ভাঙড়, ব্যাঙ্গালোর, ভাবাবেগ ও মুসলিম সমাজ

পারভেজ খান

 

কয়েকদিন আগে এ রাজ্যের জনৈক মুসলিম নেতার উপর আক্রমণ করেন তৃণমূলের এক নেতা, আর তারপর বিভিন্ন জায়গায় চলে তার সমর্থকদের ক্ষমতা প্রদর্শন। রাস্তা অবরোধ। যে কারও গায়ে হাত তোলা, আক্রমণ করা নিন্দনীয় ও অপরাধ। প্রশাসন আছে সে জন্য। থানাপুলিশ আছে, বিচারব্যবস্থা আছে। কিছু মৌলবির হাতে টাকাপয়সা গেছে, রাজনৈতিক পাশা পাল্টাতে সে টাকার সদ্ব্যবহারও করা হয়েছে বিভিন্ন সময়। হয়ে আসছে। হঠাৎ করে ধর্মীয় নেতা আর রাজনৈতিক নেতার মধ্যে এরকম ঘটনা কেন ঘটতে যাবে বলুন যদি না সেই ধর্মীয় নেতা ওই রাজনৈতিক নেতার স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটান? মানে এখানে বিষয়টা পুরোটাই রাজনৈতিক, আর ধর্মীয় নেতা হওয়ার ফলে একটা অংশের অন্ধ সমর্থন থেকেই যায়, তাই পরোক্ষ রাজনৈতিক জমিও পাকা। মাঝখান দিয়ে ওই অন্ধ সমর্থকদের না ওই ধর্মীয় নেতা বোঝাবেন, না এই বিবাদের ফসল পাওয়া রাজনৈতিক দল বোঝাবে যে এসব ফালতু ইস্যুতে রাস্তাঘাট আটকানো, ঝামেলা পাকানো সঠিক কাজ নয়।

দুদিন আগে ব্যাঙ্গালোরে কোনও কংগ্রেস নেতার আত্মীয় ফেসবুকে মুসলিম ধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মপ্রচারক মহম্মদকে নিয়ে অপ্রীতিকর পোস্ট করে ফেসবুকে। নিন্দনীয়, খারাপ। খারাপ? কতটা খারাপ? কতটা নিন্দনীয়? সেসব চাইলেই ওই পোস্টে বোঝাতে পারতেন, আরও একটা পোস্ট নামাতেন, আপনার আপনাদের মত জানাতেন– হ্যাঁ ওই পর্যন্তই! এত ঠুনকো বিশ্বাস? এত ঠুনকো ভাবাবেগ? যে রাস্তায় দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লেন, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করলেন?!! (ব্যাঙ্গালোরের ঘটনায় পুলিশে অভিযোগ জানানো স্বত্তেও, পুলিশ শুরুতে ব্যবস্থা নেয়নি, যে জন্য পরিস্থিতি এই জায়গায় গেছে, সেটা জেনেও বলছি)

যে সংখ্যালঘু জনগণ, বিশেষত মুসলিম সমাজের একটা অংশ, তারা তাদের শিক্ষা, চাকরি, সামাজিক উন্নতিতে সরকার নজর দিল কি না সেদিক না দেখে উন্মাদের মত বেরিয়ে পড়ে ফালতু কোনও একটা ইস্যু পেলেই, তাদের পিছিয়ে থাকা কেউ আটকাতে পারবে না যতক্ষণ না তারা নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসবে। মুসলিম সমাজে দারিদ্রতার হার বেশি, মুসলিম সমাজে শিক্ষিতের হার কম, চাকরিতে তাদের অনুপাত কম, বড় ব্যবসাতেও অংশ নেওয়া কম! তাই কোন ধর্মীয় নেতা কী বলল, তাতে হুজুগে মাতার থেকে এই সমাজে তাদের বেশি উচিত এই বিষয়গুলিতে নজর দেওয়া। কিন্তু দেওয়া বললেই তো দেওয়া নয়। আশার খবর উচ্চশিক্ষিত মুসলিমের সংখ্যা বাড়ছে, তাদের দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে। যদি তারা দায়িত্ব নিতে পারে, তবে এই মেকি ধর্মকে নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থলোভী ধর্মগুরুদের ভণ্ডামি শেষ হবে, আর সেসব গ্রুপের নেতাদের কেউ পাত্তাই দেবে না। ধর্ম যে পালন করতে চান নিশ্চই করবেন, কিন্তু সেই ধর্মবিশ্বাসকে এত ঠুনকো মনে করে করবেন না যা সামান্য কারও পোস্টে, বা কোনও নেতার সামান্য উস্কানিমূলক ভাষণেই ভেঙে যাবে!

তবে হ্যাঁ এটা একটা অংশই, অবশ্যই সবাই নয়, নইলে ব্যাঙ্গালোরে যে মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ দাঙ্গা করল সেই সম্প্রদায়েরই কিছু মানুষ হাতে হাত ধরে সারারাত মন্দির পাহারা দিলেন যাতে তাতে আঘাত না পড়ে। লকডাউনেই এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে মানবিক কর্তব্য হিসেবে তারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, ধর্ম সেখানে বাধা হয়নি। সেটাই হওয়া উচিত, স্বাভাবিক, এটা খবর হওয়ার কথাও না, কিন্তু হয়ে যায়, কারণ, কিছু মানুষের দ্বারা তৈরি হিংসার কারণ হিসেবে গোটা সম্প্রদায়কেই দায়ী করা হয়, আর সেটা মুখ্য খবর হিসেবে চলতেই থাকে তেমন উদাহরণ প্রচুর। যদিও যারা হিংসার সঙ্গে যুক্ত তারা ভুল করছে, অপরাধ করছে, তাদের ভুল বোঝাচ্ছে কিছু সেই সম্প্রদায়ের সংগঠন, কিছু ধর্মীয় নেতা। অন্য কারও কথায় নাচা নয় নিজের মতামত তৈরি করার শিক্ষা, চিন্তাভাবনা করার শিক্ষার অভাবে এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকছে। সেই সম্প্রাদায়ের শিক্ষিত জনগণের উচিত এই বিষয়টায় নজর দেওয়া।

ব্যাক্তিগতভাবে আমার কোনও প্রথাগত ধর্মের প্রতিই আকর্ষণ নেই। আমার কাছে একটা মানুষের জীবনধারণের পদ্ধতিই তার ধর্ম, তার শিক্ষা, পরিবেশ, পরিস্থিতি, আদর্শের ভিত্তিতে সেই জীবনধারণ পরিচালিত হয়। কোনও ইশ্বরের প্রতি টান অনুভব করি না, তাই নামাজ রোজা এসব থেকে দূরেই থাকি, কিন্তু ধর্মীয় কারণে কোনও উৎসব হলে সে ঈদ হোক বা যে কোনও পূজা, ক্রিসমাস, তাতে সমাজের অংশ হিসেবেই অংশগ্রহণ করি, এবং তার মধ্যে অন্যায় কিছু দেখি না এবং পাপবোধেও ভুগি না যে আমি না মেনেও কেন অংশ নিচ্ছি। নিই তার কারণ অন্য মানুষের মত আমিও সমাজবদ্ধ, এবং উৎসব মানে মিলন, খাওয়াদাওয়া, ওটা মিস করার কোনও মানেই হয় না। অনেকেই বিভিন্ন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, ধর্মপালন করে থাকেন, সেগুলো তাদের ব্যক্তিগত ভাবনা বিশ্বাস। কোনও ধর্মই শেখায় না অন্য ধর্মকে অসম্মান করতে, আবার প্রত্যেক ধর্মের অধিকাংশ ধর্মগুরুরা মনে করেন তার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, আর এই আমারটা শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে গিয়েই যত ঝামেলার সূত্রপাত! পৃথিবীর ইতিহাসে বহু ধর্ম এসেছে আগে, বহু ঈশ্বর এসেছে, সে সব ধর্ম সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে, এখন কেবল ইতিহাস বইয়ের পাতাতেই স্থান পায়। তাই ঈশ্বর ধ্রুবক নয়, ধর্মের সংজ্ঞাও ধ্রুবক নয়। আপনি যেভাবে দেখবেন সেভাবেই হাজির হবে। একটু খোলা চোখে দেখলে, সহনশীলতার সঙ্গে ভাবলে, তুচ্ছ ফেসবুক পোস্ট ঘিরে অহেতুক ঝামেলা, দাঙ্গার ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই বার্তা তাঁদের কাছে পৌঁছাবে কি করে যাঁরা ভাবাবেগ রোগে ভুগছেন!

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!

Be the first to comment

আপনার মতামত...