গণপিটুনি আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে…

সোমেন বসু

 

 



লেখক কাগজকার

 

 

তিনজনকে পিটিয়ে মারা হল। গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি। মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলায়। গড়চিঞ্চালে গ্রামের কাছে। থানা কাসা। তিনজন গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। একজন ড্রাইভার আর দুজন সওয়ারি। সেইসময়ই প্রায় ২০০ জন গ্রামবাসী তাঁদের আক্রমণ করে। সন্দেহ ছেলেধরা। প্রথমে ঢিল ছুঁড়ে, তারপরে গাড়ি থামলে লাঠি দিয়ে পেটানো। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সবার। পুলিশ খবর পেয়ে তাঁদের বাঁচাতে গেলে তারাও আক্রান্ত হয়। পরে পুলিশ ৯ জন নাবালক সহ ১১০ জনকে গ্রেপ্তার করে।

এই হচ্ছে খবর বা ঘটনা। চুম্বকে।

কিন্তু ঘটনার আগেপিছেও অনেক ঘটনা থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক। দেখা যাক খানিক। প্রথমে সামাজিক দিক থেকেই।

দুটি পক্ষ স্পষ্টতই। আক্রান্ত বা নিহত দুজন। হ্যাঁ, সওয়ারি দুজনের কথাই বলছি। ড্রাইভারও মারা গেলেও সে তো ড্রাইভার নিছক। তাকে নিয়ে কোনও কুম্ভীরাশ্রুই বর্ষিত হচ্ছে না। স্বাভাবিক।

আর আক্রমণকারীরা। ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা।

বলা হচ্ছে নিহত দুজন সাধু। কারণ তাদের পরিধানে গেরুয়া ছিল। দুজনের নাম কল্পভ্রুক্ষ গিরি এবং সুশীল গিরি। বয়স যথাক্রমে ৭০ ও ৩৫। এখন এই সাধু পরিচয়টুকু কিছু উত্তেজক প্রচারের জন্য কার্যকরী হতে পারে, কিন্তু তার আর বেশি কোথাও আমাদের পৌঁছে দেয় না। কিন্তু এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রকৃত উৎস অনুধাবনের জন্য তাঁদের বিশদ পরিচয়টা জানা জরুরি।

তবে এই বৃদ্ধ সাধু সম্পর্কে একটা জিনিস নজরে এল সেটা জানিয়ে রাখি। ইনি একটি জমায়েতে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সমস্ত হিন্দুদের এককাট্টা হয়ে সশস্ত্র হওয়ার ডাক দিচ্ছিলেন একটা ভিডিও[1]তে দেখা গেল। যাই হোক, এসব নিয়ে কথা বলে মূল বিষয় থেকে সরে আসার কোনও মানে হয় না।

এনারা, অর্থাৎ এই নিহত দুজন, গোসাবি যাযাবর সম্প্রদায়ের অন্তর্গত গিরি উপসম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। বেনারসের শ্রী পঞ্চ দশনম আখড়া[2]র সঙ্গে যুক্ত। সমাজতাত্ত্বিক কালিদাস শিন্ডে, যিনি নিজেও গোসাবি সম্প্রদায়ের মানুষ, জানাচ্ছেন— “গোসাবি সম্প্রদায়ের মধ্যে কম করে ১৬টি উপসম্প্রদায় আছে। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন আখড়ার সঙ্গে যুক্ত। এরা সাধারণভাবেই গেরুয়া পরিধান করে থাকে। যদিও এদের সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায় না, কিন্তু এরা যাযাবর জীবনযাপনেই অভ্যস্ত। এদের এই জীবনযাত্রার জন্যেই মানুষ এদের সন্দেহের চোখে দেখে এবং গণরোষের শিকারও এদের হামেশাই হতে হয়।”[3]

বিভিন্ন যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষকেই যে সাধারণ গৃহী মানুষেরা সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন, সেটা প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করার জন্য শব্দ খরচ নিষ্প্রয়োজন। আরও একটা তথ্য দিয়ে রাখি। দু বছর আগেই এই মহারাষ্ট্রেরই ধুলে জেলায় এই গোসাবি সম্প্রদায়েরই পাঁচজন মানুষ এইরকমই ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হন।[4]

যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষদের রাষ্ট্রও কীভাবে সফট টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়, তা নিয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশাল সাইন্সেস-এ যাযাবর উপজাতিদের নিয়ে কর্মরত সমাজবিজ্ঞানী মায়াঙ্ক সিনহা সেই সময় একটি নিবন্ধ[5] লিখেছিলেন। পড়ে দেখার অনুরোধ রইল।

এবার গ্রামবাসী অর্থাৎ আক্রমণকারীদের কথায় আসা যাক।

ভৌগোলিক দিক দিয়ে পালঘর উপকূলবর্তী মহারাষ্ট্রের উত্তর প্রান্তবর্তী জেলা। গুজরাট এবং দাদরা ও নগর হাভেলির সঙ্গে এই জেলার সীমান্ত আছে। এই লকডাউনের বাজারে এখন পালঘরে প্রচুর পরিযায়ী শ্রমিক আটকা পড়ে রয়েছেন। এত বহিরাগত মানুষের উপস্থিতি এই সন্দেহের আবহে স্থানীয় মানুষকে এমনিতেই সতর্ক এবং সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। তার সঙ্গে যোগ করুন এই লকডাউনের বাজারে হঠাৎ একটি বহিরাগত গাড়ি এবং তাতে দুটি অপরিচিত মানুষ। এখানে বলে রাখি, ওঁরা সিলভাসা যাচ্ছিলেন একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। জাতীয় সড়ক দিয়েই যাওয়ার কথা, কিন্তু লকডাউনের জন্য জেলার সীমান্ত সিল থাকায় তাঁরা গ্রামের ভেতরের রাস্তা ধরেন। আরও যোগ করুন বিভিন্ন সময়ে হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে চালিয়ে যাওয়া ছেলেধরা গুজব। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনও মব লিঞ্চিং-এর ঘটনার পেছনে এখন হোয়াটস্যাপ একটা অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। বিজেপির জমানা শুরু হওয়ার পর থেকে এ তো এখন প্রায় শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ।

যাই হোক, গ্রামবাসীদের সবাই আদিবাসী। সাক্ষরতার হার ৩০ শতাংশ। প্রায় সবাই প্রান্তিক চাষি, আর নয়তো কাছাকাছি শিল্পশহরগুলিতে শ্রমিকের কাজ করেন।

তাহলে এই হচ্ছে সামাজিক চিত্র।

রাজনৈতিক দিক দিয়েও এই ঘটনার থেকে দুটি বিষয় অবশ্য-প্রণিধানযোগ্য।

প্রথমত, ঘটনার পরবর্তীতে সোশাল মিডিয়ায় বিজেপির যথারীতি নোংরা সাম্প্রদায়িক প্রচার। হিন্দু সাধু আক্রান্ত, হিন্দু খতরেঁ মেঁ হ্যায়… সেই চেনা, কিন্তু কার্যকরী লাইন। কে নেই সেখানে? চিত্রপরিচালক অশোক পণ্ডিত, সুদর্শন নিউজের প্রধান সম্পাদক সুরেশ চৌহানকে তো এই ঘটনার ভিডিও দেখে ‘মার শোয়েব মার’ কথাগুলোও শুনে ফেললেন। বিভিন্ন স্তরের বিজেপি নেতারা সেকথা টুইট করে ছড়াতে লাগলেন।[6] অর্ণব গোস্বামীও সোনিয়া গান্ধিকে আক্রমণ করে আসরে নামলেন। কেন তিনি নীরব? কারণ তিনি ইতালীয়।[7] তা এগুলি তো প্রকাশ্যে। এর সঙ্গে ধরে নিন আইটি সেলের সর্বগ্রাসী প্রচার। বিশেষত হোয়াটস্যাপে।

একটা ব্যক্তিগত কথা বলতে ইচ্ছে করছে এ প্রসঙ্গে। কয়েকদিন আগে, এসব লকডাউন শুরু হওয়ার আগেই, দাঙ্গা নিয়ে একটা কুচো গল্প লিখেছিলাম। বেশ কয়েকবার ভেবেছি, নিজের ফেসবুক ওয়ালে দেব সেটা। কিন্তু তারপর পিছিয়ে গেছি এই ভেবে যে, এই করোনা এবং লকডাউন ইত্যাদির বাজারে অন্য প্রসঙ্গে কোনও লেখা দেওয়া আসলে মানুষকে বিরক্ত করার নামান্তর হবে বোধহয়। এই যে এই মানসিকতা, আমি নিশ্চিত এ আমার একার নয়, আমাদের চূড়ান্ত দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখুন বিজেপির দিকে। করোনা হোক, লকডাউন হোক, দুনিয়া রসাতলে যাক, ওরা ওদের অ্যাজেন্ডায় একাগ্র, অনড়, অটল, নাছোড়। এই করোনা সঙ্কটের মধ্যেই আমরা তবলিগি জামাত কাণ্ডে ওদের পেটোয়া মিডিয়ার প্রচার[8] দেখেছি। দেখেছি উত্তর প্রদেশ সরকারের সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বিরুদ্ধে শমন[9] জারি করা। দেখেছি কান্নন গোপীনাথন, প্রশান্ত ভূষণদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপ[10]। আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত অতএব, বিজেপির থেকে, একমুখিনতার শিক্ষা, আক্রমণাত্মক মনোভাবের শিক্ষা।

আর দ্বিতীয় বিষয়টি হল এই গণপিটুনির সংস্কৃতি। মব লিঞ্চিং ভারতবর্ষে নতুন নয়। এর প্রধান কারণ দেশের মানুষ প্রশাসনের ওপর ভরসা করে না। মানুষ বিশ্বাস করে পুলিশ ঘুষ খায়। বিশ্বাস করে, কোনও অপরাধীকে— এখানে অপরাধী সত্যি কি মিথ্যে বিচার্য নয় কিন্তু, কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যখন মানুষ আইন হাতে তুলে নেয় তখন সে অবশ্যই বিশ্বাস করে যে সে প্রকৃতই অপরাধটা করেছে বা করবে— পুলিশের হাতে তুলে দিলে তারা তাকে টাকা খেয়ে ছেড়ে দেবে। এসব বিশ্বাসকে ভুল বলার কোনও জায়গাই নেই। একদেশদর্শী বলা যেতে পারে বড় জোর। কারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দেখতে দেখতে এহেন শিক্ষা অর্জন করেছে।

এবার, তা সত্ত্বেও গণপিটুনির এই মাত্রাছাড়া প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি হালে, অবশ্যই বিজেপির বদান্যতায়। বিজেপি সুকৌশলে মানুষের এই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাওয়ার মনোভাবের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার গরল মিশিয়ে দিয়েছে। আখলাক, জুনেইদ, আফরাজুলের মতো ঘটনাগুলির পর উল্লাস করেছে প্রকাশ্যে। ঘোষণা করেছে যে আরকম আরও হবে। কিন্তু এতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মুক্ত হয়ে গেলে বিজেপি সামলাতে পারবে তো?

আমাদের দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির যা বর্তমান হাল, তাতে এই ভয়ানক সংস্কৃতি যে অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হচ্ছে না তা নিয়ে কোনও সংশয় রাখা নিরর্থক। বিরোধীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষের মধ্যে থেকে এই প্রবণতা বন্ধ করার জন্য নিবিড় রাজনৈতিক কাজের প্রয়োজন। আবার কোনও এক সুন্দর প্রভাতে কোনও জাদুদণ্ডের পরশে প্রশাসনও নিজের চরিত্র বদল করে ফেলবে, এমনটাও হওয়ার নয়। ফলে এধরনের ঘটনা আমাদের আরও প্রত্যক্ষ করার জন্য তৈরি থাকতে হবে।


[1] https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=260308678481951&id=100035084614126
[2] Sadhus lynched in Palghar were affiliated with this UP akhara, the largest in India; The Print, 22/4/2020
[3] Plight of Nomadic Tribals; Three Men Lynched in Maharashtra, Two from Nomadic Tribe, BJP Leaders Push Communal Angle; The Wire, 20/4/2020
[4] In Another Rumour-Triggered Lynching, Five Men Killed in Maharashtra; The Wire, 2/7/2018
[5] How Nomadic Groups End up Being Victims of Stigma and Discrimination; News18, 7/7/2018
[6] Palghar lynching incident falsely communalised on social media; Alt News, 20/4/2020
[7] Would Antonia Maino (Sonia Gandhi) have remained silent if Christian padres were killed? Arnab asks on news debate over Palghar mob-lynching of Sadhus; OpIndia, 22/4/2020
[8] করোনা ও ইসলামোফোবিয়া: নতুন বোতলে পুরনো মদ; চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ১৯/৪/২০২০
[9] করোনা সঙ্কটের মধ্যেও শমন জারি চলছে; চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ১৯/৪/২০২০
[10] লকডাউন, তবু রাষ্ট্রের দমননীতি চালু আছে; চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ১৯/৪/২০২০

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4873 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...