প্রকৃতি কি পরম আত্মীয় হবে?

জয়ন্ত বসু

 


লেখক সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী

 

 

 

বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আসা যাওয়াটা খানিকটা দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বহুদিন পর আসার মতো, যাকে বাড়িতে আপ্যায়ন করে একদিনের জন্য চা-মিষ্টি খাইয়ে বিদায় জানানো যায় কিন্তু তারপর আর সারাবছর মনে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। সেই আত্মীয়ও নির্বিবাদে ও নিঃশব্দে পরের বছর আসার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু এবারের পরিবেশ দিবস একটু অন্যরকম। বিশ্ব, দেশ ও রাজ্য জুড়ে আনুষ্ঠানিক আসার বেশ কিছু সময় আগে থেকেই সে জানান দিচ্ছে যে ‘আমি আসছি’ আর তার সঙ্গে বেশ মিলে গেছে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আনুষ্ঠানিক স্লোগানটি, “Time for Nature” অর্থাৎ “এটা প্রকৃতির সময়”।

বিশ্ব জুড়ে করোনা অতিমারির অমোঘ দাপাদাপি কিন্তু শুরু প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকেই। একবছর আগে যখন সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের বিজ্ঞানীরা ২০২০ সালের ৫ই জুনের জন্য পরিবেশ বিষয় নির্বাচন করেছিলেন, তখন তারা বোধহয় ভাবেননি যে নির্বাচিত বিষয়টি অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য রক্ষা আজকের পৃথিবীর বাঁচামরার ক্ষেত্রে এত জরুরি হয়ে উঠবে। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্য পেতে সময় লাগবে কিন্ত এটা প্রায় নিশ্চিত যে করোনা ভাইরাস মানবশরীরে ঢুকেছে কোনও প্রকারের বাদুড় ও অন্যান্য কোনও প্রাণীর থেকে। পরিবেশবিদরা বলছেন যে লাগাম ছাড়া বনজঙ্গল ধ্বংস না-মানুষ প্রাণীদের বেঁচে থাকার জায়গার সঙ্কোচন করে দিয়েছে, ফলে তাদের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বেড়েছে ও তারই ফলাফল করোনার মতো মারণ সংক্রমণ।

প্রকৃতি ধ্বংসের কথা যখন উঠল তখন মনে করতেই হবে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা ও তার কারণে যে আরও মহা বিপর্যয় পৃথিবীর সামনে আসতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, তার কথা। বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, সদ্য কলকাতা সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গে আছড়ে পড়া আমফান সুপার সাইক্লোনই তার যথেষ্ট প্রমাণ। গত ২০শে মে সুন্দরবনের সাগরদ্বীপ অঞ্চলে যে ঝড় আছড়ে পড়ে তার সমতুল্য কিছু খুঁজতে গিয়ে মানুষকে প্রায় ৩০০ বছর পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। কয়েক ঘন্টার ঝড়ে সুন্দরবন তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গের প্রায় ৮টি জেলা ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, রাজ্যের হিসেব ক্ষতির অঙ্ক এক লক্ষ কোটি টাকার আশেপাশে পৌঁছতে পারে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর হারিয়েছেন, নদীর নোনা জল উপচে পড়ে বা বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে দিয়েছে হাজার হাজার হেক্টর চাষের জমি। এটাও মনে রাখার প্রয়োজন যে এই ঝড় আসার আগে আরেকটি প্রবল ঝড়, বুলবুল, প্রায় গোটা সুন্দরবনকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করেছিল।

সম্প্রতি আমফান ঝড়ের কয়েকদিন পর ঝড় ঠিক যেখানটা আছড়ে পড়েছিল তার পাশাপাশি অঞ্চলগুলিতে যাওয়ার সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য হয়েছিল। সৌভাগ্য, কেননা সশরীরে ওই দুর্গম, কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দূরে, অঞ্চলগুলিতে না পৌঁছলে বোঝা যেত না যে প্রকৃতির প্রতিশোধ কতটা কঠোর হতে পারে। আর দুর্ভাগ্য, কেননা সাধারণ মানুষ, যারা প্রকৃতি নষ্টের খেলার খেলোয়াড় তো দূরস্থান, দর্শকও নন, তারা সম্পূর্ণই বিনা দোষে কিভাবে বারবার ধাক্কা খাচ্ছেন, ছাদ হারাচ্ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন; তা সামনে থেকে দেখার। মৌসুনী দ্বীপের বালিয়ারা অঞ্চলের বাসিন্দা মুসলিমা বিবি। যখন বুলবুল ঝড়ে হারানো ছাদ ধারকর্য করে সারাতে না সারাতেই সে ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গেল আমফান; তখন মুসলিমা, রাজমিস্ত্রি স্বামী আর দুটি ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে সে ঘরেরই এক কোণে কোনোরকমে বসে জীবন বাঁচিয়েছে! কিন্তু শুধু জীবনটুকুই বেঁচেছে, আর কিছু বাঁচেনি। যখন স্থানীয় বামাখ্যাপা ক্লাবের সহযোগিতায় ত্রাণ নিতে এসে মুসলিমা জিজ্ঞাসা করে আরেকটা ঝড় আসছে নাকি, তখন উত্তর দেওয়ার কিছু থাকে না। একই গল্প উত্তর চন্দনপিড়ি গ্রামের জয়প্রকাশ দাসের। মাটির সঙ্গে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া মাটির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জয়প্রকাশবাবু এমন নির্বিকারভাবে জানাচ্ছিলেন যে কীভাবে প্রায় তার উপরেই বাড়িটা ভেঙে পড়েছে, তখন মনে হচ্ছিল উনি তৃতীয় কারও ঘটনা বলছেন। এটা শুধুমাত্র বালিয়ারা বা চন্দনপিড়ির গল্প নয়, ভারতীয় সুন্দরবনে কমবেশি যে আধ কোটি মানুষ থাকেন, তাদের সবারই গল্প।

প্রশ্ন হল, তবে কি কিছুই আমাদের করার নেই? সবকিছুর শেষের কি শুরু হয়ে গেছে? স্পষ্ট উত্তর না। যদি প্রায় এক দশক পুরনো আয়লা ঝড় আমাদের শিখিয়ে দিয়ে থাকে যে সুন্দরবনে বাঘের পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ মানুষও থাকেন; তবে আমফান এই মহাবিপর্যয়ের মধ্যে শিখিয়ে দিয়ে গেল যে সেই বিপর্যয় থেকে মহানিষ্ক্রমণের পথটা। অভিজ্ঞতা বলছে যে যত প্রবলবেগেই ঝড় আসুক না কেন, সুন্দরবনে থাকা পাকা ঘরবাড়ি তাদের সামাল দিতে পেরেছে; অভিজ্ঞতা বলছে যেখানে ১১৫ কিমি অঞ্চল জুড়ে আয়লা বাঁধ তৈরি করা গেছে সেখানে বিপদ, বিপর্যয়ে রূপান্তরিত হতে পারেনি। পাশাপাশি এটাও দেখা গেছে যে এই বিপদের সময় মেন গ্রিডের বিদ্যুতের লাইন মুখ থুবড়ে পড়ে গোটা সুন্দরবন অন্ধকারে ডুবে গেলেও, সাতজেলিয়ার মতো যেসব অঞ্চলে সৌর আলোর বন্দোবস্ত রয়েছে সেগুলি কীভাবে আলোর দ্বীপের মতো জেগে রয়েছে। এটাও দেখা গেছে কিভাবে ম্যানগ্রোভ সমৃদ্ধ অঞ্চল ঝড়ের বিরুদ্ধে দেওয়াল তুলেছে। আজকের পরিবেশ দিবসের ভাবনা হল আমরা এই কিছু কিছু উদাহরণগুলিকে যোগ করে সমাধানের পথ খুঁজব, নাকি প্রকৃতি একটু শান্ত হলেই আবার সদলবলে হারিয়ে ফেলা লাভ সুদে উসুলে মেটাতে প্রকৃতির গলা টিপে ধরব। অর্থাৎ এবার প্রকৃতিকে আমাদের সত্যিকারের পরম আত্মীয় বলে স্বীকার করে নেব নাকি বছরে একদিন আদর আপ্যায়ন করে দায়িত্ব এড়াব।

বিশ্ব জুড়ে কিন্তু প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক নেতাদের মুখের ও দেহের ভাষা দ্বিতীয় সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করছে। যেমন আমেরিকায় স্পষ্টভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে লকডাউনের বাজারে দূষণ টুষণ নিয়ে বিশেষ না ভাবলেও চলবে। জেমস বন্ডের মত তারা ‘লাইসেন্স টু কিল’ পদবাচ্য; আক্ষরিক অর্থেই, কেননা দূষণ বাড়লে যে মানুষ বেশি মরবে এখন তা ক্লাস ফাইভের বাচ্চারাও জানে। তাতে কিছুই এসে যায় না কেননা, ট্রাম্প সাহেব জানেন না! বরং বলা ভালো জানতে চান না। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ কে অস্বীকার করা চলেছেই, একের পর এক মারণ ঝড় ও প্রাকৃতিক বিপদের সম্মুখীন আমেরিকা বারবার হওয়া সত্ত্বেও। বাকি পৃথিবীর হালহকিকত কমবেশি একইরকম।

এমনকি আমাদের দেশেও।

লকডাউনে যখন মানুষ ঘরবন্দি, তখন সরকার শিল্পের মনোমত নতুন পরিবেশ আইন আনার চেষ্টা করছেন, চেষ্টা করছেন আরও বনাঞ্চল কিভাবে উন্নয়নের নামে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের করতলগত করানো যায়। পাশাপাশি পরিবেশ অন্যায় থামাতে যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের আইন আছে, তার প্রয়োগেও বিস্তর ফাঁকফোকর। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সেন্টার ফর সাইন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে দেশে পরিবেশ আইনের প্রয়োগ প্রায় নেই, কমবেশি ৪৮০০০ প্রকৃতি ও পরিবেশ খুনের মামলা ঝুলে রয়েছে। সেসব মামলার ফয়সালা করা তো দূরস্থান, বরং খানিকটা নিয়ম করে পরিবেশ বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। পরিবেশের অন্যান্য বিষয়ও আটকে আছে ইংরেজি পরিভাষায়, লিপ সার্ভিসের মধ্যে। একই অবস্থা এ রাজ্যেও। বায়ুদূষণ লকডাউনের প্রভাবে বাধ্য হয়ে কমলেও সাধারণভাবে তা ঊর্ধ্বগামী, শব্দদূষণ আইনের প্রয়োগ অভিযোগ জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, শহরের মেয়র পাল্টালেও, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি দখল করে রাস্তা বানানোর ইচ্ছায় ভাটা পড়েনি!

এতসব দেখে বুঝে, ঘর হারা মানুষের মন তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাবেই; আক্ষরিক অর্থেই।

ফলে আমরা শেষমেশ কি করব, কোন পথে হাঁটব… তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে পছন্দ যেমন আমাদের, তেমন সেই পছন্দের ফলাফলও আমাদেরকেই ভুগতে হবে। আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে অদূর ভবিষ্যতে পরিবেশ আমাদের পরম আত্মীয় হবে নাকি বছরে একদিন দেখা হওয়ার খাতায় কলমের আত্মীয় হয়ে থেকে যাবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...