্ত কিশলয় ও হলুদ পাতা হাওয়ায় গোঁত্তা খেতে খেতে আমার কাছে ফিরে আসছে
ধনুকের ছিলার মতো আমার শরীর ক্রন্দসী, শত সহস্র জন্মের বেদনা।

(জাতিস্মর। অজাতক সমগ্র থেকে। কলিকাতা লেটার প্রেস। ২০১৭।)

রোম্যান্টিক খোলা হাওয়া পালে লাগিয়েই তৃষ্ণা পৌঁছে যেতে চান তাঁর কবিতায় আবহমানকে ছুঁয়ে ফেলার লক্ষ্যে। কিন্তু এ কবিতায় আমরা ওপরে দুটো কবিতার ছবির বাইরেও, গতির মধ্যে গতিময়তা আর রোম্যান্টিকতার বাইরেও, আর একটা ছবি পেয়ে গেলাম, যাতে তৃষ্ণা-র বহু কবিতাই ভরা, যা আমাকে মনে করিয়ে দেয় তৃষ্ণা-র কবিতা পড়া আমার কাছে পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর বাঁক বেয়ে তরতর করে চলে যাওয়া নৌকো দেখার মতো হলেও, সে পাড় কখনও যেমন গ্রামে, কখনও গঞ্জে হতে পারে, তেমনি কিন্তু বাবুঘাটও হতে পারে দিব্যি। নাগরিক। ততটাই নাগরিক, যতটাতে নগরমাত্রেই দেঁতো বিনিদ্র রাতদিন সাতদিন ঝলমলে হাসির শপিং মলের শহর ছাড়াও রয়েছে আটপৌরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিকিমাউস ছাপের তোয়ালে দিয়ে নারীর কালো-মেঘ-চুল ঝাড়া।

আর যেটা বলতেই হয়, তৃষ্ণা-র কবিতা দ্ব্যর্থহীন ভাবে নারীর স্বর। শরীরী বর্ণনাতেই শুধু নয়, অনুভবে। আমাকে একবার এক সংবেদনশীল মহিলা কবি বলেছিলেন — ‘‘নীলাঞ্জন, ‘নারীর হৃদয়’ বলে কিছু হয় না, ওটা ‘পুরুষ অবলোকনে’ গঠিত। ওতে পুরুষদের খুব সুবিধে হয়।’’ এর বেশি কিছু বলেননি। চমকে উঠেছিলাম। তর্ক করিনি। পুরুষ হয়ে এ নিয়ে কোনও কথা বলার এক্তিয়ারই তো নেই, গর্ভযন্ত্রণার ক্ষমতা যার নেই সে জানবে কী করে, হৃদয়ের নারী-পুরুষ ভেদ হয় না হয় না? কিন্তু ‘মা-বোন-দেবী’ যে পুরুষ-নির্মাণ তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে বলেই মনে করি না। প্রশ্ন হল, ‘মা-বোন-দেবী’-র হৃদয় কি পুরুষের থেকে পৃথকভাবে অনুরণিত হয়, বিষাদে বা পুলকে? জানি না। কিন্তু তৃষ্ণা-র কবিতা পড়ে মনে হয়েছে নদীটিকে নারী করেছে পুরুষ বৈয়াকরণেরা, এতে নদীর কোনও হাত নেই, নারীর তো নেই-ই। একমাত্র অর্থহীন এই লিঙ্গ-ব্যাকরণ ছাড়া, নদীকে নারী বলে চেনার তিলমাত্র প্রয়োজন কখনও বোধ করিনি। তৃষ্ণা-র কবিতা পড়তে পড়তেও মনে হয়নি এ কবিতার হৃদয় নারী, আর তার কিছু ছলাৎছলের তরঙ্গ আমি ধরতেই পারছি না। হতে পারে কিন্তু তোমনটা, আমার তা মনে হয়নি, স্রেফ এইটুকুই। তবে নদীকে নারী করে দেওয়া দিয়েই তো মালুম হয় যে, পুরুষ আবলোকন অবশ্যই পৃথক একটা আছে। কাজেই নারী-অবলোকনও আছে বইকি আলাদা। সে অবলোকনে যা চোখে পড়ে তা হৃদয়ে জারিত করে যে কবিতা উঠে আসে তার স্বরও অবশ্যই আলাদা। এক নকল না করলে, নারী-পুরুষ স্বরে গুলিয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই। তৃষ্ণা-র কবিতা তা জানান দেয়। জানান দেয় এমন কবিতাতেও, যার কথিত বিষয় নারীর পুরুষ-নির্ধারিত সীমানার মধ্যে পড়ে না ঠিক। নদীর বহমানতা বা নৌকোর তরতরে চলায় পার্থক্য দেখি না। লক্ষ্য জানি না, তাই তফাৎ বোঝার ভান করে লাভ নই। কিন্তু মাঝিটি যে নারী তা তার শরীর ছাড়াও, নৌকোয় তোলা ছবিগুলো দেখেও মালুম চলে বইকি। তৃষ্ণা-র কবিতায় অহরহ চলে। সে ভিন্নতাটা মোক্ষম —

নীল টিউনিক, তার ভেতরে সাদা ব্লাউজ, তার ভেতরে একটা মেয়ে —
মেমসাহেবের মতো চুল;
লাল নীল মাছ ঘিরে আছে মেয়েটাকে,
সোনালি মাছ, রূপলি মাছ — তাও থাকতে পারে,
খুব পুরোনো পর্যটনের মতো এরা আমার বায়োলজি
খাতায় ঢুকে গেল।
চিরল চিরল পাতাটা কঙ্কালের হাতের মতো আমার মুখের খুব কাছে,
আমি ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ সেই হাতটা আমার মুখের ওপর,
আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি,
আর আমার ঘুম ছিঁড়ে যাওয়া মালার পুঁতির মতো
চারদিকে ছিটকে যায়।
আমি বেসিনের মধ্যে প্রায় মুখ গুঁজে জোরে জোরে
জলের ঝাপটা দিই,
আয়নায় দেখি রক্তের ছিটে, মুখটা ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে
সেইসময় অনেকটা অলৌকিক ভাবেই
দেওয়ালে নীল টিউনিক, আর ভেতরে সাদা ব্লাউজ,
তার ভেতরে একটা মেয়ে,
চারদিকে ভিড় করে আছে লাল, নীল কিংবা সোনালি, রূপোলি
মাছের ঝাঁক!

(কঙ্কাবতী। উল্টে মেলো একুশ শতক। ২০১৩)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...