অসাড়লিপি ১৩

অসাড়লিপি ১৩ : শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় 

 

ধোঁয়াশা, ছাই হয়ে থাকা দৃশ্য গাছ, যতটা চলন তাকে চোখের ভিতরে আলোর স্থিরতা ভাবি, ভাবি মরুদিবসের ধুলো, নিজেকে ব্যক্ত না করতে পারার রাগ কতদূর যায় সূক্ষ্ম বালির মধ্যে দিয়ে…

আমার শরীরের ঠান্ডা তোরই তাপে                 তোর শীতলতাই আমার বালি
বালির তৈরি যে পাখি লুকিয়ে রেখেছিস বাড়ির বাক্সে তার যত্ন নিতে তোর দিন
ক্রমাগত আচমকা জন্ম নেওয়া লার্ভা                থকথকে মৃদু বিচলন
ক্ষয় ও খেলার মাঝে, ঠিক সময় ও ঠিক মানুষের না-বোঝাপড়া
আমার অপেক্ষাগুলোর ফ্যাকাশে তরুণাস্থি

বালির তৈরি যে পাখি লুকিয়ে রেখেছিস বাড়ির বাক্সে
তোর জন্মশহরের ভিড়ে আঠা দিয়ে আটকানো তার পালক
যেভাবে জোরালো ফোঁটা থেঁতলে দিয়েছে বালকের হাতের পাপড়ি
একধরণের ভাষার জটিল উজ্জ্বল মিনার
এক দৃষ্টিভঙ্গি            যার চোখ নেই

কোথায় চলেছি আমি? এই দীর্ঘ প্রস্তরীভূত অরণ্যে এই শীতলতম বরফের বিস্তীর্ণ চরাচরের মত জমাট রোদ্দুরে? একটু দূরের পাতা-স্থির গাছটাকে ভেবে নিচ্ছি আগুনের বীজতলা, চোখ বুজলে যে দুনিয়া ধরা আছে দুই-ভুরুর মাঝখানে তাকেই ঋতু বলে ডাকি। খুন হওয়া আমার ভ্রূণ, দুমড়ে দেওয়া আমার হাড়, ঠিকরে আসা পচা তরুণাস্থির রঙে মুড়ে থাকা বিকেলে কতদূর যাওয়া যায়? নাক ও গন্ধের মধ্যবর্তী কণায় ভাসিয়ে রেখেছি শান্তি, যাবতীয় না হওয়া চিৎকারগুলো পুঁতে দিচ্ছি এই রোদ্দুরের ডেলায় যেমন মেরু প্রদেশের নদীর গভীরে প্রাণ

গ্রীষ্মই তো সেই অঞ্চল সেই বিশেষ রকমের অভ্যেস থেকে বেরিয়ে আসা যেভাবে জীবনে প্রথমবার রং। যেভাবে জমাট আলো ও অন্যান্য স্তম্ভে স্থির হয়ে আছে পাতা, বাকি দেহ পুড়ে গেছে দৃষ্টিভঙ্গীহীন বর্ণনায়… স্থিরতা কি বেরিয়ে আসতে পারে? অন্ততঃ ছোট উড়ানে ভর করে? মাংসল গন্ধের দিকে? প্রতিটা কবিতা আসলে একটা কাদা ও বর্ষার জলে ভারি সাপ, তার চলনের গায়ে উপড়ে এসেছে ঘাসের শিকড়, ফেলে দেওয়া কাগজ ও গতকাল। প্রতিটা কবিতা আসলে গ্রীষ্ম, দীর্ঘ সন্ধ্যালোক। যে সব ভাষা মুখ দেখল না পরিচিত দুনিয়ার বাইরে, যে সেরা শব্দটার মোহে ঝুলে রইল শিকারি পশুর দাঁতে, স্বীকার ও খেলার মধ্যে দীর্ঘদিন উঁচু হয়ে থাকা মিথ্যা, পরমের করোটি ফাটিয়ে উড়ে যাওয়া মাছি, আমাদের নির্লিপ্ত প্রেমাস্পদ, জোর দিয়ে বলার মত কিছু নেই… শুধু এক বৃষ্টিতাড়িত দেশ, তাড়াতাড়ি সন্ধে নামা এক ভূখণ্ড যাকে মাতৃভাষা বলে ডেকেছি

আমি নেমে এসেছি রাস্তায়, চলন্তের বুকে এক প্রচ্ছন্ন ভাষাস্বদেশ, বারবার ছিটকে যাচ্ছি, পেরোতে পারছি না, চকিত দ্রুতির পেটে স্থির ডিভাইডারের উপর আমার আমার একধরনের গিঁথে থাকা: এই সকাল আসলে একধরনের না ফিরিতে পারা, একধরনের সোনালি মোটা ফিতে, ধাপে ধাপে ছড়িয়ে রয়েছে সমস্ত বাহনে, আসবাবে, চুম্বনহীনতা কিংবা একঘয়ে পুরনো শরীরে হিংস্র নখ বসানো হস্তমৈথুনের মাঝবয়স!

সেইসব রাস্তা, এবড়ো খেবড়ো, পাথর ও বালি, ভাঙা মূর্তি, বিশ্বাসের অনভ্যস্ত দিক, আমি খুঁজে নিতে চাইছি তার উৎস ও সঞ্চার, বিন্যাস ও বাক্য। বারবার উৎসবের আগুনে ঝলসে যাওয়া চামড়ার গন্ধ আমার চারপাশে, অথচ আমি ভেদ করতে পারছি না তার রসায়ন, যদিও দেখতে পাচ্ছি এক ত্রিশিরা কাচ ফালা করে গিঁথে রয়েছে আশ্বিনের রোদ, তবুও তার ধারালো উচ্ছাস আমাকে স্পর্শ করছে না

আমি টের পাই এক জোনাকি আমার জিভের তলায়, অস্বস্তি-সূচিত আলো, ব্যাপিত হচ্ছে যেভাবে পুকুরের শ্যাওলার নিঃশ্বাস, যেভাবে সদ্য ফল ধরা কুমড়ো ফুলের পাপড়িতে শুকনো সকাল, আমার যন্ত্রণা বাড়ে, আমার ভাষা থেকে বাক্য বিন্যাস অব্দি ঘিনঘিনে অনুভূতি, আমার পুরুষ দেহ থেকে বারবার ছিঁড়ে নিতে চাওয়া লিঙ্গ সম্ভাবনাগুলো গুটিয়ে আসছে, আমি অজ্ঞাত কারণে আলোক তরঙ্গ থেকে ছিটকে যাচ্ছি বিপ্রতীপে, আমার চামড়ার রং কিছুতেই সাদা করা যাচ্ছে না

আমি এভাবেই এড়াতে চেয়েছি, যেভাবে আমাদের মফস্বলের প্রধান রাস্তাগুলো এড়িয়ে চলে প্রান্তের বিরাট পরিত্যক্ত কারখানা। অথবা তার পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা বস্তি ও রেলপথ। আমি থেমে থেকেছি, আমার তখনও ঢিলে ঢালা পোশাক আমাকে বুঝতে দেয়নি বন্ধ কারখানার অবিন্যাস বা তার উপর ঝুঁকে থাকা আইভি লতার স্থাপত্য-বাস্তু। আমি দিনের পর দিন লিখে গেছি দুপুরের নিজস্ব মিনার ও তার গায়ে পাক খাওয়া পুকুরগামী মেয়েদের স্নানদীর্ঘ ব্রীড়া…

আর এভাবেই ডুবে যাচ্ছি এক অবিচ্ছিন্ন আনন্দ প্রবাহে। অবিচ্ছিন্ন এক থকথকে আলোর ফিতের মধ্যে সামান্য পতঙ্গ-ডানা ঝাপটাচ্ছি আমরা, পিছিলে যাচ্ছে হাত থেকে পুরনো দুঃখের দিন, চোখ থেকে দৃশ্যচূর্ণ ঝরে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে আলোয়, আর কোনও দেখা বেঁচে নেই

এখানেই ঘুম ভাঙার পর আমি আবিষ্কার করি এক এবড়ো খেবড়ো জন্তুর পিঠ, আমি ও আমার না যাওয়ার ভ্রূণ। প্রতিটা প্রেম আমাকে শান্ত হতে শিখিয়েছে, প্রত্যেকটা অস্থিরতায় আসলে ছড়িয়ে আছে বিশাল এক জলের স্বদেশ, যেখানে প্রতিটা চর আসলে শুকিয়ে যাওয়া ঘা।  প্রবাহ কি হেমন্ত শুরুর ছাতিম গন্ধ? আমি বেরোতে চেষ্টা করি, রাস্তা বলে তেমন কিছু নেই, গ্রাম একধরণের অভ্যাস, যাকে আমরা ধরেই নিয়েছি সমগ্র, আমাদের শিরার অন্ধকার। অথচ , ক্রমাগত ডাক আসে। ধরা যাক যে কোনও জায়গার নাম রামপুর, যে কোনও সুরের নাম আলাহিয়া বিলাবল, ক্রমশ রশিদ খাঁ হতে চাইছে দুপুরের মুখ, চকচকে সূর্য কুয়োর জলে, দীর্ঘ অব্যবহার কোনও শ্যাওলা নয়, শুধু অনুপস্থিত রঙের একটা স্পন্দন, জিভে ব্যাপিত হচ্ছে কড়া চায়ের স্বাদ, নি:শ্বাস ও এতদিন না লেখা ধ্বনি

আর এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এতদিনের ফোসকা পড়া বাক্যের চামড়া। যা কিছু দেখে চোখ বন্ধ করেছি তাকেই স্বাভাবিক বলা। সামগ্রিক সৌন্দর্য থেকে আস্ত একটা ধর্ম নিয়ে ভেন্ন হল ভাষা, আমরা সহ্য করলাম। কবিতায় লেখা যাবে না বিবিমা তলার দিকে যে শিব রাস্তা পড়ে রইল, তার গ্রীষ্ম ছায়ার ভান ও পাখি- কর্কশ সমেত। বেরোনোর রাস্তা বলে কিছু হয় না, শুধু পাকানো অভ্যাস

বাক্সে ধরে রাখা বালির পাখি
স্বীকৃতি না দেয়া আগুনের কবরখানা
ভাষা জুড়ে বড় হয়ে ওঠা উঠোনে
ক্রমাগত গড়াগড়ি খাচ্ছে কুকুরের শীত
এই বর্ণনামূলকে স্থির একটা সম্ভাবনা হল অসাড়!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...