করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে ট্রাম্প প্রশাসনের হাস্যকর পদক্ষেপ

জেফ্রি স্যাক্স

 



লেখক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট-এর নির্দেশক। লেখাটি সিএনএন-এর ই-পেপারে প্রকাশিত।

 

 

 

হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সারভিসেস-এর সেক্রেটারি আলেক্স আজারের সাম্প্রতিক বিবৃতি থেকে আমেরিকার ক্ষমতাবান এলিটদের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া গেল। আজারকে ট্রাম্প প্রশাসনের মার্কামারা নিযুক্তি বলা যেতে পারে। ওষুধ কোম্পানির এই প্রাক্তন ম্যানেজার ওষুধ কোম্পানির এক তদ্বিরকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে ডেকে এনে জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব দেওয়াটা নিছক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সাম্প্রতিক কালের এমন ব্যাপক মহামারির মধ্যেও সাংবাদিক সম্মেলনে আজারের চিন্তাধারাতে বোঝা গেল তিনি জনস্বাস্থ্যের উন্নতির চেয়েও কর্পোরেট মুনাফার ব্যবস্থাপনা বজায় থাকলেই স্বস্তি পান।

করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির ব্যাপারে যে আজব বিবৃতিটি আজার দিয়েছেন, তা হল:

“সত্যি কথা বলতে কি, এখন এই মুহূর্তে শুধু বিশ্বের মানুষজনই ভাবছেন না, বেসরকারি বাজারি আর ওষুধ কোম্পানিগুলিও এই নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের ধারণা অনুযায়ী, এটাকে ঠিক জীবাণুযুদ্ধের জন্য স্বাভাবিক প্রস্তুতি বলা যাবে না, যেখানে একমাত্র সরকারই ক্রেতা হিসেবে নির্ধারিত। যেমন ধরুন স্মল পক্সের চিকিৎসার সময়ে ছিল। আমাদের বিশ্বাস, এক্ষেত্রে চাহিদা, বিক্রি এবং রসদ করবার ব্যাপারগুলি বাজারই ঠিক করবে। কিন্তু প্রতিষেধক তৈরির কাজটা ত্বরান্বিত করবার পাশাপাশি আমরা নিশ্চিত করতে চাইব যে ওষুধ সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও গবেষণাও চলতে থাকে।”

আজার বলতে চাইছেন করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি হয়ে গেলেই তা সরকারি রসদখানায় জমা না করে বেসরকারি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাই তিনি বলছেন, “চাহিদা, বিক্রি এবং রসদ করবার ব্যাপারগুলি বাজারই ঠিক করবে।” ইলিনয়-এর সেনেটে রিপাবলিক পার্টির জ্যান স্যাকোয়োস্কি-র চাপে আজারকে বলতে হয়েছে বটে যে “প্রতিষেধকটির দাম সবার সাধ্যের মধ্যে থাকবে।” কিন্তু একই সঙ্গে তিনি কৈফিয়ত দিচ্ছেন, “আমরা দামটিকে সাধ্যের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করছি, তবে দামটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না কারণ আমরা চাইছি বেসরকারি সেক্টর এতে বিনিয়োগ করুক।” এখানে তিনি ইঙ্গিত দিয়ে রাখছেন যে ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি যেহেতু দাম ঠিক করবে, তাই তা সবার সাধ্যের মধ্যে থাকবে কিনা, তা সরকার নিশ্চিত করতে পারছে না। ঘটনাটি অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে মহামারির ক্ষেত্রে এর জের মারাত্মক হতে পারে।

এটা ভুল পথ। যদি আমরা অনুসন্ধান, গবেষণা এবং পরীক্ষার শেষে এক বছর পরে সাধ্যের মধ্যে প্রতিষেধকটি সৌভাগ্যবশত পাই, সেটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগণ এবং দুর্বল সম্প্রদায়গুলির উপর মহামারি সংক্রান্ত বিদ্যা (epidemiology) অনুসরণ করে সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি মেনে নিয়মানুগভাবে লাগাতার ব্যবহার করা প্রয়োজন। এভাবেই পরিকল্পিত জনস্বার্থ নীতি এবং কার্যক্রমের মাধ্যমে মহামারিকে থামানো হয়ে থাকে।

আজারের বিবৃতি আরও বেশি অনিষ্টকারী এই কারণে যে গবেষণার জন্যে যে ব্যয়ভার তা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অফ হেলথস (NIHs) প্রায় পুরোটাই বহন করবে। ধনিকতান্ত্রিক (plutocratic) আমেরিকার চলতি মডেল অনুযায়ী করদাতারাই ওষুধ সংক্রান্ত অধিকাংশ অনুসন্ধান ও গবেষনার খরচ জোগায়, এবং তারপরে সেই মেধাশক্তির ফলশ্রুতিতে পাওয়া কারিগরি কৌশলগুলিকে বিনামুল্যে বেসরকারি উদ্যোগগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়। যাতে ওরা ২০ বছরের পেটেন্ট প্রোটেকশন নিয়ে আমেরিকার জনগণের পরিশ্রমের টাকায় নিজেদের সোনার সংসার গড়তে পারে।

অসদুপায়ে উপার্জনের এই দশকের পর দশক ধরে চলা এই কালোবাজারির পুরোটা এখন আমাদের চোখের সামনে রয়েছে। এই আশ্চর্যজনক তদ্বিরের জন্য ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য দপ্তরের ৫৯৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য অনুসারী পথটি সঠিক পথ। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অফ হেলথস এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে এবং একটি বৃহৎ করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরির জন্য খরচ জোগাবে। যা তার পরিকল্পনায় আছে। এরপর বেসরকারি সংস্থাগুলি NIH-এর সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে আগাম পরিকল্পনা সহ আমেরিকা সরকারকে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির জন্য রয়্যালটি দিয়ে একটি প্রতিষেধককে সফলভাবে ব্যবহার করার জন্য যুক্ত হতে পারে।

এটা নিশ্চিত যে একটি প্রতিষেধকের সাফল্য NIH এবং অন্যান্য সরকারি এবং অলাভজনক সংস্থাগুলির দেওয়া টাকার ঊপর (যার মধ্যে প্রাইভেট ফাউন্ডেশন এবং অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্য চিনের মতো আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও আছে) অনেকটাই নির্ভর করবে। অনুসন্ধান ও গবেষণার একটি অংশ হয়তো বেসরকারি উদ্যোগগুলি থেকেও আসতে পারে।

জনস্বাস্থ্য নীতি অনুযায়ী প্রতিষেধকটি তৈরি করা গেলে তা বিশ্বের সব উৎপাদক সংস্থাকে সঠিক উৎপাদন প্রক্রিয়া মেনে বিনা লাইসেন্সে বানানোর কথা বলা হবে। বিশ্বের জনগণকে সেই প্রতিষেধক দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশ জনসমক্ষে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন সহ বিভিন্ন দান সংস্থার সাহায্য নিয়ে জোগান দেবে।

না আজার সাহেব। বেসরকারি উদ্যোগের হাতে এই কাজ দেওয়াটা হাস্যাস্পদ হবে। সেক্রেটারি মহাশয়, আমরা রোগী সুরক্ষার জন্য জনসাধারণের টাকায় নতুন প্রতিষেধক বানিয়ে বিশ্ব জুড়ে এই জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করব না।

প্রতিষেধক বানানোর কাজটা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজ-এর দক্ষ নির্দেশক ডক্টর অ্যান্টনি ফাউসি-র হাতে দিন। তারপরে ফেরারেল গভর্নমেন্টকে ভ্যাক্সিন ডেলিভারির দায়িত্বটার নেতৃত্ব দিতে বলার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অর্থ জোগানের কথা বলুন। বেসরকারি উদ্যোগ জুড়িদার হিসেবে থাকতে পারে, তবে তাঁকে ফেডারেল সরকারের স্পষ্ট নেতৃত্বে কাজ করতে হবে। ভ্যকসিনের কারও একচেটিয়া অধিকার থাকবে না।

এই সূত্রে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি পোলিও ভ্যাকসিন তৈরির প্রেরণাদায়ক ঘটনাটি মনে করুন। তদানীন্তন রাস্ত্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, যিনি ১৯২১ সালে পোলিও আক্রান্ত হন, বোঝেন যে, শুধু বেসরকারি উদ্যোগ দিয়ে কাজের কাজ হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার পাবলিক ফান্ড তৈরি করবার আগেই ১৯৩৮ সালে FDR লাভজনক নয় এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ভাবনা ভেবে তাকে ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইনফ্যান্টাইল প্যারালিসিস-এর নেতৃত্বে বসিয়ে বিখ্যাত ‘মার্চ অফ ডাইমস’ শুরু করেন।

পোলিও ভ্যাকসিন-এর প্রাথমিক কাজের জন্য মার্চ অফ ডাইমস প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দেয়। ১৯৫৩ সালে প্রথম সফল পোলিও ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে বলে ঘোষণা করেন ডক্টর জোনাস সাল্ক। ভ্যাকসিনটিকে ১৯৫৪ সালে কনট্রোলড ট্রায়ালসের জন্য আমেরিকা, কানাডা এবং ফিনল্যান্ডের ১৬ লক্ষ শিশুদের উপর ব্যবহার করা হয়। তা নিয়ে ১৯৫৫ সালে বিরাটভাবে ইমিউনাইজেশন ক্যামপেন চালানো হয়। এর ফলশ্রুতিতে আমেরিকায় পোলিও-র ঘটনা কমে। ১৯৫৪ সালে যা ১ লক্ষ জনসংখ্যায় ১৩.৯ ছিল, ১৯৬১ সালে তা নেমে লক্ষপিছু ০.৮-এ পৌঁছায়।

কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের নিউস অ্যাঙ্কর এডওয়ার্ড আর মারো যখন জানতে চান, “এই ভ্যাকসিনের পেটেন্টটির মালিক কে?” তখন সাল্ক যে বিখ্যাত উত্তরটি দেন তা হল, “দেখুন, আমি বলব এটি মানুষেরই। এর কোনও পেটেন্ট নেই। আপনি কি সূর্যের পেটেন্ট করতে পারবেন?” জনমুখী এই চিন্তাধারার জন্য পোলিও এপিডেমিক বন্ধ হয়। আমেরিকাকে করোনা ভাইরাস থেকে শুরু করে আবহাওয়া পরিবর্তনের মতো মস্ত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করে উঠে দাঁড়াতে হলে জনমুখী এমন চিন্তাধারাই আমাদের এখন প্রয়োজন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...