মা শীতলার শীতল জল

জগন্নাথদেব মণ্ডল

 



লেখক কবি, গদ্যকার

 

 

 

শ্রীকৃষ্ণ কলোনি যেখানটায় শেষ হচ্ছে ঠিক সেখান থেকে চষা জমির শুরু। খানিকটা এগোলেই দৃষ্টি হারিয়ে লেপেপুছে যায়। ছোট রোগা নালা বেয়ে তিরতির করে জল ওঠে পাইপ বেয়ে বেয়ে— চারিদিক মা লক্ষ্মীর ধানে ধানে ছেয়ে আছে। নরম ঠান্ডা দুধ। এখন মড়কের হাওয়া লেগে এইখানটা নীল নির্জনতার ভিতর ডুবে আছে।

যদিও রোগভোগ থেকে বাঁচতে একটি নিমগাছ লাগানো আছে দক্ষিণ দিকে। নিমের তেতো বাতাস খুব ভালো— আকাশের চিকিৎসকরা নাকি বসবাস করেন এখানে। তারপাশে ছোট শাহ জংলির মাজার বকুল গাছের নীচে। গাছে ধুনো জমে। লোকে লাল ঘোড়া, ধূপ মানত করে যায়।

ছাগল চরানো হাকিমের মা এসে গাছের ছায়ায় মাথা পেতে শুয়ে থাকে। তার পুত্রশোক তাকে ঘিরে রাখে। তার পায়ের কাছে সোনারং বেজি, কাঁটা ঝমঝম করা শজারু, ক্যাঁচকেঁচে পাখি ঘুরে ঘুরে যায়। কঙ্কালসার গরু জলঘাসে মুখ ডুবিয়ে ডুবিয়ে খায়। পাকা কাতলা মাছ ঘাই দিয়ে দিয়ে জল তোলপাড় করে। জলঢোঁড়া সাপ কলমিবনের ডগা হয়ে ঠান্ডা জলের গোলাপি মমতায় শুয়ে থাকে।

মানুষ বেরোতে পারে না বাড়ি থেকে। দাপে গজগজ করা মানুষ এখন ঘরবন্দি। সকাল থেকে আকাশ পানাফুলের চেয়েও উজ্বল ঘন নীল হয়ে থাকে। কুচো কুচো তারার ফুলের মতো নিমফুল তিতকুটে গন্ধে বাতাস মাতিয়ে রাখে।

আমি অনেক দূরে নীলাভ আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে এসব দেখি। কানকে আরও তীক্ষ্ণ করে শোনার চেষ্টা করি। খুব সুতীক্ষ্ণ হলে কানে মাছের কানকোর রং ধরে। আমি শুনতে পাই ফিশফিশ করে জলের নীচে ঘোড়া চরছে। তাতে বসে আছে পীরবাবা। শ্বেতঅশ্বের পায়ে বাঁধা ঘুঙুরধ্বনি আর মাটির চৈতন্যের পায়ে বাঁধা মল রুনুঝুনু করে বাতাসে। মাটির পার্ষদ সকলে নামজপ করে।

দূরের হাকিমের মা মনে মনে বিড়বিড় করে মরা ছেলের জন্য আরও একটি মুর্গিডিম রাঁধতে হবে।

সে প্রশ্ন করে ভেরান্ডা গাছকে— বল গাছ মোরে বল, রোগভোগ নরম হবে কবে?

গাছ নিরুত্তর।

ওরে শালিক, মানুষ পেটপুরে খেতে পাবে তো রে?

শালিক পোকামুখে উড়ে পালায় গাছের ডালে।

বিকেলের কেরোসিন গন্ধ মেঘ এসে বুড়ির চুল অধিকার করে। চালডালআলুতেলের গন্ধে ভরে ওঠে দশদিক। মড়ক ডাঙশ খাওয়া দাঁড়াশ সাপের মতো পিছু হটে। বুড়ি মঙ্গলকামনায় মাটিতে গড়াগড়ি দেয়। আর তার শরীরে পায়ের ডিমে, নাকের ফুলে, চোখের তারায় একটি দুটি করে পাতা ফুটতে থাকে।

আমাকে হাকিমের মা ভাবে দূরের বনতুলসীর ঝোপ। চারিদিকে বনের মায়া ছুটে আসে, গরম ভাত রান্নার গন্ধ মানুষের গভীর চেতনাকে চেপে ধরে।

এইভাবে মানত করা ভাঙা ঢেলা হয়ে মা শেতলার গেরাম গভীর শুশ্রূষার দিকে এগোয়। আমাদের বুকে থ্যাঁতলানো গাধার পায়ের মতো পাপছোপ মিলিয়ে যেতে শুরু করে। আমরা সর্বজয়া গাছ লাগাই আর সকলে মিলে ফিরতে চাই গভীর আদিম বৃষ্টিরেণুর গন্ধে মাখামাখি বনজঙ্গলের দিকে।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...